Rocky Kazi

Horror Romance Crime thriller classics others

4.8  

Rocky Kazi

Horror Romance Crime thriller classics others

টাইম ক্রাইম

টাইম ক্রাইম

48 mins
804


     রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে, তবুও চন্দ্র মামা হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। ফিকে জ্যোৎস্নায় প্রকৃতির শোভা যেন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বদ্ধ ঘরে দুই প্রেমিক প্রেমিকা কাঁচের এপার থেকে সেই রূপময় দৃশ্য উপভোগ করছে। সময় রাত দুটো, ঘুম নেই কারো চোখে। চোখে শুধু প্রেমেরই ছোঁয়া। সুচিস্মিতা আমার কাঁধে মাথা রেখে শান্তিতে সমুদ্রে ভেসে চলেছে। শুধু আমি আর তুমি এই বিশাল সমুদ্রের মাঝে, ভেসে চলেছি নৌকায়, অজানা এক দ্বীপের সন্ধানে। এই একদিন হল দুজনে এক গন্ডগ্রামে। প্রথম দিন যা বৃষ্টি তাতে এই প্রকৃতির মায়াময় রূপ দর্শন করার সুযোগ হয়নি। যাহ্, কারেন্ট চলে গেল। এইতো মোমবাতি তো এখানে, দেশলাইটা কোথায় গেল। রঘু তো সকালেই দিয়ে গিয়েছিল কোথায় আবার রাখলাম। ডয়ারে? নাকি তাক টাই? নাকি আবার ঝুড়ি টাই? কোথায়? কোথায়? হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, ওই তাক টাই রেখেছিলাম। এইতো (খস-খস-খস-খস) জ্বলনারে (ফর-ফর-ফর) (ঠক-ঠক-ঠক) কে আবার দরজা ঠক-ঠক করছে? অতীন্দ্র? হতে পারে।

     একি, ভেতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া নেই কেন? না ভূলে গিয়েছিলাম? হবে হয়তো। যদি সারারাত খোলা থাকতো তাহলেই তো মাথায় হাত। যদি চুরি টুরি হয়ে যেত, না না ধনসম্পদ কী আর আছে। হ্যাঁ এমন একটা জিনিস আছে যা ধন-সম্পদ এর চেয়েও মূল্যবান। সেটা গেলে তো যেতাম আরকি। 

(অ্যুঁ অ্যুঁ)

(অ্যুঁ অ্যুঁ অ্যুঁ)

একি দরজা খুলছে না কেন? তাইতো।

(অ্যুঁ অ্যুঁ অ্যুঁ)


     সত্যিই তো খুলছে না। ভূতুড়ে ব্যাপার নয় তো। না কী যে বলি আমি নিজেই বুঝিনা। ভূত আবার কী? ভূত বলে কিছুই নেই, বেকার ভয় পাচ্ছি। কিন্তু এটাও তো ভাববার বিষয় খুলছে না কেন? হতে পারে যদি কেউ বাইরে থেকে লক করে থাকে। কিন্তু কেই বা লক করবে, তাহলে? হ্যাঁ এটা হতে পারে যে দরজা আটকে গেছে। বহুকালের পুরনো দরজা, জং টং লেগে হয়তো দরজার ভবলীলা সাঙ্গ। কিন্তু আমারও তো ভবলীলা সাঙ্গ হতে চলেছে, দরজা না খুললে বাইরে বেরবো কিভাবে, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা না ছাড়া উপায় নেই। বাথরুমে তো যাওয়াই যাবেনা, তাহলে কী করি? শেষে অসভ্যের মতন, ভাবতেই ভয় করছে। তাহলে অতীন্দ্রকে কি ফোন করে ডাকবো? ফোন করলেও তো ফোনের আওয়াজ শুনতে পাবে না, যা গভীর ঘুম; কানের পাশে বিস্ফোরণ হলেও ঘুমভাঙা সন্দেহ। কী করি? কী করি? হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। আলমারির পাশে একটা গেট দেখেছিলাম মনে হচ্ছে। হ্যাঁ পুরানো গেট, কিন্তু ছিটকিনিটা একেবারে নতুন চকচক করছে, হয়তো সদ্য পাল্টানো হয়েছে। গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ, যদি বাইরে থেকেও বন্ধ থাকে। তবুও দেখি গেটটা খুলে যদি বাইরে বেরোনোর কোন উপায় হয়, চেষ্টা করতে কি আছে।


(ঘট চু অ্যুঁ অ্যুঁ) (ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও) (হুস হুস)


     এই দরজাটা অনেকদিন কেউ খোলেনি। দরজাটা কী জন্য বানানো হয়েছিল, কে জানে। তা যাই হোক না কেন আমার যে এটি কাজে লাগলো এটাই বড় কথা। ঘুটঘুটে অন্ধকার যাই ফোনটা নিয়ে আসি। না ফোনটা তো এই কিছুক্ষণ আগে চার্জ দিলাম। খুব একটা চার্জ হয়নি। আরে নিম্নচাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফোনটাও সুইচ অফ অবস্থায় চার্জে লাগানো আছে। সেটার এখন পাওয়ার অন করে ফ্লাশলাইট জ্বালানো পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবোনা। এই ঘরে একটা টর্চ লাইট দেখেছিলাম মনে হচ্ছে, ঐতো ওখানে আছে ওটাই নিয়েই যাই (ঘট)। আহ্! বাঁচা গেল। 


     বৃষ্টিটা একেবারে থেমেই গেছে, চাঁদের আলোও জোরালো হয়েছে। হ্যাঁ কারেন্ট চলে এসেছে, বারান্দার লাইটটা জ্বলছে। (ঘেউ ঘেউ ঘেউ) যাই একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি। একটু বোরিং বোরিং লাগছে, কিরকম যেন একটা বদ্ধ পরিবেশের আছি। ছাদে গেলে আশা করি একটু আরাম পাবো।

     হাতে টর্চের আলো নিয়ে আমি ছাদের দিকে এগোতে থাকলাম। সিড়ি বেয়ে উঠতে থাকলাম। বাহ্! কী ঠান্ডা বাতাস, আহ্! মন যেন জুড়িয়ে যায়। এতক্ষণে যেন একটু স্বস্তি পেলাম। লাইটটা বন্ধ করে দিলাম। জ্যোৎস্নার জোরালো আলোয় ছাদের সব প্রান্তই প্রায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টিও থেমেছে। ছাদের সমতল পৃষ্ঠের ওপর কোথাও কোথাও ঠান্ডা জলের অল্প ছোঁয়া পায়ে লেগে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ছাদে রুপো ছড়িয়ে দিয়েছে। যাই ছাদের ওই দিকটা একটু যাই। ওটা কী? অ্যাঁ, হঠাৎ এক দৃশ্য দেখে আমার বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল, এক অজানা আতঙ্কে। গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। কে যেন সাদা কাপড় পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাঁ, সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে, সাদা কাপড় পড়ে, স্থির ভাবে।

     মন কে আর বলতে হলো না, হঠাৎ করে এরকম কিছু অস্বাভাবিক দেখলে তাদেরই কথা আগে মনে হয়। ভয়ে আমার হৃদস্পন্দন যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে গেল। সবাই তাহলে ঠিকই বলতো বাস্তবে এদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। কী করি? কী করি? ভূত! বাবারে বলেও চিৎকার করতে পারছি না। মুখ দিয়ে টু শব্দটুকুও করতে পারছি না, যেন আমি বোবা হয়ে গেছি। পাও যেন স্থির, সেখান থেকে সরছেনা। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি কতক্ষণ কে জানে। অমনি হঠাৎ সাদা কাপড় পরা মানুষটার মাথাটা যেন একটু নড়ে উঠলো। হ্যাঁ নড়ে উঠলো। আমার ভয় যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল। এবার কম্পন শুরু হল সারা শরীরে। কিন্তু স্থান পরিবর্তন? না, স্থান পরিবর্তন হলো না। সস্থানে অস্থির মনে ভয়ে আতঙ্কিত হতে থাকলাম। আমি কোথায়? কোনখানে?  ভুলে যাচ্ছি ধীরে ধীরে সব স্মৃতি, হ্যাঁ আমি ভূত দেখছি, চোখের সামনে ওটা ভূত, সাদা কাপড় পড়ে ভূত। গলার মধ্যে যেন একটা চাপ অনুভব করছি, নিশ্বাস প্রশ্বাস ধীরে ধীরে কমে আসছে, কানও তালা হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে কেউ যেন গলা চেপে ধরেছে, আমার গলা টিপছে, (অ্যা অ্যা অ্যাউল অ্যা।

     তারপরেই হঠাৎ একটা ঝোড়ো বাতাস দিল। আহ্! বাঁচা গেল। এই বাতাসটার জন্যই আমি পুরো ব্যাপারটা বুঝে গেলাম। বাতাসটা না থাকলে যে কী হত, হয়তো হার্টফেল করেই পেতাম অক্কা। আপনারা হয়তো ভাবছেন কী ব্যাপার? কী বুঝলাম? আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে কী, যা দেখে আমি এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিলাম সেটা কোন সাদা কাপড় পড়া ভূত নয়। আসলে সেটা একটা কলাগাছ, যা সাদা কাপড় জড়ানো। হয়েছিল কী, ঝোড়ো বাতাসের বেগে জড়ানো সাদা কাপড়টা কলা গাছ থেকে সরে গিয়েছিল। কলাগাছ, হয়তো কোন পুজোর কলাগাছ। কোন সদগতি না করে ছাদেই ফেলে রেখেছে নতুবা ছাদেই ফেলে রেখে সদগতি করেছে।

     গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ। আমি যে কাজ করি তাতে ভয় ডর যেন হাড় ছাড়া লেগ পিসের মতন। কিন্তু আমি যে এভাবে ভয় পেলাম, আপনারা হয়তো আমাকে ভীতু বলে অভিহিত করবেন, তাই না? কী আর করা যায়। মানবচক্ষুর সামনে হঠাৎ করে কোন অবাঞ্চিত ঘটনা ঘটে গেলে সেই সময় অবাক আর ভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকেনা বললেই চলে। এমনিতেই ভয় টয় পেতাম না, যা সব অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটছে তাই ভয় টা একটু বেশিই পেয়ে গেলাম। এখন আমার খুব ভালো লাগছে যে ভূত-টুত বলে কিছু হয় না, সব গাঁজাখুরি গল্প।


     আমি নীচে নেমে এলাম। কী ব্যাপার ঘরের লাইটটা বন্ধ কেন? কোন আলোয় জ্বলছে না। কারেন্ট তো অনেকক্ষণ চলে এসেছে। আমি তো বন্ধ করিনি, তাইতো। না এই মুহূর্তে কারেন্টটা চলে গেল? কিন্তু সুইচটা তো বন্ধ। সুইচটা টিপে আলো জ্বালালাম (খট)। তাহলে কেউ কী ঘরে এসেছিলো? অমনি সেই সময় কাচের জানলা দিয়ে আমার দৃষ্টি বাইরের ল্যাম্পপোস্টের দিকে পড়ল, আর কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার হৃদস্পন্দন যেন আবারও স্থির হয়ে গেল। একটা অজানা আতঙ্ক আমায় পেয়ে বসলো। আমি কী করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। কী করবো? কী করবো? দেখি আমার কোর্টটা ওখানে আছে তো? না... নেই। কোর্ট নেই ওখানে। হ্যাঁ, সত্যিই আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। আমার সন্দেহ ঠিকই, সত্যিই চোর এসেছিল। যে আমার ডোরাকাটা নীল বর্ণের কোর্টটা নিয়ে বেমালুম চম্পট দিয়েছে। আমার কত স্বাদের কোর্ট ছিল। কী করতে যে দরজাটা খোলা রেখে ছিলাম। নিজের এই কৃতকর্মের জন্য নিজের প্রতি বিশাল রাগ ধরছে। হঠাৎ একটা কথা ভেবে উঠতেই আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল। হ্যাঁ লোকটার হাতে, কী যেন একটা ঝুলছিল? স্যুটকে... তারপর আমার মনের বাক যেন স্থির হয়ে গেল, হৃদস্পন্দনও যেন থেমে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। হ্যাঁ হ্যাঁ স্যুটকেস। কোর্টটার থেকে স্যুটকেসটা আগে। দেখি দেখি আলমারিতে। অ্যাঁ... আলমারিটা খোলা, আর স্যুটকেসটা ভ্যানিস। অমনি আমার মুখ থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। আবারও নিজের অজান্তেই জানলার দিকে চোখ চলে গেল। আর আমি আবারও চমকে উঠলাম। দেখি কয়েকজন লোক যেন হন্তদন্ত হয়ে সেই দিকেই দৌড়ালো, হাতে কী যেন নিয়ে। তারপর আবারও চমকে উঠলাম। শুধু চমকের ওপর চমক। দেখি বন্ধু অতীন্দ্র তাদের পিছনে। তাহলে কি অতীন্দ্রের কোনো বিপদ হয়েছে? ওই লোকগুলোই বা কে? চোর কি তাদেরও কিছু চুরি করে পালাচ্ছে? না তারা চোরের সঙ্গিনী? অতীন্দ্র মনে হয় তাদেরকেই তাড়া করছে। কিন্তু অতীন্দ্রতো ঘুমকাতুরে লোক, সে তো বলে যে সে রাতে কখনো উঠে না। হয়তো আজ উঠে গিয়েছিলো বাথরুমে। টার্গেট খোলা, আর সেই ফাঁকেই ঘরে চোর ঢুকে চুরি করে ফুড়ুৎ। কিন্তু কিছু হলে আমি তো বুঝতে পারতাম। কোন পায়ের আওয়াজতো পেতাম, কেননা আমি তো ঘুমোইনি। পাশাপাশি ঘর সে আমাকেও জানাতে পারতো। মনে হচ্ছে আমি যেই সময় ছাদে ছিলাম, সেই সময়ই এত কাণ্ড ঘটে গেছে। হয়তো সে আমাকে ডেকেছিলো। কিন্তু কোন ফিডব্যাক না পেয়ে চোরের পিছনে একাই বেরিয়ে গেছে। আর ওই ঠক ঠক আওয়াজটা। মনে হচ্ছে চোর কিছু একটা দিয়ে আমার দরজার লক খোলার চেষ্টা করছিল, তখনই ওই ঠক ঠক আওয়াজটা হচ্ছিল। আর হয়তো সেই কারণেই দরজাটা আটকে গিয়েছিল খুলছিল না। আর আমি দরজার কাছে আসতেই বোধ হয় সে আমার আওয়াজ শুনে কেটে পড়েছে। হয়তো এটাও হতে পারে যে, আমার আওয়াজ শুনে সে নিজেকে লুকাবার জন্য এই উল্টো দিকটাই গা আড়াল করতে এসেছিল। আর এই দিক থেকেই আমায় বেরোতে দেখে তার কাজটা আরও সহজ হয়ে গেল। তারপর আমার ঘর থেকে চুরি করে যখন বেরহচ্ছিল তখন হয়তো অতীন্দ্র বাইরে বেরিয়ে ছিল। আর চোরের কাছ থেকে সেগুলি উদ্ধার করতে, চোরের পিছনে এখন দৌড়াচ্ছে।

     কী করতে যে ছাদে উঠলাম। তা এখনও আমি এ ঘরে কী করছি, বন্ধু অতীন্দ্র একাই লড়তে বেরিয়ে গেছে। সত্যিই ওই লোক গুলো যদি চোরের সঙ্গিনী হয়, তাহলে ভাবতেই ভয় করছে। অতীন্দ্র একা, সেকি পারবে? তার সাহায্য দরকার। তাছাড়া আমারও তো ওই স্যুটকেসটা উদ্ধার করা দরকার, অনেক মূল্যবান জিনিস রয়েছে। অসংখ্য মানুষের ভবিষ্যৎ রয়েছে, আমাকে যে করেই হোক স্যুটকেসটা উদ্ধার করতে হবেই। তাড়াতাড়ি, সঙ্গে ফোনটা নিয়ে নিই। আরে, ফোনটা কোথায়? এখানে তো চার্জে দেওয়া ছিল। চার্জারের পিনতো একাকী ঝুলছে। চোরটা তাহলে ফোনটা নিয়েও পালিয়েছে। কী যে করি? লাইট, আমি লাইট নিলাম কিন্তু লাইট আর জ্বলছে না। তো কি আর করা যায়, বিনা আলোয় আমি বেরিয়ে পড়লাম উদ্ধারকার্যে।

     বহুকষ্টে অন্ধকারে হাতরে হাতরে সিড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম। একবার তো পড়েই যাচ্ছিলাম, রেলিংটা না ধরলে এতক্ষণে হয়তো হাত-পা ভেঙেই বসে থাকতাম। একি বাড়ি মালিকের দরজাটাও খোলা যে?  ঘরের সাদা আলো দরজার বাইরে অল্প বেরিয়ে এসেছে। কই ভেতরে তো কেউ নেই। সদর দরজাটাও খোলা আমি সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম, কী ওটা? কে যেন ওখানে পড়ে আছে মনে হচ্ছে। খুব চেনা চেনা লাগছে, আজকেই দেখা কোন ব্যক্তি হবে। কিন্তু কে? আমি এগিয়ে গেলাম, একি, আমি অবাক হয়ে গেলাম। বাইরের ল্যাম্পের হালকা হলুদাভ আলোয় একটা মুখ ফুটে উঠল। হ্যাঁ, চেনা মুখ। আজকেই দেখা, এক ভদ্রলোক। বাড়ি মালিক, সুদর্ষণ ভট্টাচার্য। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। এই হাল ওনার কী করে হলো? কেন? গায়ের যতগুলি লোম ছিল যেন সবগুলোই খাড়া হয়ে উঠল।


     হ্যাঁ উনি এখনো বেঁচে আছেন। পেটের বাঁ দিক থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। গো গো আওয়াজ হচ্ছে।


     "এমন কাজ কে করল?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।


     উনি বহুকষ্টে বললেন "আমায় ক্ষমা করে দাও, আমি বড় পাপ কাজ করে ফেলেছি।"


     কিছু বুঝতে পারছিনা উনি কী বলছেন? ক্ষমা কী ক্ষমা? কেনই বা ক্ষমা? 


     কয়েকটা কুকুর এসে সামনে জটলা করে ডাকতে থাকল।


     এখনই ওনাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। ওনার শুশ্রূষা প্রয়োজন। এখনও প্রাণ আছে, ওনাকে বাঁচানো প্রয়োজন।

     আর কুকুর যা ডাকছে, কান মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। কখন না আবার এসে কামড়ে দেয়। হয়তো তারা আমাকেই তার খুনি ভাবছে। এখনই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

     আমি তাকে চাগিয়ে খুব সাবধানে তার রক্তাক্ত ক্ষতস্থানটিতে আমার রুমালটি দিয়ে চেপে তার ঘরে নিয়ে আসলাম। বিছানায় শোওয়ালাম না, বেকার বিছানাটা রক্ত মাখা হবে। তাই ঘরের মেঝেতে শুইয়ে দিলাম। বাড়ি মালিক গো গো করতে করতে বললেন, "আমায় ক্ষমা করে দাও। আমায় মরতে দাও। আমি বড় পাপ কাজ করে ফেলেছি। এটাই তার ফল, পাপের ফল। আমায় মরতে দাও।"


     আমি : "না না আপনার কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো। ফোন ফোন ফোন, ফোনটা কোথায় গেল? হ্যাঁ ফোনটা তো চুরি গেছে। (চিস) এবার কী করি?"


     বাড়ি মালিক আর নেই, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। তার নাড়ি দেখে বুঝলাম কোন স্পন্দন নেই। আমার চোখের সামনে একটা নিরীহ মানুষকে মরতে দেখে নিজেকে বড় পাপী মনে হচ্ছে। বাঁচাতে পারলাম না(চিস), উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে যে করেই হোক তার খুনিকে খুঁজে বার করতেই হবে। স্যুটকেসটার কথা মনে পড়তেই গা টা একটু শিঁউরে উঠলো। টেবিলে রাখা টর্চ লাইটটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

     সদর দরজার বাইরে বেরিয়ে এলাম। সামনে আলো ফেলতেই দেখি, এক জায়গায় রক্ত একটু বেশিই পড়ে আছে। যেখানে উনি এতক্ষণ পড়েছিলেন। বাট সেখানেই শেষ নয়। ঘটনাস্থল থেকে রক্তের ফোটা যেন সামনের দিকে আরো এগিয়ে গেছে। পায়ের দাগ? না পা এর দাগ কিছুই বোঝা যায়নি। সামনে-পিছনে ইটের উপর সবকিছুই অস্পষ্ট, শুধু রক্তের বিন্দুগুলি স্পষ্ট হয়ে নতুন কিছুর ইঙ্গিত করছে। ফোঁটাগুলির পারস্পরিক দূরত্ব যেন খুবই বেশি মনে হচ্ছে। এটা কী চোরের কৃতকর্ম? না ডাকাতের? ওই লোকগুলো ডাকাত নয়তো? হয়তো এনার কাছ থেকে টাকা চেয়েছিল। দেয়নি বলে হত্যা করেছে। কিন্তু বাড়ির বাইরে কেন খুন করবে? টাকা কী বাইরে চেয়েছিল? না অন্যকিছু? ডাকাতেরা জানি জেনে শুনে তাদের অভিযান চালায়। হয়তো তারা কোন ভাবে খবর পেয়েছে যে এর কাছে অনেক টাকা আছে। আবার এর নিজের বলতে কেউ নেই অর্থাৎ একে উপরে পাঠানো খুব সহজ হবে। বাড়ি মালিককে তারা বাইরে কোন ছ্যূত ধরে ডেকে এনে বসিয়ে দেয় পেটে ধারালো অস্ত্র।

     সেই সময়ই হত্যার আর্তনাদ শুনে অতীন্দ্রের ঘুম ভেঙে যায়। অতীন্দ্র চোরকে তাড়া করতে করতে ওখানে পৌঁছায়। চোর তীর বেগে দৌড় দেয়। তারই সাথে অতীন্দ্রের হাতে বন্দুক দেখে ডাকাতগুলোও পালাতে শুরু করে। আর তাদের হাতে থাকা রক্তমাখা ছুরিটা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে, যা ফোঁটা ফোঁটা হয়ে রাস্তায় যেন তাদেরকে খুঁজে পাওয়ার নিশান তৈরি করে। আনুমানিক ধারণা করলে এইরকমই দাঁড়ায়। রক্তের দাগ অনুসরণ করতে করতে বাড়ির পিছনেই ওই ল্যাম্পপোস্টের নীচেই চলে এলাম। হ্যাঁ, এখানেই আমি দেখেছিলাম অতীন্দ্রকে। চোরকে, আর ওই লোকগুলোকে, যারা ছুটন্ত অবস্থায় ছিল। আর রক্তের দাগ কোথায়? চারিদিকে আলো মেরে দেখলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। মনেহয় ছুরিতে লেগে থাকা রক্তের পরিমাণ এতটাই কম ছিল যে এখানেই তার শেষ নিশান রেখে হারিয়ে গেছে অতল গভীরে।

     চারিদিকে ছোট ছোট গলি পথ কোথায় কোনদিকে গেছে অনুমান করাটা খুব কঠিন। না, সামনের দিকে যাব, ভাগ্যের উপর ভরসা করে। যদি রাস্তাটা ভুল হয়। হঠাৎ এ কথা ভাবতে ভাবতে আমার টর্চের আলো বহুদূরে কিসের ওপর পড়ে যেন আলোটা প্রতিফলিত হয়ে আমারই দিকে ফিরে এল অর্থাৎ কিছু একটা চকচক করে উঠলো। আমার হাতে থাকা টর্চের আলো একটা গলির রাস্তার বহুদূরে গিয়ে পড়েছিল একটা দেওয়ালের ওপর। ওটা কী?  আমি এগিয়ে গেলাম সেইদিক অনুসরণ করে। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে যে আমার টর্চ লাইটের আলো একটা জানলায় পড়েছিল। এই জানালাটা ছিল লোহার বেড়া লাগানো জানালা। প্রত্যেকটি লোহার বেড় আড়াআড়ি ভাবে পরপর সজ্জিত আছে। আর ওই জানালার দুটি বেড়ের মাঝেই আটকে ছিল সেই রক্তমাখা ছুরি, যাকে আমি অনুমান করেছিলাম মাত্র। এই ছুরিতেই টর্চের আলো পড়ে প্রতিফলিত হয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছিল। মনে হয় খুনির অজান্তেই ছুরিটা কোনভাবে ছিটকে এসে এখানে নিজের আশ্রয় করে নিয়েছে। অজান্তে বললাম এই কারণে, যে বেশিরভাগ খুনিরাই তার খুনের ক্লু কি রেখে যাবে সজ্ঞানে? উত্তেজনাই আর ভয়ে ত্রুটি হয়ে যায়। তো পথ পরিষ্কার। একটাই রাস্তা। আর কোনো সন্দেহ নেই যে খুনি এইদিকেই গেছে। আমিও হন্তদন্ত হয়ে দৌড় দিলাম।


     গলির রাস্তা পেরিয়ে একটা ছোট রাস্তায় পড়লাম। এই রাস্তার কথাটাই তো বাড়ি মালিক সুদর্শন ভট্টাচার্যের মুখে শুনেছিলাম, এবড়ো খেবড়ো অসমতল রাস্তা। যা নাকি নদীর দিকে চলে গেছে। হতে পারে, সেই রাস্তা। তিনি আমাদের নিয়ে আগামীকাল এইদিকে, নদীর দিকে ঘুরে যাবেন বলেছিলেন। হায়রে! কপাল, তিনি অকালে চলে গেলেন। কিন্তু আমাকে যে করেই হোক তার খুনিকে খুঁজে বার করতেই হবে।


     আমি ছুটতে থাকলাম। এই ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ঘামে ভিজে যাচ্ছে সারা দেহ। কেউ কোত্থাও নেই। কেউ কোথাও থাকবেইবা কেন? কটা বাজে? এতো আর শহর নয় যে রাত্তিরেও মানুষ জেগে থাকে। তাছাড়া এমন বৃষ্টি বাদলা তার ওপর শীত। এমন সময় শহরেও কারোও পাত্তা পাওয়া বিরল। সবাই গুটিসুটি মেরে ঘুম দিচ্ছে, আর গ্রাম তো দূরের কথা।

     চারিদিক নিস্তব্ধ বলা যাবেনা। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজের সাথে ব্যাঙের কলরব মিশে যেন একটা সঙ্গীত তৈরি হয়েছে। যেন সেই সংগীত তাহার মোহমায়ায় মনকে আচ্ছন্ন করতে চাইছে। গায়ে শুধু একটা ফুলহাতা শার্ট; তবুও যেন ঠাণ্ডা কে উপেক্ষা করে আমি এগিয়ে যাচ্ছি নিঃশব্দে।

     কিছুক্ষণ পর কানে ভেসে এল নদীর কুলুকুলু ধ্বনি। সামনেই নদী। জ্যোৎস্নার আলো নদীর উপর যেন রুপোলী চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। কেউ কোত্থাও নেই। শুধু ভেসে আসা কুলুকুলু ধ্বনি ও তারই সাথে মিশ্রিত থাকা ঝিঁঝির আওয়াজ যেন তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করতে চাইছে। আর প্রকৃতির এই রুপোলী মায়াময় রূপ সত্যিই এর তুলনা নেই। যেন কোনো চিত্রকরের চিত্র থেকে বেরিয়ে এসেছে এই দৃশ্য। মনে হয় রূপকথার কোন দেশে আমি চলে এসেছি। অসাধারণ, অতুলনীয় যাই বলি না কেন এইরূপ কে বর্ণনা করার মতন কোন শব্দ যেন আজও অনাবিষ্কৃত। মনে হয় আমি স্বপ্ন দেখছি? না সত্যি? বিচার করার মতন কোনো শক্তিই যেন আমার কাছে নেই। শরীরের কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন আমার নিয়ন্ত্রনে নেই। তারা যেন গভীর ভাবে উপভোগ করতে চাই প্রকৃতির এই মায়াময় রূপ। এই তৃপ্ত অনুভূতি।


     হঠাৎ একটা চিৎকার আমার কানে ভেসে এল। তার সাথে অনেকগুলো চিৎকার। সমস্ত ঘোর কেটে গেল। আমি দৌড় দিলাম, সেই আওয়াজের উৎসের দিকে। আমি ছুটতে থাকলাম। লাইটের আলোও ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছে। আর একটু থেকে যা, আর একটু। যাহ্! চার্জটা একেবারে শেষ হয়ে গেল, না লাইটারই কোন ব্যারাম আছে? আলো নিভে গেল। এবার কী করি? কী আর করবো।

     জ্যোৎস্নার আলোয় চারিদিক ভালোই দেখা যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলোয় সহায়। তবুও গাছ-গাছালির নীচের অন্ধকার তো দূর হয়নি। যদি সাপ বেরিয়ে ছোবল মারে, বলা যায় না।

      আমি এগোতে থাকলাম মৃত্যু ভয় কে উপেক্ষা করে। আবারও চিৎকার শোনা গেল। কে যেন বলল, "চোপ শালা, ইয়ার্কি পেয়েছ। খুবতো কসরত করিয়েছ চাঁদু। এবার ভালোই ভালোই স্যুটকেসটা দিয়ে দাও।" তারই সাথে কতকগুলো লোকের হাসির আওয়াজ কানে ভেসে এলো। মনে হয় সেই চোরটার কাছ থেকে প্রতিবেশীরা আমার স্যুটকেশটা উদ্ধার করছে। হয়তো তারা চোরটাকে পাকড়াও করে ফেলেছে। তাহলে তারা প্রতিবেশীই হবে, আর আমি কি না কিই ভাবছিলাম। তাহলে খুন? হ্যাঁ ব্যাপারটা তাহলে এরকম দাঁড়াতে পারে। উপরে এসে সে আমার জিনিসপত্রগুলো চুরি করে পালানোর সময় অতীন্দ্র তাকে তাড়া করে। নীচে নামবার সময় বাড়ি মালিকের কাছে ধরা পড়ে যেতেই সে আত্মরক্ষার জন্য বাড়ি মালিক কে খুন করে। আর রক্ত বিন্দু গুলি তার খুন করা ছুরিটা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া প্রতিবেশীদেরও কিছু হয়তো সে চুরি করেছে, নতুবা তাদেরও কাউকে হত্যা করেছে অথবা বাড়ি মালিকের হত্যার কথা জেনে তারাও দলে দলে যোগ দিয়েছে অতিন্দ্রের সাথে।

     ওই তো অতীন্দ্রও ওদের সাথে আছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ঠিক। কিনা কিই ভেবেছিলাম। ওই চোর ব্যাটাই খুনটা করেছে। ব্যাটার উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত মনটা শান্তি পাচ্ছে না। এইতো চোরটাকে পাকড়াও করেছে, যাই ছুটি।

