তুঁহু মম/৬
তুঁহু মম/৬
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এখনও আমি যাকে খুঁজি, এই কাহিনি সেই মানুষটির। সেই ছেলেটির। হিরের মতো দামি আর ঝকঝকে ছেলেবেলা তার। সেই ছেলেবেলায় আশ্চর্য সব কল্পনা ছিল, নদী ছিল, কবিতা ছিল, গান ছিল। আর ছিল দুই ঘর এক উঠোনের একটি খেলাঘর।
খেলাঘর! হ্যাঁ, বলি তার কথা। আমার জন্ম কৃষ্ণনগরে। এখনও আমি চোখ বন্ধ করলে কৃষ্ণনগরে আমাদের সেই বাড়িটা দেখতে পাই। দুটি ঘর, রান্নাঘর আর একটি উঠোন নিয়ে মূল বাড়িটি। বাথরুম বাড়ির পিছনদিকে। বাড়ির নাম খেলাঘর। কে রেখেছিলেন জানো? আমার বাবা। আমি যখন খুবই ছোট, ধরো ছয়-সাত বছর বয়েস, তখন থেকেই বাবার মুখে একটা কথা প্রায়ই শুনতাম, 'বুঝলি অজু, জীবনের সব ঘরই খেলাঘর।' সে কথার কী মানে ওই বয়েসে কিছুই বুঝতাম না। এমনকী, মা যখন চলে গেল, দাহকাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে বাবা ওই একই কথা বলেছিল কিন্তু আমি সেবারও কিছু বুঝিনি। আমার তখন একটাই জিজ্ঞাসা, বাবা মাকে কোথায় রেখে এল? সেদিন দুর্গাষষ্ঠী। কাছেই প্যান্ডালে ঢাক বাজছে। প্রতি বছর মা এই দিনে আমাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে যায়। এবার আমি বুঝি একলা যাব? ভালো ছেলেরা তা বুঝি করতে পারে? ভয়ে আর বিস্ময়ে আমি প্রায় দিশেহারা। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। উঠোনের শিউলি গাছ ফুল ফুটিয়েছে দেদার। মন কেমন করা গন্ধে ভরে গেছে আমাদের খেলাঘর। পাড়া-প্রতিবেশী যারা এসেছিলেন তারা কেউ কাঁদছেন, কেউ থম মেরে বসে আছেন। এসবের কী অর্থ সেদিন একটা দশ বছরের ছেলে বুঝতে পারেনি। সে তার বাবাকেই জিজ্ঞাসা করেছিল, 'মা কোথায় বাবা? মা আমাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে যাবে না?'
সেই প্রথম বাবাকে আমি কাঁদতে দেখেছিলাম। সোজা-সরল একটা মানুষ, স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক আমার বাবা তার সদ্য মাতৃহারা ছেলের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিল,'আমাদের খেলাঘর ভেঙে গেল রে অজু!' না, তখনও বুঝিনি বাবার কথার মানে। কিছুটা বড়ো হওয়ার পর যেদিন মৃত্যুর মানে স্পষ্ট হল সেদিন খেলাঘর ভেঙে যাওয়ার মানেও জলের মতো সহজ হয়ে গেল। আমার মনে আছে। একদিন বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'সব ছেলেই মায়ের মুখাগ্নি করে। আমাকে তুমি শ্মশানে নিয়ে গেলে না কেন বাবা?' বাবা বলেছিল, 'সবাই আমাকে নিয়ে যেতে বলেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল তুই সহ্য করতে পারবি না। আর তোর মাও খুব কষ্ট পাবে।'
কুমুদিনী, তুমি হয়তো ভাবছ কাহিনির শুরুতেই আমি কেন মৃত্যুকে এনে ফেললাম? কারণ যে-মৃত্যুবোধ থেকে আমি আজও মুক্ত হতে পারিনি, তাকে প্রথমেই স্বীকার করে না নিলে আমার আত্মমন্থন সম্পূর্ণ হবে না। আমি যে সারাজীবন নিরাপত্তার অভাবে ভুগব, প্রতিটি নারীর মধ্যে খুঁজব আমার মাকে-- সেদিন মায়ের মৃত্যুতেই তা স্থির হয়ে গিয়েছিল। তার মানে অবশ্য এই নয় যে আমার জীবনে বাবার কোনও ভূমিকা নেই। আজ আমি যা, তার সবটাই বাবার জন্য। বাবা না থাকলে মা মারা যাবার পর আমি হয়তো হারিয়েই যেতাম। সেই সময় দিনের পর দিন মন খারাপের মধ্যে ডুবে থাকতাম। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকত। বলতে পারো, বাবা আমাকে একটা ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিল। এমনকী, মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়েসে বিপত্নীক একজন সক্ষম পুরুষমানুষ নিজের সুখের কথাও ভাবেনি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে জীবনটা। এত বড়ো ত্যাগস্বীকার ক'জন বাবা করতে পারে বলো? পাঁচ বছর হয়ে গেল বাবাও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করো কুমুদিনী, বাবাকে আমি শুধুই মিস করি। কিন্তু মাকে আজও খুঁজি। মনে হয় মা কোথাও আছে। ভালো করে খুঁজতে পারলে একদিন আমি ঠিক পেয়ে যাব। বিশ্বজোড়া অন্ধকার উঠোন দেখে তখন আর আমার ভয় করবে না।
ছেলেবেলা মানেই কারণে-অকারণে অবাক হওয়া। সামান্য এক পশলা বৃষ্টির কথা যদি ভাবো তা হলে তার মধ্যেও দেখবে বিস্ময়ের হাজারো উপকরণ আছে। কোথাকার মেঘ কোনও এক নতুন জনপদে এসে সব জল ঝরিয়ে নিঃস্ব হয়ে আবার এক নতুন আকাশে উড়ে গেল। ঠিক আমার মায়ের মতো। আমার ছেলেবেলাও বিস্ময়কর। আমার উঠোন-থেকে-দেখা আকাশ ছিল, খাতা ভর্তি কবিতা ছিল। যখন মন খুব খারাপ হয়ে যেত তখন আমি দুপুরবেলায় ছাদের কার্নিসে হেলান দিয়ে বসে মাকে চিঠি লিখতাম। চিঠি লিখতে গিয়েই একদিন আমার লেখা কবিতা হয়ে গেল। এও কি কম বিস্ময়ের, বলো? পরে, এক স্বনামধন্য কবির লেখায় একটা সুন্দর কথা পেয়েছিলাম। শূন্যতা থেকেই নাকি কবিতার জন্ম হয়। হয়তো হয়। কিন্তু বিশ্বাস করো, রুরু চলে যাবার পর আমি একটা কবিতাও লিখিনি। লিখতে পারিনি। রুরুর মধ্যে মাকে পাইনি বলেই বোধহয় ওর ফেলে যাওয়া শূন্যতা থেকে কোনও কবিতার জন্ম হয়নি।