STORYMIRROR

Arup Maitra

Comedy Classics

4  

Arup Maitra

Comedy Classics

মোটরবাইকের ড্রাইভার

মোটরবাইকের ড্রাইভার

16 mins
456

পটলবাবু বাজারের দিকে যাচ্ছেন নিজের মনে হাটতে হাটতে | বাজারে যাওয়াটা একটা গভীর চিন্তার বিষয় | এই রাস্তাটা খুবই ছোট | গলিতে পাশাপাশি দুজন হাঁটা যায় না | কিন্তু এই গলি দিয়ে গেলে বড় রাস্তায় তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায় | এই গলিতেই ভুবনের কোচিন ক্লাস |হঠাৎ কানে এলো ভুবন বলছে পটল খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভালো | পটোলের বিভিন্ন উপকারিতা আছে |

পটলবাবু জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো ক্লাসে একটাও ছেলে নেই | চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে ভুবন এইসব কথা বলে যাচ্ছে |

পটলবাবু রেগে বললো - ভুবন তুই যদি এরকম অসভ্যতা করিস , তাহলে তোর ছাত্ররা কি শিখবে ?

আমি কি অসভ্যতা করলাম ? একটু প্র্যাকটিস করছিলাম আজ পড়াবো বলে |

কেন পটল ছাড়া আর কিছু নিয়ে প্র্যাক্টিসের জিনিস পাস্ নি ?শিক্ষা দীক্ষা কিছুই পাসনি - পটল বাবু রেগে হাঁটতে লাগলো |

বাবা মা'র ওপর খুব রাগ হলো | কি যে একটা নাম রেখে ছিল ? পাড়ার ছেলে ছোকরা গুলো নাম নিয়ে এইরকম অসভ্যতা করে |

গলি থেকে বেরিয়েই একটা লাল রঙের বড়ো গাড়ি দেখে পটলবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন | এতো বড়ো আর সুন্দর গাড়ি এ এলাকায় আগে দেখেন নি | সামনেটা মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে যেন |গাড়ির ভেতরটা ঝক ঝক করছে | জানলার কাঁচ গুলো সবজে সবজে আভা ফেলছে | সিট্ গুলো দেখে মনে হচ্ছে বসলেই যেন নরম তুলোর মধ্যে ডুবে যাবে | হাঁ করে দেখতে দেখতে কেমন একটা ঘোরে চলে গেলো | যেন মনে হচ্ছে নিজেই গাড়ি কিনে বাড়িতে এসেছে | আর সবাই হাঁ করে দেখছে |

হঠাৎ পিঠের ওপর কে যেন হাত রাখলো | পটলবাবু সম্বিৎ ফিরে পেলো | ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো তড়িৎ সমাদ্দার দাঁড়িয়ে আছে |

কি দেখছেন পটলদা - তড়িৎ সমাদ্দার তির্যক হাসতে হাসতে বললো |

না কিছু না এই গাড়িটা , পটল বাবু একটু হকচকিয়ে গেলো |

সেডান, ছোট গাড়ি ঠিক ভালো লাগে না |এটার লেগ স্পেস দেখেছেন ? আমার আবার লেগ স্পেস টা বেশি লাগে , তড়িৎ সমাদ্দার একটু অহংকারের সুরেই কথা গুলো বলছিলো |পটল বাবু বেশ ভালোই বুঝতে পারলো |তড়িতের একটু হামবড়া ভাব আছে , এখন বেশিই হয়েছে| | তাকেই যে শোনাচ্ছে ভালোই বুঝতে পারলো |

কেন আপনি কি গাড়িতে শুয়ে শুয়ে যান ? পটল বাবু ভাবলেশহীন ভাবে বললো |

কেন শুয়ে শুয়ে যাবো কেন ? আপনার না পটলদা কথা বার্তার কোনো ছিরি নেই | আমি কি শেষ হয়ে গেছি যে শুয়ে শুয়ে যাবো |তড়িৎ সমাদ্দার হন হন করে নিজের বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো |


তড়িৎ সমাদ্দারের রেগে যাওয়া দেখে পটল বাবু মনে মনে খুশিই হলো | আবার একটা দুঃখ মনের মধ্যে বাসা বাধলো এই ভেবে যে নিজের না আছে একটা গাড়ি , না আছে একটা মোটরবাইক | ভাবতে ভাবতেই সামনে দিয়ে বাচ্চু একটা মোটরবাইক নিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলো | পেছনে মনে হয় ওর বান্ধবী হবে | নীল রঙের মোটর সাইকেল | টু সিটার | পটলবাবু ভাবলো তারও যদি এরকম একটা মোটরবাইক থাকতো সুচিকে নিয়ে বেরোতে পারতো | সুচি পটলবাবুর বৌ | ভালো নাম সুচরিতা | বড়ো শখ ছিল সুচির একটা মোটর বাইকের | কিন্তু কিছুতেই কেনা হলো না | তখন এতো টানাটানির সংসার ছিল যে নিজেদের শখ পুরণ করার মতো পয়সা জোগাড় করা যেত না | তারপর তো মেয়ে হলো | খরচ বাড়লো | নিজেদের শখের কথা গুলো ভুলেই গেলো | এখন পয়সা থাকলেও মোটরবাইক শেখার মতো বয়েস ও নেই আর সাহস ও নেই | মনটা বড়ো বিষন্ন হয়ে গেলো |বাজার করার ইচ্ছেটাই চলে গেলো | বাজার না করে নিয়ে গেলেও মুশকিল | বাড়িতে মা আর বৌয়ের চিৎকার চ্যাঁচামেচি লেগে যাবে | কোনো রকমে বাজার করে বাড়ি ফিরে এলো | বাড়ি ফিরে বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরের সামনে রেখে নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকলো | পটলবাবুর মনে হলো যেন জীবনে কিছুই করা হলো না | না মোটরবাইক শিখলো না প্রেম করলো | অফিসের প্রতীক মুখার্জী বাইক নিয়ে মানালি থেকে লেহ লাদাখ গিয়েছিলো | বাচ্চা ছেলে | আঠাশ বছর বয়েস | বাইক নিয়ে কত জায়গায় ঘুরে বেড়ায় | একটা বাইকের কত শখ ছিল | একবার কেনার ইচ্ছা হয়েছিল | মা বাবা বাধা তো দিয়ে ছিলই | কিছু আত্মীয় স্বজন এসেও অযাযিত জ্ঞান দিয়ে গিয়েছিলো | সঙ্গে অনেক উদাহরণ দিয়ে, ওই পাড়ার কার যেন এক্সিডেন্ট হয়ে মাথা ফেটে ছিল , কে ট্রাকের তলায় চলে গিয়েছিলো , এইসব বলে বাবা আর মা'র মনে ভয় ঢুকিয়ে মোটরসাইকেল কেনা বানচাল করে ক্ষান্ত হয়ে যে যার বাড়ি চলে গেলো | তারপর শুনলো অনেকেরই ছেলে মোটরবাইকে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে , কারো কারো মোটরবাইকে ওকেও চড়তে হয়েছে|

কি গো আজ অফিস যাবে না ? সুচরিতা জিজ্ঞেস করলো |


ভাবছি !

এতে আবার ভাবার কি আছে |

তড়িৎটা গাড়ি কিনেছে -

তাতে তোমার মন খারাপের কি আছে | তড়িৎদ্বাদের বিশাল ব্যবসা , কিনতেই পারে | তোমার তো মোটরবাইক কেনার ক্ষমতাও নেই | সরি , এখন কেনার ক্ষমতা আছে কিন্তু চালাতে জানো না |

সুযোগ পেয়ে ঠুকে দিলে |

ঠোকার কি আছে যা সত্যি তাই বললাম |

পটলবাবু দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো , সুচরিতা হাঁ হাঁ করে উঠলো - কোথায় যাচ্ছ ?

পটলবাবু এক দৌড়ে গিয়ে মা'র ঘরে ঢুকে পড়লো |

পটলবাবুর ওই রকম রুদ্ধশ্বাস ঢোকা দেখে পটলবাবুর মা ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো খোকা কি হয়েছে তোর | শরীর খারাপ নাকি ?

আমাকে মোটরবাইক শিখতে কেন দাও নি ?

এতো বড়ো একটা দামড়া হয়ে গেলি , নিজের মেয়ে কত বড়ো হয়ে গেলো তবু তোর বুদ্ধি টা বাড়লো না | যা এখন শিখে নে |এখন তো আমি কিছু বললেও শুনবি না |

- এখন এতো বয়েসে শেখা যায় না | বয়েস বাড়লে ভেতরে একটা ভয়ে ঢুকে যায় |

- তুই ছোট থেকেই ভীতু ছিলি | ভাগ্যিস শিখতে দিই নি | না হলে আজ হাত পা ভেঙে বসে থাকতি |

মা আপনি খুব অন্যায় করেছেন - সুচরিতা বললো , আজ মোটরবাইক জানলে আমাদের কত সুবিধা হতো | কত জায়গায় বেড়াতে যেতে পারতাম | টুবলাইটাকে পড়াতে দিতে যেতে পারতো |

তোমার তো ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরলেই ভালো লাগে |আর আমার পটল টা যদি মোটরবাইক থেকে পরে যেত |

আপনার পটল কি শিশু যে পরে যাবে | এই জন্যই কিছু হলো না |

পটলবাবু আস্তে আস্তে বললো - হ্যাঁ মা সূচি তো ঠিকই বলছে |

বৌয়ের উস্কানি তে আমার কাছে জবাব দিহি চাইতে এসেছো |বৌয়ের কথা শুনে চলো বলেই তোমার কিছু হলো না|

পটলবাবুর বৌ ও চিৎকার করে উঠলো - বৌয়ের কথা শুনে চলে বলেই আজ ঠিক ঠাক চাকরি বাকরি করে খাচ্ছে | আপনার কথা শুনে চললে তো বাড়িতে বসে থাকতো |


মুখ সামলে কথা বোলো বৌমা

পটলবাবু বুঝলো এরপর মানে মানে কেটে পড়াই ভালো | আজ মনে হয় সকালে খেয়ে অফিস যাওয়াও হবে না |ঘরের বাইরে এসে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো | খালি বাচ্চুর মোটরবাইক আর তড়িতের গাড়ির কথা মনে পরতে থাকলো |নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারে জন্ম নেওয়ার এই এক জ্বালা সবই দেরী করে হয় | আবার কখন কখনো হয়েও না| চাকরি দেরিতে , প্রমোশন দেরিতে , বিয়ে দেরিতে বাড়ি দেরিতে | গাড়ির কথা বাদ দিলো | না আর ভেবে লাভ নেই অফিস যেতে হবে | দেরী হয়ে যাচ্ছে |


স্নান করে জামা প্যান্ট পরে বেরোতে যাওয়ার সময় সূচি পিছন থেকে বলে উঠলো - কি গো খেয়ে যাবে না ?

- তোমাদের যা ঝগড়া চলছে রান্না করার সময় পেলে তো ?

- যা হয়েছে তাই খেয়ে যাও| তোমার জন্যই তো হলো | বুড়ো বয়েসে বাবুর খোকা হবার শখ হয়েছে |

পটলবাবু নির্বিবাদে খেয়ে নিয়ে অফিসে বেরিয়ে গেলো |

অফিসে আজ কাজকর্ম খুব বেশি একটা নেই | ই মেইল খুলে দেখে নিলো | এখনই উত্তর দেবার মতো কিছু নেই | মাথা থেকে মোটরবাইকের ভাবনাটা কিছুতেই যাচ্ছে না |প্রতীক এক মনে কম্পিউটারে কাজ করে যাচ্ছিলো |

পটলবাবু বললো - প্রতীক তোমার মোটরবাইক কেমন চলছে ?

দারুন চলছে নতুন মডেল বেরিয়েছে | খুব ভালো চলছে | সেদিন তো মেচেদা থেকে ঘুরে এলাম |কি দারুন স্পিড |

পটলবাবু বলতে থাকলো - বুঝলে প্রতীক আমার একটা মোটরবাইক কেনার ইচ্ছে ছিল | পয়সাও জামাতে শুরু করেছিলাম | কিন্তু হয়ে আর উঠলো না |টুবলাইটাকে স্কুলে ভর্তি করা আরো কত সংসারের চাপে জমানো টাকা পয়সা সব বেরিয়ে গেল , মোটরবাইকের স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেলো | আজকাল শুনছি বিদেশী বাইক ও এখানে পাওয়া যাচ্ছে |

প্রতীক বললো - হ্যাঁ , পাওয়া যাচ্ছে তো , আমার এক বন্ধুই তো কিনলো , আট লক্ষ টাকা দিয়ে |

- বলো কি প্রতীক ? বাইকের দাম এত টাকা |

- এর চেয়েও বেশি হয় |

- এইসব মোটরবাইকে কি থাকে যে এতো দাম |

- অনেক সব ফীচার থাকে | ঐসব বাইক রাস্তায় নিয়ে বেরোলে আপনার ইজ্জত বেড়ে যাবে |পটলদা এবার একটা বাইক আপনি কিনেই ফেলেন |আপনার এতো ইচ্ছা |


কি বলছো প্রতীক এই বয়সে বাইক চালাবো |মাথা খারাপ নাকি ?

পটলদা সময়ে পাল্টে গেছে | বয়েস এখন একটা নাম্বার মাত্র | লোকে আপনার চেয়ে বেশি বয়েসে কত রকম এডভেঞ্চার এক্সপ্লোর করছে | আর আপনি সামান্য একটা মোটরবাইক চালানো নিয়ে এতো ভাবছেন | এক সপ্তাহের মধ্যে শিখে যাবেন |

- হ্যাঁ এক সপ্তাহের মধ্যে শিখে যাবো ? পটলবাবু একটা কান এটো করা হাসি হেসে বললো |

আসলে মনে একটু বল পেলেন প্রতীকের কথা শুনে |

পটলবাবু বললো - আর বুক করার কতদিন পরে পাবো ?

ওসব কোনো ব্যাপার না | আপনার পছন্দসই মডেল স্টকে থাকলে একসপ্তাহের মধ্যে পেয়ে যাবেন |


প্রতীকের কথা শুনে পটলবাবু একটু আশান্বিত হলেন |সত্যি শেখার কোনো বয়েস নেই | লোকে এই বয়েসে কত কি করছে |এভারেস্টে চড়ছে| আর সামান্য একটা মোটরবাইক শিখতে পারবেন না ? নিজের মনেই বলে উঠলেন |আবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সুচিকে পেছনে বসিয়ে মোটরবাইক নিয়ে হাইওয়ে ধরে চলেছেন | সুচির খোলা চুল হাওয়ায় উড়ছে| তার পিঠে মাথা রেখে সুচির মুখে এক তৃপ্তির হাসি | সুন্দর ভাবনার মাঝেই অন্য একটা আশঙ্কার কথাও মনে এলো | এক দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে মোটরবাইক তিনি এখন কিনতে পারেন | কিন্তু শিখবেন কার কাছে | পাড়ার সব ফাজিল ছেলে ছোকরাদের কাছের শেখাটা বিড়ম্বনার বিষয় |শুভ ছেলেটা এদের মধ্যে ভালো | ওকে একবার বলে দেখলে হয় |


কি ভাবছেন পটলদা? বাইকটা কিনেই ফেলুন |


                                     2

পটলবাবু বাড়িতে আসছেন বাইকের পিছনে চড়ে| প্রতীকের চালানোর হাতটা সত্যিই ভালো | পটলবাবু ভাবছেন বাড়ি গিয়ে কি বলবেন সেটাও একটা চিন্তার বিষয় | কেউ কিছুই জানে না | মনে মনে ভেবেছিলেন সারপ্রাইস দেবেন | কিন্তু এখন ভাবছেন উল্টে তিনিই না বিপাকে পড়েন বউ আর মায়ের আক্রমণে |

বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পটলবাবু সিঁড়ির দরজা খুলে দিলেন | সিঁড়ি ঘরেই বাইক রাখবেন

প্রতীক বাইকটা রাখার ব্যবস্থা করছিলো এই সময়ে সুচরিতার আবির্ভাব |

একই তুমি কার বাইক রাখছো ?

প্রতীক কে দেখে বলে উঠলো - প্রতীক তোমার বাইক ?

প্রতীক মুখভরা হাসি হেসে বললো - আরে বৌদি মিষ্টি খাওয়ান | পটলদা বাইক কিনেছেন |

সুচরিতার এই কথা শুনে চোখ বড়ো হয়ে গেলো | মিহি স্বরে পটলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললো , তুমি বাইক কিনেছো ? আসলে এতটাই আশ্চর্য হয়েছে যে গলা দিয়ে ঠিকমতো আওয়াজ বেরোচ্ছে না |

পটলবাবু ঠিক বুঝতে পারছেন না তার বৌ খুশি হয়েছে না রেগে আছে না খুবই অবাক হয়েছে |

তাই উনিও মিহি আওয়াজ করেই বললেন - হ্যাঁ সূচি |

এইবার বাজখাঁই গলায় সুচরিতা বলে উঠলো - তোমার কি বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ধরেছে ,ছোকরা সাজার ইচ্ছা হয়েছে ? যে বাইক কিনেছো ?

এই সময়ে পটলবাবুর মা ও উপস্থিত হয়েছেন | পটলবাবু ভাবলেন , সেরেছে, একে মা মনসা তার ওপর ধুনোর গন্ধ |

কি হয়েছে বৌমা, তুমি ওরকম চ্যাঁচাচ্ছ কেন ?

দেখুন আপনার ছেলে কি করেছে ?

কি করেছে ?

বাইক কিনে নিয়ে এসেছে |

হ্যাঁ! - পটলবাবুর মা বাইকটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললো |

পটলবাবু একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন - ভালো না মা বাইকটা | কালারটা কেমন হয়েছে ?

হ্যাঁরে পটলা তোর কি মাথাটা একদমই খারাপ হয়ে গেলো ? তুই এই বয়সে বাইক কিনলি ?সাইকেল চালাতে গিয়ে কতবার মুখথুবড়ে পড়েছিস মনে আছে তোর ? এই বয়েসে মোটরবাইক থেকে পড়লে তো আর রক্ষে থাকবে না ?

পটলবাবু মাকে একটু খুশি করার জন্য বললো - বাইকে চড়িয়ে তোমাকে মন্দিরে নিয়ে যাবো মা |

হ্যাঁ ওটাই বাকি আছে | ভগবান আশু জ্যোতিষের কথাটাই মনে হয় সত্যি হলো | আমার পটলের বাইক থেকে পরেই দেহত্যাগ হবে- বলতে বলতে পটলবাবুর মা চলে গেলো|

এইসব কান্ড কারখানা দেখে প্রতীক ঘাবড়ে গেলো | পটলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললো- পটলদা যাই তাহলে |

সুচরিতা বলে উঠলো - আরে চা মিষ্টি খেয়ে যাও|

- না বৌদি পরে এসে একদিন খাবো | আজ একটু তাড়া আছে |

প্রতীক চলে গেলো | পটলবাবু হাত মুখ ধুয়ে এসে নিজের ঘরে বসলেন | টুবলাইটার খুব আনন্দ হয়েছে | কিন্তু এখন একটাই চিন্তা | যে করেই হোক বাইক শিখতেই হবে না হলে প্রেস্টিজ থাকবে না |


                             3

শুভ ঘরেই বসে থাকে| হাতে কাজকর্ম কিছুই নেই | বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারাটাই প্রধান কাজ |আর বাবার কাছ থেকে কথা শোনা | এদিক ওদিক ঘুরেও কিছু করে উঠতে পারছে না | তার মধ্যে পটলদার ফরমাশ বাইক শেখাতে হবে | শুভ ভাবলো লোকটা ভালো | বড়ো কোম্পানিতে চাকরি করে| এই সুযোগে যদি খুশি করে একটা চাকরি জোগাড় করতে পারে | পয়সার এখন খুবই দরকার| সবসময় বাবার কাছে হাত পাততে ইচ্ছা করে না |

ভোর বেলায় শুভর সাথে পটলবাবু বাইক শিখতে বেরোলেন | কাছেই মাঠে শিখবেন| এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বাইক শেখা খুবই ঝামেলার | তার ওপর এই বয়সে এসে | ক্লাচ আর গিয়ার্ কে বাগে আনা একটা কসরতের ব্যাপার| ক্লাচ পরে তো গিয়ার্ পরে না আর গিয়ার্ পড়লে ক্লাচ পরে না | আর বাইকের ওজন সামলানো আরো ভয়ঙ্কর | ঠিক ঠাক দাঁড় করাতে গিয়েই হেলে যাচ্ছেন | তার ওপর বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মন্তব্য | ' কি পটলদা সিনেমায় নামবেন নাকি ? বাইক শিখছেন' | কেউ আবার পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলছে ' পটলটার ভীমরতি হয়েছে , এখন সকালের হাঁটাটাও মনে হয় ওর যন্ত্রণায়ে বন্ধ হবে' | এরমধ্যেই দুবার পরতে পরতে কোনোরকমে বাঁচলেন | কিন্তু তৃতীয় বার পরেই গেলেন| শুভটা এক লাফে নেমে গেলো আর পটলবাবু বাইক নিয়েই উল্টে পড়লেন | হাত পা ছড়ে রক্ত বেরোতে লাগলো |

যারা হাঁটছিলো তারা বলতে শুরু করলো ' বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ধরলে এরকমই হয় |অসীম মুখুজ্জে কোনোরকমে ধাক্কা লাগতে লাগতে বেঁচেছেন | পটলবাবুকে এই মারেন কি সেই মারেন | কিন্তু পটলবাবুর পা দিয়ে রক্ত পরা দেখে থামলেন | শুভ কে বললেন ' চল এখুনি ডাক্তারের কাছে চল|

তোমার কি মাথাটা একদমই গেছে পটল - অসীম মুখার্জী বললেন | 'এই বয়েসে বাইক শিখতে গেছো|

 না মানে অনেকদিনের শখ ছিল তাই - পটলবাবু অতি কষ্টে বললেন |

তা জোয়ান বয়েসের শখ বুড়ো বয়েসে পূরণ করার কি কোনো দরকার আছে| শখগুলো বয়েস ধরে ধরে আসে| এখন তোমার মাথায় যদি দু তিন বছরের শখ চেপে বসে| এবং কারো কোলের ওপর চড়ে বসো, তাহলে কি হবে |

পটলবাবু বুঝতে পারলো কথা বাড়িয়ে আর লাভ নেই | চুপ করে থাকাই শ্রেয়|    

বাড়িতে খোড়াঁতে খোড়াঁতে ঢুকতেই হৈ চৈ বেধে গেলো | একদিকে মা আর একদিকে বৌ | কার কথার যে উত্তর দেবে আর কি যে উত্তর দেবে কিছুই পটলবাবু বুঝতে পারছেন না |টুবলাইটাও কান্না কাটি জুড়ে দিয়েছে | ভালো করে যেটা বুঝতে পারলেন সেটা হলো বাইক শেখাটা বন্ধ হয়ে গেলো | এতো টাকা দিয়ে বাইকটা কিনলেন শখ করে সেটাই আর শেখা হবে না |ভাবতেই মনটা দুঃখে ভোরে উঠলো |

- তুই যদি বাইকে আর পা দিস, তোর পা আমি ভেঙে দেব পটলা - পটলবাবুর মা বলে চলে গেলেন |

খোকাবাবু চা টা খেয়ে নিন| শখ মিটেছে? - সুচরিতা টিটকিরি দিয়ে চলে গেলো |

পটলবাবুর মনে হলো সত্যিই ভুল বয়েসে মোটরবাইক শিখতে গেছেন |কিন্তু এখন বাইকটার কি হবে | বাইক না চালালে খারাপ হয়ে যাবে | আর তারও তো বাইক চড়ার শখ | একটা কাজ করলে হয় | পটলবাবু শুভকে ফোন করলেন ' শুভ একটু আসবি আমার বাড়ি '|

শুভ একটু চিন্তিত হয়ে বললো - কেন পটলদা কি হয়েছে ?

কিছু না আয় না , তোর সাথে একটু দরকারি কথা আছে - পটলবাবু বললেন|

কিছুক্ষন পর শুভ পটলবাবুর বাড়ি উপস্থিত হলো |' বলুন পটলদা , কি বলবেন বলছিলেন ?

পটলবাবু গলাটা নামিয়ে নিচু স্বরে বললেন - আমার ড্রাইভার হবি ?

শুভ তার চেয়েও নিচু স্বরে অবাক হয়ে বললো - আপনি এর মধ্যে বাইক বেচে গাড়ি কিনে ফেললেন ?

দূর হতভাগা , গাড়ির ড্রাইভারের কথা কে বলেছে | বলছি আমার বাইকের ড্রাইভার হবি? বিনে পয়সায় নয়? মাইনে দেব |

শুভ মোড়ার ওপর বসেছিল | ড্রাইভারের কথাটা শোনার পর অবাক হয়ে একটু বেশি পেছনে হেলান দিয়ে ছিল | তাই নিচে পরতে পরতে কোনো রকমে সামাল দিলো | কিন্তু এইরকম অভিনব প্রস্তাব জীবনে কখনো শুনতে পাবে স্বপ্নেও ভাবেনি |একটা কাজের দরকার আছে, কিন্তু এইরকম কাজ পাবে ? কি কপাল! বাইক থেকে পরে গিয়ে পটলদার মাথাটা খারাপ হলো কিনা সেটাও ভাবার বিষয়| 

-পটলদা আপনার মাথায় লাগে নি তো ?

-কেনো তুই কি ভাবছিস আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে|

-না না সেরকম নোই আসলে বাইকের ড্রাইভার ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে তাই |

অদ্ভুতের কি আছে তোকে মাইনে দেব তুই ড্রাইভার হবি | সে বাইকের হোক কি গাড়ির - পটলবাবু একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন |

শুভ দেখলো তারও ইনকাম হবে, যতই ভিন্ন লাগুক শুনতে | রাজি হয়ে গেলো |

শুভ মাঝে মধ্যে পটলবাবুকে নিয়ে বাইকে চড়ে বেরোতে লাগলো | বাড়ি আর বাইরের কেউই জানতে পারলো না যে পটলবাবু মোটরসাইকেলের ড্রাইভার রেখেছেন | পটলবাবুও মহা ফুর্তিতে বাইকে চড়ে বাজার হাট করা , অফিসে যাওয়া সবই করতে লাগলেন | মাঝে মধ্যে টুবলাইটাও পড়তে যাওয়ার সময় বাইকে চড়ার বায়না করে | শুভ টুবলাইকে পড়তেও দিয়ে আসে |বাইক চালাতে চালাতে পটলবাবুকে বলে - এই ভাবে ব্রেক কষবেন পটলদা দেখবেন বৌদি আপনাকে ভয় জড়িয়ে ধরবে |

ফাজলামো করিস না শুভ - পটলবাবু বললেন| কিন্তু মনে মনে যখন ভাবলেন মনটা খুশিতে ভোরে উঠলো |কবে যে বাইকটা শিখতে পারবেন ?

পটলবাবুর সাথে শুভর একটাই চুক্তি হয়ে ছিল যে বাইরের কেউ ড্রাইভারের কথা জানতে পারবে না | পটলবাবুও শুভর শর্ত মেনে নিয়েছিলেন | কিন্তু সময় একরকম যায় না | সে সততই বদলায়| একদিন সকল বেলায় বাজারে যাওয়ার সময় শুভর বাবা সরকারবাবু , সত্য সরকার , বাইকের পথ আটকালো |শুভ হতচ্ছাড়া সকাল সকাল ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়াতে চলে যাস - সত্য সরকার চিৎকার করতে লাগলো |

- সেরেছে বাবা আবার ভোর বেলায় উঠে এখানে - শুভ মনে মনে বললো |মোটরবাইকটি কোনোরকমে থামিয়ে দাঁড়ালো| ' তুমি এখানে এরকম চিৎকার করছো কেন'?

-তুই কেন রোজ সকালে বেরিয়ে পটোলের বাইক চালাস | তুই কি ওর চাকর?

 -আরে কি যে বলো, চাকর হবো কেন ? পটলদার এক্সিডেন্ট হয়েছিল তাই একটু সাহায্য করে দিচ্ছি |

- কেন পটল তো রিকশা করেও বাজারে যেতে পারে? ওর তো হাত পা ভাঙে নি |তুই ওকে অফিসে নিয়ে যাস | এখানে ওখানে নিয়ে যাস আমার কাছে সব খবর আছে |চাকরি বাকরির চেষ্টা নেই শুধু ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস ?

শুভ মনে মনে ভাবতে লাগলো কি করে যে বোঝাবে যে এর জন্য ও মাইনে পায়| এটা বললে আর রক্ষে থাকবে না | এখুনি কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে আর বন্ধু বান্ধবদের কাছে হাসির পাত্র হবে |তবু বান্ধবী কে নিয়ে বাইকের পেছনে বসে ঘুরে বেড়ালে কিছু বলতে পারতো| কিন্তু এখন তো কিছুই বলার মতো নেই | পটলদাও খুবই আরামে ঘুরছে | আজকাল অফিসেও নিয়ে যেতে হচ্ছে |মাইনে দিচ্ছে তাই নিয়েও যেতে হয়|

কি কুক্ষনে যে রাজি হয়েছিল | এও ভাবছে যে মোটরবাইক চালিয়ে দু পয়সা রোজগারও হচ্ছে| কিন্তু মোটরবাইকের ড্রাইভার বলাটাও একটু খেলো ব্যাপার হয়| গাড়ির ড্রাইভার হয় , বাসের ড্রাইভার হয় কিন্তু মোটরবাইকের ড্রাইভার তো কেউ শোনে নি | পটলদাও আরাম করে বাইকের পেছনে বসে দিব্বি ঘুরে যাচ্ছে | বাড়িতে একটু খোড়াঁচ্ছে| বৌদিও বুঝতে পারছে না | শুভ ভালো বাইক চালাতে জানে বৌদিও জানে , তাই বারন করছে না | আজ মনে হয় সব কিছু ওলোট পালট হয়ে যাবে | বাবা যে ভাবে খেপে আছে |

সত্য সরকার বললো ; নাম বাইক থেকে আর ঘরে যা| এই যে পটল তুমি নিজের বাইক নিজে চালাও| চালাতে জানো না তো কিনেছো কেন ? আগে চালানো শিখে তারপর তোমার কেনা উচিত ছিল |

সত্য দা অন্যের বাইকে শেখা উচিত না | নিজের বাইকেই শেখা উচিত | আর আপনিই বা এতো হই চই করছেন কেন - পটলবাবু বললেন |

হই চই করবো না ? রোজ সকালে গিয়ে তোমার খিদমদগিরি খাটবে আমার ছেলে আর আমি চুপ করে থাকবো ?

পটলবাবু মোটরবাইকে বসেই বলতে থাকলেন ' আরে সত্যদা থামেন না | ও তো সাহায্যই করছে |

এলাকায় সবাই সবাইকে সাহায্য করবে এটাই তো ভালো |'

সত্য সরকার বললো - সেটা তো নিশ্চয়ই ভালো | কিন্তু মানুষ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করবে| কিন্তু তুমি তো বিপদে পরোনি |

- কি বলছেন সত্যদা আমি বিপদে পড়িনি! এতো বড়ো দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলাম আর আপনি বলছেন বিপদে পড়িনি| আরো বড়ো কিছু হলে বুঝি আপনার বিপদ বলে মনে হবে ?

- ওটাকে বিপদ বলে না, সত্য সরকার বলতে থাকলো ,' তোমার মতো আপদের যদি ভীমরতি ধরে তো এরকম বিপদ তো আসবেই |

শুভ দুজনকেই থামাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো | পটলবাবুকে বললো ' আরে পটলদা ছাড়ুন না |

বাবা আমি পটলদাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসে আর চালাবো না |

সত্য সরকার উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো - না তুই আর চালাবি না | পটোলের বাইক পটল চালিয়ে নিয়ে যাবে কি মাথায় করে নিয়ে যাবে ও বুঝবে |চারিদিকে লোক তৎক্ষণাৎ জড়ো হয়ে গেছে | পটলবাবুর মাথা গরম হওয়া শুরু হয়েছে| মোটরবাইক চালাতে পারে না এই কথা শুনলেই খুবই অপমানিত বোধ করেন | জীবনে অনেক আফশোসের মধ্যে এ এক বড়ো আফশোস| কিশোর বয়েস থেকে দেখে আসছে বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন, ওনার বয়েসি সবাই মোটরবাইকে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে | কিন্তু উনি কখনোই বাইক চালাতে পারেননি | এই বয়েসে এসে বাইক কিনতে পারলো কিন্তু চালানোর শখ পূরণ হলো না | শিখতে গিয়ে পরেই গেলেন | তবু শুভটার জন্য যদিওবা বাইক চড়তে পারছেন সেটাও বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে শুভর বাবার পাগলামোর জন্য|

পটলবাবু সত্য সরকারের দিকে তেড়ে গিয়ে বললেন ' আপনার ছেলেকে আমি মাইনে দিয়ে ড্রাইভার রেখেছি | ও বিনি পয়সায় আমার বাইক চালায় না |'

শুভ যে ভয়টা এতক্ষন করছিলো সেইটেই ঘটলো | মাথায় হাত দিয়ে শুভ বসে পড়লো | সবাই দাঁড়িয়ে আছে | লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারছে না |

সত্য সরকার বলে উঠল - হতভাগা আর কাজ পেলি না শেষমেশ মোটরবাইকের ড্রাইভার হলি!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy