সুবোধের সাধু হওয়া
সুবোধের সাধু হওয়া
আজ সকাল থেকে বাড়িতে হৈ চৈ শুরু হয়েছে । মায়ের চিৎকারে সুবোধের খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে গেছে । কারণ পাশের বাড়িতে এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ।সম্পর্কে লাল্টুর কাকা । সুবোধদের পাশের বাড়িটা লাল্টুদের বাড়ি । লাল্টুর দাদু আর সুবোধের দাদু পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু ছিলেন । দুজনে একই জায়গায় জমি কিনে বাড়ি বানিয়েছিলেন ।
লাল্টুর কাকা অনেকদিন হলো সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়েছেন ।তবু মাঝে মাঝে লাল্টুদের সংসারে আবির্ভূত হোন । সুবোধের মায়ের এই ব্যাপারে খুবই উৎসাহ । উনি নাকি সোজা হিমালয় থেকে আসেন । তবে সুবোধ যতদূর জানে ওনার এখানে কোথাও একটা আশ্রম আছে ।
সুবোধের ছোট বেলা থেকেই সন্ন্যাসী জীবনের প্রতি আকর্ষণ আছে ।ওই ঘুরে বেড়ানো আর ভালো খাওয়া আর সবার সন্মান প্রদর্শন ওকে খুবই আকর্ষিত করে ।এখন ভালোই বুঝতে পারছে রোজগার করা খুবই কঠিন কাজ। সন্যাসী হওয়াটা অনেক সোজা ।
কিন্তু মা বলে সন্ন্যাসী হওয়া অত সোজা নয় । অনেক ত্যাগ , ধ্যান আর পরিশ্রমের পরেই সত্যিকারের সন্ন্যাসী হওয়া যায় ।
সুবোধ অনেকসময় ধ্যান করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হতে পারেনি ।দু তিন মিনিটের মধ্যেই দম বন্ধ হয়ে যায় ।যাই হোক মনে ঠিক করে ফেলেছে ওকে সন্ন্যাসী হতেই হবে । বাবার জন্যই ভয় হয় । বাবার এইসবে একদমই বিশ্বাস নেই ।
গতকাল মাকে বলছিলো - ধীরাজের সন্ন্যাসী ভাইটা আবার হাজির হয়েছে ।মনে হয় টাকা পয়সার ভাগ নিতে এসেছে ।
সুবোধের মা মাথায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল - কি যাতা বলছো? সন্ন্যাসী মানুষ ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেছেন ।
- ঘুরতে ঘুরতে ঠিক বাড়ি চিনে পৌঁছে গেলো । সন্ন্যাসী মানুষ তো মাঠে ঘটে , পাহাড়ে , জঙ্গলে থাকবে । আর কি খাওয়ার বহর । ওদের মাসের খরচ তো সাত দিনেই বেরিয়ে যাবে ।
- তোমার কি ভক্তি ভয় কিছুই নেই ? ওনারা অন্তর্যামী হন । সব বুঝতে পারেন ।
-আসল সাধু হলে তো বুঝতে পারবে? ওকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি । এক নম্বরের ফেরেব্বাজ ।
মা মাথায় হাত ঠেকাতে ঠেকাতে ঠাকুর ঘরের দিকে চলে গেলো।
সুবোধের সাধু হওয়ার ইচ্ছেটা তবু মন থেকে যায় না । সাধু হলে বিনা বাধায় ঘুরে বেড়ানো আর নানা রকম খাওয়া দাওয়া ওকে খুবই আকর্ষিত করে । এখন যা চাকরির অবস্থা তাতে কিছু যে জুটবে মনে হয় না । আর বাবার ব্যবসার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয় । অনেক ভেবেচিন্তে দেখেছে সন্ন্যাসী হয়ে যাওটাই সবচাইতে ভালো ।
দুপুরে খেতে বসে একবার কথাটা পেড়েছিল।
- মা আমি যদি সন্ন্যাসী হয়ে যাই কিরকম হবে ।
মা কিছু বলার আগেই বাবা বলে উঠলো - এই বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে আর যেখানে দেখবো সেখানে জুতো পেটা করবো ।
একি কথা - মা চেঁচিয়ে উঠলো । ছেলেটা আমার কত ভক্তি ভোরে কথা বলছে।ছোটবেলা থেকে দেখেছি ওর ঠাকুর দেবতার প্রতি অগাধ ভক্তি । কিন্তু তোকে আমি সাধু হতে দেব না বাবা । তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না ।
বাবা বলে উঠলো - কোনো ভক্তিটক্তি নয় । ওর চিরকালই ফ্রি তে থাকা খাওয়ার ইচ্ছে । তোমায় আমি সোজা বলে দিচ্ছি - সুবোধের দিকে তাকিয়ে বললো - রোজগারের চেষ্টা করো নাহলে ফ্রিতে খাওয়া আমি বন্ধ করে দেব।
বাবার কথা শুনে সাধু হওয়ার ইচ্ছেটা অনেকখানি কমে গেলো ।
২
সুবোধ একদিন সাধু বাবার সাথে বেরিয়ে পড়লো তার আশ্রমের উদ্দেশে । সাধু বাবার শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে । লাল্টুর সাহায্যে উদ্দেশ্য সাধন হয়েছে।
ঘরে ঢুকেই সাধুবাবার পা জড়িয়ে ধরেছিলো - বাবা আমাকে আপনার শিষ্য করে নিন । যা বলবেন তাই করবো ।
- তুই কে রে ? সাধুবাবা চিৎকার করে উঠলো ।
- আমি লালটুর বন্ধু ।
- ও শয়তানটা আমার ধ্যানের সময় তোকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে । ওঃ আমাকে তাড়াতাড়ি আশ্রমেই ফিরে যেতে হবে দেখছি।
- বাবা আমাকে আপনার শিষ্য করে নিতেই হবে ।
সাধুবাবা বলেছিলো - সাধু হওয়া কি হাতের মোয়া । অনেক কৃচ্যসাধন করতে হয় ।
চারপাশের ফলমূল , দুধ আর হরেকরকম খাওয়ার সরঞ্জাম দেখে মনটা আরো উচাটন হয়ে উঠলো সাধু হওয়ার জন্য । সাধু বাবার পা জড়িয়ে ধরে বললো আমাকে আপনার শিষ্য করতেই হবে বাবা। আমার এই সংসারের প্রতি মন উঠে গেছে ।
'সংসারের তুই কি দেখলি যে মন উঠে গেলো । এখনো অনেককিছু দেখার বাকি আছে ।' সাধুবাবা বলতে লাগলো ' বিয়ে করার পরেই তো সংসারের আসল রূপ দেখবি ।
সুবোধ বললো - না বাবা আমি এই অবস্থা থেকেই মুক্তি চাই ।
সাধুবাবা মনে মনে হেসেছিলো । খুশির হাসি। সুবোধের বাবাকে এইবার টাইট দেওয়া যাবে। ছোটবেলা থেকেই সুবোধের বাবার সাথে সাধুবাবার একটা শত্রুতা আছে। সবাই ওকে মান্নীগণনি করলেও সুবোধের বাবা খুবই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। আর সবার সামনে ছোটবেলার ডাকনাম পচা বলে ডাকে। কখনো বলে ওঠে পচা সাধুটা আবার হাজির হয়েছে !
অনেক সাধ্যসাধনার পর সাধু বাবার সাথে আশ্রমে এসে
পৌঁছলো । আশ্রমের পরিবেশটি বড়োই মনোরম । সুবোধের মন বসে গেলো ।মনের ভেতরে একটা স্বাধীনতা অনুভব করলো ।মনের ভেতরে একটা স্বাধীনতা অনুভব করলো । শুধু মায়ের জন্য মনটা খারাপ লাগছে । মা এখন খুবই কান্নাকাটি করছে আর বাবা চিৎকার করছে ।
সুবোধকে কিছু কাজের দায়িত্ত দেওয়া হয়েছে ।নির্দিষ্ট দায়িত্ত পালন করতে লাগলো । সন্ধ্যের সময় সাধু বাবার পায়ের কাছে সুবোধের স্থান । সাধুবাবার সেবা করে এইটুকু অর্জন করেছে ।
সন্ধ্যের সময় নামকীর্তন হয় আর সাধুবাবার প্রবচন ও পরামর্শ নিতে বহু লোক আশ্রমে আসে।
একদিন এক মা তার মেয়েকে নিয়ে সাধুবাবার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল - বাবা অনেক চেষ্টা করেও আমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না।কিছু একটা উপায় করুন ।
-তোমার মেয়ের নাম কি ?
বনি বাবা ।
সুবোধ একদৃষ্টে মেয়েটাকে দেখতে লাগল ।
সাধুবাবা আড়চোখে সুবোধকে একবার দেখলো ।
সাধুবাবা বললো - বাহ্ খুব সুন্দর নাম তো । চিন্তা করো না । খুব তাড়াতাড়ি তোমার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে ।
- আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছি । জানি ফল পাবোই । বনি বাবাকে প্রণাম কর ।
- ঠিক আছে তোমরা কাল একবার এসো ।
রাত্রিবেলায় সুবোধের ডাক পড়লো সাধুবাবার ঘরে ।
- আয় বোস আমার কাছে ।
সুবোধ বাধ্য ছেলের মতো সাধুবাবার পায়ের কাছে বসলো ।
- শোন , আমি অনেক ভেবে দেখলাম সাধু হওয়া তোর পথ নয় । সংসারই তোর পথ । তোকে সংসারেই ফিরে যেতে হবে ।
- কি বলছেন বাবা ? আমি তো আপনার মতো সাধু হতে চাই । সংসারে আমার মন নেই ।আমার কি কিছু ভুল হয়েছে ?
- সংসারে মন যাতে বসে সেই ব্যাবস্থাই করে ফেলেছি । তোর বিয়ের ব্যবস্থা করেছি ।
সুবোধ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললো - কি বলছেন বিয়ে! বাবা তো পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে দেবে ।কোনো রোজগার নেই ।
- সে ব্যবস্থা আমি করছি । তোর বাবাকে বুঝিয়ে বলা যাবে। আর বনি মেয়েটি ভালো ।আর তোর বাবার অবস্থা এমন কিছু খারাপ নয় । বিয়ের পর রোজগারের চেষ্টা করবি । বিয়ের চাপে রোজগারের ইচ্ছা তোর বেড়ে যাবে ।
বনির কথা শুনে সুবোধের মনে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। বিয়ের ইচ্ছাটাও মনের মধ্যে উঁকি দিলো।
সাধুবাবা একটু গর্জে উঠে বললো - তোকে বিয়ে করতেই হবে । এটা আমার আদেশ ।
মনে মনে সাধুবাবা খুশি হলো, কারণ সুবোধের বাবার ওপর প্রতিশোধ নেওয়া গেলো । অনেক অপমান সইতে হয়েছে । বলে কিনা পচা সাধু। এবার দেখ কেমন লাগে।
৩
সুবোধ সারারাত ধরে ভাবতে লাগলো । একই বিপদে পড়লো । বাড়িতে ঢুকবে কেমন করে । আবার বনির মুখটা মনে করতে বিয়ের ইচ্ছাটাও মনের মধ্যে উসখুস করতে লাগলো ।
শেষপর্যন্ত সুবোধের বিয়ে হয়ে গেলো । সুবোধের কোনো বাধাই গ্রাহ্য হলো না ।
সুবোধ নতুন বৌ নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলো । বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করতে থাকল । বনি সুবোধের সেই যে হাত ধরেছে আর ছাড়ছে না। কলকাতার নানা কথা জিজ্ঞেস করতে থাকল । সুবোধ ও প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তর দিল । ভালোই লাগছিলো । কিন্তু বাড়ির কাছে এসে ভয়ের থেকে পেটে একটা মোচড় দিলো।
বাইরের দরজা খোলা ছিল । তাই বাড়িতে প্রবেশ করতে কোনো সমস্যা হলো না ।চুপি চুপি বাড়িতে ঢুকে পড়লো ।
হঠাৎ পিসির তারস্বরে চিৎকার - বৌমা শিগগির এস । সুবোধ ফিরে এসেছে ।
মা দৌড়ে এসে সুবোধ কে জড়িয়ে ধরলো - আমাকে ছেড়ে যেতে তোর কষ্ট হলো না ? তুই কি নিষ্ঠূর । পিসি বলে উঠলো তা সাধু হোলি যে গেরুয়া কাপড় কই ।
- মা আমি সাধু হবো না ।
- কি ভালো খবর । তোকে আমি কোথাও আর যেতে দেব না । তোকে এবার আমি বিয়ে দিয়ে সংসারী করবো ।
ততক্ষনে সুবোধের বাবা বেরিয়ে এসেছে -রোজগার পাতি করার চেষ্টা নেই আবার বিয়ে দেবে । কেন যেখানে গিয়েছিলি ওখানে পরিশ্রম করতে হচ্ছিলো বলে পালিয়ে এলি ? ফ্রি তে খাওয়া পাস্ নি ।
পিসি বাবাকে ধমক দিলো- এতদিন পর ছেলেটা বাড়িতে ফিরলো আর তুই যা তা বলতে থাকলি । আয় বাবা ঘরে এসে হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া কর ।
হঠাৎ সবার নজর বনির দিকে গেলো । পিসি বলে উঠলো - তুমি কে গো অনেক্ষণ ধরে দেখছি এখানে দাঁড়িয়ে আছো ?
বনি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল ।
সুবোধ বললো - আমার বৌ আমি বিয়ে করেছি পিসি|
পরিস্থিতি একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো । সমস্ত হৈচৈ বন্ধ ।
সুবোধের বাবা বলে উঠলো - গেলি সাধু হতে আর ফিরলি বিয়ে করে ।
সবাই মাথায় হাত দিয়ে যে যার জায়গায় বসে পড়ল ।