     ছুটতে থাকলাম, হালকা অস্পষ্ট কথা শোনা যাচ্ছে, একসময় আর ছুটতেও পারছি না। তলপেটের বাঁ দিকটাই লাগছে। আজ যেন একটু তাড়াতাড়িই হাপিয়ে গেলাম। আমরা যে কাজ করি একথা শুনলে যে কেউ হাসবে। কী জানি, হয়তো এই সব অদ্ভুতুড়ে ঘটনাগুলির জন্যই আজ এরকম মনে হচ্ছে। তা এখন ছুটে আর কী হবে? সবাই তো ধরেই ফেলেছে। ছোটা আর কি হাঁটতেও পারছিনা। আমি মাটির উপরে হাঁটু গেড়ে বসে গেলাম। যা ছুটেছি একটু বিশ্রাম না ছাড়া কোন উপায় নেই। অতীন্দ্র তো আছে সব ব্যাপারটা দেখে নেবে।


     ঘটনাস্থল থেকে আমি বহু দূরে বসে আছি। বহু দূর থেকেই ঘটতে থাকা ঘটনার অনুমান করছি মাত্র।


     একি তাইতো, অতীন্দ্র ওটা কী বার করছে? তার পকেট থেকে ছুরি।(হ্যুঁ হ্যুঁ হ্যুঁ)ছুরি নিয়ে করবেটা কী? হত্যা। ঠিক তখনই এই কথাগুলো আমার কানে ভেসে এলো। অতীন্দ্রের গলায়, "আহারে! কত করে বলা হলো নেওয়া দেওয়া কর, (চিস) মানলি না। যেন মানুষকে বাঁচাবার হুচুক উঠে গেছে। একটুর জন্য আগে বেঁচে গেলি। আগেই খেল খতম হয়ে যেত। সব প্ল্যান রেডি ছিল। বাট পাখি কিভাবে ফুরুৎ। বোকা ছেলে, স্যুটকেসটা তো আমি পেয়ে যাব, বাট তোকে না মারলে আমার মরন নিশ্চিত। এবার তেরা ক্যা হোগা কালিয়া (হি হা হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ)।"


     সত্যিই অতীন্দ্রের কথার কোন মাথামুণ্ডু বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ তখনই আরেকটা আওয়াজ আমার কানে ভেসে এলো।

     "না আমায় মেরো না। তুমি এত নীচে নামতে পারলে অতীন্দ্র। সেই সব গরীব মানুষদের কথা, তাদের সাথে ঘটা সব মর্মান্তিক দৃশ্য, মনে পড়ে। না অর্থের লোভে এ সব তোমার কাছে তুচ্ছ, অর্থহীন। ভাবতে অবাক লাগছে। তুমি পারলে এসব।" আওয়াজটা আমার খুব চেনা চেনা লাগছে। খুবই চেনা। অনেকবার শুনেছি,কিন্তু মনে করতে পারছিনা। কার আওয়াজ? কার কার ? হ্যাঁ এতো আমারি মতন আওয়াজ। তাইতো, আমারই মতন। যায় ব্যাপারটা কী আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখি।  সামনে গাছ, এখান থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব প্রায় হাত দশেক। অতীন্দ্রের গলায় "এই বিশ্বজগতে টাকায় সব। টাকার জন্য সবকিছু করতে রাজি আছি। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও (হি হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ)। বিদায় বন্ধু।"


     চাঁদের আলো অতটা ম্লান বলা চলে না, একটু জোরালো। এই জোরালো আলোয় এক দৃশ্য দেখে আমি সত্যিই অবাক। দেখি আমার সেই ডোরাকাটা নীল কোর্ট পড়ে মাটিতে বসানো, হাত পা চেপে ধরে রাখা অবস্থায় থাকা মানুষটি আর কেউ নয়। স্বয়ং আমি। আমারই মতন একই মুখশ্রী, একই কণ্ঠস্বর। হঠাৎই না— না— না— অ্যাঁ— অ্যা— আ...

( হি হা হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ)




     পাখিদের কলরবে ঘুমটা গেল ভেঙে। সারা দেহ একটু ব্যথা ব্যথা করছে; মাথাটাও ঘুরছে। অ্যাঁ এ আমি কোথায়? চারিদিক গাছগাছালিতে ভর্তি, পায়ের উপরে একটা জোঁক বসে আনন্দ করে রক্ত খাচ্ছে কতক্ষণ ধরে কে জানে। ফুলে একেবারে ঢোল হয়ে গেছে। এ্যে এ্যে, ডান হাত দিয়ে অতি সন্তর্পনে তার চোষক টিকে পায়ের চামড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করলাম ও দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। অমনি হঠাৎই গতরাত্রির সব কথা মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ তাহলে কী এটা সত্যি? না স্বপ্ন? স্বপ্ন যদি হয় তাহলে আমি এখানে এলাম কীভাবে? কিছুই ভেবে উঠতে পারছিনা। বন থেকে বেরোলাম।


     ক্লান্তি ও মাথা ঘোরার দরূন একটু হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। দূরে কিছু লোকের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। হ্যাঁ, লোকজনকেও দেখা যাচ্ছে। আগুন জ্বলছে, শ্মশানে মরা পোড়ানো হচ্ছে। আমি ঐদিকে উদ্দেশ্য করে পা চালালাম। ঠান্ডায় শরীরও কম কাঁপছিল না। গায়ে আগের দিনের সেই হাতাওয়ালা শার্টটা ব্যতীত আর কিছুই নেই। শ্মশানের কাছে গেলে হয়তো একটু আরাম পাবো। গা টা একটু গরম হবে।


     কিছু লোকজন এই দিকেই তাকিয়ে ছিল– আমার দিকে। বন থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আমায় টলমল ভাবে আসতে দেখে, আমাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা সবাই তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। শুধু শুনতে পেলাম ক্ষিন আওয়াজ "ভূত"। তবে কি ওরা আমায় ভূত ভেবেছে? না ওরাই কালকের সেই সব হত্যাকারী যারা অতীন্দ্রর সহযোগিতা করেছে। হয়তো আজ কালকের সেই হত্যা করা দেহটিকে এখন পড়াচ্ছে। ঐতো মরাটা এখনও পুড়ছে। আমায় দেখে তারা ভূতই ভেবেছে। আমি তো ওই মৃত দেহটার মতন একই রকম দেখতে; তাইতো এটাতো ভাববার বিষয়। কালকে ওটা কে ছিল যে আমার মতন পুরো নিখুঁত নকল?

     এক স্থানে মদ ও মদ খাওয়ার সরঞ্জাম রাখা ছিল। হ্যাঁ দাদা আছে, সাথে গামলা ভর্তি কানমোলা আর লেস ভাজা। আপনার হয়তো ভাবছেন কানমোলা আবার কী? আর লেস ভাজা? লেস শুনেছি, লেস ভাজাটা আবার কিরে বাবা। আসলে এগুলো সবই চিপসের নাম, কানমোলাটা কানকে মুললে যেমন দেখতে হয় ঠিক সেই রকমই, যা অল্প দুমড়ানো মুচড়ানো বাটির মতো। আবার কানে খোলও আছে, মানে লাল হলুদ রঙের মশলা লাগানো, হ্যুঁ, তো কী আর বলবো কানমোলা যদি বলা যেতে পারে, কানের খোল কেন বলা যাবেনা, হ্যুঁ, কী সব চিপসরে বাবা, আর কত কী দেখবো। লেসভাজা, লেসভাজাটি হচ্ছে আলুর চিপস, লেস নামক বাজারে যে সব প্যাকেট বন্দি চিপস পাওয়া যায় সেই চিপসেরই ভেঙে যাওয়া প্যাকেট বন্দি না হওয়া তুলনামূলক ছোট চিপস গুলি লেসভাজা নামে পরিচিত। আর এক লিটার বিসলারি বোতল। ওয়াহ্! আর কী চাই।

      একটা প্লাস্টিকের গ্লাসে একটু দাদা ঢেলে একটু বিসলারি মেশালাম, প্যাক রেডি। বাট যেইনা মুখে দিতে যাব কয়েকজন লোক ফিরে এলো, কয়েক জনের মুখে শোনা গেল, "নারে এত ভূত নয় রে, ভূত আবার মদ খায় নাকি? এ মানুষ।"

     তবুও অনেকে কাছে আসতে ভয় পেল। আমারও যে ভয় করেনে তা নয়। আমি পাচ্ছিলাম অন্য ভয়, যদি আমাকে তারা আবার হত্যা করতে আসে।

     একজন হনুমান চল্লিশা পড়তে পড়তে ভয়ে ভয়ে এল, বললো, "তুমি মানুষ না ভূত?" হায় ভগবান কিনা কিই ভেবেছিলাম।

     এরা নিশ্চয়ই সেই সব দুষ্ট লোকেরা হবে না (হ্যুঁ হ্যুঁ)। আমি বললাম, "না আমি জ্যান্ত মানুষ, না হয় ছুঁয়ে দেখো।"

    একজন ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলো ও দূর থেকে হাত বাড়িয়ে আমায় স্পর্শ করল আর বললো, "হ্যাঁ হ্যাঁ মানুষ।" সবার ভয় কেটে গেল।

     আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, "এটা কার মরা পোড়ানো হচ্ছে?" তারা বলল, "এটা খগেন খুড়োর মরা পোড়ানো হচ্ছে।" স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ফেললাম। এক প্যাক পেটে পড়লো, সাথে কয়েকটা কানমোলাও খেলাম, হ্যাঁ মানতে হবে টেস্টি আছে। একটু শরীরটা চাঙ্গা হল বই কি। কিছু লোককে জিজ্ঞাসা করলাম কালকের সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এরা হয়তো জেনে থাকবে কেননা এরা খুব সকালে শব দাহ করতে এসেছে। কিন্তু না কেউ কিছুই বলতে পারল না।

     কোন রক্তের দাগ হত্যার ক্লু কিছুই সেই স্থানে পাওয়া যায়নি। হঠাৎই একটা কথা মনে পড়তেই গাটা শিঁউরে উঠলো সেই স্যুটকেস; যার জন্য এত লড়াই, এই হত্যা।

     আমি উঠে দাঁড়ালাম,ও হন্তদন্ত হয়ে দৌড় দিলাম। লোকগুলো হয়তো এবারে পাগল ভেবেছে– হঠাৎ করে উঠে দৌড়। কিন্তু ওরা কি বুঝবে আমার এই পরিস্থিতির কথা, হ্যুঁ— হালকা হাসি।


     বাড়িতে পৌঁছে তো আমি একেবারেই অবাক। কোথাও কোন মৃত্যুর ছাপ নেই; কাল যেই স্থানে আমি রক্ত পড়ে থাকতে দেখেছিলাম এখন সেখানে রক্ত যেন কোথাও উধাও হয়ে গেছে। লাল বর্ণের কোনো চিহ্নমাত্র নেই। আর দিব্যি নাক ডাকিয়ে বাড়ি মালিক শান্তির ঘুম দিচ্ছে। তাহলে কি সত্যিই আমি কোনো স্বপ্ন দেখলাম? কিন্তু ওখানে পৌছালাম বা কী করে? নাকি স্বপ্নের মধ্যে চলন জাতীয় কোন রোগের কারনে স্বপ্ন ঘোরে আমি ওই স্থানে পৌঁছে যাই। হতেও পারে, না অন্য কোন কারণে।


     অতি সন্তর্পনে উপরে উঠে এলাম, জানিনা কোথায় কী বিপদ অপেক্ষা করছে। তাই একটু সাবধানে থাকতে হবে। আরে গেট খুলছে না কেন? আমিও বলিহারি জংটঙে কালকেও তো খোলেনি। যাই আরেকটা গেট আছে, হ্যাঁ ওই টা দিয়েই যাই। কী ব্যাপার গেটটা বন্ধ কেন? কাল তো গেট খোলাই রেখেছিলাম। না স্বপ্নে, তাহলে কী করি এতো ভারি মুশকিলে পড়া গেল। সব কিছু যেন অদ্ভুত লাগছে। কোন গেটই খুলছে না। মারি, জোরে ধাক্কা মারি, ইয়া (দরজা জোরে ধাক্কা মারার আওয়াজ)। শেষমেশ হার মানতেই হলো; পুরনো দরজার ছিটকিনি অনায়াসে খুলে গেল। আওয়াজটা অতটা বেশি হয়নি, যাতে অন্য কারোর ঘুম ভেঙে যায়। 

     তাড়াতাড়ি ঢুকে এলাম দেখি লাইট জ্বলছে ফোনেও চার্জ হচ্ছে, কাগজটা একাকী পড়ে রয়েছে পেনটা হয়তো নীচে পড়ে গেছে। কাগজে লেখা শেষ লাইনটা মনে করিয়ে দিচ্ছে, গত রাত্তির জেগে ওঠা প্রেম কাহিনীর সেই দৃশ্য। হ্যাঁ আমি রোম্যান্টিক গল্প লিখছিলাম— সাথে ছিল মুভির কিছু রেম্যান্টিক অভিজ্ঞতা। কারেন্টটা না চলে গেলে হয়তো আরও কিছুক্ষণ লিখতাম। মগ্ন থাকতাম প্রেমের গভীরতায়। কিন্তু না, হঠাৎ করে কারেন্ট টা চলে গিয়ে সব বিগড়ে দিলো। তারপরেই যত সব উদ্ভট ঘটনা— লেখার মুডটাই নষ্ট করে দিল।

     একপাশে আমার স্বাধের কোর্টটা ঝুলছে। আর স্যুটকেসটা? হ্যাঁ, স্যুটকেসটাও সস্তানে রয়েছে সঠিকভাবে। সবকিছুই ঠিকঠাক, যেন কোন কিছুই হয়নি। তাহলে কি কাল আমি সত্যিই স্বপ্ন দেখলাম? না ওই মুভির মতন আমিও ভবিষ্যতে পৌঁছে গিয়েছিলাম। হয়তো তাই, হয়তো ভবিষ্যত এই ঘটনার মাধ্যমে আমায় সতর্ক করতে চেয়েছে। নিজের মৃত্যু নিজেকে দেখিয়ে সাবধান করতে চেয়েছে। বন্ধুর কু চক্রান্ত  জানিয়ে দিতে চেয়েছে, আগেভাগে। এটা কি সম্ভব? না অসম্ভব বলে কিছুই হয়না। আর বিলম্ব না করে, কাউকে না জানিয়ে, ভ্যানিশ সে এলাকা থেকে।


     এজেন্সিতে জমা দিয়ে দিলাম সুটকেশটা। কিছু বড় মাপের ঘুঘুও ধরা পরল, জেলও হল। প্রতিবাদের আগুন যেন আরেকটু জোরালো হল। অনেক প্রতারিত মানুষরা একটু আশার আলো পেল।


     আসলে আমি খুফিয়া এজেন্সিতে কর্মরত এক ব্যক্তি। না না, নামটা বলা যাবেনা, সবই গোপনীয়। আপনি আমাকে মনে মনে যে কোন নাম দিতে পারেন।


     মিশন চিটফান্ড— এই মিশনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল চিটফান্ডের সঙ্গে জড়িত ঘুঘু গুলোকে খুজে বার করা ও জনগনকে ন্যায় দেওয়া। ঘুঘু বলতে সেই সব ব্যক্তিরা যারা এই কান্ড ঘটাতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছে। অতীন্দ্র? অতীন্দ্রোরতো শাস্তি পাওয়ার কথা, সেওতো বেইমানি করেছে। নিজের বন্ধুর সঙ্গে, আমাদের এজেন্সির সঙ্গে, এই দিশেহারা মানুষজন দের সাথে। অর্থের লালসাই সে নিভিয়ে দিতে চেয়েছে এই প্রতিবাদের আগুনকে। কিন্তু না, প্রমান কোথায়? আমার এ স্বপ্ন দিয়ে আমি কি তা প্রমান করতে পারি? স্বপ্ন ছাড়া এই ঘটনাকে কিবা বলতে পারি। কাউকেই বলিনি এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে তারকাটা ছাড়া কিছুই ভাববেনা তারা। অতিন্দ্র আমায় কী ভাবলো কে জানে। আমার এ ব্যবহারে নিজের প্রতি নিজের অনেক রাগ ধরছে। কিন্তু কিবা করতে পারি তাই বলে সকলের আশার আলোকে তো নিভতে দিতে পারিনা।

     অতীন্দ্রকে না জানিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে এসেছি, স্যুটকেসটা ওকে না বলে একাই জমা দিয়েছি এজেন্সিতে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে এই অপারেশনে আমিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছি। তাই জমাটা আমিই না হয় দিলাম আর কি। কিন্তু তবুও কিরকম যেন একটা স্বার্থপর স্বার্থপর লাগছে। ওকে না জানিয়ে দিয়ে দিলাম, ও কী ভাবল।


      কয়েক দিন কেটে যায়, এই কদিন মিডিয়ায় তোলপাড়, জনবিক্ষোভ, প্রতিবাদ মিছিল, কত কিনা হল। ধীরে ধীরে সব ঠান্ডাও হতে শুরু করলো। কিন্তু মেন ঘুঘু মানে নাটের গুরু সে ঠিক বহাল তবিয়তে আছে। এত লোকের পয়সা খেয়ে আনন্দেই তার দিন কাটছে।





     মিশনটা এখনো সমাপ্ত হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত না সম্পূর্ণরূপে ন্যায় পাওয়া যাচ্ছে মিশন চলতেই থাকবে। নতুন কোনো ক্লু মিশনকে আরও জীবন্ত করে তোলে। তাই ক্লু ধরে ন্যায় খোঁজার তাগিদে বেরিয়ে পড়লাম নতুন অপারেশনে। এবারে অতীন্দ্র আর নেই। কেন নেই তা ঠিক বলতে পারব না। সে কি অন্য মিশনে আছে? না একাজ ছেড়ে দিয়েছে? না রাগ করে আমার সাথে কথা বলবেনা? দেখাও হয়নি যে তার সাথে কথা বলবো। আর তার ব্যাপারে কাউকেই কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারবো না। কেননা এটা রুলের ফিলাপ, আর জিজ্ঞাসা করলেও কেউ সে বিষয়ে জানেনা অথবা জানলেও বলবেনা। সবই নিয়মের বেড়াজালে বদ্ধ। সেই দিনই স্যার জিজ্ঞাসা করেছিলেন তার কথা, আমি জানিনা বলে দিয়েছি। বিপদের গন্ধ পেয়েছিলাম তাই বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি জমা দিয়ে দিয়েছি।



     শ্রুতি বললো, "ক্লুতো কিছু একটা আছে, নাহলে এটা মিলতো না।"


     আমি বললাম, "যদি এটাকে উপেক্ষা করি তাহলে আমাদের পুরো ফোকাসটা যাবে ওই দিকটাই, দূরত্ব এখান থেকে 7 কিমি পশ্চিম, শো লেটস্ ডু ইট।"



     বেরিয়ে পড়লাম আমি আর স্রুতি। হ্যাঁ একজন নারী। সে এই সদ্য জয়েন করেছে। পিতৃহীন মেয়ের মনে দেশ প্রেমের ছোঁয়া। তার বাবা একজন উচ্চপদস্থ আর্মি অফিসার ছিলেন। আতঙ্কবাদী দের হাতে দেশের স্বার্থে শহীদ হয়েছেন। দেশের মাটিতে আজ অন্যায়ের প্রতিবাদে সে রুখে দাঁড়িয়েছে এক নারী হয়ে। সমাজের বুকে জলন্ত প্রদীপ হয়ে দেখিয়ে দিতে চাই নারীশক্তিকে।


     কেন নারী থাকবে সমাজের সেই অন্ধকারের কোনে। তারা কি পারেনা লড়াই করতে? না তাদের লড়াই করতে দেওয়া হয় না। তারা কি চায় না অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে? কিন্তু সমাজ, সমাজ তাদের বাধা দেয় প্রতি পদক্ষেপে। তুচ্ছ মনে করে নিমজ্জিত রাখে গাঢ় অন্ধকারে।



     শ্রুতি: "কেন? এও হতে পারে যে, সে সেদিন ওখানে আসেই নি?"


     আমি : "হ্যাঁ এটাও হতে পারে, বাট সে ওখানে যদি নাইবা থাকতো তাহলে আগের মত একই কেম্পানির ওই আধখাওয়া সিগারেট ওখানে দেখা গেল যে? কিছু তো একটা লিংক আছে।"


     শ্রুতি: "হ্যাঁ, এটাও তো ভাবতে হবে।"


     প্রথম দর্শনেই মনে প্রেমের ছোঁয়া লাগে।জানিনা প্রেম কাকে বলে। আর ভালোবাসাই বা কী? তবুও প্রথম প্রেমের প্রথম ছোঁয়াটা সামলানো ভারি মুশকিল। মনরম মনে শুধু হাঁসি ফুটে ওঠে আর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে পুনরায় তাকে দেখার আশায়। তার টানাটানা চোখ, ঠোঁটের কোণে সেই হাঁসি, কথার সেই মিষ্টতা যেন ভূলিয়ে দেয় শত-সহস্র পাহাড় প্রমাণ বেদনা। হারিয়ে যাই যেন কোন রূপকথার দেশে। মনটা এতটাই আনন্দ পাই যা কথায় প্রকাশ করা কঠিন।



     প্রপোজ? প্রপোজ করবো করবো কতবার না ভেবেছিলাম। কিন্তু যখনি বলতে যাই এতটাই এক্সসাইটেড থাকি যে সম্পূর্ন বলা আর হয়ে ওঠেনা। সম্পূর্ন, এই রকম যে আই লাভ ইউ বলতে গিয়ে একবার আই লাভ চকলেট। আর একবার আই লা ক্যা হো গেয়া রে বাবা, হিন্দি বলে ফেলেছিলাম( হ্যুঁ হ্যুঁ )। তবুও উপযুক্ত পরিবেশ দেখে একদিন বলেই ফেললাম— মনের কথা। যা হবে হবে। আর চেপে রাখতে পারছিনা।



     বিকেলের অন্তগামী সূর্যের কমলাভ আলোই আকাশটা অল্প রাঙা। আকাশে উড়ে ফিরে যাচ্ছে বাসায় পাখিদের দল। গাছগাছালির ফাঁকে অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে। শ্রুতি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে এই মনোরম দৃশ্য। বাতাসের ছোঁয়ায় তার চুল গুলো দোলা খেয়ে যাচ্ছে। অন্তগামী সূর্যের কমলাভ আলোকছটা তার মুখশ্রীতে পড়ে আরও তাকে সুশ্রী লাগছে। আরও নতুন লাগছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম আর বলেই ফেললাম এতদিনের ব্যার্থ হওয়া অসম্পূর্ণ সেই কথা। তার ঠেঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল, আর মুখ দিয়ে লাভ ইউ টু। কিছুক্ষন নিরবতা এক দৃষ্টিতে এক অপরের দিকে তাকিয়ে। দৃষ্টি স্থির, এগিয়ে গেল দুই মুখ পারস্পরিক দূরত্বকে উপেক্ষা করে। ঠোঁটে-ঠোঁট মিশল আর হৃদয়ে-হৃদয়। নীরবতা ভাঙলো ফ্রাঞ্চ কিসের আওয়াজে। তারপর? তারপর আপনাদের আর বলে দিতে হবেনা। সবই বুঝতে পেরে গেছেন (হ্যুঁ)।



     শ্রুতি : "প্রথম দিনই বুঝে গিয়েছিলাম তোমার মনের কথা। আমার প্রতি তোমার প্রেম। আমারও সেদিন মনটা হাওয়ায় ডানা মেলতে শুরু করেছিল। তোমার কথা ভাবতে ভাবতে জানিনা কখন তোমায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তোমায় প্রপোজ করতে দেখে মনে কত আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু রাগ ধরে যাচ্ছিল, ভালো করে বলতেই পারছোনা। অসম্পূর্ণ কথাতেও বুঝতে পেরে যাচ্ছিলাম তোমার মনের কথা। কিন্তু কবে সম্পূর্ন ভাবে বলবে, কবে প্রপোজ করবে, কবে তোমায় একটা কিস দেব,তোমার  ঠোঁটে ঠোঁট মেশাবো, তোমায় পাবো নিজের করে। তখন অনেক অস্বস্তি হত। একসময় আর পারছিনা, শেষে দেখছি যে আমাকেই প্রপোজ করতে হবে। বাট শেষমেষ তুমি স্বার্থক হলে বংস। দাও আমায় তুমি গুরুদক্ষিনা দাও তোমার ওই হৃদয়।"


     আমি : "তোমারি জন্য হৃদয় কি, জীবন দিতে পারি। তুমিই আমার জীবন শক্তি, তুমিই আমার নাড়ি।"


      শ্রুতি : "উ মা গো ট্রু লাভ।" 


মুখে তার হালকা হাসি, কিন্তু যা দিল তোড়কে রাখদেগা (হ্যুঁ)।


     আমি : "হ্যাঁ একদম। সূর্যের উদয় ও অস্তের দিকের মতো জীবন্ত সত্য, ট্রু লাভ।"


 তারপর সে জড়িয়ে ধরলো আবারও ঠোঁটে ঠোঁট মিশেগেল। আলো নিভে গেল দূর দিগন্তে।




     সেই একই জায়গায় একই স্থানে একই ঘরে, আবারও আসতে হল, সেই স্বাধের কোর্ট ও স্বাধের সুটকেশ নিয়ে। সুটকেশটা অবশ্য সেই ঘটনার পর থেকে স্বাধের হয়েছিল। এই সুটকেশটা অনেকক্ষেত্রে সাফল্য এনে দিয়েছে, জানি এইসবের কোনো মানেই হয় না, তবুও কী জানি এটা থাকলে যেন একটু অন্যরকম লাগে। একটু শক্তিশালী ফিল হয়। আর সেই ঘটনার কথা ভাবলে আজও অবাক লাগে, যতসব উদ্ভট স্বপ্ন।

     সেদিন তাড়াহুড়োয় কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাগজ মানে ক্লু রয়ে গিয়েছিল এই বাড়িতে। তাছাড়া এমন কিছু নতুন তথ্য পেয়েছিলাম যা পুরনো কেশটার সাথে অল্প হলেও জড়িত, যা থেকে নতুন কিছু সাসপেক্টদের উদ্ভাবনা করা যেতে পারে। আর সেই সমস্ত তথ্য প্রমাণ করার জন্য— নতুন কিছু তথ্য আবিষ্কার করার জন্য একই স্থানে আরেকবার আসতে হল। হ্যাঁ কত কেশে একস্থানে কতবারই না যেতে হয় আর এখানে তো সবে দুবার। যাই হোকনা কেন মারাত্মক মারাত্মক যা ক্লু পাওয়া গেছে, তা থেকে ফাঁস হতে চলেছে এতদিনের রহস্য। চিটফান্ড রহস্য।


     বাড়ি মালিক : "বাবু এটা খেয়ে নেন। আপনার জন্য এটা নিয়ে এলাম।"


     আমি : "আরে আরে আপনি আবার কী নিয়ে এলেন।  রঘু তো  যথেষ্টই দিযে গেছে। এত কিছু ব্যাঞ্জন। আবার? এত খাবো কী করে?"  


     বাড়ি মালিক : "এই একটু আরকি খাসির মাংস বানিয়ে ছিলাম। গত বারে তো আতিথিওতা ভালোভাবে করতে পারিনি, তাড়াতাড়ি তো চলে গেলেন। সকালে উঠে দেখলাম ওদিকের দরজাটার ছিটকিনিটা ভাঙা। কিছু কি বিপদে পড়েছিলেন নাকি?"


     আমি : "(এখন কি বলি। সেই ঘটনার কথা বলবো নাকি। না থাক।  হয়তো আমায় কোন মানসিক রোগাগ্রস্থ ভাববে— উল্টো পাল্টা বকে যাচ্ছে।) না না মেন দরজাটা খুলছিলনা, খুব জোরে ইয়ে পেয়ে ছিল। আর এদিকে এই দরজাটা দেখেছিলাম, এটাও খুলছিলোনা। ছিটকিনিটা কোন কারণে আঁটকে ছিল, তাই বাধ্য হয়েই ছিটকিনিটা ভাঙতে হলো।"


     বাড়ি মালিক : "সামনের দরজাটা ছেড়ে ওই দরজাটার ছিটকিনি কেন ভাঙতে গেলেন?"


     আমি : "ও ও ওইতো, যে বললেন সামনের দরজা, সদর দরজা, তাই আর কি সামনেরটা ভাঙতে মনটা বড় আফসোস করছিল, সামনের জিনিস বেশি প্রয়োজনীয়, বেশি ব্যবহার হয়। পেছনেরটা থাকতে সামনেরটা কেন অচল করবো। তাই এই পেছনেরটা দিয়েই কাজটা সেরে নিলাম। এই আর কী। আপনি রাগ করলেন নাকি?"


     বাড়ি মালিক : "না না রাগ করার কী আছে। আরে আপনাকে খাবার সময় বেকার বকাচ্ছি, এই দেখো আমিও বলিহারি। খাবারটাও যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।" 


     আমি : "আপনি আবার দিতে এলেন কেন? রঘুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হত।'


     বাড়ি মালিক : "না মানে, নিজে বানিয়ে ছিলাম, তাই আর কি নিজেই দিতে এলাম।"


     আমি : "না না আপনার জিনিস আমি খেতে পারবো না। বয়স হয়েছে সিঁড়ি ভেঙে কষ্ট করে উঠে আসলেন। আপনাকে দিয়ে খাটিয়ে পরিশ্রম করিয়ে সেই খাদ্য আমি কিভাবে গ্রহন করতে পারি বলুন?"


     বাড়ি মালিক : "আরে এসব ভাববেন না। খেয়ে নিন, ভালেই হয়েছে। আমায় নিরাশ করবেন না।"


     আমি : "আরে আরে নিরাশ হচ্ছেন কেন? আমি একটু ঠাট্টা করছিলাম বইকি। এত কষ্ট করে আপনি আমার জন্য নিয়ে আসলেন, অমি কি না খেয়ে আপনাকে নিরাশ করতে পারি বলুন।"


     বাড়ি মালিক : "তাহলে আমি এখানে রেখে যাচ্ছি, আপনি খেয়ে নেবেন।"


     আমি : "হ্যাঁ হ্যাঁ।"


     বাড়ি মালিক : "তাহলে আমি আসি এখন। অনেক কাজ পড়ে আছে।"


     আমি : "হ্যাঁ সাবধানে নামবেন কিন্তু।"


     বাড়ি মালিক চলে গেলেন।


     আমি : "দেখি একটু চেখে দেখি, কেমন হয়েছে?"



     ব্যাস হয়ে গেল। হঠাৎ করেই কোথা থেকে কী জানি একটা উড়ন্ত আরশোলা এসে একেবারে পড়ে গেল মাংসের বাটির গরম ঝোলের নরম মাংসে। 

     মাংস খাওয়া মাটি হয়ে গেল।

     কত আশাই না করেছিলাম। অনেকদিন পর খাসি খাব ভেবেছিলাম। কিন্তু না, আর খাওয়া হলো না, সব কেচরে গেল। বাড়ি মালিক কী ভাববে কী জানি। ওনার কথা রাখতে পারলাম না (চিস)। এ শালা আরশোলা টাই যত নষ্টের গোড়া। তারো বা দোষ কী। কী আর করবে অবলা প্রাণী। সেকি জেনেশুনে একাজ করেছে নাকি, অজান্তেই ঘটে গেছে। মানুষ যদি এত ভুল করতে পারে, আর এ তো সামান্য একটা আরশোলা। যা হবার হয়ে গেছে। তাছাড়া বেচারার ওপর রাগের থেকে দয়া হচ্ছে, সে এখন আধমরা অবস্থায় পড়ে রয়েছে গরম মাংসের বাটিতে। আহারে! শুনেছি অনেক চাইনিজরা নাকি আরশোলা খাই। তাহলে গরম মাংসের সাথে আরশোলার মিক্সিং তাদের ভালোই জমবে। 


     অনেক দেরি হয়ে গেল তা এখন বেরোনো দরকার, ইনফরমার অপেক্ষা করবে, রাত্রি দুটো  বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি বেরোনো দরকার। এবার শুধু ঘুঘু ধরার পালা।


     আলমারিটা খুলে স্যুটকেসটা নিয়ে নিলাম ও নীল কোর্ট পড়ে বেরিয়ে এলাম ফোনটা চার্জ থেকে খুলে। স্যুটকেসটা নিয়ে নিলাম এই জন্যেই যে, এই সব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চোখে চোখে রাখা ভালো। কখন কী বলতে কী ভ্যানিশ হয়ে যাবে। বলা যায় না, এইসব কাজে বিশ্বাসী লোকেদেরও বিশ্বাস করতে সন্দেহ হয়। দরজায় চাবি দিয়ে দিলাম। যাহ্! আবার কারেন্টটা চলে গেল। ভাললাগে এরকম, গ্রাম্য এলাকায় একটু বেশিই কারেন্ট যায়, কী আর করা যাবে স্যুটকেস থেকে লাইটটা বার করলাম।


     লাইট জ্বালিয়ে নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকলাম। জুতোটা কিন্তু খাসা হয়েছে, চললে কোন আওয়াজই হয় না। শ্রুতির এইসব দিকে ভালোই আইডিয়া আছে মানতে হবে। খুঁজে খুঁজে ভালোই জুতোটা বার  করেছে কিন্তু।  মেয়েটা কিন্তু বড্ড ভালোবাসে, ওর জন্য মন কেমন করে। যদি ওকে আর না দেখতে পাই, যদি চিরকালের মতন হারিয়ে যাই। কিন্তু মন , না মন থেকে তাকে কোনদিন হারাতে পারবোনা। সে আমার মনে হৃদয়ে বেঁচে থাকিবে আজীবন, যুগ যুগান্তর ধরে।


     একি কিসের আর্তনাদ? কার গোঙানি? আমি হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলাম আওয়াজ এর উৎস লক্ষ্য করে।


     একি, কে ওটা? কারা ওখানে?


     আমি এগিয়ে আসতেই কে যেন একজন ছুটে পালালো। হাতে তার ছুরি— রক্ত লেগে। ধপাস করে পড়ে গেল একজন সদর দরজা থেকে একটু দূরে, চেনা চেনা লাগলো। আমি দ্রুত এগিয়ে গেলাম ঘটনাস্থলের কাছে।

     একি, এযে বাড়ি মালিক, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে মাটিতে। গরম রক্ত বেরোচ্ছ তার ক্ষতস্থান থেকে। কিন্তু সে জীবিত আছে। আমি দৌড় দিলাম খুনির দিক উদ্দেশ্য করে,সে গলির ভেতর প্রবেশ করল। কিসের যেন একটা আওয়াজ হল ঠং করে।

     আমি তার পিছু অনুসরণ করে তাকে তাড়া করলাম। হ্যাঁ সে ছুটছে, সে আমার প্রায় হাতের নাগালে, আর একটু, আর একটু, আর একটু হলেই আমি তাকে পাকড়াও করে ফেলবো নাহ্ হলোনা, আর তাকে ধরা গেলনা। কোথায় কোন শালা বাঁশের টুকরো ফেলে রেখেছিল, তাতেই পা পিছলে একেবারে আলুর দম। তারপর সে উধাও। (চিস) একটুর জন্য ফসকে গেল। আরে, এতো বড্ডো ভূল করে ফেললাম। বাড়ি মালিকের কাছে আগে যাওয়া প্রয়োজন ছিল তারা এখন চিকিৎসার প্রয়োজন, শোচনীয় অবস্থা। ধাওয়া করার থেকে তার জীবন বাঁচানোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভুল করে ফেললাম। আর ধাওয়া করেই বা কী উদ্ধার করলাম, সেইতো পালিয়ে গেল। এর চেয়ে ওনার পাশে থাকলে ভাল হত। ওনাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে কী বড়ই ভুল করলাম আমি। রাগ ধরছে নিজের প্রতি, এ আমি কেমন মানুষ রে বাবা। একজনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে চলে গেলাম।


     আমি তাড়াতাড়ি বহু কষ্টে পথ খুঁজে ফিরে এলাম। ওই তো দেখা যাচ্ছে হালকা হলুদাভ আলোয় বাড়ি মালিক কে, উনি এখনো জীবিত আছেন, ওইতো নড়ছেন, চোখের পাতাও পড়ছে। ওনাকে বাঁচাতেই হবে। কিন্তু হল আরেক দুর্ঘটনা। বাড়ি মালিকের কাছে যেইনা যাবো, দেখি কার যেন ছুটে আসছে এইদিকেই, আমার দিকে। সবই অচেনা মুখ, তা অচেনা তো হবেই। হাতে সব ধারালো অস্ত্র, ধীরে ধীরে মুখগুলো আরও স্পষ্ট হচ্ছে। একটা মুখ চেনা ঠেকলো। হ্যাঁ তাইতো, কে? কে? কে? আর ভাববার সময় নেই, এখনই পলায়ন করতে হবে। জানি বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, পালানো ছাড়া উপায় নেই। আমি ছুট দিলাম স্যুটকেস হাতে, নীল কোর্টটার জন্য ঘামটা একটু বেশিই দিচ্ছে বৈকি। কী কাজের জন্য বেরিয়েছিলাম, কী সব ঘটে গেল। তা এইলাইনে এসব নতুন কি, এ তো হামেশাই ঘটে।


     ছুটতে থাকলাম, ছুটতে থাকলাম, সামনে গলি, গলি দিয়ে ছুটতে থাকলাম। অনেক গলি, যেন ভুলভুলাইয়ার মতন। তারাও গলিতে প্রবেশ করল। কতক্ষণ যে গলির মধ্যে ঘোরাঘুরি করলাম জানিনা, এক পথে বেরিয়ে এলাম। যে মুখে ঢুকে ছিলাম, সেই মুখেই বেরিয়ে এলাম।


     এ তো বাড়ি মালিকের ঘরের সামনের সেই রাস্তা। এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। কই বাড়ি মালিকের দেহটা কই। আমায় দেখে কয়েকটা কুকুর চিৎকার করে উঠলো। আমি এগিয়ে গেলাম আবারো সেই ঘরে, সেই হত্যার ঘটনাস্থলে। না, নেই। শুধু পড়ে রয়েছে এক জায়গায় অনেকটা রক্ত। ব্যাপারটা কী হলো, উনি কোথায় গেলেন। সত্যিই তো, কী হলো? কুকুর টুকুর টেনে নিয়ে যায় নি তো? সামনের দিকে আলো ফেলতেই দেখলাম, ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ দরজার দিকে এগিয়ে গেছে। আমি এগিয়ে গেলাম দাগ অনুসরণ করে। দাগ ঘরের ভেতর ঢুকে গেছে, দাগ ধরে ধরে এসে দাড়ালাম বাড়ি মালিকের ঘরের সামনে।

     অমনি থমকে দাঁড়ালাম। দেখি পড়ে রয়েছে মেঝেই বাড়ি মালিকের নিঃসাড় দেহ। তার পেট থেকে রক্ত বেরিয়ে চলছে। মেঝেতে রক্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে। লাল মেঝেকে যেন রক্ত গ্রাস করে আরও লাল করে দিতে চাই। তার নাড়ি দেখে বুঝলাম তিনি গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়েছেন। এইতো সবেমাত্র লোকটিকে জীবন্ত দেখলাম, একটুর জন্য পরলোক গমন করলেন। যদি খুনি টার পেছনে ধাওয়া না করতাম, আর যদি এসব গুন্ডাদের হামলা না হত, তাহলে হয়তো তিনি বেঁচে যেতে পারতেন। আমার জন্যই এইসব হল। নিজেকে বড় পাপী মনে হচ্ছে। নিজেকেই খুনি মনে হচ্ছে। একি ক্ষতস্থানে রুমাল দেওয়া আছে যে। রক্তে ভেজা রুমাল লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তাহলে তিনি নিজেই একাকী উঠে এসেছেন তার এই ঘরে। তারপর ক্ষতস্থানে রুমাল দিয়েছেন। কিন্তু বেঁচে থাকার শেষ রক্ষা আর হয়নি।


     বাড়ি মালিকের ঘটনাটি কী? কে জানে? আমার ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত ? হতে পারে আমার ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাহলে আর দেরি কেন ? না না এই ঘরে আর থাকা চলবে না, যেকোনো সময় তারা এখানে আসতে পারে, আমার খোজে, কিংবা অন্য কোনো কাজে।

     তার ঘটনাটা আমার সঙ্গে সম্পর্কিত না হলেও, দুষ্কৃতীরা আমার ঠিকানা জানেনা এর গ্যারান্টি কী।


    এক্ষুনি পলায়ন করতে হবে। ফোনও করা যাচ্ছে না, যে ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে সাহায্য চাইবো, একটুও টাওয়ার নেই। টাওয়ারের কী হল কী জানি? আর কাউকে জানিয়েও আসিনি, তাড়াতাড়ি এখানে আসতে হয়েছিল। শ্রুতি কেউ ফোন করে জানাতে পারেনি। এখন কী করি?


     আমি পালিয়ে এলাম, সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। এগোতে থাকলাম, এগোতে থাকলাম। প্রান ভয়ের চেয়ে সম্মান ক্ষয়ের ভয় বেশি ভয়ানক আমার কাছে, আত্মসম্মান ক্ষয়। এত মানুষের আশার আলোকে ধুলোয় মিশতে দিতে পারিনা। স্যুটকেসটার জন্য খুবই ভয় করে। শেষ রক্ষা করতে পারব তো? একি একজন লোক সামনে দাঁড়িয়ে মুত্র ত্যাগ করছে, সিস বাজাচ্ছে। একি তাদেরই একজন? না অন্য কেউ? না, অন্য কেউ না; এ তাদেরই একজন। কেননা ধারালো ছুরিটা দেয়ালের একপাশে হেলানো অবস্থায় রাখা আছে। সাবধান, সাবধানে এগোতে হবে, না হলে ধরা পড়ে যাব। আমি তার দিকে মুখ করে ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম। সে রাস্তার দিকে পিছন ফিরে রাস্তার এক ধারে মূত্র ত্যাগ করছে। খুব সাবধানে, ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। শব্দহীন পদক্ষেপে ভালোই এগোচ্ছি।  পায়ে এটা কী ঠেকলো নরম স্পঞ্জের মত? কী, বোঝার আগেই একটা আর্তনাদ শোনা গেল, "আউ, আউ আউ আউ," কুকুরের আর্তনাদ। কুকুরের লেজে পা দিয়ে দিয়েছি, আর রক্ষে নেই। হঠাৎই সে পেছন দিকে তাকালো, আর জোরে সিটি বাজালো এবং আমার পিছনে তাড়া করলো। তার সাথে যোগ দিল আরও কয়েকজন। আবারও দৌড় দৌড় দৌড়। কতক্ষণ দৌড়াচ্ছি জানিনা। কিন্তু না, সামনে অন্যান্যরা  হঠাৎই উধাও হলো। শেষে ধরা পড়ে গেলাম।


     একজন মুখে লাথি মারলো। খুব জোরেই মারলো, মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে গেল। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম। 


     সে বলল, "চোপ শালা, ইয়ার্কি পেয়েছ। খুবতো কসরত করিয়েছ চাঁদু। এবার ভালোই ভালোই স্যুটকেসটা দিয়ে দাও।" তারি সাথে কতকগুলো লোক হাসতে থাকলো। খুশির হাসি। তারা আমায় মাটিতে বসালো পিছমোড়া করে। স্যুটকেসটা সামনেই পড়ে।


     একটা চেনামুখ ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। কে? কে? কে হতে পারে? মুখটা স্পষ্ট হতেই অবাক হয়ে গেলাম। একি, এত অতীন্দ্র। আর আমনি এক নিমেষে সেই সব ঘটনার কথা মনে পরল। এটা কি আদৌ সম্ভব? সম্ভব না হয়ে যায় কোথায়। এখন তো নিজের চোখের সামনে সব জীবন্ত। আমি সেদিন কোন ভাবে এই দিন, এই সময়ে, ভবিষ্যতে চলে এসেছিলাম। না স্বপ্নে দেখেছিলাম এই দৃশ্য। বাড়ি মালিকের মৃত্যু, আমার মৃত্যু, বন্ধুত্বের বেইমানি। স্বপ্ন হলে, এটাও কী স্বপ্ন না সত্যি? হয়তো স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে, এটাই বাস্তব। স্বপ্ন হোক বা ভবিষ্যৎ আমার মৃত্যু অনিবার্য।


     অতীন্দ্র বলল, "চিনতে পারছিস। তোর জন্য আমার কত ক্ষতি হলো বলতো দেখি? 52 লাখ, একেবারে 52 লাখ টাকা পকেটে আসতো। সব তোর জন্য কেলিয়ে গেল। এবারে আর নয়। দুঃখ লাগে, ভারি দুঃখ লাগে। কত লাগবে বল, ছাড় এসব বেরিয়ে আই এই কেশ থেকে, আমাদের সাথে জুড়ে যা। নেওয়া দেওয়া কর। নাহলে খামখা হাতটা রাঙা করতে হবে, রক্তের রঙে। সে বারে তো তাড়াতাড়ি চলে গেলি, নইলে সেবারে অফারটা মিশ হত না, আর আজ এই দিনটা দেখতে হত না। আমারই ভূল, আমি একটু বেশি ঘুমকাতুরে, এই ঘুমই শেষে কাল হল, জিততে দিল না, তাই আজ ঘুমইনি, আজ জিতবোই, যে কোরেই হোক। আরে ভাই নেওয়া দেওয়া কর, টেনশান খতম।"


     আমি : "না, কখনোই না।"


     অতীন্দ্র : "ভেবে দেখ? তোকে কী দেবে তারা তোর এই কাজের জন্য, খেটে খেটে মরে যাবি, কিছ্ছু পাবিনা। বল কত টাকা লাগবে?"


     আমি : "না, কখনোই আমি গাদ্দারী করতে পারবোনা।"


     অতীন্দ্র : "আরেকবার বলছি, শেষবার, নেওয়া দেওয়া কর?"


     আমি : "না।"


অতিন্দ্র তার পকেট থেকে ছুরি বার করলো।


     অতীন্দ্রের গলায়, "আহারে! কত করে বলা হলো নেওয়া দেওয়া কর (চিস)। মানলি না, যেন মানুষকে বাঁচাবার হুচুক উঠে গেছে। একটুর জন্য আগে বেঁচে গেলি। আগেই খেল খতম হয়ে যেত। সব প্লান রেডি ছিল। বাট পাখি কিভাবে ফুরুৎ। বোকা ছেলে স্যুটকেসটা তো আমি পেয়ে যাব, বাট তোকে না মারলে আমার মরন নিশ্চিত। এবার তেরা ক্যা হোগা কালিয়া (হি হা হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ)।"


     আমি : "না আমায় মেরো না। তুমি এত নীচে নামতে পারলে অতীন্দ্র। সেই সব গরীব মানুষদের কথা, তাদের সাথে ঘটা সব মর্মান্তিক দৃশ্য, মনে পড়ে। না অর্থের লোভে এ সব তোমার কাছে তুচ্ছ, অর্থহীন। ভাবতে অবাক লাগছে। তুমি পারলে এসব।"


     অতীন্দ্র : "টাকার জন্য সবকিছু করতে রাজি আছি। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও (হি হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ) বিদায় বন্ধু।"


     তারপর সে এগিয়ে এল, হ্যাঁ সেই এগিয়ে এল ছুরি হাতে, আমারই দিকে।

না— না— না...

     হঠাৎই কয়েক মুহুর্তের মধ্যে সেটা বসিয়ে দিলো আমার পেটে।

অ্যাঁ— অ্যা— আ...


     রক্তের ধারা বইতে শুরু করল। মাটি ভিজে যেতে থাকলো গরম রক্তে। আর নয়, এবার এ বিশ্বকে টাটা বাই বাই করার পালা। জীবনের মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুকে বরণ।


     হাত-পা হালকা বোধ করলাম। মৃত্যুর পর এরকমই হয়, অনেক হালকা বোধ। মৃত্যুর দেশে পাড়ি দিতে চলেছি। আমায় কি তোমরা ক্ষমা করতে পারবে? তোমাদের আশার আলোকে অন্ধকারের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলাম না। অন্ধকার আজ নিভিয়ে দিলো সে আশার আলো কে।


     হঠাৎই কোথা থেকে কী যেন একটা ছিটকে পড়ল মাটিতে; আর তা থেকে আলো এসে পড়ল এই দিকে। টর্চের আলো, না টর্চের আলো নয়, আশার আলো। একটুর জন্য সবাই চমকে গেল কয়েকজন সেদিকে এগিয়ে গেল আমায় ফেলে রেখে। অতীন্দ্রও এগিয়ে গেল। তাহলে কি আমি এখনো মরিনি? না মৃত্যুর পরও মানুষ কিছুক্ষণ বেঁচে থাকে? হয়তো আত্মা কিছুক্ষণ দেহে থাকে, প্রাণ থাকে দেহে। কিন্তু প্রাণের কোনো স্পন্দন পাওয়া যায় না।

     এই সুযোগ, কিছু একটা করতে হবে। ঐতো সামনে স্যুটকেসটা পড়ে। কেউ নেই আমার পিছনে, সবাই ঐদিকে।

     এই সুযোগ, এক সুবর্ণ সুযোগ, পালানোর। যদি এখনও দেহ বেঁচে থাকে। হ্যাঁ এই তো, আমি তো বেঁচে আছি।

     আমি বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম, সুটকেস হাতে নিয়ে দৌড় দিলাম দিকবিদিক শূন্য হয়। পিছনে চিৎকার শোনা গেল, ধর শালাকে, পালাচ্ছে, ওই ধর ওকে। হ্যাঁ তারা আমার পিছনে আবার তাড়া করেছে। আমি রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড় দিলাম, যতটা জোরে পারি, হ্যাঁ আমাই দৌড়াতে হবেই। মরণ-বাঁচন এর দৌড়, অজস্র লোকের আশার আলো নিভতে না দেওয়ার দৌড়। সমস্ত ব্যথা, সমস্ত বেদনা উপেক্ষা করে আমি দৌড় দিলাম। সামনে নদী, ছুটলাম, ছুটলাম সেই দিকে। এগিয়ে গেলাম, চারিদিকে ফাঁকা পালানোর কোন পথ নেই। শুধু সামনে বিশাল নদী। হ্যাঁ তারা কাছাকাছি চলে আসছে আর একটু হলেই ধরে ফেলবে। এখন ভাববার কোন সময় নেই। চাঁদও মেঘে ঢাকতে শুরু করেছে। বিলম্ব না করে নদীতেই ঝাপ দিলাম।




     চোখ খুলতেই সামনে শ্রুতিকে দেখতে পেলাম। শ্রুতি, কাঁদতে শুরু করল। ও আমার কপালে একটা চুম্বন করিল।


     শ্রুতি : "আমি একদম আশাহত হয়ে গিয়েছিলাম, ভেঙে পড়েছিলাম, ভেবেছিলাম তোমায় আর দেখতে পাবোনা। কে আমায় ভালোবাসবে? খেয়াল রাখবে, কার সাথে সুঃখ দুঃখের কথা শেয়ার করবো?"


     আমি : "বিয়ে হয়নি যেহেতু আরেকটা বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে নিলেই হয়।"


     শ্রুতি : "দাঁড়াও তোমার একদিন কি আমার একদিন, চলো এক্ষুনি আমরা বিয়ে করবো। আমি শুধু তোমাকেই চাই। তোমাই ধন প্রান মন দিয়ে ভালোবাসি। তোমাই ছাড়া এ পোড়া কপালি অচল, সঙ্গী হারা, দিশেহারা।"


     আমি : "আরে আরে আর একটু সুস্থ হতে দাও। আমি তো তোমায় জোর করছি না বিয়ের জন্য, একটু মজা করছিলাম আরকি।"


     শ্রুতি : "মজা, হ্যাঁ মজা করা আমার সাথে। কী ভেবেছ কী, মজা করে পার পেয়ে যাবে।"


     আমি : "আরে আরে রাগ করছো কেন, তুমি ছাড়া আমার কে আছে বলতো। তোমার সাথে মজা করবো না তো কার সাথে করবো। তুমিই তো সব, তুমিই তো আমার স্বপ্নের রাজকুমারী। তুমিই তো সোনালি ভবিষ্যৎ। তোমাই ছাড়া বৃথা এ জীবন, তুমিই আমার হৃদয় ও মন।"


     শ্রুতি : "আর অত সোহাগ দেখাতে হবে না। আমি কি জানিনা তোমার মনের কথা, চিনি না তোমায়। তুমি আমায় ভালোবাসো আর আমি তোমায় । আমাদের দো দিল এক জান।"


     আমি : "মে জিতনা তুমে দেখু, দিল এ না ভারে। মেরা দিল কি পারি, আব এক কিস তো দে দো।"


     শ্রুতি : "দিলাম তো কপালে।"


     আমি : "না ওই রকম না , ফ্রেঞ্চ কিস, মাউথ টু মাউথ।"


     শ্রুতি : "হেয়, সকলের সামনে এসব।"


     আমি : "কই, কেউ তো নেই।"


     শ্রুতি : "কেউ চলে আসতে পারে।"


     আমি : "ও কেউ আসবে না।"


     শ্রুতি : "যদি চলে আসে?"


     আমি : "না আসবে না। দেবে না তো? ঠিক আছে তোমার সাথে কথায় বলবোনা, আড়ি তোমার সাথে।"


     শ্রুতি : "আরে বাবা রাগ করছো কেন,দিচ্ছি বাবা, দিচ্ছি।"


এই বলে মিশে গেল দুই ঠোঁট ভালোবাসার টানে।



     স্যার ভেতরে প্রবেশ করলেন সাথে আরও কয়েকজন।


     শ্রুতি : "হায় হায় স্যার চলে এসেছেন।"


     স্যার : "ডিস্টার্ব করলাম নাকি?"


সকলে হাঁসতে লাগলো।


     শ্রুতি : "না না আসুন আসুন।"


     শ্রুতি লজ্জায় পড়ে গেল।

     স্যার আমার দিকে মুখ করে, "এখন ভালো আছো তো" বলে আমার পাশে একটা ফ্লাওয়ার ভাস রাখলেন। "গ্রেট জব" স্যার বললেন। অন্যরাও অভিবাদন জানালো।


     স্যার : "তোমার জন্য চিটফান্ডের আসল ঘুঘু ধরা পড়ে গেছে। তুমি আমাদের ডিপার্টমেন্টের নাম উজ্জ্বল করেছো। সাথে সেইসব মানুষদের মুখে তুমি হাসি ফুটিয়েছো। তাদের মনে আশার আলো জ্বালিয়েছো। তোমায় কী বলে যে আমি ধন্যবাদ জানাই। কোন শব্দই যেন এখনো সৃষ্টি হয়নি।"


     আমি : "না স্যার কী যে বলেন, আমি সাধারণ মানুষ, ভারত মায়ের সন্তান। দেশের জন্য করবো না তো কার জন্য করবো। এতো আমার কর্তব্য।"


     স্যার : "হ্যাঁ আমরা গোপনে দেশের সাহায্য করি, কেউ জানে না আমাদের কথা। সমাজে সম্মান তো দূরের কথা, মরলেও চোখের জল ফেলার মতন লোক থাকে না। তবুও আমরা লড়ে যায়, দেশের জন্য, ভারত মাতার জন্য। কারণ আমাদের একটাই বিশ্বাস, কাজটা কে করলো এটা জরুরী নয়, কাজটা যে হইলো এটাই জরুরি।"


     আমি : "হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছেন স্যার।"


     স্যার : "অতিন্দ্রও ধরা পড়েছে। সে এখন জেলে ঘানি টানছে। সে এতটা বেইমান আগে জানতাম না। সে ওইসব ঘুঘুদের সাথে হাত মিলিয়ে ছিল অর্থের লোভে, স্বার্থের বশে। তুমি তো জানবে ভালো করেই?"


    আমি : "অতটা বেইমান আমিও ভাবিনি। কত ভালো ভেবেছিলাম, বন্ধু ভেবেছিলাম।" 


     স্যার : "সেই প্রথম ডিজেবাজার অভিযানের পর থেকেই উদাও। হয়তো সে সেই অভিযান টাও ব্যর্থ করে দিত, যদিওবা এই অভিযানটা ব্যর্থ করতে পারেনি।  তুমি বারেক তাকে না জানিয়ে আমাদের তা জমা দিয়ে দিয়েছিলে, না হলে এই রকম ঘটনা হয়তো আগেই ঘটে যেতে পারত, প্রথম বারেই। আর সব ঘুঘুরা বেঁচে যেত।


     (স্যার ঘড়ির দিকে তাকালেন)


     স্যার : ঠিক আছে, আমি  আসি এখন, অনেক কাজ বাকি আছে। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। আর বাকি কথা গুলো না হয় শ্রুতিই বলবে। একদিন বসে তোমার অভিযানের কথা জানা যাবে ক্ষন। এখন একটু তাড়াই আছি। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলে তোমার জন্য একটা পার্টি রাখা হবে, সেদিন তোমায় পুরস্কৃতও করা হবে, ডিপারমেন্টের পক্ষ থেকে। আর সে দিনই না হয় শুনবো সব কথা। ওকে, এখন তুমি বিশ্রাম নাও, অনেক দিনের ছুটি। আর তাহলে তোমাদের বিয়েটা কবে খাওয়া হচ্ছে?"


     আমি : "আরে, কী যে বলেন স্যার।"


     স্যার : "আমি কি কিছু জানিনা নাকি? ওকে আমি তাহলে এখন আসি, টেক কেয়ার।"


     বাকিরা বলল ঠিক আছে আমাদের নব জুটি, আসি তাহলে। আমাদের নেমন্তন্ন করতে ভুলোনা যেন। সবাই হাঁসতে হাঁসতে চলে গেল।



     শ্রুতি : "তোমায় বলেছিলাম এখন খেওনা, এখন খেওনা, শুনলে কই। সবাই জেনে গেল তো।"


     আমি : "হ্যাঁ একদিন না একদিন তো জানতেই হত। আগেই জানতে পেরে গেল, এ তো ভালোই হলো। জানাতে হলো না। আর একটা হবে নাকি?"


     শ্রুতি : "আবার, দাড়াও তোমায় একাকী পাই, তোমার হচ্ছে। কিস খেয়ে খেয়ে তোমার ঠোঁট না লাল টকটকে করে দিই, আমার নামও শ্রুতি নয়।"


     আমি : "হ্যুঁ হ্যুঁ হ্যুঁ হ্যু( হালকা হাসি) তা বল এখন, আমি এখানে কিভাবে এলাম? কী হলো তারপর? যতটা মনে আছে আমি সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে ছিলাম, তারপর কী হলো?"


     শ্রুতি : "তোমাকে আমরা একটা জেলের নৌকায় পেলাম। সে বললো যে সে তোমাকে চেনে, সে ডিজেবাজার এক শশানে খগেন খুড়োর মরা পোড়ানোর সময় তোমায় দেখেছে, অনেকদিন আগে। ওই ডিজেবাজা থেকে অনেক দূরে সে নৌকোয় মাছ ধরতে ধরতে তোমায় দেখতে পাই ভাসমান অবস্থায়। যেহেতু তোমায় চেনে তাই কোন দ্বিধা না করে নৌকায় তোলে ও স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করে। আর স্যুটকেসটা তোমার হাতেই ছিল, ওই স্যুটকেসটার জন্যই তুমি ভেসে ছিলে।"


     আমি : "স্যুটকেস হাতে অতক্ষণ কিভাবে ধরেছিলাম?"


     শ্রুতি : "স্যুটকেসের হ্যান্ডেলটা তোমারা কোর্টের ডান হাতার বোতামের সাথে আটকে ছিল।"


     আমি : "হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে, নদীতে ঝাঁপ দেয়ার সময় তাড়াতাড়ি করে স্যুটকেসের হ্যান্ডেলটা ডান হাতার বোতামে আটকে দিই, যাতে স্যুটকেশটা হাতছাড়া না হয়। এটা যে আমায় ভাসিয়ে রেখে প্রাণ রক্ষা করবে তা ভাবিনি। তারপর?" 


     শ্রুতি : "তারপর তোমায় আমরা ঢোলবাজার একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পায়।"


     আমি : "কী করে জানতে পারলে যে আমি ওখানে আছি?"


     শ্রুতি : "কোন খবর পাইনি তোমার। সেই দুপুরবেলা তোমার শেষ কল। তারপর বললে যে রাত্রিবেলা ফোন করবে। রাত্রি অনেক পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, করলে না। ভাবলাম হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছ। রাত্রিরে তোমার ফোনে ফোন লাগালাম, কিন্তু শুধু বলছে,— আপনি যাকে ফোন করেছেন তিনি এখন নেটওয়ার্ক কভারেজ সীমার বাইরে আছে।

     আর লাগালাম না। সকালে ফোন লাগালাম, তখন ফোনটা লাগলো এবং একটা অপরিচিত আওয়াজ শোনা গেল। অপরিচিত ব্যক্তি বললেন যে তুমি ঢোলবাজার একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আছো।

     তারপর বাকিদের জানালাম; টিম নিয়ে সেখানে পৌঁছলাম। তারপর ওখান থেকে তোমাকে এখানে শিফট করা হল। এই হসপিটালে।"


     আমি : "তারপর?"


     শ্রুতি : "তারপর আর কী, আমাদের টিম তল্লাশি চালিয়ে দিল— ইনভেস্টিগেশনস শুরু হল। খবর পেলাম পাশের ডিজেবাজা নামক একটা এলাকায় কাল একটা মানুষের রহস্যজনকভাবে মৃত্যু ঘটেছে; পেটের বাম পাশে ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে।

     এলাকার মানুষদের বক্তব্য যে এটা ভুতের কাজ ওই বাড়িতে ভূত আছে। আগেও অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে ওই বাড়িতে। ওই ভুতই বুড়োর ভবলীলা সাঙ্গ করেছে।

     স্থানীয় পুলিশদের সাথে আমরা ওখানে পৌছালাম। দেখলাম সত্যিই একটা বৃদ্ধ লোক মেঝেতে শোয়ানো আছে, চারিদিকে রক্ত।"


     আমি : "(হাসতে থাকলাম) গ্রামের লোকেরা কিন্তু ভুতে বেশি বিশ্বাসী। আমার সামনেই খুনটা হল, একেবারে নিজের চোখের সামনে। ধরেই ফেলেছিলাম, একটুর জন্য সে ব্যাটা ফস্কে গেল। তারপর?"


     শ্রুতি : "তারপর পোস্টমর্টেম। এরপর তল্লাশি চালাতে চালাতে একটা গলির ভেতর জানলার রডের কোনে একটা রক্তমাখা ছুরি পাই, যা  খুনের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। এলাকারই এক লোক খুনটা করেছে। ধরাও পড়ে গেল। ভয় পেয়ে সব উগরে দিল। আর ওর কাছ থেকেই  খবর পেলাম অতীন্দ্রের। অতীন্দ্র ধরা পড়লো, সাথে তার সাঙ্গপাঙ্গরা। খুনি লোকটার কাছ থেকে জানতে পারলাম, যে সেই রাতে তাকে বুড়ো লোকটার কাছে পাঠানো হয়েছিল এই জানতে যে, বাড়িতে থাকা লোকটি টেঁসে গেছে কিনা, বিষ খেয়ে।

     বুড়ো লেকটি বললো,— তাকে বিষ মাখানো খাসির মাংস খেতে দিয়েছিলাম। যা, টেস্টি করেছি না, চেটেপুটে খাবে, এতক্ষণে বোধহয় টেঁসে গেছে।

     লোকটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যদি বুড়ো কাজটা কমপ্লিট না করে, তাহলে তাকে কিছু অর্থ ও পরে আরো অর্থ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে কাজটিকে তাড়াতাড়ি কমপ্লিট করা ও বুড়ো কে সাহায্য করা। আর যদি কাজটা কমপ্লিট করে থাকে, তাহলে তাকে অর্থ না দিয়ে হত্যা করা। কেননা সে তাদের পথে বাধা হতে পারে। খুনের কোন সাক্ষী না রাখাই ভালো।

     লোকটি বলল,— আপনি নিশ্চিত যে সে মরেছে?

     বুড়ো বলল,— না মরে যাবে কোথায়? আমায় শ্রদ্ধা করে, নিশ্চয়ই খাবে। আমার বিশ্বাস আমার কথা রাখবেই।


     আমি : "শালা বুড়োর পেটে পেটে এত কুচক্র। কত ভদ্র, কত ভাল ভেবেছিলাম। বারেক খাইনি। আরশোলাকে কত গালমন্দ করছিলাম। আহারে! সে জীবন দিয়ে আমার জীবন রক্ষা করল।"


     শ্রুতি : "কেন কী ঘটেছিল?"


     আমি : "আর বলোনি, যেইনা খাসির মাংস টা একটু চেখে দেখতে যাব, হঠাৎ একটি আরশোলা উড়ে এসে তার ওপর পড়ে গেল। খাওয়া একেবারে ভেস্তে দিল। বারেক পড়েছিল না হলে এখন এখানে থাকতাম না। থাকতাম পরলোকে।"


     শ্রুতি : "একটা আরশোলা প্রান বিসর্জন দিয়ে একটা জীবন রক্ষা করলো। আহারে! কোন জীবকে ছোট, মূল্যহীন ভাবা উচিত নয়, সে তা প্রমান করে দিল।"


     আমি : "তারপর?"


     শ্রুতি : "তারপর লোকটা ছুরি হাতে নিয়ে বুড়োটার পেটের বাঁদিকে বসিয়ে দিল কয়েকবার। সেই সময় হঠাৎ সে একজনকে আলো হাতে ছুটে আসতে দ্যাখে এবং পালাতে শুরু করে। তারপর তুমি তার পিছনে তাড়া করলে, সে দৌড়াতে দৌড়াতে গলির ভেতর পৌঁছালো। হাত থেকে ফসকে গেল রক্তমাখা ছুরিটা। তারপর তুমি তার পেছনে ধাওয়া করতেই থাকলে, সে একটু হলেই ধরা পড়ে যেত, যদি না তুমি মাটিতে পড়ে যেতে। তারপর সে ভ্যানিশ। সে দ্রুত অতীন্দ্রের কাছে পৌঁছাল। সব বললো, যে বুড়ো গাদ্দারী করেছে, ঠকিয়েছে তাদের। বুড়ো লোকটাকে মারেনি। লোকটাকে আমাদের কথা সব বলে দিয়েছে, তাকে মারার কথা বলে দিয়েছে। সে লোকটার সঙ্গ দিয়েছে। কিন্তু বুড়ো ভাবিনি যে তার জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে। বুড়োকে মারার সময় সে লাইট হাতে ছুটে আসে ও তার পিছনে তাড়া করে। তারপর সে অতীন্দ্রের সাথে অস্ত্র হাতে দলবল নিয়ে ছুটে আসে। তোমায় যে তারা বুড়োর বাড়ির সামনের রাস্তায় দেখতে পেয়ে যাবে তা তারা ভাবেনি। তারা ভেবেছিল যে তুমি পালিয়ে গেছো, তাদের সব প্ল্যান ভেস্তে গেছে। তারপর তারা ছুটে আসে এবং তোমার পিছনে তাড়া করে, তুমি সুটকেস হাতে দৌড় দাও।

     তারাই আশেপাশের টাওয়ারগুলোকে অচল করেছিল সে রাত্রির জন্য, যাতে তুমি সেই রাত্রিরে কাউকে ফোন লাগাতে না পারো। কারো কাছ থেকে সাহায্য চাইতে না পারো। তাই সেদিন তোমার ফোনে ফোন লাগছিল না। তারপর গলির ভেতরে দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে। তারা তোমায় খুঁজে পেল না। তবুও তারা হাল না ছেড়ে চারিদিক খুঁজতে থাকলো। অনেকক্ষণ পর একজনের সিটির ডাকে, সে আর কয়েকজন সেখানে পৌঁছালো আর তোমার পিছনে তাড়া করতে থাকলো। একসময় তুমি তাদের হাতে ধরা পড়ে গেলে। তারপর তারা তোমায় পিছমোড়া করে মাটিতে বসিয়ে দিল, তারপর অতীন্দ্র তোমার পেটে ছুরি বসিয়ে দিল। তারপর কোথা থেকে একটা টর্চ লাইট যেন মাটিতে পড়ে জ্বলে উঠলো। তারা সকলেই চমকে উঠেছিল, ভয় পাইনি বললে কম হবে। সেটা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল; তারা এগিয়ে গেল সেটার দিকে। তারা ভেবেছিল যে এ মরে গেছে বা না মরলেও এ অবস্থায় পালানো অসম্ভব।

     তারা এটা আশা করিনি যে তুমি আবার জ্যান্ত হয়ে দৌড় দেবে, আবার সুটকেস হাতে। তারপর নদীতে ঝাঁপ দিলে, ভ্যানিশ হয়ে গেলে। তারা অনেক খুঁজল, কিন্তু খুঁজে পেল না। তারপর তারা ভয়ে ভয়ে থাকতে শুরু করলো। কিন্তু শেষমেশ ধরা পড়তেই হলো আমাদের হাতে। অতীন্দ্র প্রথমে কিছুই মুখ খুলতে চাইনি। তারপর থার্ড ডিগ্রি টর্চার দিতেই সব বলে ফেলল, যে কারা কারা এই ঘটনা চক্রে জড়িত। তারপর আর কী, সুটকেসের কাগজগুলো ছিল। একে একে ধরা পড়ে গেল সব মনীষীরা। রঘু কে জেরা করা হয়েছিল, সে কিছুই জানেনা এই ব্যাপারে। তাকে খাসির মাংসের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, সে খাসির মাংস ছাড়া বাকি সব রান্না গুলো করেছিল, খাসির মাংসটা শুধু বাড়ি মালিক রান্না করেছিলেন। সে এও বলল যে, সে ঝুটো বাসন আনার সময় খাসির মাংসে একটা আরশোলা পড়ে থাকতে দেখে ছিল, তাই সে বেকার কেন ফেলে দেবে, রাস্তার একটা কুকুর কে খেতে দিয়েছিল। তারপর আমরা খোঁজ খবর নিয়ে দেখি আশেপাশে কোন কুকুর মরেছে কিনা। আমাদের সন্দেহ ঠিক, কুকুর মরেছে, একটা নয়, দুটো কুকুর। কুকুর দুটো কে পরীক্ষা করা হল। কাল রাত্রিরেই মরেছে। না বিষ পাওয়া গেলনা। হয়তো এমনই কোন বিষ ছিল যেটা স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে চিহ্নিত করে, বিষের কোন উপস্থিতি পরিলক্ষিত হতে দেয় না। বাড়ি মালিকের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা কিন্তু ভালোই ছিল। বাড়িতে নিয়ে এসেছিলে, নিজের রোমাল তার রক্তের স্রোত বন্ধের জন্য দিয়েছিলে। আর..."


     আমি : "রুমাল। রুমাল তো আমার পকেটে, রুমাল আমি দিইনি। তাহলে কে দিল?"


     শ্রুতি : "তারমানে?"



     অমনি হঠাৎ সেই অতীতের ঘটনাটার কথা মনে পরল। ভেসে উঠল আবারও মনে। তাহলে সত্যিই কি?

     আমি বলে উঠলাম, "বাড়ি মালিকের পোস্টমর্টেম-এ কটা ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে?"


     শ্রুতি : "দুটি। একটা সেই খুনির, আর একটা তোমার।"


     অবাক হয়ে গেলাম, তাহলে এটাই সত্যি। কিন্তু কিভাবে? কিভাবে তা সম্ভব? হয়তো সেই বাড়িতে কিছু একটা আছে, হয়তো সত্যিই সেটা কোন ভূতুড়ে বাড়ি। তাই আমি ভবিষ্যতে চলে গিয়েছিলাম। নিজের মৃত্যু নিজের চোখে দেখেছিলাম। নিজের মৃত্যু যখন নিজের চোখে দেখেছিলাম তখন অবাক হয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, আর আমার হাতে থাকা টর্চ লাইটি কোনভাবে ছিটকে এসে মাটিতে পড়েছিল। তা জ্বলে উঠে পালাবার শেষ সুযোগটা করে দিল।


     একটা পুরনো স্মৃতি ভেসে উঠছে মাথায়। প্রথমবারে বাড়ি মালিককে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, আমি তার সাহায্য করতে তাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে এসেছিলাম, তার ক্ষতস্থানে আমার রুমালটা দিয়ে চেপে। তাই আরকি আমি রুমালটা সেই দিন থেকে পাচ্ছিলাম না, সেটা তো ভবিষ্যতেই রয়ে গিয়েছিল।

     আর বুড়ো ক্ষমা চাইছিল। আমায় ভবিষ্যতের আমি ভেবে। তাই আমি বুঝতেই পারিনি, সে কেন বলছে একথা? এখন বুঝতে পারলাম সব। আর সমস্ত ঘটনার অস্বাভাবিকতা, সবই বুঝতে পারলাম। কুকুরগুলোও যে সেদিন এমনি ডাকছিলনা, হয়তো তারা তাদের বিষে মৃত বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিবাদে ঘেউ-ঘেউ করছিল, রেগে ছিল, বিষন্ন মনে ছিল। নতুবা, তারা স্বাভাবিক কারণেই খুনের গন্ধ পেয়ে এসেছিল, আর ঘেউ ঘেউ করছিল।


     আমায় চিন্তিত থাকতে দেখে শ্রুতি জিজ্ঞাসা করল।


     শ্রুতি : "কী ব্যাপার তোমায় চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? কী ব্যাপার আমায় খুলে বল?"


     তারপর আমি সব কথা প্রথম থেকে বললাম একেবারে প্রথম থেকে। সে অবাক হয়ে গেল।

সে কতটা বিশ্বাস করল আর কতটা অবিশ্বাস জানিনা।

     আমার এই ঘটনা আমরা,আমরা মানে আমরা দুজন, আমাদের ডিপার্টমেন্টের স্যার ও বাকিদের জানালাম, বললাম। কিন্তু না, কেউ বিশ্বাসই করল না। 


     স্যার বললেন, "চোট টেট খেয়ে তোমার মাথার কিছু সমস্যা হয়েছে। কিছুদিন বিশ্রাম করো দেখবে ঠিক হয়ে যাবে।"


     কয়েকজন আবার পাগল বলতেও ছাড়ল না।

     শ্রুতি জীবনসঙ্গিনী, সে তো বিশ্বাস করবেই যতই অবিশ্বাস্য হোক। কিন্তু সেই কি মন থেকে বিশ্বাস করল? কে জানে।


     কিন্তু এটা সত্য তা আমি হলফ করে বলতে পারি। অতীত থেকে ভবিষ্যতে গিয়ে ভবিষ্যতের কিছু পরিবর্তন করেছিলাম, তা অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে। আর ভবিষ্যতেও এই পরিবর্তনের ফল দেখতে পেয়েছিলাম বা পেলাম। না এটা স্বপ্ন নয়, টাইম ট্রাভেল।


     এই ঘটনার বহু দিন কেটে গেছে আমাদের বিয়েও হয়েগেছে।



     আমি : "কিন্তু একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছিনা, কারেন্ট চলে গেল— মোমবাতি  জ্বালালাম, তাহলে কে দরজা ঠকঠক করল? আমি তো ভবিষ্যতে দরজা ঠকঠক করিনি।"


     শ্রুতি : "ভাল করে মনে করো। হয়তো তুমি কোন কারণে দরজা ঠকঠক করেছিলে।"


     আমি : "নাহ্, আমার নিখুঁত মনে আছে, কারেন্ট চলে যাওয়ার পর, আমি স্যুটকেস থেকে লাইটটা বার করে তোমার ওই আওয়াজ বিহীন জুতোটা পরে সিঁড়ি দিয়ে নিঃশব্দে নেমে গিয়েছিলাম। তাহলে আওয়াজটা কে করলো? ঠক ঠক ঠক।"


     শ্রুতি : "ভৌতিক ব্যাপার তো।"


     আমি : "হ্যাঁ আরেকটা কথা। ভিজে কাপড় কি হাওয়ায় উড়তে পারে?"


     শ্রুতি : "উড়তে পারে অনেক কারণে যদি সেটা কোন অবলম্বনকে জড়িয়ে না থাকে, বা কোন অবলম্বনকে অল্প জড়িয়ে থাকে। হাওয়ার বেগে উড়লেও উড়তে পারে।"


     আমি : "আর যদি ভিজে কাপড়ের সবটাই কোন অবলম্বনকে সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে থাকে, তাহলে?"


     শ্রুতি : "তাহলে তো উড়তে পারা খুবই কঠিন বা অসম্ভব।"


     বিস্ময়ে আমার গালটা হাঁ হয়ে গেল। সত্যিই বাড়িতে মধ্যে ভৌতিক ব্যাপার আছে। গ্রামের লোকেরা তাহলে ভুল বলেনি। কিছু একটা রহস্যতো লুকিয়ে আছে। আমায় তা খুঁজে বার করতেই হবে—জানতেই হবে।


     আবারও গেলাম সেই এলাকায়, সেই গ্রামে। অনেকে অনেক কিছু বললো। ঠিকমতো ভাবে পুরো ঘটনাটা কেউ বলতে পারলো না, শুধু একজন বৃদ্ধ ছাড়া। বৃদ্ধ মানুষের কাছ থেকে জানতে পারলাম পুরো ঘটনাটা, আসল ব্যাপারটা।



     বৃদ্ধ : "বহুদিন আগে এই বাড়িটা একজন বিজ্ঞানী বানিয়েছিল, নিরিবিলি স্থানে ভালোভাবে গবেষণা চালানোর জন্য। তিনি সারা দিনরাত এই বাড়িতেই গবেষণা করতেন। বাড়ি থেকে কম বের হতেন। তার একটা চাকর ছিল, নাম ছিল লালু। সেই তার সব যাবতীয় কাজকর্ম করে দিত। রান্নাবাড়া, বাজার করা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সে খুব ধূর্ত ছিল। বিজ্ঞানীর চোখের আড়ালে সে অনেক কুকর্ম করত। তার বাড়ি থেকে অনেক দামি-দামি জিনিস চুরি করে তা বিক্রি করতো।

     একদিন একটা খবর চারিদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল যে বিজ্ঞানী প্রতিদিন রাতে উধাও হয়ে যেত। চলে যেত নাকি বহু যুগ আগে, বহুযুগ পেছনে, ভবিষ্যতে, অতীতে। সেও নাকি গিয়েছিল বিজ্ঞানীর সাথে। বিজ্ঞানী ওকে নিয়ে গিয়েছিল। তার কথা প্রথমে কেউ বিশ্বাস করেনি। তারপর একে একে লোক বিশ্বাস করতে লাগলো। লালু তাদেরকে বিজ্ঞানীর বাড়িতে নিয়ে এসে লুকিয়ে বিজ্ঞানীর ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া দেখাতো। তারা দেখে অবাক হয়ে যেত ও তার কথা বিশ্বাস করে নিত। তারপর ঘটলো এক ঘটনা। চাকরটা তাকে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে মারার চেষ্টা করল, তার সম্পত্তি পাওয়ার জন্য। যতটা জানতাম বিজ্ঞানীর সাতকুলে কেউ ছিলনা, হয়তো বিজ্ঞানীর পর সে এই সম্পত্তিই পেত। কিন্তু না বাবুর ধৈর্য নেই, উনি সব আগে চান। এ হয়েছে সেই সোনার ডিমের মতন, প্রতিদিন মুরগি সোনার ডিম দিচ্ছে। মুরগি মালিকের হচ্ছে না, উনি মুরগিটা মেরেই আগেভাগে সব ডিম পেতে চান। অপেক্ষা করতে পারবেন না। বিশেষ করে তার ওই টাইম মেশিন যন্ত্র। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। তার বিষে কোন কাজই হলনা। হয়তো বিজ্ঞানীর কাছে এমন কোন ঔষুধ ছিল যা সর্ব বিষনাশক। তা খেয়েই সে বেঁচে গিয়েছিল। বিজ্ঞানী জানতে পেরে গিয়েছিল যে এ কার কাজ। তারপর সে লালুকে তাড়িয়ে দিয়েছিল এবং  নতুন চাকর নিয়োগ করেছিল।

     একদিন হল আর এক ঘটনা। বিষের ঘটনার তিন দিন পর লালু ডাকাতদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিযান চালালো বিজ্ঞানীর বাড়ি। উদ্দেশ্য বিজ্ঞানী কে হত্যা করে তার সম্পত্তিগুলো হাতানো। বিজ্ঞানীর বাড়ি থেকে ডাকাতদের নেওয়ার মতন কিছুই ছিল না। তারা কী নেবে, রাসায়নিক দ্রব্য, কেমিক্যাল তা তাদের কী কাজে আসবে, তারা তো কিছুই জানেনা।

     বিজ্ঞানী কে মারার, ডাকাতদের কোন অভিসন্ধিই ছিল না। ডাকাতদের চাকরটা টাইম মেশিনের লোভ দেখিয়ে ছিল। তারাও লোকমুখে শুনে ছিল এই বিজ্ঞানীর কথা, তার উধাও হয়ে যাওয়ার কথা। তাই ভবিষ্যৎ দেখবার লোভ সামলাতে না পেরে তারা লালুর নির্দেশ মেনে চলতে শুরু করল। লালুর প্রথম নির্দেশ ছিল যে আগেভাগেই বিজ্ঞানী কে হত্যা করা। কারণ বিজ্ঞানী তাকে অপমান করেছিল তাকে দূর করে দিয়েছিল বাড়ি থেকে। তাই বিজ্ঞানী কে হত্যা করে সে প্রতিশোধ নিতে চাই, মনের জ্বালা মেটাতে চাই। তারপর অন্য কথা। কিন্তু সে এ ভাবেনি যে, যদি বিজ্ঞানীকেই কে মেরে দিই, তাহলে ডাকাতদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির কী হবে। তারা কিভাবে ভবিষ্যৎ দেখতে পাবে, ভবিষ্যতে যাবে।

     ডাকাতরা বিজ্ঞানীকে শোবার ঘরে হত্যা করে, সেই ঘরেই টাইম মেশিন ছিল। সেই ঘর থেকেই বিজ্ঞানী উধাও হয়ে যেত সময়ে যাত্রা করতো। লালুর আশা পূরণ হয় প্রতিশোধ নেওয়া সার্থক হয়।

     কিন্তু সে এ আশা করেনি যে তার জন্যও বিপদ অপেক্ষা করছে। যখন সে ব্যাপারটা জানতে পারল, তখন তার কিছু করার উপায় ছিল না। সে ভয়ে কাঁপতে থাকলো, এখন কী করা যায়? কী করবে এখন সে? সেতো  টাইম মেশিন চালাতে জানেনা। ডাকাতেরা এবার টাইম মেশিনে করে ভবিষ্যতে যেতে চায়। কিন্তু কীভাবে লালু তাদের ভবিষ্যতে পাঠাবে। সে তো কিছুই জানে না। তখন সে ডাকাতদের মেশিনটার কয়েকটা সুইচটি টিপতে বলে, যা টিপলে কী হবে তা সেও জানেনা। তারপর সে ঘরের বাইরে বেরিয়ে ঘরের দরজা লক করে দেয়। ডাকাতেরা তার দেখানো সুইচগুলো টিপে, কিন্তু কিছুই হয়না।

     তারা লালুকে ডাকে, লালু উত্তর দেয় না। তারা বুঝে যায় লালুর অভিসন্ধি, যে লালু তাদের ঠকিয়েছে। গেটও খুলছে না, বাইরে থেকে লক করা আছে। মজবুত দরজা, কিছুতেই ভাঙছে না। তারা রেগে যাই ও রাগে টাইম মেশিন কেই ভাঙতে শুরু করে। ভাঙতে ভাঙতে মেশিনের মধ্যে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয় ও মেশিন বাস্ট করে। মেশিন সমেত তারাও উধাও হয়ে যায় সাথে কারেন্টও চলে যায়। 

     এদিকে ডাকাতদের দরজা বন্ধ করে লালু বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা ল্যাবটিতে পৌঁছায়। সে ভেবেছিল ডাকাতরা একবার ঘর থেকে বেরোতে পারলে তাকে মেরেই ফেলবে। দরকার নেই সম্পত্তি, প্রাণ আগে। এখন যা পাই নিয়ে পলায়ন করি।

     সে জানতো ওখানে একটা দামি জিনিস আছে। একটা কলাগাছ একটা শুকনো গাছ যা নাকি অমর। বিজ্ঞানীরই আবিষ্কার।

     কিন্তু একটা অসুবিধা হলো গাছটা জলের সংস্পর্শে আসলে পচে যেতে শুরু করে। তার অমরত্ব আর থাকেনা, আয়ু কমতে থাকে। তাই গাছটার ওপরে একটা সাদা চাদর জড়ানো আছে যা গাছটিকে জল ও আগুন এর হাত থেকে রক্ষা করে।

     সেই ওই গাছটার সম্পর্কে বিজ্ঞানীর কাছ থেকেই জানতে পেরেছিল। বিজ্ঞানী যখন সারাদিন ল্যাবে ব্যস্ত থাকতেন, তখন তার খাবার দিতে আসত সে। আর বিজ্ঞানীর কাছ থেকেই এই সব জিনিস গুলো সম্পর্কে জানতে পারত, আর অবাক হত। সে জানতো এইসব জিনিসের মূল্য কী হতে পারে। সে অতি সন্তর্পনে কাপড় জড়ানো কলাগাছটাকে নিয়ে নিজের বগলে চেপে ধরলো। তারপর তাড়াতাড়ি ল্যাব থেকে বেরোতে গেল ডাকাতদের হাতে ধরে পড়ে যাওয়ার ভয়ে। হঠাৎই কারেন্ট চলে গেল আর অন্ধকারে আসতে গিয়েই হল দুর্ঘটনা। ধাক্কা খেয়ে কাঁচের কেমিক্যালের শিশি গুলি নীচে পড়ে ভাঙতে শুরু করে ও তাদের বিক্রিয়ায় বিস্ফোরণ ঘটে— তার মৃত্যু হয়। সে আগুনে পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে যায়; তার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না। শুধু সাদা কাপড় জড়ানো শুকনো একটা কলা গাছ পাওয়া যায়।"



     একটু বিরতি, বৃদ্ধ একটু থেমে জল খায়, তারপর আবার বলতে লাগলো, "অনেকে বলে যে লালু ওই কলাগাছটার মধ্যেই ভূত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে, তাকে কেউ কেউ ওই বাড়ির ছাদে রাত্তিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে; সাদা কাপড় পড়ে। কেউ দেখেছে সাদা কাপড় পড়া শুকনো কলা গাছকে। আবার অনেকে বলে বিজ্ঞানী মরেনি হয়তো কোন সুদূর ভবিষ্যৎ বা অতীতে এখনো বেঁচে আছেন। আবার কেউ কেউ বলে বিজ্ঞানী মারা গেছেন তার দেহ উধাও হয়ে গেছে কিন্তু তার আত্মা উধাও হতে পারিনি এই বাড়িতেই রয়ে গেছে। আবার কেউ বলে তিনি তার দেহ খোঁজার জন্য, মুক্তির জন্য প্রতিদিন এই ঘরে আসেন ও সময় যাত্রা করে বিভিন্ন সময়ে গিয়ে তার দেহকে খুঁজতে থাকেন।"



      আমি : "তাহলে আপনি এত সব কিভাবে জানতে পারলেন?"


      বৃদ্ধ : "আমিই তো তার নিয়োগ করা নতুন চাকর ছিলাম।"


     আমি : "তাহলে, আপনি কীভাবে বেঁচে গেলেন?"


     বৃদ্ধ : "তারা প্রথমে আমার পেটে ছুরি বসিয়ে ছিল, কিন্তু আমি মরিনি, আদমরা ছিলাম। সব ঘটনার সাক্ষী ছিলাম। আর বাকি ঘটনা কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে অনুমান করেছি মাত্র। তারপর সকালে অন্যরা এসে আমায় উদ্ধার করে। বাকিদের কোন চিহ্নই পাওয়া যায়নি। আর আমি ওমুখো হয়নি।

     তারপর বাড়িটা ওই লালুর ভাই দেখাশোনা করতে শুরু করে। সেই এতদিন দেখাশোনা করে আসছে, বহুদিন বন্ধ ছিল বাড়িটা। লোভ আর স্বার্থের বশে, ওইসব ঘটনা, ভুতুড়ে বাড়ির গুজবে কান না দিয়ে সে বাড়িটা দখল করে ও নিজের নামে করে নেয়। যাতে কেউ পরে দখল করতে না পারে। ভুতুড়ে বাড়ি বলে কেউ তার একাজে প্রতিবাদ করেনি। আর এই কদিন হলো তো সে মারা গেল।

     সে বাড়ি ভাড়া দিতে শুরু করে গেস্টদের জন্য। ন মাসে ছ মাসে গেস্ট আর কই হত।

     একদিন একজন ডাক্তার ওই গেস্ট হাউসে ছিলেন তারপর থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। একদিন এক সাহিত্যিক কলকাতা থেকে এসেছিলেন শহরের জনবহুল পরিবেশের আওয়াজ থেকে একটু মুক্তি পাওয়ার জন্য, ছুটি কাটানোর জন্য— শান্তিতে একটু লেখালেখির জন্য ওই ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু সেও উধাও হয়ে গেল। তাকেও অনেক খোঁজা হল, পাওয়া গেল না, কিছুদিন পর পাওয়া গেল, তাও আবার পাগল অবস্থায়।

     তারপর থেকে লোক আসে না বলবো না। আসে, কেউ না জেনে আসে। কেউ আবার জেনে আসে— যাদের সাহস বেশি।"




     এই ছিল আসল ব্যাপারটা। তাহলে সত্যিই ধন্যবাদ জানাতে হয় সেই বিজ্ঞানী কে যার কীর্তির জন্য আমি ভবিষ্যতে পৌঁছায়, যার জন্য স্যুটকেসটা বেঁচে যাই। যার জন্য সকলের মনে আশার আলো জ্বালাতে সক্ষম হই। এমনকি নিজেও বেঁচে যায়।


     ঘটনাটা জানালাম শ্রুতিকে। সে তো যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেল, ব্যাকুল হয়ে উঠলো।


     প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, আর যাব না কিন্তু ভেবে দেখলাম না আর একবার গিয়ে ঘুরেই আসি না, রহস্যের সামনাসামনি হব। আর তাছাড়া আমাদের বিয়েও হয়ে গেছে। হানিমুনের প্লানিং চলছিল, ওখানেই তাহলে হানিমুনটা সেরে নেব ক্ষন।


     শ্রুতিও রাজি, সে বলল, "এই রকম ভৌতিক বাড়িতে হানিমুন কাটানোর মজাই আলাদা।"



     রিমঝিম নয় ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। ফিকে জ্যোৎস্নায় প্রকৃতির শোভা যেন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বদ্ধ ঘরে দুই স্বামী স্ত্রী কাঁচের এপার থেকে সেই রূপময় দৃশ্য উপভোগ করছে। সময় রাত দুটো, ঘুম নেই কারো চোখে। চোখে শুধু প্রেমেরই ছোঁয়া। শ্রুতি আমার কাঁধে মাথা রেখে শান্তির সমুদ্রে ভেসে চলেছে।

     তারপর সে আর আমি মুখোমুখি কতক্ষণ তাকিয়ে জানিনা। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। দূর তেরি ভাললাগে এসব। তোমায় কী সুন্দর দেখছিলাম। 


     এইতো মোমবাতি তো এখানে, দেশলাইটা কোথায় গেল। রঘু তো সকালেই দিয়ে গিয়েছিল কোথায় আবার রাখলাম, ডয়ারে? নাকি তাক টাই? নাকি আবার ঝুড়ি টাই? কোথায়.. কোথায়? হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে ওই তাক টাই রেখেছিলাম। এইতো, দুটো আছে।


(খস খস খস খস) জ্বলনারে (ফর ফর ফর)


     একি শ্রুতি তোমার পাশে ওটা কী? মোমবাতির হলদে আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে একটা কঙ্কাল পড়ে আছে মেঝেতে।


     তারপর দরজায় আওয়াজ, ঠক ঠক ঠক।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror