Rocky Kazi

Crime Thriller Others

4.9  

Rocky Kazi

Crime Thriller Others

অন্ধকারে

অন্ধকারে

12 mins
2.9K


উহ্হ্হ্ কী ঠান্ডা। তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে কম্বলের ভেতর ঢুকতে না পারলে স্বস্তিই হচ্ছে না। ও ভাই গাড়ির গতিটা একটু বাড়াও না, এ যেন পিঁপড়ের থেকেও স্লো যাচ্ছে। এরচেয়ে টলি নিঃসন্দেহে জোরে যায়। এই বলে আমি টোটো চালক কে একটু রাগিয়ে দিলাম, হ্যঁউ। যদিওবা সে সত্যিই গাড়িটি জোরেই চালাচ্ছিল, তার উপর আমার এই ব্যঙ্গোক্তিতে সে গাড়ির গতি আরোও বাড়িয়ে দিল। যার ফলে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেলাম। 

      অন্য দিন অফিস থেকে ফিরতে আধঘন্টার অর্ধেক সময় লাগতো তো বটেই। কিন্তু আজ সত্যিই তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে গেলাম। টোটোওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে এগোতে থাকলাম।
      রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলছে মিটমিট করে। তারই নীচে আধশোয়া অবস্থায় আর্তনাদ করছে একটা বাচ্চা কুকুর। চারিদিক নিস্তব্ধ, কিন্তু সেই নিরবতার মাঝে তার আওয়াজ যেন সত্যিই অস্বাভাবিক।
     উগ্র শীতের প্রকোপে কাঁপতে থাকা বাচ্চা কুকুরটির ঐরকম অসহায় অবস্থা দেখে আমার মনে দয়ার উদয় হল। যা আমি বহুদিন আগেই বিসর্জন করেছিলাম। ভেবেছিলাম এ বিশ্বজগতে স্বার্থপর না হলে কষ্টের সহিত বাঁচা বড় দায়, তাই দয়া নামক বস্তুটিকে আপন মন থেকে সরিয়ে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টার সত্ত্বেও, আজ তার এইরকম উত্থানে সত্যিই একটু অবাক লাগছে। তা অবাক লাগবেনাই বা কেন? এ তো আর মানুষ নয় যে স্বার্থান্বেষী। এতো একটা অবলা শিশু কুকুর।
      একদিন হয়েছিল কী? আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর শোচনীয় অবস্থায় অর্থ সংকটের দরুন সে আমার কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিল। সে ওই অর্থের সুদসহ আসল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর খাতিরে আমি তাকে ওই আলোচ্যমান অর্থের সুদ দিতে বারণ করেছিলাম। বুঝতেই তো পারেন বন্ধু তাকেই বলে যে বিপদে সাহায্য করে, তা তো আমরা সেই ছোটবেলা থেকে শিখে আসছি, পড়ে আসছি, দুই বন্ধু ও ভাল্লুকের গল্প, পিঁপড়ে ও পায়রার গল্প,  সবইতো জানি আমরা, তবে কেন? কেন আমরা বন্ধুর বিপদের বেলায়
মুখ লুকায়, এড়িয়ে চলি? স্বার্থপরতার দরুন? কে জানে হয়তো তাই।
       বলেছিলাম "ভাই তোর এই আর্থিক অবস্থা দেখে আমারও খুব দুঃখ লাগছে। এমনিতেই সুদ নেওয়ার মতন পাপ কাজ করা তো দূরের কথা কল্পনাও করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য, আর তুই তো দূরের কথা। বন্ধু হয়ে বন্ধুর সাহায্য করতে না পারলে বন্ধুত্বের কোন মূল্যই থাকে না। ভালো থাকিস। আর যদি কোনোরকম অসুবিধা হয় তাহলে এই বন্ধুকে স্মরণ করিস।"
      এই ভাবে কয়েক বছর কেটে যায়। বন্ধুর টাকা তো দূরের কথা বন্ধুর পাত্তা পাওয়া বিরল। তাছাড়া বন্ধুর মানসিকতার এমনই পরিবর্তন হয়েছে যে রাস্তাঘাটে দেখা হলে কথা বলে না, সব সময় এড়িয়ে চলে। যদিও বা কথা হয় কোন ছ্যুঁত ধরে চলে যায়,যেন বন্ধুত্বই কোনদিন হয়নি। অচেনা কারোর সাথে কথা বলছে। এইরকম গতিতে এগোতে থাকে আরও কয়েকটা বছর। তা এখন সেই ঋণি বন্ধুর অবস্থা খুবই ভালো, সে একজন ব্যবসায়ী হয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে।
     একসময় আমাকেও খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। অর্থের প্রয়োজন ছিল কয়েক লক্ষ টাকা। এই অসহায় অবস্থা থেকে বেরোনোর কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিলামনা, হঠাৎ সেই সময় আমার সেই ঋণগ্রস্ত বন্ধুর কথা মনে পড়লো। যার বর্তমান অবস্থা অভাবনীয়।  আমি সেই বন্ধুর কাছে গিয়ে অর্থ সাহায্য চাইলাম। বললামー"ভাই আমি খুব আর্থিক সংকটে পড়েছি, আমাকে কিছু অর্থ দিয়ে সাহায্য কর না ভাই,আমি তোর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।"
      আমি তাকে আমার দেওয়া সেই কয়েক লক্ষ টাকা ধার এর কথা বললাম না, কেননা আমার সে কথা বলতে মানসিকতায় আঘাত লাগছিল।
যা দেখবেন অনেকেরই হয়, নিজের জিনিস নিজেকে চাইতেই লজ্জা লাগে, কীরকম যেন একটা মনে হয়, সামনের ব্যক্তিটা খারাপ ভাববে না তো, এরকমটা আপনিও নাকি? ভাবলাম দেখিনা বন্ধু কী বলে। তখন সে বলে উঠল "কত টাকা ধার লাগবে?" আমি তাকে আমার ধার দেওয়া অর্থের কিছু কমিয়ে বললাম। হঠাৎ সে আমার এই উত্তর শুনে আঁতকে উঠল। আর বললোー"এত টাকা তোকে কোন বিশ্বাসে দেব? দিতে পারি যদি এই টাকার সুদ গুলো ঠিক সময় মতন দিতে পারিস। দিতে পারবি তো সময় মত।" তার এই কথা শুনে আমি সত্যিই অভিভূত হলাম। এমনকি মনেও একটু আঘাত পেলাম আর কী।
       বন্ধুত্বের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারলাম।  এই ভাবেইতো বন্ধু শব্দের মানহানি হয়, বন্ধুত্ব তখনই সার্থক হয় যখন পারস্পরিক বিশ্বাস শ্রদ্ধা ও মনোমালিন্য দৃঢ় হয়। যখন একে অপরের প্রতি নির্ভরশীলতা বেড়ে ওঠে। কিন্তু আমার এই বন্ধুর মধ্যে কোথায় সে সব? বন্ধুর এমন ব্যবহারে আমার প্রচন্ড রাগ ধরল এবং আমি তাকে আমার ধার দেওয়া অর্থের কথা জানালাম। তার এহেন ব্যবহারের তীব্র নিন্দা করিলাম। কিন্তু আমার এই কথাতেও তার কোনো বিশেষ পরিবর্তন হলো না। পরিবর্তন হয়েছে হয়তো তার মনে রাগ জাগ্রত হয়েছে। যার ফলে সে আমাকে ভৎসনা সহ অপমান করল এবং এমনই ভাব করল যে সে এই বিষয়ে কিছুই জানেনা। সে আমার সেই ধার দেওয়াটিকেই মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিল। এমনকী আমাকে পুলিশে দেওয়ার ভয়ও দেখালো। তো কী আর করা যায়, মিথ্যুক হয়েই তার কাছ থেকে ভিক্ষা করতে হলো। কিন্তু ভিক্ষারও কোন মূল্যই পেলাম না অর্থাৎ সে আমাকে অর্থ ধার দিতেও রাজি হলো না। এমনকী আমাকে বিতাড়িত করতেও একটুও দ্বিধা করল না।
     তার এই নিষ্ঠুর কৃতকর্মে আমি দুঃখ পেলামবইকি। বন্ধু! কোথায় আর সে বন্ধুত্ব? হারিয়ে গেছে স্বার্থের সমুদ্রে। অনেক ক্ষেত্রে বা প্রতি ক্ষেত্রেই স্বার্থপরতা ছাড়া আর দয়ালুতার দৃষ্টান্ত উপেক্ষণীয় দেখে আমিও স্বার্থপরের পথই বেছে নিলাম। কেননা স্বার্থপরতা ছাড়া এই বর্তমান সমাজে বেঁচে থাকাটা যেন বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর মতন। মানে যা খুবই কষ্টকর। কিন্তু আজ সেই দয়ার আকস্মিক আবির্ভাব,সত্যিই একটু অবাক লাগছে।
      ল্যাম্পপোস্টের নীচে পড়ে থাকা শিশু কুকুরটি শুধুই যে শীতের প্রকোপে আর্তনাদ করছে তা নয়। তার ডান পায়ের পুরো অংশটাই যেন কোনরকম ভাবে আঘাত পেয়েছে। এমনকী সেই স্থানে একটা ক্ষতেরও আবির্ভাব ঘটেছে। আর সেই ক্ষতস্থান থেকে নীরবে বয়ে চলেছে রক্তের অর্ধতরল স্রোত। তার এই অস্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি নীরবতার মাধ্যমে যেন সমবেদনা জানাচ্ছে।
      আমি যেন যন্ত্রচালিতের মতন তার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার স্বার্থপর প্রবৃত্তি আমাই যেন আটকাতে পারল না। যেন সে লজ্জিত মুখে সরে পালালো। এই কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় বাতাসও যেন অভিমান করে দূরে চলে গেছে। নিজের অজান্তেই হাতটা চলে গেল প্যান্টের পিছনের পকেটে, আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে এল আমার সেই পছন্দের বেগুনি রুমালটি। যা দিয়ে আমি শিশু কুকুরটির ক্ষতস্থানটিকে বেধে দিলাম রক্তস্রোত বন্ধের প্রত্যাশায়।
      শিশু কুকুরটির আর্তনাদ ক্রমহ্রাসমান হতে থাকলো। আমার স্বার্থহীন মানসিকতা তাকে আর এই প্রতিকূল পরিবেশে থাকতে দিল না। তাকে তুলে নিলাম হাতে থাকা বাজারের ব্যাগটির মধ্যে, আর এগিয়ে চললাম নিজস্ব গন্তব্যস্থলে। শুধু পড়ে রইলো মিটমিট করে জ্বলা ওই ল্যাম্পপোস্টের নীচে, থকথকে জমাট বাঁধা রক্ত।
      কাঁধে ব্যাগ ও হাতে ব্যাগ নিয়ে চলে এলাম বাড়িতে। সে রাত্রিরে তাকে খেতে দিলাম আমার প্রিয় স্বাধের চিলি চিকেন ও দু মুঠো ভাত। যদিও বা খাদ্যগুলি আপন পেটস্ত না হওয়ার দরুণ আফসোস করছিলাম। কিন্তু তার এই ক্ষুদার্থ ও অসহায় অবস্থায় উদিত করুনার কাছে আপন আফসোস যেন সত্যিই অর্থহীন। ক্ষুধা নিবারণের পর বাচ্চা কুকুরটি গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম নিজস্ব ক্ষুধার বাইনা মিটিয়ে।
      পরের দিন সকালে মিষ্টি ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি ঘড়িতে সাতটা বেজে পাঁচ মিনিট। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। আর তার পিছনে থাকা ছোট্ট লেজটি নাড়িয়ে যেন সে অভিনন্দন জানাচ্ছে। তার সেই ঘেউ ঘেউ আওয়াজ যেন আমায় বলতে চাইছে সুপ্রভাত। তার এই মিষ্টি আওয়াজ ও আনন্দের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হয় সকালের উদিত সূর্যের স্বর্ণালী আলোই সুপ্রভাত এর সূচনা হচ্ছে। যেন অন্ধকারময় এক কুৎসিত জীবনে সুখের তথা আলোর আবির্ভাব ঘটছে।
     সুপ্রভাত, এই নাম থেকেই তার নাম দিলাম সুভা, হ্যঁউ। সুপ্রের সু আর ভাতের ভা, হয়ে গেল সুভা। তাকে দেখে প্রায় সুস্থই মনে হচ্ছে, আমি বিছানা থেকে নামতেই সে আমার পায়ের কাছে এসে পায়ে মাথা ঘষতে থাকল। যেন সে আমার অনুগত্য প্রকাশ করছে। ঠিক যেমনটা অন্যান্য কুকুররা করে থাকে যখন তারা বেশি আনন্দ পায় বেশি খুশি হয়, নিজেকে একটু চনমনে মনে করে। আমি তাকে তুলে নিলাম আমার দুই হাতে, আর তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আদর করতে থাকলাম। সে আমার হাত চেটে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকলো। তাকে বিস্কুট খেতে দিলাম, সে কোন দ্বিধা না করে অনায়াসে সেগুলি গ্রহণ করল। তারপর তাকে নিয়ে আসলাম বাড়ির বারান্দায়।
      সূর্যের আলো তখনও পুরোপুরি চারিদিকে ছড়ায়নি। পাখিদের কলরবে মগ্ন যেন বাতাস। সূর্যিমামা বাঁশ গাছের আড়াল থেকে উঁকি মারছে।  আহা প্রকৃতির কী রূপ। যেন এরূপ আমার কাছে অজানা ছিল আজ পর্যন্ত। যেন কল্পনার কোনো গভীরে সুপ্ত ছিল এইরূপ। যা আজকে এখন জাগ্রত হয়েছে আমার এই বাস্তবিক দৃষ্টিতে। কেননা এত সকালেই ঘুম থেকে ওঠা আমার পক্ষে হয়না বললেই চলে। আর উঠলেও কখনো হৃদয় চক্ষু দিয়ে দেখিনি এই বিশ্বপ্রকৃতিকে। আজ সেই বাচ্চা কুকুরটির জন্যই যেন দেখতে পেলাম এই প্রকৃতির বর্ণময় রুপ, যা সত্যিই অতুলনীয়।   
       সুভার বয়স এখন 5 বছর, কী করে জানলাম? আমিতো আর কুকুরটার জন্ম তারিখ জানিনি, হয়তো আপনারা এটাই ভাবছেন তাইনা? হ্যাঁ আমি একজন কুকুর বিশারদ কে দেখিয়ে ছিলাম সে-ই বলেছে। যখন তাকে প্রথম বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম তখন তার বয়স আনুমানিক এক বছর তো হবেই। শিকার, হ্যাঁ শিকারে তার জুড়ি মেলা ভার, নামিদামি শিকারি কুকুরের থেকে কিছু কম যায় না। আর তার জ্ঞানের বিচার করলে তো সত্যিই অবাক হতে হয়।
      একদিন হয়েছিল কী একবার পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম, ঝর্নার উৎপত্তিস্থল মানে ঝরনা যেখান থেকে নেমে আসছে, সেখানে... বুঝতে পারলেন? না পারেননি? তাহলে চলুন একটা উদাহরণ দেয়া যাক, ধরুন একটা টেবিলের ওপর এক বালতি জল ঢেলে দেওয়া হলো, জলটি নীচের দিকে পড়ল, টেবিলের ওপরে তল থেকে। ঠিক তেমনই ঝর্না যদি নীচের দিকে পড়তে থাকা টেবিলের অপর ঢেলে দেওয়া জল হয় তাহলে ওই টেবিলের উপরের তলটা হচ্ছে ঝর্ণার উৎপত্তিস্থল। সেখানেই নদীর পাশে  তাঁবু খাটিয়ে শুয়ে আছি হঠাৎ দেখি সুভা ঘেউ ঘেউ আওয়াজ করে দৌড় দিল।  আমিও তাকে অনুসরণ করলাম, দেখলাম সে পাহাড়ি নদীর জলে অর্ধডুবন্ত অবস্থায় মৃত্যুগামি এক ইঁদুরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে ঘেউ ঘেউ আওয়াজে। সেই ইঁদুরটি ধীরে ধীরে ঝর্নার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজের প্রাণ রক্ষার, কিন্তু সে প্রতিমুহূর্তে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে। ইঁদুরটি যে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে সেই অবস্থায় একটা মানুষ থাকলেও তার বাঁচা বড় সন্দেহ। সাঁতার জানলেও যদি জলের স্রোত একটু বেশি হয় তাহলে মৃত্যু ছাড়া উপায় নেই। হঠাৎ দেখি সুভা কোথায় চলে গেল।
      নিজের চোখের সামনে একটা জীবন্ত অবলা প্রাণীকে মরতে দেখে নিজেকে বড় পাপী মনে হচ্ছে। আহারে,কতস্থানে, কতরকমভাবে, কতইনা জীবের মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু জানিনা এটাকে দেখে একটু দুঃখ বোধ হল। ঠিক যেমন খাঁচায় বন্দী অভুক্ত বাঘের সামনে একরাশ মাংস যদি রাখা হয়, না না, ভিতরে নয় খাঁচার বাইরে। তখন বাঘটার ঠিক যে রকম লাগে, এই পরিস্থিতিতে আমারো সেইরকমই লাগছে। আমি কিছুই করতে পারছি না, কেননা আমি নদীর এপারে আছি। আর ইঁদুরটা আমার থেকে বহু দূরে আছে। আর সুভা আছে নদীর ওপারে। ওপার থেকে ইঁদুরটির দূরত্ব হাত পাঁচেক তো বটেই।
      সুভা ঝুলন্ত একটি গাছের ডালের ওপর লাফ দিয়ে নদীর ওপারে পৌঁছেছিল। কিন্তু আমার পক্ষে ওপারে পৌঁছানোটা খুবই দুঃসাধ্য, হয়তো ওপারে যেতে গিয়ে অন্যকে বাঁচানো তো দূরের কথা নিজের পৈতৃক জীবন না যেন আবার হারাতে হয়। হয়তো দেখা যাবে নিজেই ডুবে মরে যাচ্ছি। অমনি কোথা থেকে সুভা একটা গাছের ভাঙা ডাল মুখে করে নিয়ে আসলো, আর সেই ডালটি বাড়িয়ে দিল মৃত্যুগামি ইঁদুরটির দিকে। ইঁদুরটি অনায়াসে ডালটি ধরে নিজের প্রাণ রক্ষা করল। সেই দিন সুভা কে দেখে আমার গর্ব হয়েছিল, মনে হয়েছিল সুভার মতন এক সঙ্গী পেয়ে আমি সত্যিই ধন্য।
      একদিন আমার এক আত্মীয়ের পথদুর্ঘটনার দরুন আমাকে মহকুমা হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। পথদুর্ঘটনা বলতে বাসের সাথে লরির ধাক্কায় বাসের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গিয়েছিল, বাসটার এমনই জখম অবস্থা হয়েছিল যে তাতে আহত তো দূরের কথা নিহতই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমার এই আত্মীয় আর একজন যুবক ব্যক্তি সৌভাগ্যবশত প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। বাকিদের বহু চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। হঠাৎ কোথা থেকে একটা গুলির আওয়াজ তারই সাথে এক মহিলার আর্তনাদ শোনা গেল। চারিদিকে কোলাহল বেড়ে গেল আর গুলির আওয়াজও বেড়েই চলল, সাথে চিৎকার-চেঁচামেচিতে চারিদিকে হুলুস্থুল কান্ড বেঁধে গেল। বুকের হৃদপিন্ডের গতি অজান্তেই বেড়ে গেল। ভয়ে শরীর যেন ভূমিকম্পের ন্যায় কম্পিত হতে থাকলো। কী করি? কী করি? কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না। ঘটছে টা কী? আর আর কেনই বা হচ্ছে? কিছুই বুঝতে পারছিনা। শুধু এটা বুঝতে পারছি যে কোন বিপদের আবির্ভাব হয়েছে। হঠাৎ কোথা থেকে কে যেন বললー"এই হসপিটালটিতে জঙ্গিরা আক্রমণ করেছে। পালাও পালাও।" হঠাৎ এক অজানা আতঙ্ক আমায় পেয়ে বসলো। অজানা নয় জানা আতঙ্ক, কেননা তাদের উদ্দেশ্য মানুষকে হত্যা করা অর্থ ও স্বার্থের বশে।
      তা এখন কী করি? কোথায় যাই? কোথায় যাই? প্রাণ ভয়ে ছুটতে থাকলাম বেডে শোয়া সেই আত্মীয়টিকে নিয়ে  সুরক্ষিত স্থানের প্রত্যাশাই। বেড থেকে তুললেই  আত্মীয়টি আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর এই পরিস্থিতিতে চাগিয়ে চাগিয়ে দূত নিয়ে যাওয়াও যাবেনা, তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই বেড সমেত ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে হচ্ছে। সুভা আমার পিছন  পিছন  ছুটতে থাকলো। বাইরে বেরোতেও পারছিনা কেননা জঙ্গীরা নাকি নীচের দিকে আক্রমণ করেছে তাই নীচের দিকে তাদের সংখ্যা সর্বাধিক। সবাই উপরের দিকে প্রাণ রক্ষার তাগিদে ছুটে চলেছে, আমরাও তাদেরকে অনুসরণ করলাম।
      সত্যিই মানুষের অনিষ্ট ছাড়া তাদের কোন কর্ম নেই, তারা মৃত্যুকেও ভয় পেতে নারাজ। যে যেদিক পারে দিকবিদিক শূন্য হয়ে ছুটে চলেছে। কিন্তু কী করি? উপরের ফ্লোরে উঠতে গেলে তো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়, কিন্তু এই অসুস্থ আত্মীয়টিকে বেড সমেত ওপরে নিয়ে যাওয়াও খুবই দুঃসাধ্য। তাহলে কী করি এখন? কী করি? বেড ত্যাগ করে তাকে চাগিয়েই নিয়ে যেতে হবে? হ্যাঁ এটাই একমাত্র উপায়। কিন্তু এতে তো রোগীর স্বাস্থ্যের অসুবিধা বাড়বে বৈকি কমবে না। কিন্তু তবুও রোগীটির  প্রাণে বাঁচার আশা পাওয়া যেতে পারে তো?  তা কী আর করি? স্বাস্থ্যের কথা বস্তায় পুরে বাধ্য হয়েই তাকে কাঁধের ওপর ভর করে, বহুকষ্টে উপরের ফ্লোরে নিয়ে আসলাম এবং একটা ঘরে বহু  জনের সাথে আমরা আশ্রয় নিলাম এবং নিঃশব্দে যেন মৃত্যু থেকে বাঁচার অপেক্ষায় থাকলাম।    
      গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে অনেকটাই আস্তে, দূর থেকে আসছে সে আওয়াজ। হঠাৎই কাছাকাছি কোথাও  গুলির আওয়াজ শোনা গেল আর গুলিবর্ষণের আওয়াজও যেন ক্রমে বেড়েই চলল।
      আমরা যে রুমে আছি সেই রুমে একটা মা তার শিশুকে হারানোর জন্য নীরবে কাঁদতে থাকলো। সেই সময় বাইরে থেকে ভেসে আসলো এক ভয়ার্ত গলায় "মা" আওয়াজ। ওমনি ভেতরে থাকা মা-টির মনে আশার আলো জেগে উঠলো। তিনি বলে উঠলেনー"আমার বাবু" বলে বাইরে বেরোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলেন, কিন্তু অনেকেই তাকে বাধা দিলেন, কেননা উনি যদি ওই স্থান থেকে বেরিয়ে যান তাহলে তার পুত্রের প্রাণ বাঁচানো তো দূরের কথা নিজের প্রাণ বাঁচানোও সন্দেহ। কিন্তু পুত্র হারানোর শোক কি মা সহ্য করতে পারে? তার মন ব্যাকুল হয়ে থাকে পুত্রকে কাছে পাওয়ার আশায়। তো কী আর করা যায় আমাকেই বেরিয়ে আসতে হল। কেননা আমার মনুষ্যত্বে আঘাত লাগলো। আমি তো আর চোখের সামনে তাকে মরতে দিতে পারিনা।  কোন মায়ের দুঃখ আমার সহ্য হয় না,  মায়ের কষ্ট আমি দেখতে পারিনা। খুবই দুঃখ হয় সাহায্য করতে না পারলে, যেন কেউ বুকের ওপর দূর্মুস পিটতে থাকে। অনেকেই বাইরে বেরোতে বারণ করেছিল, কিন্তু কে শোনে তাদের বারণ। নিজের জীবনের চেয়ে ওই বাচ্চা শিশুটির জীবন অনেক মূল্যবান। এমনিতেই বাঁচবো আর কতদিন কিন্তু ওই বাচ্চা শিশুটির তো এখন জীবনের শুরু। তাকে মরতে দেওয়া যায় না। সে আপনজন হোক বা নাই হোক না  কেন,  একজন মানব শিশু তো? 
        আমি বাইরে বেরিয়ে শিশুটিকে খুঁজতে থাকলাম। দেখলাম সে তার মাকে ভয়ার্ত গলায় ডাকছে। ー"মা মা মা তুমি কোথায়? আমার খুব ভয় করছে, কোথায় তুমি? মা ওমা মা, মা মা..." উন্মত্তের মতন আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম বললামー" ভয় পেয় না। চলো তোমার মায়ের কাছে, চলো। আমি তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি, চলো।" তাকে নিয়ে আমি এগোতে থাকলাম সেই রুমটির দিকে, যেখান থেকে আমি বেরিয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি সামনে একজন আতঙ্কবাদী বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার দিকে তাক করে। মুহূর্তের মধ্যে বন্দুক গর্জে উঠলো। আমি আর নেই ........ আরে আমি তো বেঁচে আছি, তা কী হল? বন্দুক গর্জে ওঠার মুহুর্তের মধ্যে আমার সুভা আমাকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বন্দুকের গুলির সামনে। সেই সুভা যাকে আমি ল্যাম্পপোস্টের নীচে আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। সেই সুভা যাকে স্বার্থের কথা ভেবে মরতে দিতে চেয়েছিলাম। সে কিনা আজ আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য গুলিবিদ্ধ হলো। আমি সত্যিই অবাক হলাম যাকে কিনা আমি আপন স্বার্থপরতার দরুন ফেলে রেখে আসতে চেয়েছিলাম সেই ল্যাম্পপোস্টের নীচে, ওমনি আহত অবস্থায়। সে যেন আমায় এক নতুন জীবন দিল।
      সুভা সেই গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেও আবারও ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই আতঙ্কবাদীর উপর। অমনি আতঙ্কবাদীর হাত থেকে বন্দুকটা পড়ে গেল। আমি ছুটে গিয়ে বন্দুকটিকে তার নাগালের থেকে বহুদূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আপনারা হয়তো ভাবছেন বন্ধুকটি হাতে পেয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া,
কী বোকা রে বাবা, হ্যঁউ। না না, বন্দুক চালিয়েছিলাম, কিন্তু বন্ধুকে আর গুলি ছিল না। যেন পরিশ্রমটা বৃথা হল।
      তারপরই সুভার সঙ্গে আতঙ্কবাদীটির ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল, হঠাৎই আতঙ্কবাদীটির হাতে আবির্ভাব হলো একটা ধারালো অস্ত্র, যা সে নিষ্ঠুরভাবে সুভার পেটে বসিয়ে দিল।
       সুভার বেদনাদায়ক আর্তনাদে আমার বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। তখন ক্রোধে আমার এমনই অবস্থা যেন জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, যেকোনো সময় অগ্নুৎপাত ঘটে যেতে পারে। কিন্তু কোন কিছু করার উপায় ছিল না, কেননা আতঙ্কবাদীটির সারা শরীরে টাইমবোমা ফিট করা ছিল। আতঙ্কবাদীটি বলে উঠলো আর 10 সেকেন্ডের মধ্যে সবকিছু ধ্বংসে ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। এই বলে সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল "হা হা হা হা হা.."। তার এমনই অট্টহাসি যেন আকাশের বজ্রপাতকেউ হার মানাবে।
      সেই সময় নীচে  থেকে মেলেটারি পুলিশরা উঠে এল। নীচের পরিস্থিতি কন্ট্রোলে আছে, কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য কেইবা রাজি ছিল। তাদের কিছু করার ছিলনা শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা ছাড়া। এই দশ সেকেন্ডের মধ্যে কী বা করা যেতে পারে। বোমাকে থামানো? গুলি করে জঙ্গি টিকে মেরে ওর শরীরে লাগানো বোমাটাকে বিনষ্ট করা? আর যদি বৃথা চেষ্টা হয়, তবুও চেষ্টা করতে কী আছে? কিন্তু কে করবে এই চেষ্টা?
      এই মৃত্যুর মুখে দাড়িয়েও কি স্বার্থের কথা ভাবা? যে যত দূরে চলে যেতে পারে ওখান থেকে চলে যাচ্ছে স্বার্থের কথা ভেবে। কিন্তু এই 10 সেকেন্ডে যাবে পালিয়ে কোথায়। মৃত্যু গ্রাস করল বলেই।  হঠাৎই সেই সময় একটা ঘটনা ঘটে গেল যা আমি কখনোই ভুলতে পারবো না। স্মৃতির মধ্যে যেন এই দৃশ্যের ঘটনা খোদাই করে লেখা হয়ে গেল। মুছবেনা আর কোন দিন। 
      মুহূর্তের মধ্যে যেন সুভা আবারও প্রাণবন্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই আতঙ্কবাদীরটির উপর। আর সেটাই ছিল আমার দেখা তার শেষ ঝাঁপ।  তার ঝাঁপে টাল সামলাতে না পেরে আতঙ্কবাদীটি তাকে নিয়ে পড়ে গেল ভাঙা কাঁচের জানালা থেকে একেবারে নীচে ঝিলের মধ্যে। গভীর ঝিল, যা একেবারে হসপিটালের পাশে একটু দূরত্বে  নীচের দিকে অবস্থিত। হসপিটালটা পাহাড়ের গায়ে অনেকটাই উঁচুতে অবস্থিত আর ঝিলটা পাহাড়ের গা থেকে ভালোই নীচে। অমনি জলোচ্ছ্বাসের সাথে একটা তীব্র আওয়াজে স্থির হয়ে গেল হৃদস্পন্দন কয়েক মুহুর্তের জন্য। ভূমিকম্পের সহিত কেঁপে উঠল সমস্ত শরীর।
      অজান্তেই যেন চোখ থেকে জলবিন্দু গড়িয়ে পড়ল। তাকে হারানোর শোক যে কীরকম তা আপনাকে বলে বোঝাতে পারবোনা। সে কি শুধুই  আমার প্রাণ রক্ষা করেছে? এই হাসপাতালে থাকা কয়েক হাজার জীবন কেউ রক্ষা করেছে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে।
      সে শুধুই অমর থাকবে না আমার মনে, থাকবে এই বিশ্ব জীবকুলেরও মনে। যেন সে মানবজাতির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইছে নিঃস্বার্থের প্রকৃত দৃষ্টান্ত! হ্যঁউ।
      স্বার্থের কথা ভেবে আমি যে তার সাহায্য করতে দ্বিধা করেছিলাম, কিন্তু সে আজ নিজের স্বার্থ ধ্বংস করে একাধিক মানুষের স্বার্থ রক্ষা করল, নির্বিশেষে। সে আজ মরেও না মরে থাকিলো মোর মনওপ্রাণে। তার ভাবনা আজও মনে উদ্ভাসিত হয়ে দুঃখ পাইয়ে দেয়। সত্যিই তার ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না। ধন্য তুমি ধন্য হে জীব, ধন্য তুমি ধন্য।
      আমি এখন বেশি মাইনের উঁচু পোস্টে কাজ করি, আর একটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি, যে সেই ঘটনাস্থলে সিসিটিভি ক্যামেরায় সেই ঘটনার সমস্ত দৃশ্য রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল যা সারা বিশ্বজগতের কাছে ভাইরাল হয়ে গেছে। আর সেই জন্যই সুভার মালিক হিসেবে আমি এই  উঁচু পোস্টের চাকরি, বাংলো, গাড়ি কত কী যে পেয়েছি। এমনকী অনেক সম্মান অনেক পুরস্কারও পেয়েছি। কিন্তু এইসব গুলো যেন তুচ্ছ সুভার থেকে। তার সেই মনোমুগ্ধকরা আওয়াজ, প্রানতৃপ্তি খেলাধুলা, লেজ নাড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ, চোখের মধ্যে সেই আনন্দের আভাস আজ মিস করি।  
      কাজের ছুটিতে একসময় যায় সেই স্থানে, যেখানে আমি প্রথম সুভাকে দেখেছিলাম, দেখি সেই নীরবতা মাখা শীতল রাত্রির মতন আজও শীতের প্রকোপে আহত অবস্থায় পড়ে আছে কাঁপতে থাকা একটা বাচ্চা কুকুর। সেই মিটমিট করে জ্বলা ল্যাম্পপোস্টের নীচে। তাকে কোলে তুলে নিলাম, যেন সেই অন্ধকারে পড়ে থাকা সুভা, আবারও  জন্ম নিল অন্ধকারে।
  
                                 _________

                 Wʀɪᴛᴇʀ✍︎     : 𝓡𝓸𝓬𝓴𝔂 𝓚𝓪𝔃𝓲

©rockykazi


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime