ট্রেন যাত্রা (পর্ব - সাত)
ট্রেন যাত্রা (পর্ব - সাত)
প্রতীম হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে ওই বাড়িটির সামনে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আগের দিন জ্ঞান হারিয়ে গেলেও আজ তেমন কিছু হলোনা।প্রতীম আমার হাত ধরে টান দিয়ে বললো "দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? এখন তোর বাড়ি যাব না। চাবিটা আনা হয়নি।"
তারপর বাড়িটা পেরিয়ে নিয়ে গেল একটা বাগানে। আমি উনার সাথে সাথে সম্মোহিতের মতো চলতে শুরু করলাম।
তারপর বাগান পেরিয়ে একটা মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো " কি রে চিনতে পারলি মান্তু?এখানে আমি এলেই লুকোচুরি খেলতাম। অবশ্য সাথে দাদাও থাকতো। "
আমি এবারে কিছু বুঝতে পারছি না। সব কি সত্যি, কিন্তু কি করে হয়। কারণ মালাটা আমার নয়। কিন্তু কেন বারবার মনে হচ্ছে এই আকাশ বাতাস মাটি সব আমার। আমার পথ চেয়ে এতো কাল বসে রয়েছে। আমি ধীর পায়ে মন্দিরের সামনে এগিয়ে গেলাম। মন্দিরের দরজাতে হাত দিতেই ক্যাচ ক্যাচ শব্দে দরজা খুলে গেল। ভেতরে কিছু ফুল দেখে হল সবে পুজো সম্পন্ন করে গিয়েছে। আমি দেওয়ালে হাত দিয়ে স্পর্শ করে মন্দিরের ভেতর ঘুরতে লাগলাম। প্রতিটি স্পর্শতে আমার মনে হল আগেও আমি মন্দিরটাকে এমন করেই স্পর্শ করেছি। আর আমার হঠাৎ মনে হলো ঘর ভর্তি মানুষ, সবাই বসে রয়েছে হাত জোর করে। সম্পূর্ণ মন্দির খানি ফুল দিয়ে সাজানো আর সাথে সুন্দর আল্পনা ছোঁয়ায় সৌন্দর্য্যতা অন্য মাত্রা পেয়েছে। ধুপের মিষ্টি গন্ধখানি মোহিত করে রেখেছে মন্দির প্রাঙ্গণ। আমি এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম সেই দিকে। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুজো করা দেখছিলাম। সামনে একটা ছোট কালি মূর্তি। পুজোয় ব্যস্ত পুরোহিত আর সাথে স্থানীয় মেয়ে পুরুষরা বসে। এরই মধ্যে আধিক্য বেশী মহিলার, ছোট বাচ্চা রয়েছে কিছু। আমি মন দিয়ে পুজো দেখতে লাগলাম, বেশ লাগছিলো দেখতে। তারপর একজন মহিলা আমার দিকে পেছন ফিরে তাকাতেই আমি চিনতে পারলাম। সেই মহিলা যে আমাকে বারবার ওর পেছনে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি কেমন মুচকি হাসতে শুরু করলেন।মনে হলো আমাকে দেখে তিনি ব্যঙ্গ করছে।আমাকে যেন বোবায় পেল। আমি কথা বলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেললাম। একটা স্পর্শ পেয়ে পাশে প্রতীমকে দেখে হাত তুলে দেখালাম ওকে ওই ভদ্রমহিলাটিকে। তখনও হেসে চলেছেন ভদ্রমহিলাটি।তারপর একটা ঝাঁকুনি অনুভব করতেই দেখি প্রতীম আমাকে জিজ্ঞেস করছে " বল কি হয়েছে তোর? কি রে এমন করছিস কেন?"
আমি আবার আঙ্গুল তুলে উনাকে দেখাতে গেলাম ভদ্রমহিলাটিকে, কেউ নেই সেখানে। শুধু সেটা নয়, সেখানে নেই কোনো আল্পনা আর ফুলের সাজ। সম্পূর্ণ মন্দিরে আমি আর প্রতীম, একটা লোকেরও দেখা নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় কালি মূর্তিটিও নেই সেখানে।
আমায় যেন বোবায় পেল, আমি কথা বলার ক্ষমতা যেন আমার নেই।আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে চললেন তিনি।
মন্দিরের প্রাঙ্গণ ছেড়ে এগিয়ে হঠাৎ পেছনে তাকাতেই দেখি ওই মুখ। মন্দিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আর হাত নারিয়ে কি যেন বলছে। কিন্তু কি বুঝতে পারলাম না। তবে আর নিতে পারলাম না এমন অপ্রাকৃতিক অবস্থাটি। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম।
তারপর আমার যখন জ্ঞান ফিরলো দেখি উৎকন্ঠিত মুখে তাকিয়ে প্রতীমবাবু। আরও কিছু লোক জড়ো হয়ে গিয়েছে, আমার মুখের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। " কি ঠিক আছিস তো মান্তু?"
হঠাৎ আমার কি হলো জানিনা প্রায় চিৎকার করে "আমি মৃণাল শুধু মৃণাল.." বলে ছুটতে শুরু করলাম। ছুটতে ছুটতে কোথায় এসে পৌঁছালাম আমি জানিনা, তবে একটা বটবৃক্ষর তলায় বসে সামনে রাখা পাথরে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করলাম। কি হচ্ছে আমার সাথে, কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার মাথায় একটা স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখি একজন বৃদ্ধা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছি দেখে তিনি আমাকে বললেন " কি হয়েছে এমন করে কাঁদছো কেন দিদিভাই?"
আমার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠেছিল, তাই আমি উত্তর দিতে পারলাম না, শুধু চেয়ে রইলাম।
তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন " পৃথিবীতে অনেক কিছুকেই রহস্যময় আর অবিশ্বাস্য মনে হবে, যদি না তুমি ঘটনাগুলোর কারণ বোঝার চেষ্টা না করো। এই পৃথিবীতে যা ঘটে সেসবের প্রতিটি ঘটনার কার্য কারণ থাকে। এমনি এমনি কিছুই ঘটে না। যখন তোমার সব কিছুকে অবোধ্য মনে হবে চোখ বন্ধ করে নিজের সাথে একাকি সময় কাটাবে, দেখবে সব কিছুর উত্তর পেয়ে যাবে তুমি দিদিভাই।"
তারপর হেসে বললেন "কি এই বুড়ির কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা তাই তো, আচ্ছা তবে আমার কথাটা পরীক্ষা করেই দেখো।" বলে আমার চোখের উপর হাত দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে দিলেন।
আমি যেন নিজের অতীত জীবনে এক ধাপ একধাপ করে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। ছোট্টবেলা যা আমার পরিচিত। মৃণালের জীবন, মিনুর জীবন। দাদা, ভাই,ঠাকমা,দাদু আর আমার মায়ের আঁচল তলের সুখী জীবন। হঠাৎ একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো মা তাকে বকছেন কোমর থেকে কবজটি খুলে রাখার জন্য। বলে দিলেন এটাকে কখনো কাছ ছাড়া না করতে।
হঠাৎ একটা ডাকে বর্তমান জগতে ফিরে এলাম আমি।
" আপনি এখানে আমরা কোথায় না কোথায় খুঁজে বেড়াচ্ছি, বাবা তো চিন্তায় পাগল।"
আমি উনার দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালাম। সত্যি বলতে কিছুক্ষণ সময়ের জন্য আমি কোথায় সেটা মনে করা তো দূর, সামনে থাকা কাউকেই চিনতে পারিনি। তারপর হঠাৎ কি মনে হতে পাশের পাথরের দিকে তাকালাম, না সেই স্থান ফাঁকা। কেউ নেই সেখানে।
" কি এমন করে ওদিকে কি দেখছেন, চলুন মিস মৃণাল। "
আমি তবুও বসে রইলাম। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওই হোটেলের একজনকে সাথে এনেছিলেন প্রতীমবাবু। আমি হাত ধরে তিনি উনার সাথে নিয়ে যেতে শুরু করলেন আর আমি কেমন একটা সম্মোহিতের মতো চলতে শুরু করলাম। অবশ্য তখন আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। প্রতীম আমাকে কথাটা বলেছিলেন।
হোটেলে এসেই দেখি প্রত্যয়বাবু দাঁড়িয়ে রয়েছেন, "কি রে কোথায় গিয়েছিলে মা, আমরা তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।"
প্রতীম কিছু বলতে যেতেই তিনি উনাকে হাত ধরে থামিয়ে আমাকে যে ভদ্রমহিলা সাথে করে এনেছেন, উনাকে বললেন আমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিতে। আমি ঘরে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। এখন প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে শুরু করেছে। আমার ক্লান্ত লাগছিলো তাই গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ আমাকে কে যেন বললো "কি দিদিভাই উত্তর পেলে?"
আমার ঘুম ভেঙে গেল, আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসে চারিদিক চেয়ে দেখি কেউ নেই।
তারপর কোমরে হাত পড়াতে সেই কবজটার কথা মনে পড়তেই সেটাকে খোলার চেষ্টা করতে লাগলাম। না খোলাতে সামনের টেবিল থেকে ফল কাটা ছুরিটা এনে কেটে ফেললাম। আমার মন বলছে এটাতেই আমার উত্তর লুকিয়ে আছে। আমি আমার কবজটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। সাধারণ কবজের থেকে তবে আকারে বড়।তাই ছোটবেলায় পড়তে চাইতাম না। আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। রাগের চোটে ছুড়ে ফেলে দিলাম কবজ খানা। কবজটি সামনের টেবিলের উপরে পাথরে লেগে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। আমি মুখ ফিরিয়ে নিতেও একটা জিনিসে চোখ আঁটকে গেল। কাছে গিয়ে দেখি একটা মালার সাথে ছোট্ট লকেট,ঠিক আমি যেটা খুঁজে পেয়েছি, যা বর্তমানে আমার গলায় রয়েছে। আমার মালাটা পেয়ে সব উত্তর মিলে যেতে লাগলো। আমি তার মানে প্রত্যয়বাবু ঠাকুরদার বন্ধুর ছেলের নাতনী। যারা দুই বন্ধু মিলিতভাবে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তারমানে প্রত্যয়বাবু যা যা বলেছিলেন সবটা সত্যি।
আমি মালাটা হাতে নিয়ে ছুটে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। পথের মাঝে প্রতীমকে দেখে হিতাহিত ভুলে জড়িয়ে ধরলাম। সে প্রথমে ভ্যাবাচেকা খেলেও, আমার এমন ব্যবহার দেখে অবাক হলেন বেশি।
" প্রতীম সব উত্তর মিলে গিয়েছে, সব সব..." বলে উনাকে ছেড়ে আমি আনন্দে ঘুরতে শুরু করলাম। সামনে সিঁড়ি ছিল, সেদিকে আমি লক্ষ্য না করাতে পড়ে যাচ্ছিলাম। প্রতীম তাড়াতাড়ি করে আমার হাত ধরে আমাকে বাঁচালেন।
" কি হচ্ছে? এখুনি তো একটা কান্ড ঘটতে যাচ্ছিল।"
আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে বললাম "স্যার কই স্যারের ঘরে চলুন।"
বলে উনার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললাম।
চলবে..
