তুঁহু মম/৫
তুঁহু মম/৫
সন্দীপ চক্রবর্তী
কলম্বো
শ্রীলঙ্কা
অর্জুনদা,
কেন সব গুলিয়ে দিলে বলো তো? যা বলার সহজ করে বললে কী হয়! সত্যি বলছি, তোমার লেখার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারিনি। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল তোমার বলার কথা অনেক। কিন্তু সব একসঙ্গে বলতে গিয়ে তুমি তাল রাখতে পারছ না। তাই বারবার তাল কাটছে। তোমার লেখা গানের মতো আমার প্রাণে বাজে। কিন্তু কাল তুমি গান হতে পারোনি।
সেই প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই তোমাকে একজন সহজ স্বভাবের মানুষ বলেই আমার মনে হয়েছে। হ্যাঁ, কথা একটু কম বলো৷ মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি একাই বকে যাচ্ছি। তুমি বিচরণ করছ অন্য কোনও গ্রহে। যারা দিবারাত্র ভাবনার জগতে বাস করেন, এই অন্যমনস্কতা তাদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। যে-কোনও সম্পর্কে এটাই তো স্পেস। একজন সৃজনশীল মানুষকে এই স্পেসটুকু না দিলে সম্পর্কটা বাঁচবে কী করে! হ্যাঁ, স্বীকার করি, প্রথম দিকে আর পাঁচজনের মতো এই ভুল আমিও করেছি। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে জিজ্ঞাসা করে ফেলেছি তোমার অতীতের কথা। এটাও ঠিক তুমি 'বলব'খন' বলে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সিগারেট ধরিয়েছ। কিন্তু তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে শুনি? ভুল তো আমারই। বিশ্বাস করো, সম্পর্ক যত গভীর হয়েছে ভুলটা ততই দিনের আলোর মতো আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজ আর তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনও কৌতূহল নেই। তুমি যতটুকু আমার কাছে ধরা দিয়েছ তাতেই আমি ভরে আছি। এর বেশি নেওয়ার ক্ষমতাও যে আমার নেই। কাউকে ভালোবাসলেই তার যথাসর্বস্ব অধিকার করতে হবে-- তার নিজের বলতে একটা খোলা জানলাও থাকবে না---তেমন মানুষ তো আমি নই। কোনওদিন ছিলামও না। আমার গাছে ফুল ফুটেছে৷ সেই ফুল সবাইকে দেখিয়েই আমার আনন্দ। আমার ফুল পুজোর নৈবেদ্যে স্থান পেল কিনা, সে ভাবনা আমার নয়।
তাই বলে তুমি কিছু বললে আমি কি শুনব না? নিশ্চয়ই শুনব। তোমার রুরুর কথাও শুনব। যদিও তুমি লেখোনি তিনি কে? এমনকী তিনি নারী না পুরুষ তাও বোঝার উপায় নেই। এরকম ভাবনা মনে এল কারণ মহাভারতে রুরু নামের একজন সম্রাট ছিলেন। আর সেই যুগে সম্রাট পুরুষরাই হতেন। এখনও তারাই হন। আমার অভিজ্ঞতা অন্তত সেরকমই। তবে তোমার মনের যে-ভাবের অনুষঙ্গে নামটি এসেছে তাতে তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি তিনি একজন নারী। হয়তো তোমার প্রেমিকা। স্ত্রীও হতে পারেন। যাই হোন তাতে আমার দুঃখ পাবার কিছু নেই। অবাক হওয়ারও না। আমি তো তোমার বউ হতে চাইনি অর্জুনদা। যে আনন্দে সারাদিন ডুবে থাকি, আমি শুধু সেই আনন্দকেই প্রকাশ করতে চেয়েছি। ভাগ করে নিয়েছি তোমার সঙ্গে। আশীর্বাদ কোরো যেন এরকম আনন্দে সারাজীবন থাকতে পারি।
তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ। অযথা নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। কোনও দ্বিধা রেখো না মনে। চোখ বন্ধ করে ভাবো তোমার মন কী চায়। মনের সায় যেদিকে, সেদিকেই তোমার পথ। তোমার পৃথিবী। তুমি সেই পথেই হাঁটবে, সেই পৃথিবীতেই বাস করবে। নিজের মতো হও অর্জুনদা। তাতে কেউ দুঃখ পেলে পাবে। আমি একটা কথা খুব মানি। নিজে সুখী না হলে কাউকে সুখী করা যায় না। তাই তো সারাদিন এমন টইটম্বুর হয়ে থাকি। হেসে-খেলে, হাত-পা ছড়িয়ে বেঁচে থাকার লোভ আমার ফুরোতেই চায় না।
ভালো থেকো
কুমুদিনী
রাখিগঢ়ি
হরিয়ানা
কুমুদিনী,
তোমার সরল এবং অকপট স্বীকারোক্তি সত্যিই সাধুবাদ যোগ্য। মাথা আপনা থেকেই নত হয়ে আসে। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, এত শক্তি পাও কোথা থেকে? কই, আমি তো পাই না! তুমি ভালোবেসে সুখী৷ বিনিময়ে কী পেলে আর কী পেলে না ভাবার অবসর নেই। কিন্ত কুমুদিনী, এই উদাসীনতা যদি কোনওদিন তোমার বোঝা হয়ে ওঠে? যদি কখনও মনে হয় তুমি ভুল করেছ তখন সেই গ্লানি কোন সান্ত্বনায় ঢাকবে তা কি ভেবে দেখেছ? পোশাকের আড়ালে সবাই নগ্ন আর আয়নার সামনে সবাই একা। সে বড়ো কঠিন সময়। আমি সেই কাঠিন্যের মধ্যে বাস করি বলেই কথাটা তোমাকে বললাম।
যাক সে কথা। আজ আমি তোমার কোনও কিছুই গুলিয়ে দেব না। আজ আমার আত্মমন্থনের দিন। মন্থনে বিষ উঠবে নাকি অমৃত, আমি জানি না। কিন্তু বলব সব কথাই। যদিও তুমি লিখেছ, আমার অতীত নিয়ে তোমার কোনও কৌতূহল নেই। নাই বা থাকল। তাগিদ আমার। রুরু বলেছিল, আমি নাকি শুধু নিজেকেই ভালোবাসতে পারি। একটি মেয়েকে ভালোবাসার, তার ঘর বাঁধার স্বপ্নকে আলো-হাওয়া-জল দিয়ে ফুটিয়ে তোলার কোনও ক্ষমতাই আমার নেই। রুরুকে ওর ইচ্ছেমতো থাকতে না দিয়ে আমি নাকি প্রতারণা করেছি।
তিন বছর ধরে আকাশ-পাতাল ভেবেও রুরুর অভিযোগের সত্যিমিথ্যে বুঝতে পারিনি। কেন এরকম করল রুরু? আমি তো তাকে ভালোই বেসেছিলাম। সাত বছর কম সময় নয়। চার বছরের প্রেম আর তিন বছরের বিবাহিত জীবন।তারপরেও রুরু কীভাবে সম্পর্ক ভেঙে, বিয়ে ভেঙে চলে গেল? হয়তো এই প্রশ্ন আর এই নৈঃশব্দ আমৃত্যু আমার মনেই থেকে যেত। যেমন থেকে যায় আর কী! আর আমিও ইতিহাসের একটার পর একটা ধ্বংসস্তূপে খুঁজে বেড়াতাম কোনও জীবন্ত মানুষকে। যাকে বন্ধু ভাবা যায়। যার আয়নায় দেখা যায় নিজের মুখ। কিন্তু তেমন মানুষ কি অত সহজে পাওয়া যায়। অনেকদিন পর তোমাকে পেলাম। মনে হল তোমাকে বলা যায়। তাই তোমাকেই বলব। লেখাটা অনেক বড়ো হবে। প্লিজ একটু ধৈর্য ধরে শুনো।
(ক্রমশ)