তিন কন্যা
তিন কন্যা
- রহিম চাচা, ওখানটায় অত ভিড় কেন গো?
- ওই যে তিস্তা মা, তোর্সা মা, মহানন্দা মা আছে, ওগুলাকে সরকার থেকে লোক এসে লিয়ে যাচ্ছে গো।
- বল কি গো! ওগুলোকে নিয়ে কি করবে সরকার?
- কি সব বোঝালো ওরা। আমি মুখ্যু মানুষ, বুঝিনি অত কিসু। গোপাল মাস্টার কথা কইছে। আল্লাহ্ই জানে কি হবে।
- সেকি!
- গোপাল মাস্টারই ভরসা গো বাবু।
আমি যখন এই এলাকায় আসি, আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে তখনও এখানে তেমন জনবসতি ছিল না। অতঃপর ধীরে ধীরে একে একে পরিবার এখানে আসতে থাকে। অদ্ভুতভাবে এলাকার সবাই একটা পরিবারের মত হয়ে উঠতে থাকে। কারোর বিপদে নিজের সব কাজ ফেলে যেমন সবাই ছুটে যায় তেমনই কোনো উৎসবে একসাথে হাসি আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে সবাই।
যখন এই এলাকায় এসেছি তখন থেকেই দেখি রেলগাড়ির তিনটে কামরা পরিত্যক্ত অবস্থায় রেললাইনের পাশে রাখা। জিজ্ঞেস করে যা জেনেছি বছর পঁচিশ আগে এক ট্রেন রেললাইনচ্যুত হয়ে গেছিল কোনো কারণে। তারপর থেকে ওই তিনটে কামরার অবস্থান ওখানেই। তখন কী আর জানতাম আমাদের এলাকার স্কুলটায় গোপাল মাস্টার আসবেন আর এই রেলগাড়ির কামরা নবরূপে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা হয়ে সেজে উঠবে!
- শান্তনুদা!
পেছন ফিরে দেখলাম তিতলি ডাকছে। গত বছর তিতলি বিয়ে করেছে। তারপর থেকে তিতলির দেখা খুবই কম মেলে। পুজো-পার্বণ ছাড়া আমার সাথে দেখা হয়ই নি।
- তিতলি, কিরে! অনেকদিন পর!
- হ্যাঁ গো, শান্তনুদা, কিসব শুনছি, আমাদের তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দাকে নিয়ে কি হয়েছে?
- আমিও শুনলাম। ওখানেই যাচ্ছি রে। তুই কবে এলি?
- এই তো সকালে। বাবা বলল সরকার থেকে নাকি লোক এসছে, তাই তো ছুট্টে ছুট্টে চলে এলাম।
- সেকিরে? তোর অফিস?
- তিস্তারা বিপদে পড়েছে আর আমি অফিস যাব। বলো কি গো! আমি এগোলাম।
তিতলি আমায় পাশ কাটিয়ে দৌড়ে দৌড়ে এগিয়ে গেল। গোপাল মাস্টার একটা টিম বানিয়েছিলেন আসলে রেলগাড়ির কামরাগুলোকে রেলগাড়ির কামরা থেকে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দার রূপ দেবার জন্য। সেই টিমের মেম্বার ছিল তো তিতলি! তাই এতটা ব্যাকুল হয়ে পড়েছে।
সাত আট বছর আগে গোপাল মাস্টার আমাদের এই এলাকায় আসেন। শুধু বই খাতা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াবেন এমন মানুষ যে তিনি নন তা প্রথম দিন থেকেই তিনি বুঝিয়েছেন। এলাকার জঞ্জাল পরিষ্কার থেকে বৃক্ষরোপণ একাধারে সব কিছু একে একে তিনি করিয়েছেন তার ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে। না, না, তা বলে কিন্তু এরকম কোনো ব্যাপার ছিল না যে ছাত্রছাত্রীরা মুখ গোমড়া করে সেইসব অভিযানে অংশ নিয়েছিল, বরং অত্যন্ত আনন্দ সহকারে সেসব অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল তারা। ধীরে ধীরে শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, এলাকার লোকজনও যোগ দিল এসব অভিযানে। ফলত অভিযানের সংখ্যা বাড়তে লাগল ক্রমাগত।
সেরকমই এক অভিযান ছিল পরিত্যক্ত রেলগাড়ির কামরাগুলোর রূপ পরিবর্তন করে সেগুলোকে কোনো কাজে লাগানো। এলাকাবাসীর উৎসাহে খুবই দ্রুত নতুন সাজে সেজে উঠল তারা। রঙিন ঝলমলে সেসব কামরা দেখে কে বলবে যুগ যুগ ধরে এখানে লোকে সাপের ভয়ে আসতই না কেউ। সেজে তো উঠলো তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা। এবার কি করণীয়!
মিটিং হল, অনেক প্ল্যান প্রোগ্রাম হল। শেষমেষ ঠিক হল তিস্তার ভেতর একটা অংশ সবজি বাজার বসবে আর একটা অংশ মাছের বাজার বসবে। প্রতিদিন বাজার শেষে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবার জন্য লোকও নিযুক্ত হল। রমরমিয়ে বাজার শুরু হল তিস্তার ভিতর।
বাহ রে! তোর্সা আর মহানন্দা তিস্তার প্রতি জনসাধারণের ভালোবাসা দেখে কি আর ভালো থাকতে পারে নাকি? তাদেরকেও তো কিছু দায়িত্ব দিতে হবে। অতঃপর তোর্সার ভিতর তৈরি হল বাচ্ছাদের ইনডোর গেম শেখার জায়গা। ক্যারাম, টেবিল টেনিস, দাবা আরো হরেক রকমের খেলা। বিকেলে ট্রেনার আসে শেখাবার জন্য। বিকেল সন্ধ্যে নানান ক্লাস চলে। তারপর রাত্রিবেলা বড়রা অফিস থেকে ফিরে ওখানেই একটু সময় কাটায়। গল্পও হয়, সঙ্গে ক্যারাম, টেবিল টেনিসও চলে।
তোর্সাও দায়িত্ব পেয়ে গেল। পড়ে রইল মহানন্দা। মহানন্দারও তিস্তার মত দুটো ভাগ হল। এক ভাগে শিবলিঙ্গ বসিয়ে শিব পুজো শুরু হল, আর অন্য ভাগটা নামাজ পড়বার জন্য নিয়োগ করা হল।
রমরমিয়ে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দার প্রতি লোকজনের ভালোবাসা বাড়তে থাকল। পুজো, রথ, ঈদ, বড়দিন, নববর্ষ এই সব উৎসবে সেই তিন বোন আলোর মালা পরে সেজে ওঠে প্রতি বছর। গত ছয় সাত বছরে আমাদের জীবনযাত্রার সাথে কিভাবে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল ওরা বুঝতেই পারলাম না।
ওই তো গোপাল মাস্টার! দেখি, জিজ্ঞেস করি।
- স্যার!
- হ্যাঁ গো শান্তনু বল।
- বাঁচানো গেল?
- দেখ, সরকারের জিনিস! আজকের মত আপাতত ফিরে গেছে ওরা। জানিনা কতদিন আটকাতে পারব।
- ওদের বুঝিয়ে বললে হয় না?
- লিগাল কাগজপত্রের সামনে ইমোশানের কোনো দাম নেই গো শান্তনু।
- উপায়?
- জানি না শান্তনু, মাথা কাজ করছে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গোপাল মাস্টার। চোখেমুখে অসহায়তা, হতাশার ছাপ স্পষ্ট। নিজের অজান্তে আমার মনটাও যে কখন ভারী হয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি। তোর্সার ভিতর উঠে একটা টেবিল টেনিস বোর্ডকে পেছনে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। পাঁচশো, ছ'শো লোক নিজেদের কাজকর্ম বিসর্জন দিয়ে জড়ো হয়েছে এখানে আজ নিঃস্বার্থভাবে। হরি কাকা বলত "ও তিন তো হামাদের বেটি আছে"। তখন হরিকাকার কথাটা এত সুন্দর ভাবে বুঝিনি, কিন্তু আজ বুঝতে পারছি নিজেদের মেয়ে বলেই কারোর পা আজ আর এখান থেকে সরছে না।
"গোপাল মাস্টার বলছিল লিগাল পেপারের কথা। কি করতে পারবে সরকারের লোক যদি আমরা সবাই এভাবে মধ্যে উঠে বসে থাকি!", "কিস্যু করতে পারবে না" এরকম হাজারো শব্দ কানে ভেসে আসছে নানান দিক থেকে অনবরত। জাতি নিয়ে বিভেদ, ধর্ম নিয়ে বিভেদ, ওসব তো এই এলাকায় এমনিই বইয়ের শব্দ কিংবা সিনেমার দৃশ্য ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু আরো একবার প্রমাণটুকু পাওয়া যাচ্ছে আজ আমাদের তিন মেয়ের বিপদের দিনে।
গোপাল মাস্টার খুব ধীর পদক্ষেপে এদিকে এগিয়ে এসে বললেন
- ওনারা ফোন করেছিলেন সরকার থেকে। কাল সকালে আবার আসবে বলেছে। আজ আর এখানে থেকে তবে কী হবে! কাল সকালে আবার মিট করা যাবে।
নবি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ও বলল
- স্যার। ওসব লোককে বিশ্বাস নেই। তারপর দেখব কাল বলে আজই এসে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি এখানেই আছি।
আজ আর কেউ আর এখান থেকে এক পাও নড়বে না ভালো মতোই বুঝতে পারছি। আমার নিজের খুব গর্ব হচ্ছে আমাদের এলাকার মানুষগুলোর জন্য। বিভেদ, বিভাজনের এই পৃথিবীতে আজও কিরকম আমরা এক জোট হয়ে রয়েছি। গোপাল মাস্টার আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। চোখেমুখে হতাশার ছাপ থাকলেও সেই হাসিতে একটুকরো গর্বই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হেসে বললাম
- চিন্তা করবেন না স্যার। তিস্তারা এখানেই থাকবে। কত বাবা মা দেখুন তো চারিদিকে। কার সাধ্যি আছে ওদের নিয়ে যাবে।
ধীরে ধীরে সূর্য ডুবল, সন্ধ্যা নামল। টুকটাক পালা করে খেতে যাওয়া ছাড়া বাকি রাতটুকু সবাই এখানেই কাটালাম। দেখতে দেখতে পরদিন সকালও চলে এল। এত লোক একসাথে আছি, কথাবার্তা গল্পগুজবে কিভাবে যে চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেল তা টেরই পাইনি।
কথামতই সরকার থেকে লোকজন এলো সকাল ন'টা নাগাদ। তবে আজ আর সেরকম গম্ভীর পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, বরং ওনাদের আবির্ভাবে আমরা হতচকিত হলাম। ওনারা এলেন, মুখে হাসি, হাতে ফুলের তোড়া। এসেই গোপাল মাস্টারের সাথে হ্যান্ডশেক করে ফুলের তোড়াটি তুলে দিলেন গোপাল মাস্টারের হাতে।
- সরি, আমরা কালকের জন্য খুবই দুঃখিত। আমরা কাল গিয়ে আমাদের ম্যানেজারদের সাথে ডিসকাস করেছি। ওনারা খুব খুশি আপনাদের এরকম উদ্যোগে। শিগগির ওনারাও আসবেন। ইউ গাইস রিয়েলি ডু এন আউৎস্ট্যান্ডিং জব। দিজ আউট অফ বাউন্ড ইনিশিয়েটিভ ইজ এপ্রিসিয়েবল।
মুহূর্তে গম্ভীর চিন্তাচ্ছন্ন মুখগুলো উল্লাসে ফেটে পড়ল। আলিঙ্গন, জয়োল্লাসে যেন হঠাৎ করেই এলাকায় অকাল উৎসব কোনো।
- থ্যাংক ইউ স্যার।
গোপাল মাস্টারের মুখেও যেন হঠাৎ করেই কালো মেঘ সরে গিয়ে অনাবিল হাসির ঝিলিক। এক মুহূর্তে সব কিছু এমন ভাবে বদলে যাবে বুঝিই নি কেউ।
- উই হ্যাভ এনাদার নিউজ টু গিভ ইউ। নেক্সট টু নেক্সট উইকে মিনিস্টার আসবেন আপনাদের এই অভিনব উদ্যোগ দেখতে। তার জন্য আমরা ট্রেন বগিগুলোকে আরো সুন্দর ভাবে সাজাতে চাই। বাইরে থেকে প্রফেশনাল পেইন্টার আসবে কাল। ওরা রং করে যাবে। ওকে? চারপাশটা একটু কমার্শিয়ালাইজ করব। একটা সুন্দর দেখে গেট বসবে পার্মানেন্টলি। আপনাদের এলাকার জৌলুস কিরকম বেড়ে যাবে দেখবেন। বাইরে থেকে কত লোক আসবেন..
- স্যার।
ওনাদের থামালেন গোপাল মাস্টার। হাতদুটো জড়ো করে বললেন
- স্যার, আমরা কিছু চাইনা। আমাদের একটু আমাদের মত থাকতে দেবেন?
সত্যিই আমরা কিছু চাইনা। আমরা ভালোও থাকতে চাইনা, খারাপও থাকতে চাই না। আমরা একটু আমাদের মতন থাকতে চাই আমাদের তিন কন্যার সাথে।