Apurba Kr Chakrabarty

Romance Others comedy

4.0  

Apurba Kr Chakrabarty

Romance Others comedy

তুমি শুধু আমার

তুমি শুধু আমার

28 mins
207


 (প্রথম পর্ব)

তখন বিকাল চারটে। রূপা ট্রেন থেকে বর্ধমান ষ্টেশনে নামল। আজকেই ছিল মান্থলি টিকিটে ভ্যালিডিটি শেষ দিন ,সে তাই আগামীকাল ট্রেন ধরার ব্যস্ততার মাঝে না গিয়ে , মান্থলির টিকিটের মেয়াদের শেষ বিকালেই মান্থলির রিনিউ টিকিট করে নেয়।

চাকুরীর সুত্রে সে বর্ধমান- বোলপুর রুটে নিত্য যাত্রী।বোলপুরের পাশাপাশি এক গ্রাম্য বিদ্যালয়ে ইংরেজীর শিক্ষিকা।

এদিন বর্ধমান রেল ষ্টেশন কাউন্টারে মান্থলি রিনিউ টিকিট কোরে যখন পিছন ফিরে রূপা হাঁটা দিল। হঠাৎই তার চোখে পড়ল সামনের সিমেন্ট বেঞ্চে এক শীর্ন মলিন মুখে যুবক বসে রয়েছে।কেমন যেন চেনা চেনা! কৌতুহল বশে এগিয়ে আসে।জীর্ণ বস্ত্র, রুক্ষ চুল, সারা মুখে খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়ি, হতাশাভরা বিবর্ন চোখ মুখ।যেন কারোর অধীর অপেক্ষা করছে।বেশ অসুস্থ ক্লান্ত অবসন্ন মনে হয়।

রূপা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। এ কি সুবীর দা ! অনেক  পরিবর্তন  হলেও তার মুখচোখের আদল গায়ের রং আর বাম চোখের নিচে একটা কালো তিল তাকে শনাক্ত করছে। বুকের ভিতর একরাশ আবেগ আর উৎকন্ঠা নিয়ে রূপা ডাকে বেশ বিস্মিত স্বরে, "সুবীর দা না! "

কোন উত্তর আসে না ,এবার আরও বেশ কাছে এসে জোরে বলে "তুমি তো সুবীর দা?"

এবার যুবকটি তার দিকে তাকাল কেমন উদভ্রান্ত উদাসীন চাহনি। কোন উত্তর দেয় না। আবার অন্য দিকে চেয়ে যেন কারও অধীর অপেক্ষায়।

সুবীরের স্বভাব চাহনী সে ভালোই জানে ।এ যে তার সুবীর দা ই একশভাগ রূপা নিশ্চিত  হয়।

এবার তাই একটু আবেগ আর স্নেহের স্বরে বলে     " সুবীর দা তুমি আমায় চিনতে পারছ না ! না চিনতে চাইছ না! তোমার একী দশা হয়েছে সুবীর দা !" বলতে বলতে রূপার গলা দুঃখে অবরুদ্ধ হয়ে আসে।

এবার যুবকটি মাথা নামায় কোন উত্তর দেয় না। কেমন নির্লিপ্ত ভাবে বসে।

রূপা এবার প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলে,"বলো সুবীর দা , কী আমি দোষ করেছি ! কেন তুমি এভাবে এড়িয়ে, না চেনার ভান করছ !"

রূপার এবার নজরে এল। সুবীর দা মুখ নামিয়ে দুঠোঁট চেপে আপ্রাণ কান্না চাপার চেষ্টা করছে। কিন্ত পারছে না,কষ্টে দুচোখ বেয়ে অশ্রু গাল বেয়ে নেমে আসছে।

রূপা আর থাকতে পারে না। দুগালের জল হাত দিয়ে মুছতে যায়।অনুভব করে তীব্র জ্বরে সে কাবু! উদ্বিগ্ন রূপা বলে "একী তুমি তো অসুস্থ গায়ে প্রচন্ড জ্বর!"

আদ্র ভাঙ্গা গলায় সুবীর বলে "ও কিছু না, ঠিক  আছি।"

পাশের এক বুকস্টলে রূপা মাঝে মধ্যেই ম্যাগাজিন ও টুকিটাকি বই কেনে। বেশ মুখ চেনা। না হলেও তিন চার মাস এই পথেই রূপার যাওয়া আসা। এই সব দৃশ্য দেখে আর থাকতে পারে না।সে বলে , " ম্যাডাম ইনি কি আপনার পরিচিত! সেই সকাল দশ থেকেই দেখছি একভাবেই বসে আছেন।"

রূপা বিষ্ময়ে জিজ্ঞেস করল, "সেকী তুমি সারাদিন কিছু খাও নি?"

সুবীর কোন উত্তর দেয় না। রূপা এবার দৃঢ় কন্ঠে বলে "তুমি আমার সাথে চল।"

দ্বিধাগ্রস্ত সুবীর কাঁচুমাচু স্বরে বলে "তা কী করে হয়! " 

রূপা এবার কিন্তু রীতিমত ভর্ৎসনার ভঙ্গিতে বলে, "তার মানে ! তোমাকে এখানে মরতে রেখে যাব!"

সুবীর  উদ্বিগ্ন  সুরে বলে, " কিন্তু তোমার দিদি জামাইবাবু ভীষণ রুষ্ট হবে, তোমারও তাতে অসুবিধা"।

রূপা একপ্রকার চাচ্ছিল্য সুরে বলে "কে দিদি জামাই বাবু ! তাদের আমি খাই না পড়ি!"

সুবীর অবাক, বলে "তুমি ওদের কাছে থাকো না ? "

তীব্র ঘৃনা আর ক্রোধে রূপা বলে, "তোমাকে চক্রান্ত করে ওরা তাড়িয়েছে, আমি বুঝতে পেরেই ওদের বাড়ী ছেড়েদি,  ইউনিভার্সিটির  হোস্টেল থাকতে শুরু করি,"

একটু থেমে আত্মবিশ্বাস আর গর্বিত স্বরে বলে "আজ আমি স্কুল শিক্ষিকা, সক্ষম স্বাধীন নিজের টাকায় থাকি। যাক সে কথা ।চল তোমার চিকিৎসা দরকার। "

সুবীর আমতা আমতা করে,বলে "আমার তো একটা নীলপুরে ছোট ঘর নেওয়া আছে।"

 এবার রূপা খুব রেগে যায়,  "এই সব নাটকবাজী ছাড়ো, স্বেচ্ছায় না গেলে তোমায় জোর করে টেনে হিঁচরে নিয়ে যাবো, লোক হাসাবে না বলছি। আর আমি যা বলি তাই করি নিশ্চয় জানো।"

রূপা যে কী ডানপিঠে দজ্জাল মেয়ে তার তা জানা ।তবে মনটা বড়, আর সাদাসিদে সরল, অসহ্য তার ধাতে সয় না।

চারদিকে থেকে কিছু মানুষের নজর ছিল, লাজুক শান্ত ও নিরীহ স্বভাবের সুবীর কেমন কুঁকড়ে ছিল। মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে বলল, " আমায় জেদ করে নিয়ে গেলে তুমিই কিন্তু পরে বিপদে পড়বে ।"

রূপা এবার একটু হেসে ফেলে বলল "সে না হয় পরে দেখা যাবে। আগে তো চলো !"

সুবীর আর কিছু বলে না। সুবীরের হাঁটতেও আজ যেন অসুবিধা হচ্ছিল,বড়ই দুর্বল ক্লান্ত, আর জ্বর অসুস্থতা তো আছেই।রূপা একটা টোটো চালককে ডেকে রিজার্ভ করে সুবীর কে টোটোয় নিয়ে যায়।

রাস্তায় পথে এক প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকানের সামনে টোটো দাঁড় করিয়ে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট মানের মিষ্টি কিনল।টোটোয় বসে যেতে যেতেই রূপা কাকে যেন ফোন করছিল। 

সুবীর শারীরিকভাবে অসুস্থবোধ করছে। রূপা কাকে কি বলছে ঠিক কানে আসছিল না।কেমন অবসন্ন ঘুম ঘুম লাগছে। তেঁতুলতলা বাজারের কাছে একটা গলিতে টোটো থামিয়ে রূপা তার নিজের ভাড়া ঘরে সুবীরকে তুলল।

রূপা, প্রথমেই সুবীরকে তার সোফায় বসিয়ে সামনে টি টেবিলে বেশ কিছু মিষ্টি ও এক গ্লাস জল দিলো, চামচ দিয়ে বলল "আগে কিছু খেয়ে নাও । কোন সকাল থেকে তো কিছুই খাও নি !"

সুবীরের ক্ষীদে প্রান ওষ্ঠাগত। গোগ্রাসে সব খেয়েই নিল। লাজুক হেসে বলল,  " খুব খীদে ছিল সব খেয়েই নিলাম। "

রূপা হেসে বলে,," বেশ করেছ। আর দেবো?"

ঘাড় নেড়ে না জানিয়ে সুবীর বলল" আর পেটে জায়গা নেই, ভীষন ভালো খেতে ,অনেক দিন এমন খায়নি তো।"

রূপার চোখে জল এসে যায়। কিছুক্ষণ আবেগ চেপে, হেসে বলল "গায়ে একটু বল এল!"

 সুবীর অবাক, বলে "কেন বলতো! "

রূপা বলে, "টোটোয় আসতে আসতে ডাক্তার কাকুর সাথে কথা বললাম, মানে ডক্টর এ ব্যনার্জী, আমার ইউনিভার্সিটির বান্ধবী বৈশাখীর বাবা। বড় ডাক্তার আমাকে খুব স্নেহ করেন। অনেক বার উনার বাড়ি গেছি,শেষ দুতিন মাস যোগাযোগ নেই। কিন্ত উনি আগের মতই বললেন , "তোমার দাদা যখন, একবারে প্রথমেই দেখব, ঠিক ছটায় এসো। আর মাত্র পনের মিনিট বাকী। এবার যেতে হবে ।ঐ টোটোকেই বলে দিয়েছি, এল হয়ত।"

"আবার এসব কী দরকার ছিল! আমার কোন রোগ নেই। এমত দুদিন ভালো খেলেই ঠিক হয়ে যাবে " কাঁচুমাঁচু হয়ে সুবীর বলল।

"সে তো তুমি আমি বললে হবে না ,কাকু অনেক বড় ডাক্তার উনি যা বলবেন সেটাই হবে। "

সুবীরের আর গা বয় না ।একটু শুতে চায়, কিন্ত রূপা ছাড়ল না। ডাক্তার পরীক্ষার করলেন, খুব সময় নিয়ে দরদ দিয়ে।কিন্তু ফি কিছুতেই নেবেন না।তবে অনুযোগ সুরে বললেন। "তুমি মা মাষ্টারী পেয়ে দেখা করতেও এলে না,কাকুকে ভাবলাম ভুলে গেছো। "

রূপা দুঃখ প্রকাশ করায় কাকু হেসে বললেন"শুধু কাজে না, অকাজেও আসবে। তোমার বন্ধু আই এ এস কোচিং নিতে দিল্লিতে আছে তো কি! আমরা তো আছি!তোমার কাকী এখন বাড়ীতে একা বড় নিঃসঙ্গ ,তুমি এলে খুব আনন্দ পাবে।" ডাক্তার কাকুর এক ছেলে আর এক মেয়ে ।ছেলে বড় ,ডাক্তার জার্মানে থাকে।

রূপা বলে " নিশ্চয় যাব কাকু । পরে জিজ্ঞেস করল কেমন দেখলেন কাকু?"

ডাক্তার কাকু মুখ বেশ গম্ভীর বললেন,  "কতক গুলো পরীক্ষা করতে হবে। ব্লাড, ইউরিন ,আর ইসিজি, সব  লেখা আছে, বাইরে নরেনকে  প্রেশক্রিপশন দেখালেই সব ব্যাবস্থা করে দেবে।" সুবীর কে বলল "খেয়ে এসেছ  তো !" সুবীর সায় দিল। ডাক্তার বাবু আরও কিছু কথা রূপাকে ডেকে বললেন।

ঐ দিনই সুবীরের ইসিজি হল, ব্লাড ও ইউরিনের নমুনা  নিয়ে  নার্সিংহোমের ক্লিনিকে এক কর্মী রূপাকে বলল, " কাল আটটার পর এসে রিপোর্ট নেবেন।তার পর রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বাবু সিদ্ধান্ত নেবেন।আজ শুধু জ্বর যন্ত্রণার কিছু ওষুধ দিতে লিখেছেন।বাড়ী গিয়েই একটা ট্যাবলেট খেতে হবে, ,পরে যদি খুব জ্বর আসে তখন খাওয়াবেন ।" ছোট কাগজের খামে ট্যাবলেট ভরে দিল।

বাড়ী ফেরার পরই রূপা, জ্বরের ট্যাবলেট সুবীর কে খাওয়ালো। নিজে তৈরী করে একটু চা বিস্কুট খেয়েই আবার একাই এবার কোথাও যেন বের হল।তার আগে টিভিটা চালিয়ে সুবীরকে সোফায় বসে চা বিস্কুট খেতে খেতে টিভি দেখতে বলে গেল।

রাত তখন প্রায় আটটা ।রূপার ঘরে সে একা। সুবীরের খুব গ্লানি লাগছে। বেচারা কি ঝামেলা কষ্টেই না পড়ল। এসে থেকেই বিশ্রাম নেই। এক কাপড়ে একা দৌড়ঝাঁপ করে মরছে। ছি ছি নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিল। আবার এসে যদি রান্না করতে হয় কী যন্ত্রণা তার। সে নিজেকে অপরাধী ভাবতে ভাবতে কোন সময় সোফায় ঘুমে ঢলে পড়ল।

রূপা বাইরে থেকেই চাবি দিয়ে গেছিল। ঘন্টা খানেক পর চাবি খুলে ঘরে এসে দেখল সুবীর অকাতরে সোফায় ঝুঁকে ঘুমোচ্ছে, টিভি চলছে। রূপা টিভি অফ করে তাকে ঠেলে একটু ভালমত সোফায় যখন শোয়াতে গেলে সুবীর ধরফরিয়ে উঠে পরে।খানিক অবাক চোখে এদিন ওদিক চেয়ে বলে "আমি জেগে স্বপ্ন দেখছি মনে হচ্ছে।"

রূপা খুব একচোট হাসল বলল, "আর আমি নিশ্চয় সেই স্বপ্নের রানী!"

সুবীর বোধহয় লজ্জা পেলো, কোন উত্তর দিল না। রূপা সুবীরের কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল " যাক তোমার জ্বর তেমন নেই।  সুস্থ লাগছে তোমার?

সুবীর সায় দিল। রূপা বলল "ডাক্তার কাকু যেন ধন্তত্বরী। "

রূপার গ্রাউন্ড ফ্লোরে এক কক্ষের ঘর।ঘরটি বেশ বড়। সঙ্গে বার্থ টয়লেট,আর রান্নার ঘর ও ডাইনিং। সুবীর ডাইনিং রুমেই ছিল।রূপা এতক্ষন বাজারে গিয়েছিল।একটা ব্যাগ থেকে দুসেট করে সুবীরের জন্য আজই পাজামা, পাঞ্জাবী ,আন্ডারওয়ার, গামছা আর একটি করে টুথ ব্রাশ ,টুথপেষ্ট সাবান, দাড়ি কাটার রেজার, সুগন্ধি, তোয়ালে ,চপ্পল কিছুই কিনতে বাদ নেই ।আর সঙ্গে এক সেট রেডিমেড প্যান্ট শার্ট।

সুবীর খুব আস্বস্তিতে বলে" এত কি দরকার ছিল! অনেক তোমার খরচ হয়ে গেল। "

রূপা শুধু হাসল।

সুবীর উদ্বিগ্ন। বলল "না না এভাবে আমার জন্য তুমি এত সব অপচয় করো না।"

এবার রূপা বলল "এটা অপচয় ! কিন্তু তোমায় বাড়িতে থাকতে হলে দু সেট তো একান্ত দরকার। অসুস্থ মানুষ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্রত্যেক দিন কাচা পোষাক পরা তো দরকার।" ক্লান্ত অবসন্ন রূপা ঘাম মুছতে মুছতে বলল "তুমি বার্থরুমে গিয়ে পোষাক পাল্টে পরিস্কার হয়ে নাও, একটা সেট পোষাক দেখো বাথরুমে রেখেছি। তুমি এলে আমি যাব। "

সুবীর কুন্ঠিত হয়ে বলে "আজ আর রাতে আমার জন্য রান্নার দরকার নেই ,তেমন খিদে নেই বিকালে এত মিষ্টি খেয়েছি।"

রূপা হেসে বলে,  "রান্না আজ করব না, চিকেন বিরিয়ানি আর মটন কষা এনেছি।"

উভয়ে পরীক্ষা পরিচ্ছন্ন হয়ে পোষাক পাল্টে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসল। রাত তখন দশটা, সুবীর সারাদিন প্রায় অনাহারে থেকে বিকালে যতই মিষ্টি খাক, ক্ষিদে বেশ ছিল।জীবনে এই প্রথম বিরিয়ানি আবার সঙ্গে মটন কষা!গোগ্রাসে গিলল।

রূপারও আজ ভালো ঝক্কি গেল।ক্লান্ত লাগছিল।

খাবার খেয়ে শয়ন কক্ষে সুবীর কে ডাকল। সাত বাই ছয় বড় খাটে গদি নরম সুদৃশ্য বিছানা।

সুবীর ভীষণ দ্বিধা আর লজ্জায় বলল "আমি ডাইনিং ঘরে সোফায় বেশ ঘুমোব, তুমি ওঘরে আরামে শোও"

রূপা এবার বিরক্ত হয় বলে "দেখো আর বিলম্ব করো না ।যা বলছি শোন,অনেক ধক্কি গেল, ক্লান্ত লাগছে এবার ঘুমুব। "

সুবীর বাধ্য ছেলের মত আর রা দিল না। রূপা বলল "বড় খাটের দুজন দুপাশে শোব, মশারী না হলে রাতে মশার উৎপাতে ঘুম হবে না,আর তুমি অসুস্থ তোমারও আরামে একটু ঘুম দরকার ।"

সুবীর বিছানার নিদিষ্ট দিকে এককাতে চরম কুন্ঠিত জড়সড়ো হয়ে শুয়ে পড়ল।

রাত তখন তিন টে কী সাড়ে তিনটে হঠাৎই রূপার ঘুম ভাঙ্গে। সুবীরের বমির বেগ ও তীব্র হাঁপানোর মত আওয়াজে । ধড়ফড়িয়ে রূপা উঠে বসে ,চোখ কচুলে দেখে সুবীর খাটে নেই । বাথরুমের বেসিনে ঝুঁকে , বমির বেগে আসছে, কেমন হাঁপাচ্ছে ,পা টলমল করায় বেসিন ধরে আছে।

রূপা তাড়াতাড়ি ছুটে যায়।তাকে পিছু থেকে ধরে থাকে, যাতে না পরে যায়।বেসিনে অনেক বমি করেছে।

লজ্জিত অসহায় চোখে সুবীর বলে, " আমাকে ছাড়ো,আমার গায়ে নোংরা থাকতে পারে, আমি বেসিনটা এক্ষুনি ধুয়ে দিচ্ছি। অসুস্থ শরীর অবসন্ন দেহে সুবীর কাঁপছিল,গায়ের জ্বরটা আরও তীব্র মনে হচ্ছিল। 

রূপা স্নেহের সাথে বলল, "আর বমির বেগ আছে!"

সুবীর ইসরায় না বলে। রূপা তার মুখ মুছিয়ে জল দিয়ে তাকে কুলকুচি করিয়ে ,ধরে ধরে এনে বিছানায় বাসায়। অসহায় আর কেমন অপরাধী চোখে সুবীর বলে "বেসিনটা বমিতে নোংরা হয়ে আছে, আমি একটু পরে পরিস্কার করে দোবো।"

"তুমি ভীষণ অসুস্থ কাঁপছ ,গায়ে অনেক জ্বর ,এসব তোমায় ভাবতে হবে না।" জ্বরের একটা ট্যাবলেট খুলে এবার রূপা তার মুখে ভরে দিয়ে বলল" জল দিয়ে গিলে নাও,তারপর একটু বিশ্রাম নাও।"

সুবীরের চোখে জল, রূপার মুখের দিকে একভাবে চেয়ে অসহায় চোখে বলে "তোমার খুব অসুবিধা হচ্ছে, বিশ্বাস করো আমি অনেক চেষ্টা করেও বমি থামাতে পারলাম না, তোমার বাথরুমে বেসিনটা নোংরা করে ফেলেছি।"

" যদি বিছানাতেই করতে কী হতো ! তুমি অসুস্থ ইচ্ছা করে তো করো নেই! ও নিয়ে মন খারাপ করো না। "

একটু থেমে রূপা নিজের উপর রেগে বলে" দোষ তো আমারই।তোমাকে এত রীচ খাবার অত রাতে খেতে দেওয়া ঠিক হয় নি!এখন বুঝছি। "

সুবীর হাত নেড়ে বিষন্ন স্বরে বলে" না তোমার কী দোষ ! রাক্ষসের মত সন্ধ্যে থেকেই কেবল গিলে যাচ্ছি। "অনুতাপের সুরে বলে "আমি তোমায় ষ্টেশনেই বলে ছিলাম, আমায় নিয়ে যেওয়া না অশান্তি আর বিপদ বাড়বে।"

রূপা এবার রেগে বলে "না আনলে এতক্ষণ তো মরেই যেতে।"

সুবীর নিজের প্রতি ধিক্কারে বলে "সে অনেক ভালো হত, এই অপয়া অলক্ষুনের মৃত্যু অনেকভালো, তোমার কী দরকার , আমার জন্যে এত কষ্ট!"

আবেগতাড়িত রূপা বলে, " তোমায় কত খুঁজছি জানো! ভেবেছিলাম পেপারে ছবি দেবো, পুলিশে জানাব, শুধুমাত্র তোমার খোঁজ পেতে। পরে ভাবলাম এতে তোমার হয়ত অপমান হবে।এমন হাল যে তোমার হবে ভাবব কী করে!"রূপা অশ্রু ভরা ধরা গলায় বলে "আর বলছ তুমি মরে গেলে আমার কিছুই নয়! আরামে থাকব! কেন আনলাম! "বলতে বলতে রূপার গলারুদ্ধ হয়ে আসে দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে যায়। কান্না আটকানো চেষ্টায় দুঠোঁট চেপে সুবীরকে আড়াল করতে রান্নার ঘরে ঢুকে যায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসে।

বিব্রত বিভ্রান্ত সুবীর অসুস্থ শরীরেই রান্নার ঘরে যায়, দেখে রূপা ভীষণ কাঁদছে।

সুবীর বিব্রত "কি এমন অন্যায় করলাম বলো ! আমি ক্ষমা চাইছি। "

রূপা সুবীরকে এবার জড়িয়ে ধরে গভীর ভাবে বেশ কিছুক্ষণ ।সুবীর বাকরুদ্ধ।

রূপা সজল নয়নে ধরা গলায় বলে"কোন দিন এই সব মরে যাওয়া, অপয়া, কুকথা মুখেই আনবে না।আমার দিব্যি।"

সুবীর ভাবে,  রূপা তাকে আজও কী  ভীষণ ভালোবাসে।আবেগ তাড়িত হয়ে বলে "তুমি কেন আমায় এত ভালোবাসো! "

রূপার চোখে জল আবেগঘন  হয়ে বলে, "তোমার জন্যই তো এ জীবনে বেঁচে আছি, তুমি তা ভুলে গেলেও আমি ভুলবো কী করে! তাও তখন কতই না তোমাকে  তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা করতাম। আর তুমি আমায় বাঁচিয়ে , তোমার পুরস্কার গৃহ হারা ! মরতে বসেছ। কী পেলে জীবনে ! সেদিন আমি প্রতিজ্ঞা  করেছিলাম তুমি কিছু করো না করো, আমার দেখা দরকার নেই ।আমি সক্ষম হব। চাকরী করব, আমার বাড়িতে তোমাকে রাজা করে রাখব। ঈশ্বর আমার সক্ষম করলেন। আজ হঠাৎই ঈশ্বরের কৃপায় আজ তোমায় খুঁজে পেলাম।আর হারাতে চাই না" সুবীরকে সে আরো ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে ধরে।


( দ্বিতীয় পর্ব )

সুবীর ছিল রূপার জামাই বাবুর ভাই। রূপা এক এঁদো গ্রাম থেকে স্থানীয় মন্তেস্বর কলেজে ইংরেজী অনার্স করে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ভর্তি হয়।।

দিদির বাড়ী বর্ধমানের নিকটস্থ শোনপুর গ্রামে।জামাই বাবু ব্যাঙ্ক চাকুরে।বর্ধমান থেকে কাছেই শোনপুর। তাই দিদির বাড়ি থেকে পড়াশোনা করবে ,ডেলী গোলাবাগে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া সমস্যার নয়।

রক্ষণশীল তার পিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল বা মেসে রাখার পক্ষপাতি নয় ।ওখানে নাকি খুব অনাচার অসভ্যতা হয়।যারা মেস বা হোস্টেলে থাকে ভালো নয়।সত্য মিথ্যার তিনি যাচাই করবেন না।এমনই সে জেদী একগুঁয়ে মানুষ ।তার ধারনাই সত্য। দিদির কাছেই থাকতে হবে।এই শর্তেই তিনি এমএ ভর্তি করবেন।

সচ্ছল মানুষ তার পিতা ।রূপার মাস খরচও দিতেন মেয়ে জামাই কে। কৃপন সংকীর্ণ মনা মেয়ে জামাই যেন মানিক জোড়।জীবনে টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না।আর বড় কুমন্ত্রনার মাষ্টার রূপার দিদি শিখা, স্বামী তার বাধ্য ছাত্র। তার ইচ্ছাই সব ,বাকী বাপ মা ভাই আত্মীয়স্বজন সব তুচ্ছ।

সুবীরের বাবা মা থাকেন ঊরিষ্যার ঢেংকানল নাকি কোথায়,মেয়ের জামাই রেল ড্রাইভার। রাত ডিউটি মাঝে মধ্যেই পরে।শ্বশুর প্রাইমারী শিক্ষক পেনশন পান । কাছে থাকলে লাভ তো জামাইয়ের !

সুবীরের বাবা মা বৌমার কাছে উঠতে বসতে লাঞ্ছনা পেতেন । মেয়ের বিয়ের সময় গৃহ বন্ধক রাখতে হয়। শ্বশুরের নাম করে বড় ছেলে পাঁচ লাখে স্ত্রী শিখার নামে বাড়িটি বন্ধক রাখে।এক রকম বাধ্য হয়ে তাই মেয়ের কাছে পালিয়ে গেছেন সুবীরের বাবা মা।স্ত্রীর ক্যান্সার চিকিৎসায় করতেই অবসরকালীন সব টাকা আগেই শেষ হয়ে যায়।এখন আর তেমন যোগাযোগ নেই। মাঝ থেকে সুবীরই সমস্যায় পরে।

বেকার সুবীর তখন পঁচিশ ছাব্বিশ, বর্ধমানে প্রাইভেট টিউশন পড়ায়।কয়েকটি বস্তির বাড়িতে।আয় তেমন নয় । নিজের পেট চলে। হোটলে খেয়ে রাতে শোনপুরে বাড়িতে ফেরে, ,শুধুমাত্র শোবার জন্য আসা। বড় নিরীহ মুখচোরা। সুবীরের সরকারী চাকরীর জন্য এত পড়াশোনার সময় নেই। ম্যাগাজিন বইপত্র কেনার টাকা নেই ।সুস্থ মানসিক পরিবেশ নেই ,সংরক্ষণ নেই, সুপারিশ নেই। মামুলি ডিগ্রি।সে কাজ পায় না।নিঃস্ব প্রায় সুবীরের কয়েকটা ছেলে পড়িয়ে ,হোটেলে খাবার, পোষাক,আর যাতায়াত খরচ বাদে সঞ্চয় না থাকার মত যৎসামান্য ।

  যতদিন রূপা আসেনি ,দোতলায় দুটি ঘরে একটিতে দাদা বৌদি ছেলে নিয়ে শুতো, অন্য ঘরে সুবীর। কিন্ত সমস্যা হল রূপার আসার পর। তার ঘর দখল করল রূপা।আর সুবীরের ঘর বরাদ্দ হল চিলেকোঠায় ছোট নিচু ঘর।

রূপার মাঝারি উচ্চতা,বলিষ্ঠ শরীর,আকর্ষণীয় গঠন, রং অল্প চাপা , মুখচোখে ডানপিঠে ভাব, ভয়ডর হীন জেদী বেপরোয়া স্বভাব। গ্রামের মেয়ে সাঁতার থেকে গাছে ওঠা সব তার জানা। পড়াশোনায় ভালো কিন্ত অঙ্ক ভালো তার লাগেনা, কলা বিভাগ নিয়ে পড়ছে।

সুবীর বেশ সুন্দর, ফর্সা , নম্র স্বভাব বড় লাজুক আর নিরীহ। এটাই তার কাল ।

রূপা যাতে কোন মতে শিমুলফুল বেকার বিত্ত হীন দেওরের প্রেমে না পড়ে ।শিখা বোন কে কু মন্ত্রনা দেয়।বলে "ওর রংএর বড় অহংকার, তুই কালো তো নয়" তবু তোকে কালো বলে।বদ আর ঝগড়াটে। আবার বাবুর ঘর বদলের জন্য তোর উপর খুব রাগ।থাকিস তো রাত টুকু তাতেই !"

রূপা ভাবে ঘর বদলের কথাটা তো ঠিক। নিজের রং রূপের যদিও সে ধার ধারেনা।কিন্তু কেউ তো তাকে কালো বলে না! বরং বুদ্ধিদীপ্ত চালাক চালাক মুখ বন্ধুরা বলে। এর তো দেখছি ন্যাকা খল মেয়েদের মত রং রূপের বড় অহংকার! তাই ভালো চোখে দেখত না।

এদিন রাতে একই বাসে তারা বর্ধমান থেকে বাড়ি ফিরছিল। কদিন হল রূপা শোনপুরে তার দিদির বাড়ি এসেছে । ফিরতে আজ একটু রাত হয়েছিল। রূপা সিটে বসেছিল । দেওয়ানদিঘীতে তার পাশের সিট খালি হলে,দুরে দাঁড়িয়ে থাকায় সুবীর কে পাশে বসতে ডাকল সৌজন্যতাবশত। আনমনা সুবীর শুনতে পায় না। রূপার মনে হয় তাকে অগ্রাহ্য করছে। তখন কিছু বলে না।সহ্য করার পাত্রী কিন্ত সে নয়।

রাত তখন নটা। শোনপুরে উভয়ে বাস থেকে নেমে বাড়িমুখে ফিরছিল।কিছুটা গ্রাম্য পথ হেঁটে বাড়ী।পথে কেউ আর ছিল না। পিছনে রূপা আসছে আপনভোলা সুবীর নজর করেনি ।এত রাতে সেতো আসেও না!হঠাৎই রূপা পিছন থেকে হালকা ঠেলা দিয়ে বলে, "এই যে সুন্দর ফর্সা!"

সুবীর চমকে পিছু ফিরে তাকায়, একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। এমনিতেই লাজুক তার উপর রূপা মত বাইশ বছরের এক যুবতীর এমন সম্ভাষন ! কী বলবে ভেবে পায় না।রূপা আবার বলে "আমার প্রতি খুব আপনার জ্বালা হিংসা তাই না! "

আমতা আমতা করে সুবীর বলে " এসব কী বলছ তুমি! "

রূপা বলে "আরে আপনার ঘর দখল করেছি বলে বাসে ডাকলাম পাশে রাগে বসলেন না! না কালোর কাছে বসলে খুব অপমান হবে বুঝি!কোন প্রস্তর যুগে আছেন শুনি!"

বিষন্ন সুবীর বলে" বিশ্বাস করো আমি শুনতে পাইনি।"

রূপা এবার রীতিমত রেগে বলে "মিথ্যা কথা একদম না! আমি ঘৃনা করি।কীসের পুরুষ মানুষ আপনি! লজ্জা করে না? ছিছি। রং রূপ নিয়েই থাকুন, তবু যদি মেয়ে হতেন! সভ্য ভদ্র হতে শিখুন।"

সুবীর কিছু বলতে গেলে ধমকে থামিয়ে বলে।

"আপনাদের কত আদিম মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে ঘৃনা হয়।" বলেই তাকে পেরিয়ে গট গট করে এগিয়ে যায়। যেন কিছুই হয়নি।

সুবীর অকারনে অপমানিত হল।দুঃখে চোখে জল এলো। রূপার প্রতি তার বিদ্বেষ বা দুর্বলতা কোনটাই ছিল না। রূপ রং এর গর্ব দুরে থাক। বেকারত্বের গ্লানি তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতো। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেমন যেন আপনভোলা আনমনা।

ঠিক তার দিন তিনেক পরের ঘটনা। সুবীর বেশ উদ্বিগ্ন দ্বিধাগ্রস্ত।সে সাতটায় গ্রামে বাস ধরে নিত্য বর্ধমান যায়। রূপা ভাত খেয়ে যায় আটটার সুপার "পথের সাথী"ধরে । তখন ছটা, রূপার দাদা বৌদি নিচে নেমে গেছে।এই সুযোগে সুবীর লুকিয়ে রূপার ঘরে ঢোকে। রূপা উগ্র দৃষ্টিতে কড়া গলায় বলে "কি ব্যাপার হঠাৎ আমার ঘরে! "

"একটা কথা ছিল গোপনে , দাদা বৌদিকে বলো না। "

এবার রূপা হেসে ফেলে " প্রেম নিবেদন করবেন বুঝি! কিন্ত আমি তো কালো আপনি কত ফর্সা!"

আহত সুবীর বলে "তুমি যত খুসী ব্যাঙ্গ করো আমার খুব বলা দরকার।"

রূপা ব্যাঙ্গ স্বরে বলে"আরে বলুন না !কে আপনাকে বারন করেছে!

"একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে নিয়ে। "

রূপা রসিকতা করে বলে" তা হলে আমাকে নিয়েও আজকাল স্বপ্ন দেখছেন বুঝি ! ঝারনে কাজ হয়েছে বলুন!"

"আমার স্বপ্ন টা প্লিজ আগে--"

" বলে জান বলে জান শুনছি "বলেই রূপা খুব হাসতে লাগে। 

আহত সুবীর বলে "আজ তুমি প্লিজ পথের সাথী আটটার বাসে যাবে না"

রূপা তেতে বলে উঠে "মামার বাড়ির আবদার! আপনি বললেন আর আমি যাব না ?"

সুবীর কাচুমাচু করে বলে "ভীষণ খারাপ স্বপ্ন "

রূপা এবার বিরক্ত হয়ে বলে" আরে ন্যাকা মেয়েদের মত ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলেন কেন?"

সুবীর বেশ উদ্বিগ্ন একটানা বলে "এই বাসটা আজ এক্সসিডেন্ট করবে তুমি তোমার এক বন্ধু কলিগ্রাম থেকে ওঠে আর দুজন ড্রাইভারের উল্টোপাসের সিটে বসেছিলে স্পট ডেথ! "

রূপা এবার কৌতুক করে বলে"ভোজবাজী পেয়েছেন! রূপকথার গল্প লিখুন ,নাম পাবেন। "

সুবীর অনুনয় সুরে বলে"প্লিজ শোন আগে আমি এমন দুটো স্বপ্ন দেখেছিলাম, মিলে গেছে।"

রূপা ব্যঙ্গ হাসে বলে "কেমন শুনি!"

সুবীর সরল মনে বলতে থাকে" আমার মাধ্যমিকের টোটল আর অঙ্কের নম্বর। হুবহু মিলেছিল।

রূপা তাচ্ছিল্য সুরে বলে "ওটা হতেই পারে।মনে মনে একই চিন্তা বার বার করলে এমন স্বপ্ন পাগলে দেখে।"

সুবীর আহত সুরে বলে" আমি পাগল! বেশ তাহলে মায়ের যখন ক্যান্সার ধরা পরে, তার একমাস আগেই স্বপ্ন দেখি। দুঃখে বলি নেই পরে সত্যিই ধরা পরে। " রূপা হাসতে হাসতে বলে"এমন স্বপ্ন যে আপনি সত্যিই দেখেছিলেন তার প্রমাণ কী? "

সুবীর জোর দিয়ে বলে "প্রমাণ কিছু নেই ,এটা বিশ্বাস করতে হবে।"

রূপা এবার হো হো হেসে ওঠে বলে "আগে ভাবতাম আপনি অহংকারী বদমেজাজী। আজ বুঝতে পারছি আপনি আধ্পাগলা, কল্পনাবিলাসী ,মেয়েলী ,ভীতু জাস্ট খ্যাপা, যান অনেক সময় দিয়েছি বিদায় হোন। "

সুবীর হতাশ বলে "আমার তো কোন জোর নেই, জাষ্ট অনুরোধ করতে পারি। কিছু হলে আমি নিজের কাছে ঠিক থাকব।" কিছু যেন বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল,রূপার কানে শুধু ভেসে এল "বেকার অপদার্থ দের কোন ভ্যালু নেই।ভালো চাইলেও লোকে ধান্ধাবাজ ভাবে।"

কিছুক্ষণ পর সুবীর দিনকার মত সাতটার বাস ধরতে চলে যায় । রূপা ভাত খেয়ে আটটার সুপার "পথের সাথী "ধরতে বাস স্ট্যান্ড গিয়ে দেখে সুবীর যেন তার অপেক্ষা করছে। বিস্মিত রূপা এগিয়ে গিয়ে বলে "কী ব্যাপার আপনি যান নি এখনও!আবার কী খ্যাপামো করবেন?"

সুবীর দেখছে বাসটি ঢুকছে একবার শেষ বারের মত বলল "এটা না ধরলে--"

কথার শেষ হতে দেয় না,ব্যাঙ্গ হেসে বলে"দেখছি আমাকে না বাঁচিয়ে ছাড়বেন না! পাগল একটা! "

দুর থেকেই সুবীর যেন বাসে না উঠতে রূপাকে ইশারায় আবেদন করছে। হঠাৎই বাসের মধ্যি থেকে তার কলিগ্রামের বন্ধু বাসের সামনের দিকেই সে দাঁড়িয়ে ছিল বলে" এখানে উঠে চলে আয় রূপা। ড্রাইভারের উল্টোদিকে দুটো সিট রাইপুরে খালি হবে,দুজনেই বসব। "

রূপা এবার কেমন উদভ্রান্ত! মনে ভাবে এ কী বলছে !একবার বলে তুই নেমে আয় এ বাসে আমি যাব না!"

রূপা বাসে না উঠে নিচেই দাঁড়িয়ে থাকে। বাস ছেড়ে দিল। দশ মিনিট পর একটা লোকাল বাস এলে রূপা উঠল, সুবীর উঠল, কিন্ত কেউ কোন কথা বলল না। রূপা বেশ গম্ভীর চুপচাপ। কেমন যেন মনটা করছে।

মিনিট পনের পর।হঠাৎই তাদের বাসটা থেমে গেল। সামনের বাস বড় এক্সসিডেন্ট করেছে।একটা গাছকে স্টিয়ারিং কেটে ব্রেক ফেল করে বাসটা ঘাক্কা মেরেছে। মির্জাপুর থেকে বের হবার মুখের মোড়ে গাছটি রাস্তার পাশে বিপদজনক ভাবেই ছিল ।

বাস থেকে নেমে রূপা রুদ্ধ শ্বাসে দৌড়ে যায়। বহু মানুষের ভীড় । ড্রাইভারের উল্টো দিকে সামনের সিটটাই দুমড়ে মুচড়ে ভিতরে ঢুকে গেছে। চারজনেই স্পট ডেথ । বান্ধবীর চেপটে বীভৎস মুখটা নজরে আসতেই আঁতকে ওঠে ।

কিছুক্ষণ রূপা বাকরুদ্ধ চোখবুজে দাঁড়িয়ে থাকে।বাকী যাত্রীরা আহত, কেউ গুরুতর আবার কারও সামান্য আঘাত। রূপা কেমন উদভ্রান্ত দিশেহারা । দুরে সুবীর। একটু চুপ চাপ মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে ।রূপা তার দিকে এবার ছুটে যায়। চরম আবেগে তার সারা শরীর কাঁপছে । কৃতজ্ঞতায় ধরা গলায় সে বলে "আপনাকে কত তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা করছিলাম কিন্ত-- "

সুবীর বলে" কে অবজ্ঞা করল! তুমি তো বাসে চাপো নি! এটাই যথেষ্ট,"

 রূপার চোখে জল ,লজ্জা আর অনুতাপে বলে "কিন্ত এত হেনস্থা ব্যঙ্গের পরও আপনি কী চেষ্টাই না করলেন! কিন্ত কেন? আপনি নিশ্চয়ই আমার পূর্ব জন্মের খুব আপনজন।আমি চিনতে পারি নেই। কিন্তু আপনি ঠিক পেরেছেন!

সুবীর হেসে বলে "না না অমন কেন!কেমন যেন মনে হল তুমি ঠিক শুনবে।

রূপা মাথা হেট করে আবার অনেকক্ষণ চোখ বুজে স্থির থাকে কী ভাবছে যেন! কেমন যেন মুখচোখে অপরাধ ভাব,তার দুচোখ জলে উপচে পরছে । সহসা সুবীরের দুহাত টেনে নিয়ে,নিজের দুহাতের তালুমধ্যে রূপা চেপে ধরে ।হতচকিত সুবীর রূপার দিকে তাকায়।রূপা তার চোখে চোখ রেখে মিনতি সুরে বলে "আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও, অনেক কুকথা বলে তোমাকে ছোট করেছি ,দুঃখ দিয়েছি, আজ থেকে এ জীবন শুধু তোমার।" রূপা দুচোখ জলে ভরা , মুখ থমথমে, ঠোঁট আবেগে কাঁপছে।

সুবীর বিব্রত বলে"কী পাগলামী করছ!"

কিন্ত সেটা পাগলামি নয় ,শুধু সুবীর নয় বাড়িতে তার দিদি জামাই বাবু বুঝল। এই অলৌকিক স্বপ্নের কথা কেউ না জানলেও সুবীর রূপার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাদের আচরণ ব্যবহারে বেশ বোঝা যাচ্ছিল। আর শিখার তাতে চরম বিরক্ত ,মুলত সুবীরের উপর।

বেকার নিঃস্ব শিমুলফুল দেওরের সাথে রূপার প্রেম !তার বাবা কী বলবে! কুচিন্তা আর বদ পরিকল্পনার ফল দেড়মাস পর সুবীর পেলো।রূপা গ্রীষ্মের ছুটিতে কদিন বাবা বাড়ি গেল। এসে দেখল সুবীর আর বাড়ীতে নেই। দিদি বলল "ও আর কষ্ট করে যাতায়াত করে না। বর্ধমানেই ওর কজন বন্ধুর সাথে মেসে থাকে। ঠিকানা ও কিছু দিয়ে যায়নি ।"

রূপা অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে । পরক্ষণেই পাগলের মত সুবীরের চিলেকোঠার ঘর সব তছনছ করে, খুঁজতে খুঁজতে ছোট একটা চিঠি পেল বিছানার তলায় " বৌদির নামে এই বাড়ি, এবাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে ।সামনের মাসেই বাড়ি ছাড়তে হবে । দাদা বর্ধমানে গোলাপবাগে বাড়িও কিনেছে, দাদার অফিস যেতে সুবিধা, তোমারও ভালোই হবে। যাতায়াতে কষ্ট হবে না। আমি বর্ধমানে একটা ছোট ঘর ভাড়া পেয়েছি।অসুবিধা হবে না। আর কোনদিন হয়ত দেখা হবে না।গরীব বেকার ছেলেদের প্রেম করা ঠিক নয়। তুমি বুদ্ধিমতী খুব ভালো মেয়ে , তুমিও জানো এই অসম প্রেম হয় না ।আমাকে ভুলে যেও ।আমি তোমার যোগ্য নয়। ভালো থেকো। ইতি সুবীর। "

চিঠি হাতের মুঠোয় টিপে ধরে , ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে অনেক ক্ষণ কাঁদল। চিঠির কথা যেমন কাউকে বলল না।পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের সিটের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করল ।একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা হলে সোজা গ্রামের বাড়ি গেল। বাবাকে গোপনে বলল "বাবা জামাই বাবুর আচরণ মোটেও ভালো নয়।"

বাবা বললেন "কি খুলে বল? "

"আমি থাকলে আমার আর তোমার বড় মেয়ে দুজনেরই ক্ষতি, না থাকলে দুজনের লাভ। এসব কথা তুমি অন্য কাউকে বলো না । এমন কী মাকেও না। বাড়ির কেচ্ছা গোপন থাক , না হলে দিদির তাতে ক্ষতি হবে। "

বাবা রাশভারী চারিত্রিক দোষ ভীষণ ঘৃনা করেন, ছোট মেয়েকে বিশ্বাসও করেন। জামাই যেখানে অবিশ্বাসী বিশ্বাসঘাতক,রূপা আর থাকবে না।অগত্যা বাবা তার হোস্টেল জীবন অনুমোদন দিল!

পরদিন রূপা হোস্টেল চলে যায় । দিদি জামাই বাবু এ বাড়ী বিক্রি করেনি, রূপার অনুপস্থিততে একটা চাল চেলেছিল।সরল সাদাসিদে সুবীর তা বিশ্বাস করে। আর না করে উপায় কী!এবাড়ীতে যে তার কোন অধিকারই ছিল না। সুবীরের চিঠি থেকেই রূপা পষ্ট দিদি জামাই বাবুর চক্রান্ত বোঝে, আর কেন জলের মতন পরিস্কার হয়। সুবীরের প্রতি দরদ ভালোবাসা এতে তার শতগুন বেড়ে যায়। জেদী রূপা তাকে ছাড়া এ জীবনে সে একাই থাকবে প্রতিজ্ঞা করে।

রূপা আর দিদির বাড়ী মুখী হয়নি ,যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে।আর সেই দিন থেকেই পড়াশোনার সাথে চাকরীর জন্য ঝাঁপিয়ে পরে। সুবীর বর্ধমানেই না অন্য কোথাও তার জানাছিল না। সুবীর বর্ধমানেই নীলপুরে এক বস্তির ছোট ঘরে ভাড়া থাকে। এতদিন কাছাকাছি কজন বস্তির ছেলে মেয়েদের পড়িয়ে বর্ধমানে এক প্রান্তে ছোট গন্ডির মধ্যেই থাকত।

বেশ কিছুদিন ধরে শারীরিক অসুস্থবোধ করায় ছেলে পড়াতে যে মনসংযোগ লাগে, তা ছিল না। টিউশন পেশা যায়। ইদানিং মাস দুই হল এই এলাকায় পথে পথে লটারির টিকিট বিক্রি করত। একজন তার পূর্ব পরিচিত এ কাজের তাকে লোভ দেখিয়ে, যা কিছু তার সঞ্চয় ছিল নিঃস্ব করে। আজ কিছু টাকা দেবার সে প্রতিশ্রুতি দেয় ।ষ্টেশনে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে। কিন্ত সেটাও এক ভাঁওতা।


(তৃতীয় পর্ব )

  গতকাল সারা দিনরাত বড় ধকল গেছে ।রূপা ভোড়ে আবার শুয়ে বেশ ঘুমিয়ে গেছিল। সকল আটটায় ট্রেন ধরতে হয় ।তার আগে নিজের মত ভাত ডাল তরকারি গ্যাস ওখানে করে নিতে হয়। তাই মোবাইলে অ্যালার্ম থাকে ঠিক সকল ছটায়। বড় বিরক্ত হলেও উঠতে হয়।আজ সে ডিউটি যাবে না।আটটার পর সুবীরের মেডিক্যাল রিপোর্ট আনতে যাবে।মোবাইল থাকে দুরে ডাইনিং টেবিলে।ঘুমের সময় নাকী বিছানায় মাথার কাছে মোবাইল রাখা ভালো নয়।অতশত বোঝে না।তবে মোবাইলটা দুরে রাখলে অ্যালার্ম শব্দে জ্বালাতনে উঠে পরতেই হয়।না কেটে দিলে শব্দ থামবে না।এটা তাকে জোর করে উঠতে সাহায্য করে। আজ সে অ্যালার্ম বন্ধ করে আবার একটু শুতে যাচ্ছিল ,কাজের মেয়ে সাতটায় আসে। ঠিকের কাজ, আধ ঘন্টার মেয়াদ। যেন মেশিন,এই সময়টাই ছোট এক কক্ষের ঘরের কাজ তার পক্ষে যথেষ্ট।দশ বারো ঘরে নাকি কাজ করে।

কিন্ত একী! নজর পরে সুবীর কেমন ভাবে পরে আছে! কাছে গিয়ে দেখে যেন অচেতনের মত! উদ্বিগ্ন রূপা গায়ে হাত দিয়ে দেখে ।জ্বরটা নেই। গা ঝাঁকুনী দিয়ে তুলতে গেলে কোন সাড়া নেই। দিশেহারা রূপা,সুবীরে হাতের তালু আর কব্জি ধরে টেনে তুলে বসাতে যায় ,হাতের তালু বেশ ঠান্ডা ।

রূপা ভয়ে চমকে ওঠে। এবার ডাক্তার কাকুকে ফোন করে।ডক্টর ব্যনার্জী খুব সকাল সকাল ওঠার অভ্যাস। "বললেন কি হল এত সকালে !"

রূপা বলে" সরি কাকু আমি খুব বিপদে ! তাই ডিষ্টাব করছি। সুবীরের কোন জ্ঞান নেই, অচেতন ,প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন বলে কেঁদেই ফেলল। "

ডাক্তার কাকু বললেন "হঠাৎ কি এমন হল !

রূপা বলে " ভোড়ে অনেক বমি করেছে!ওর হাত পা কেমন ঠান্ডা!"

কাকুর বললেন "কেন!খাবারে কিছু অনিয়ম হয়েছিল! অপরাধ আর অনুতাপে রূপা বলে "আমারই সব ভুল রাতে বাজারের চিকেন বিরিয়ানি মটন কষা--"

কথা থামিয়ে ডাক্তার কাকু বললেন "বুঝেছি,খুব ভুল করেছ । তুমি শিক্ষিত বুদ্ধিমান মেয়ে। এটা ঠিক করো নি। ওর শরীর এসব সহ্য হয়! যাক আমি দেখি।পরে ফোন করছি " বলেই ফোনটা কেটে দিলেন ।

রূপা নিজের উপর রেগে ক্ষোভে হতাশায় নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল।কেন এত রাতে এই সব কুখাদ্য আনলাম! শুধু তো আলু সিদ্ধ ভাত করতে পারতাম!হাজার সংশয় ভয় ভাবনা তাকে চেপে ধরেছে। রূপা

আপ্রাণ সুবীরের হাতের তালু পায়ের তলা ঘষে গরম করার চেষ্টা করছে। ফোন বাজল, ডাক্তার কাকুর ফোন।

উদ্বিগ্ন রূপা হলে "হ্যাঁ কাকু!"

"অ্যাম্বুল্যান্স যাচ্ছে তোমার ঠিকানা কী বলো।"

রূপা তেঁতুলতলার ঠিকানা , নিকট দোকানের নাম, গলির অবস্থান বলল।

কাকু বললেন "রেডি থাকো। গেট খুলে পাঁচ মিনিট পর বাইরে রাস্তায় দাঁড়াবে । অ্যাম্বুল্যান্স ড্রাইভারের চিনতে সুবিধা হবে।

রূপা খুব তাড়াতাড়ি নাইটি ছেড়ে শাড়ি পরেনিল। খোশবাগানের এই নার্সিংহোম থেকে তেঁতুলতলার দুরত্ব খুব কম। তাই পাঁচ মিনিটের আগেই হর্ন দিল গলির মুখে অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়াল ,দুজন অ্যাম্বুল্যান্স থেকে স্টেচার নিয়ে সুবীরকে তুলে অ্যাম্বুল্যান্সের দিকে যেতে যেতে বলল "ম্যাডাম ঘরে চাবি তালা দিয়ে চলে আসুন। অ্যাম্বুল্যান্সের সাথেই যাবেন ।"

তাড়াহুড়ো করে রূপা শুধুমাত্র মেন দরজায় তালা দিয়ে ছুটল। নার্সিংহোম পৌছে, সুবীর কে স্টেচার সহ মুহূর্তে লিফটে তুলল।

একজন বলে গেল রূপাকে।অফিস রুমে যান,আগে ওখানে রেজিস্ট্রেশন করুন পরে আসবেন। পাশেই অফিসে ডিউটিরত মেয়েটি তাকে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামতে দেখেছিল ,"বলল আপনি ডাক্টর ব্যনার্জীর পেসন্টের গার্জেন?

রূপা ইশারায় সম্মতি দিলে বেশ কিছু ফর্ম সই করাল। , রোগীর নাম বয়স ঠিকানা, অনেক তথ্যসহ দুটো ফ্রম পুরন করিয়ে সই করিয়ে,অ্যাডভান্স দশ হাজার টাকা ডিপোজিট করতে বলল। রূপা তাড়াহুড়ো করে টাকাই আনে নি। তাড়াতাড়ি ডাক্তার কাকুকে ফোন করে চরম হতাশ আর উদ্বিগ্ন স্বরে বলে " কাকু আমি তো টাকার আনতে ভুলে গেছি।তাহলে কি চিকিৎসা হবে না কাকু!আমার গলার সোনার হার টা --"

কথা থামিয়ে ডাক্তার কাকু বললেন "ফোন টা অফিসে যে আছে দাও। "

"ডক্টর ব্যনার্জী কথা বললেন " বলে রূপা ফোন টা ঐ মহিলাকে দিল।"

ফোনে কী কথা হল কে জানে। ঐ মহিলা কাচুমাচু হয়ে বলল "আপনি ডাক্তার বাবুর যে আত্মীয়া বলবেন তো! ঠিক আছে অ্যাডভান্স দরকার হবে না।আর ডাক্তার বাবু বললেন আপনার রোগী তিন তোলার ছ নম্বর আইসিইউ ওয়ার্ডের সতের নম্বর বেডে আছেন।" একটি কার্ড দিয়ে বলল"এখন ভিজিটিং আওয়ার নয, তবু আজ অ্যাডমিশন করলেন ,কার্ড দেখালে গেট ম্যান ছেড়ে দেবে। "

রূপা হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়েই উঠে ,গেট ম্যানের ছাড় পেয়ে তিন তোলায় ছ নম্বর ওয়ার্ডের গিয়ে দেখে আর এক প্রহরী। অইসিইউ ঢোকার আগে নার্সিংহোম হোমে নিজস্ব কিছু নিময় ড্রেস কোড আছে বলল ,চপ্পল খুলে হাত পায়ে পলিথিন মত কভার আর গায়ে মাথা ঐ রকম কিছু পরতে হল।

ভিতরে ঢুকে দেখল থমথমে এক নির্জন পরিবেশ ।এ সি রুম অনেক রোগী । তখন প্রায় সাতটা ,মশারীর মধ্যে অন্য রোগীরা ঘুমাচ্ছে !না অসুস্থ অচেতন! তার দেখার আগ্রহ নেই ।সতের নম্বরে দেখল সুবীরের নাকে তখন অক্সিজেন, হাতে সেলাইন। দুজন নার্স ও একজন কম বয়সের ডাক্তার সুবীরে পরিচর্ষা করছিল, বেশ চিন্তিত উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। এক নার্স তাকে দেখে বলল" প্লিজ এখন বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন , দরকার হলে ডেকে নেবো। "

বিষন্ন মুখে রূপা নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে সোজা অফিস রুমে গেল।এখন আবার দুজন এক পুরুষ কর্মী নতুন এসেছে।মহিলাটিকে হতাশ হয়ে বলল"ওরা ঘরে থাকতে দিল না।"

এসব বিষয়ে রূপার কোনরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।

মেয়েটি কড়া ভাবে বলল "এখানে চুপ করে বসুন। আপনার পেসেন্টের অবস্থা ভালো নয়। ডক্টর ব্যনার্জী সাহেব আসছেন, এখন উনাকে আবার ফোন করতে যাবেন না!"

রূপা এক অজানা শঙ্কায় নীরব ,মুখচোখ কেমন তার উদভ্রান্ত দিশেহারা। একটি গাড়ী এসে দাঁড়াল ,দেখল ডক্টর ব্যনার্জী গাড়ি থেকে নেমেই গট গট করে লিফটে উপরে উঠে গেলেন। উদ্বিগ্ন আর উৎকন্ঠায় রূপা যেন চুপচাপ বসতে পারছে না ।ঘন ঘন পায়চারি করছে।প্রায় চল্লিশ মিনিট পর ডাক্তার কাকু লিফট থেকে বের হতে দেখে রূপা সেদিকে দৌড়ে গেল । তাকে এমন উদ্বিগ্ন বেপরোয়া দেখে ডাক্তার কাকু বললেন"এত দৌড় ঝাঁপ করো না। টেনশনে তুমি না আবার অসুস্থ হয়ে যাও।"

রূপা ভীষণ উদ্বিগ্ন"কেমন আছে ও!"

গম্ভীর হয়ে ডাক্তার বলল "এখন অনেকটা স্টেবল মনে হল। তুমি আজ স্কুল যেও না,ঘরে থাকো।এখানে থাকার দরকার নেই। আমায় নিয়মিত সময়ে সময়ে এরা তো খবর দেবে।আমি সঙ্গে সঙ্গেই তোমাকে ফোনে জানিয়ে দেবো। এসো আমার গাড়িতে ,তোমার ঘরে পৌছে দি।"

রূপা ব্যাকুল হয়ে বলে" কাকু ও বাঁচবে তো!"

ডাক্তার কাকু কিছুক্ষণ চুপ থাকেন।পরে বললেন "এত টেনশন নিও না,আমি আমার টিম তো তোমার সঙ্গেই আছি। আপ্রাণ চেষ্টা করছি। "

গাড়ি থেকে রূপা যখন তেতুলতলা ভাড়া বাড়ীর কাছে নামল করুন ভাবে জানতে চাইল" কাকু ঠিক টা বলুন না !আমি আর পারছি না প্লিজ" বলে কেঁদে ফেলল।

ডাক্তার কাকু বেশ টেনশনে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। সব কথা বলা যায়না ।শুধু বললেন আরও একটু সময় অপেক্ষা করতেই হবে। আরে বাবা আমরা তো ঈশ্বর নয়। একটু ধৈর্য ধরো !"

 ঠিকের কাজের মেয়েটি গেট খোলা না পেয়ে নিশ্চয়ই ফিরে গেছে। মেন গেটে চাবি খুলে রূপা ঘরে ঢোকে। ভিতরের সব খোলাই ছিল। সোফায় হেলান দিয়ে রূপা বসল সারা শরীর মন এতটাই ক্লান্ত, আর রান্না করতে ইচ্ছাই নেই। ক্ষিদেও নেই। ঘরে একটা কটু গন্ধ ! বাথরুম থেকেই আসছে ।মনে পরে গেল ভোড়ে সুবীর বেসিনে বমি করেছিল।

মুখে নাকে গামছা বেঁধে ফিনাইলের বোতল হাতে বাথরুমে ঢুকে বেসিনের জলে ট্যাপটা চালিয়ে বমির নোংরা ধুতে যায় ।কিন্ত একি বমির সাথে রক্তও! কিন্ত কেন! চিন্তা আরও বাড়ে। চোখ জলে ভরে যাচ্ছে ।

ভাবতে লাগল হতভাগা কত সুন্দর যে দেখতে ছিল!সৎ শিক্ষিত নরম স্বভাব ভদ্র বিনয়ী। যদি এমন গুন রূপের মেয়ে হত ! পুরুষশাষিত সমাজে ওর কি কোন সমস্যা হত! আর আজ ও যেন আস্তাকুড়ে এঁটোপাতা,অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য আর উদাসীনতা পেলো।ও ঠিক মরেই যাবে! ওর ভাগ্যে সুখ নেই।এক অজানা আশঙ্কায় রূপা ভারাক্রান্ত দুখী মনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কতক্ষণ কাঁদছিল কে জানে!

বেলা প্রায় এগারোটা ছুই ছুই,হঠাৎই ডাক্তার কাকুর ফোন। ভয়ে বুকটা কেমন ধরাস ধরাস করছে। উদ্বিগ্ন স্বরে বলে "কাকু বলুন। "।

ডাক্তার কাকু বললেন" ভালো খবর, ও এখন পজিটিভ রেসফন্স্ করছে।যাক আর ভেন্টিলেশনে দিতে হয়নি। তোমার ভাগ্য ভাল।"

রূপা আনন্দে চোখে জল বলে" থ্যাঙ্কু কাকু আর ভয় নেই তো! "

ডাক্তার কাকু বললেন "বিপদ আপাতত মুক্ত, যা পরিস্থিতি ছিল তোমায় বলি নি, না হলে দেখলে তো!আমার জুনিয়র রবি ভালো ছেলে, ভালো চিকিৎসা করে, আমাকে ডাকে! ও ঠিক চিকিৎসাই করছিল। কিন্ত ভরসা পাচ্ছিল না ।

একটু থেমে আবার ডাক্তার কাকু বললেন "তুমি যে আমাকে সকালেই ফোনটা করেছিলে, দারুণ কাজ করেছ । আর একটু দেরী হলে বিপদ হত।ঠিক আছে বিকালের পর দেখা করবে। আমার জরুরী ফোন আসছে", ফোন কেটে দিলেন ।

রূপা দেখল এক মিস কল!স্কুলের হেড স্যার করেছেন। ঘুরিয়ে করল ,হেড স্যার বললেন "ট্রেন লেট না মিস করেছ! পরের ট্রেনে আসছো?"

রূপা বলে"স্যার আমার হঠাৎই না শরীর ভীষণ খারাপ, সকাল থেকেই বেশ কবার বমি পায়খানা করে দারুণ অসুস্থবোধ করছি। "

হেড স্যার বললেন "ডাক্তার দেখিয়েছ!"

রূপা বলে "হ্যা স্যার ওষুধ দিয়েছেন খাচ্ছি কালও যেতে পারব না মনে হয়।"

হেড স্যার বললেন "ঠিক আছে আগে সুস্থ হও,আমি ম্যানেজ করে নেবো।তবে আজ আসবে নাএকটু আগে বললে তোমার ফাস্ট ক্লাসটা অফ যেতো না। "

রূপা বলল"সরি স্যার ভীষণ সরি।"

  হেড স্যার "ও'কে রেষ্ট নাও। " ফোন কেটে দিলেন।মিথ্যা বলা ছাড়া উপায় নেই, এই বাস্তবটা রূপা জানে,  না হলে হাজার প্রশ্ন বিতর্ক! রূপা এই বয়সে সমাজ সংসার বেশ ভালো বুঝে নিয়েছে।

বিকাল চারটে গার্জেনদের ভিজিট আওয়ারে রূপা খুব তাড়াতাড়ি নার্সিংহোম সুবীর দেখতে গেল।আজ তার কিছুই ভালো লাগছিল না।এক প্যাকেট ম্যাগী আর একটা ডিম সিদ্ধ খেয়েই দিন কাটাল। 

উদ্বিগ্ন আর অধৈর্য রূপা সুবীর কে একবার দেখার জন্য অধীর ছিল।সুবীরের বেডের সামনে অপলকে রূপা অনেকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে বিষন্ন মুখে।অচেতন সুবীর নাকে অক্সিজেন, হাতে সেলাইন, আবার ব্লাড ও চলছে। আলো আধাঁর এক শান্ত শীতল নিঝুম পরিবেশ।

একজন এসে বলল " ম্যাডাম এবার বের হতে হবে।" রূপা বেরিয়ে ডাক্তার কাকুকে ফোন করে । কাকু ফোনে বললেন "অপেক্ষা করো, তোমায় ঠিক সময় ডেকে নেবো ।"

ডাক্তার কাকুর ফোন এল প্রায় সাড়ে সাতটা। তীর্থের কাকের মত কতক্ষণ যে সে বসে! একতলায় একটি কক্ষে দরজার উপর নাম লেখা"ডক্টর এ ব্যনার্জী" "তার পর পাক্কা দুই লাইন তার অর্জিত ডিগ্রি ,স্বদেশ বিদেশের ,এত সব তার জানার আগ্রহ নেই ।কাকু বড় ডাক্তার, এক নামে জেলার মানুষ চেনে।

রূপা ভিতরে ঢুকল।

কাকু বললেন "অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করছ! "

 "ঠিক আছে কাকু " পরক্ষণে উদ্বিগ্ন অধৈর্য রূপা প্রশ্ন করে,"কাকু এত বাড়াবাড়ি ওর হঠাৎই কী করে হল! কাল অনেকটাই তো স্বাভাবিক ছিল না! "

"তুমি ওর রিপোর্ট দেখেছ!"

"না আমার নেওয়াই হয়নি যা ঝড় গেল। "

"তোমার বাড়িতে অ্যাম্বুল্যান্স পাঠাতে বলেই ,ওর মেডিক্যাল রিপোর্ট চাইলাম, ওরা হোয়াটস্ অ্যাপস্ করে আমাকে তখনই পাঠাল। ওর অ্যানিমিক ভাব তোমায় কালই বলেছিলাম, ডাক্তারী ভাষা বললে বুঝবে না।বাংলায় সরলীকরণ করলে বলতে হয়,ওর রিপোর্ট বলছে, টাইফায়েড,নিমোনিয়া সঙ্গে রক্তস্বল্পতা আর ব্লাডের আর বি সি, যা ওর বয়সে থাকার কথা, বিপজ্জনক ভাবে কম ।আবার সঙ্গে ডিহাইড্রেশন ,ফুড পয়জেন, জ্বর এত কিছুসব একসাথে। আর তার সাথে ও শারীরিকভাবেও ভীষণ দুর্বল । ইমিউনিটি পাওয়ার তলানীতে।এই জটিল পরিস্থিতিতে একমাত্র ওর হার্ট বেশ মজবুত তাই রক্ষা। আমিও ঠিক ভরসা পাচ্ছিলাম না তোমায় কী বলব! "

উদ্বিগ্ন রূপা বলল "এখন কেমন দেখলেন কাকু?" 

"খুব দ্রুত ইমপ্রুভ করছে।এতটা আমিও আশা করি নি।"

আবেগে আপ্লুত হয়ে রূপা বলে" আপনার ঋণ জীবনে ভুলব না কাকু। "

ডাক্তার কাকু শুধু একটু হাসলেন পরে বললেন "কালের দিনটা আইসিইউতেই মনে হচ্ছে রাখতে হবে। পরশু নরম্যাল বেডে দেবো। "

"কাকু কেবিনে দেবেন, যা খরচ লাগে আমি করব। "

কাকু মুচকে হেসে বললেন "সেটাই দেবো। ইচ্ছা করলে তুমিও রাতে থাকতে পারো!" আবার খুব হাসতে লাগলেন। "

বিব্রত রূপা ঠিক বুঝল না। রূপা বোকার মত তাকায়। কাকু রসিকতা করে বললেন "এ তোমার কেমন দাদা!মনে হচ্ছে কেমন যেন খুব কাছের মানুষ !আমরা তো একটু সাইকোলজি বুঝি! কী ঠিক তো!"

ডাক্তার কাকু একটু ভারাক্রান্ত রূপার চাপমুক্ত করতে চাইছিলেন।

রূপা লজ্জায় মুখ নামিয়ে হাসে।" আপনি পিতৃতুল্য মিথ্যা বলব না ! আপনি ঠিক। "

কাকু রসিকতা করে রূপাকে আবার একটু টেনশন মুক্ত করতে বলে "তা মা তোমার কী এ সব কান্ড কীর্তি বাড়ীর অমতে না গোপনে!"

রূপা আর লজ্জা পায় না হেসে বলে "কাকু আপনাকে সবকথা খুলে বলব ,নাটককে হার মানাবে। আপনার বাড়ি গিয়ে গল্প শোনাব। "

দুদিন পর সুবীরকে কেবিনে আইসিইউ থেকে সিপ্ট করে। সেখানে যখন ইচ্ছা, যতক্ষণ ইচ্ছা থাকার বাধা নেই, বিকালে রূপা এসে দেখে সুবীর আপন মনে কমলা লেবু খসা ছাড়িয়ে খাচ্ছে। রূপাকে দেখে হেসে বলে " বসো।"

"এখন শরীর কেমন আছে!"

" বেশ ভাল।"

আয়া মেয়েটি কি ভেবে যেন ঘর থেকে বের হতে হতে বলল" দিদি মনি আমি একটু পরে আসব, আপনার গল্প করুন। "

আবেগ আর কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে সুবীর বলে,        " তোমার খুব কদিন কষ্ট হয়েছে, তোমার ডাক্তার কাকু আমায় সব বলেছেন।তোমার পরিশ্রম উদ্বেগ চিন্তা আর কত খরচ!আমি সেদিনই বলে ছিলাম, এই অভাগাকে জেদ করে নিয়ে যাচ্ছ খুব বিপদে পরবে। বলতে বলতে।" দুচোখ জলে ভরে যায় ।"

 চরম নিঃসঙ্গ অসহায় দরিদ্র নিরীহ সুন্দর সুবীরকে রূপা যেমন ভীষণ ভালোবাসে স্নেহও করে যেন এক মায়ের মত এ কদিনে এটা যেন তার স্বভাবে পরিনত হয়েছে।তাই শান্ত্বনা দিয়ে বলে" তুমি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নও, শরীর খুব দুর্বল, তাই ডাক্তার কাকু আরও কিছুদিন এখানে থাকতে হবে বলেছেন। আর তুমি এইভাবে কাঁদলে মনখারাপ করলে সুস্থ হতে দেরি হবে তো! "

হত দরিদ্র জীবনে অভ্যস্ত সুবীর আক্ষেপে বলে "তোমার এত খরচ হচ্ছে। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। "

আবেগঘন কন্ঠে বলে এবার রূপা বলে "খরচ হচ্ছে তো তোমার কী!"

রূপা গভীর ভাবে সুবীরকে দুবাহু আগলে জড়িয়ে আরও কাছে টেনে নেয় ,তারপর স্নেহেরস্বরে বলে, " টাকা আসবে, আবার যাবে।জীবনে অনেক আয় করব। কতদিন পর তোমাকে খুঁজে পেলাম,আবার তোমাকে হারাতে বসেছিলাম!" রূপার যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, দুচোখ জলে ভরে ওঠে।

সুবীর বিব্রত বলে ,"আমি কে তোমার !এত ভাবো--" 

রূপা তার কথা থামিয়ে অশ্রু সজল আবেগঘন হয়ে বলে " তুমি কে! তুমি শুধু আমার । আর কেউ তোমাকে তাড়াতে পারবে না, লুকিয়ে রাখতে পারবে না , কাড়তে পারবে না । আমি তোমায় আগলে রাখব আজীবন। "



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance