টোপর
টোপর
সুরমা সোফায় বসে আপনমনে ছুরি দিয়ে সবজি কাটছিলো। আজ মন খুব খুশি এবং নিশ্চিন্ত । শিবুর বৌভাতের অনুষ্ঠান ভালোভাবেই গতকাল সম্পন্ন হয়েছে।
সুরমা আর অনিমেষের একমাত্র সন্তান শিবু ।ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ভালো চাকরি করছে । শিবুর বিয়ে হয়েছে অনিন্দিতার সাথে। ভালোবেসে বিয়ে । অনিন্দিতা খুব ভালো মেয়ে । সুরমা আর অনিমেষের খুবই পছন্দ । অনিমেষ সুরমার পাশে এসে বসলো ।
- কি হলো এতো ভোরে উঠে পড়েছো ?
- ঘুম ভেঙে গেলো তাই উঠে পড়লাম। ফ্লাস্কে চা আছে ঢেলে নাও ।
অনিমেষ চা ঢালতে ঢালতে বললো - কালকে অনুষ্ঠান ভালোই হয়েছে । রান্নাও ভালোই করেছে । সবাই খুব প্রশংসা করেছে ক্যাটারের।
হঠাৎ অনিমেষ তাকিয়ে দেখলো শিবু হন্হন করে বারান্দার দিকে যাচ্ছে । পরনে হাফ প্যান্ট , স্যান্ডো গেঞ্জি আর মাথায় টোপর ।
অনিমেষ সোফা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললো - দেখো তোমার ছেলের কান্ড ।
সুরমা চেঁচিয়ে উঠল - আই শিবু কোথায় যাচ্ছিস টোপর পরে ।
শিবু নির্বিকার মুখে বললো - সেলফি তুলতে বারান্দায় ।
- এই ড্রেস পরে তুই ছবি তুলবি ? লোকেতো পাগল বলবে ।
- কেন কালকে বৌভাত হয়েছে , আজকে একটা সস্ট্যাটাস দেব না।
- আমাদের স্ট্যাটাস তো একদম নেমে যাবে তুই যদি এইরকম ছবি দিস ।অনিমেষ বললো ।
শিবু খুব বিরক্ত মুখ করে বললো - তোমরা না আমার টোপর পড়া একদম পছন্দ করো না ।
সুরমা শান্ত স্বরে বললো - পছন্দ করি বলেই তো তোর বিয়ে দিয়েছি । আয় আমার পাশে বোস । চা খা । এই অবস্থায় তোকে দেখলে নতুন বৌ কি ভাববে ।
- খুব খুশি হবে । ও তো সেলফি তুলবে বলেছিলো ।
অনিমেষ আস্তে আস্তে সুরমাকে বললো - আবার পুরোনো রোগ মাথা চারা দিলো মনে হচ্ছে ।
সুরমা বললো - বিয়ে হয়েছে তাই অতি আনন্দে এইরকম করছে ।
অনিন্দিতা বাইরে এসে শিবুকে দেখে খুবই উত্তেজিত । চিৎকার করে বলে উঠলো - শিবু তোমায় কি কিউট লাগছে । চলো না একটা সেলফি তুলি ।
সুরমা আর অনিমেষ ভাবলো এতো আরেক বিপদ ।
সুরমা গলার স্বর মিহি করে বললো -এস মা চা খাবে । সেলফি পরে তোলা যাবে ।
অনিন্দিতা বললো - আপনি শিবুকে টোপর পরিয়ে দিয়েছেন । পুরো অন্যরকম স্টাইল । হাফ প্যান্ট , স্যান্ডো গেঞ্জি আর টোপর ।
সুরমা শিবুর মাথা থেকে টোপর তুলে নিয়ে সোফার পেছনে রেখে দিলো ।
সুরমা চিন্তায় পড়লো।
(২)
শিবুর ছোটবেলা থেকেই টোপর পরার শখ । টুপির বদলে টোপরকেই প্রাধান্য দিত । শিবুর বাবা মাকে অনেকসমই তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়তে হয়েছে । কড়া অনুশাষন এবং নজরদারির মধ্যে রেখেও শিবুর টোপর পড়ার ইচ্ছা দমন করতে তারা ব্যর্থ ।ছোটবেলার এই অদ্ভুত স্বভাবের জন্য শিবু নিজেও অনাকাঙ্খিত আকর্ষণের স্বীকার হয়েছে । কিন্তু শিবু ঠিক করে নিয়েছে সে টোপর পড়বে টুপির বদলে । শিবুর বাবা মা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছিল, কিন্তু চিকিৎসক নিজেও এইরকম একটি অদ্ভুত মানসিক ইচ্ছা দেখে খুব অবাক হয়ে বলেছিলো - আমরা একবার টোপর পরে সারাজীবন পস্তাচ্ছি , আর এ ছেলে তো দেখছি টোপর পড়ার জন্য ব্যাকুল । চিন্তা করবেন না বয়েস হলে ইচ্ছা আর হবে না আর বিয়ের পর তো ভালোই বুঝতে পারবে , টোপর কি বিষম জিনিস।
কিন্তু শিবুর ইচ্ছার প্রশমন হলো না । শিবু যথারিতি টুপির বদলে টোপর পড়ার দিকেই মনোনিবেশ করল । সমস্যা হলো শিবুকে নিয়ে কোনো বিয়ে বাড়ি যাওয়া । শিবু ঠিক বরের টোপর সবার অজান্তে বাগিয়ে নিয়ে মাথায় পরে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাটঁতে হাসি হাসি মুখে বাড়ির দিকে রওনা দেবে । সুরমা আর অনিমেষের কাছে খুবই লজ্জার এইসব ঘটনা । আরো লজ্জার বিষয় রাস্তা ঘটে বাচ্চা ছেলের ঐরকম টোপর পরে চলা ।
একদিন এক বিয়েবাড়ি থেকে সুরমা আর অনিমেষ ফিরছিলো । শিবুও সঙ্গে ছিল। শিবু নতুন স্যুট পড়েছে । ভালোই লাগছে দেখতে । সুরমা আর অনিমেষ গল্প করতে করতে একটু এগিয়ে গেছে । শিবু পিছিয়ে পড়েছে । হঠাৎ শোরগোলে পেছনে ফিরে দেখে অনেক লোক শিবুকে ঘিরে ধরে আছে । অনেকে আবার ফটো তুলছে । শিবু টোপর পরে হাঁটছে । স্যুটএর ওপর টোপর পড়া একটু অদ্ভুত বৈ কি । শিবু যে কখন বরের মাথার টোপর হাতিয়েছে কিছুই বুঝতে পারলো না সুরমা আর অনিমেষ । কোনোরকমে শিবুর মাথা থেকে টোপর নামিয়ে ভিড় থেকে শিবুকে ওরা বের করে নিয়ে আসে ।
সুরমা চিন্তা ভাবলো , অনিন্দিতাকে সব বলে দেওয়াই ভালো। পরে ভাববে কেন কেউ কিছু বলে নি ।
অনিন্দিতাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালো ।
মা কিছু বলবে - অনিন্দিতা বললো ।
- হ্যাঁ , একটা কথা বলবো বলে ডেকেছিলাম ।
- বলো কি কথা!
- শিবুর ব্যাপারে একটু কথা বলবো।
- কেন শিবু কি করেছে ?
- না শিবু কিছু করে নি । শিবুর একটা অদ্ভূত স্বভাব আছে ।
- কি স্বভাব ? শিবু তো আমাকে ওর সব কিছুই বলেছে। আমিও আমার সব কিছু সম্বন্ধে বলেছি ।
সুরমা বললো - জানি তোমরা প্রেম করে বিয়ে করেছো । দুজনের সম্বন্ধে দুজনেই সব কিছু জানো । কিন্তু এই কথাটা শিবু তোমাকে বলে নি।
অনিন্দিতা এবার একটু অবাক হয়ে বললো - বলো তাহলে।
সুরমা বললো - শিবুর না ছোটবেলা থেকে টোপর পড়ার শখ ।
- সে তো ভালো। হাসতে হাসতে অনিন্দিতা বললো - সেই জন্য তো বিয়ে করতে পারল।তোমার ছেলে তো বিয়ে পাগলা হয়ে গিয়েছিলো।
সুরমা বললো - আরে সে রকম নয়। ওর ছোটবেলা থেকে টুপির বদলে টোপর পড়ার শখ । সে জন্য খুব ঝামেলাও হয়েছে। মারধর ও খেয়েছে। কিন্তু শখটা যায় নি ।
অনিন্দিতা চোখ বড় করে বললো - তার মানে ও কি আরো বিয়ে করেছে ? কি সর্বনাশ । আমি কিন্তু তোমাদের ছাড়বো না বলে দিচ্ছি । কেস করে দেব ।
- আরে থাম । ও তোমাকেই ভালো বেসেছে এবং বিয়ে করেছে । বলছি ছোটবেলা থেকে ওর টোপর পড়তে ভালো লাগে । বিয়ে বাড়িতে গিয়ে বরের টোপর নিয়ে পরে নিত । মাঝখানে এই অভ্যেস বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু আজ সকালে দেখলাম আবার টোপর পরে ঘুরছে । তাই তোমাকে বলে রাখলাম।
- আরে এই, ও তুমি কোনো চিন্তা করো না । বিয়ে করে আনন্দ হয়েছে , তাই আজ সকালে টোপর পরে ঘুরছিলো । আমারও তো ভালো লাগছিলো । ছোটবেলার অভ্যেস এখন চলে গেছে ।
- গেলেই ভালো - বলে সুরমা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো ।
(৩)
অনিন্দিতা আর শিবুর সংসার আনন্দেই চলছিল। এরমধ্যে ওদের একটি পুত্র সন্তান হয়েছে । ছোটোর মধ্যে নামকরণ হয়েছে বিশু । বিশু খুবই মিশুকে এবং মোটা সোটা । স্কুলে ভর্তি হয়েছে । অনিন্দিতার স্বামী , পুত্র , শশুর শাশুরিকে নিয়ে সুখের সংসার । শিবুরও চাকরীতে পদোন্নতি হয়েছে । প্রাইভেট অফিসের কাজের চাপে টোপর পড়ার অভ্যেস এখন আর নেই । আর এর মধ্যে যে কটা বিয়ে বাড়ির নেমন্তন্ন পেয়েছে সবকাটাতেই অনিন্দিতা সঙ্গে ছিল । প্রথমদিকে অনিন্দিতা চোখে চোখে রাখত যদি শিবু বরের আসে পাশে ঘোরাঘুরি করত ।
তারপর ওর মনে হলো আর টোপর পড়ার ইচ্ছা নেই শিবুর ।
অনেকদিন পর শিবুর বন্ধু অরিত্রর বিয়ে ঠিক হয়েছে । অরিত্রকে অনিন্দিতাও খুব ভালো করে চেনে ।
শিবু বিয়ে বাড়িতে যাবে বলে ছুটি নিয়েছিল । কিন্তু সকালে উঠে অনিন্দিতা দেখলো শিবু রেডি হচ্ছে ।
- কি গো আজ ছুটি নিয়েছিলে না ?
- হ্যাঁ নিচ্ছিলাম তো কিন্তু একটা আর্জেন্ট কাজে যেতেই হবে । বস্ ফোন করেছিল ।
- তাহলে বিয়ে বাড়ি!
শিবু জুতো পরতে পরতে বললো - তুমি বিশুকে নিয়ে চলে যেও , আমি অফিস থেকে সোজা বিয়ে বাড়ি চলে যাবো।
অনিন্দিতা বললো - ধুতি পাঞ্জাবি পর্বে না ।
- পরবো তো । ব্যাগে নিয়ে নিয়েছি ।
- আচ্ছা ।
অনিন্দিতা বিশু কে নিয়ে বিয়ে বাড়ি পৌঁছেছে । খুবই খুশি । অনেকদিন পর একটা বিয়ের নেমন্তন্ন পেয়েছে । বিশু আগে হন হন করে হেঁটে বিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে । অনিন্দিতা দেখলো বিশু দৌড়ে বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে । অনিন্দিতার কাছে এসে হাঁফাতে থাকলো ।
- কি হয়েছে বাবা ওরকম হাঁফাচ্ছিস কেন - অনিন্দিতা ঘাবড়ে গিয়ে বললো।
বিশু হাঁফাতে হাঁফাতে বলল - মা বাবা আবার বিয়ে করছে ।
- বিয়ে করছে মানে !
- টোপর পরে হবু বৌয়ের পাশে চেয়ারে বসে আছে ।
অনিন্দিতার আর মাথার ঠিক থাকলো না । দৌড়ে গিয়ে বিয়ে বাড়িরই ভিতরে ঢুকে গেলো । দেখলো বিশু যা বলেছে ঠিক তাই । শিবু টোপর আর চেয়ারে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বসে আছে । আর পাশে পুরুত মশাই আর হবু বৌ চিৎকার করছে - আপনি বর না তো টোপর পড়েছেন কেন ।
বরের বাথরুম পেয়েছিলো বলে শিবুকে টোপর ধরতে দিয়ে উঠেছিল । শিবু হাতে টোপর না ধরে মাথায় পরে নিয়েছিল । পুরুত মশাই ওকেই বর ভেবেছিলো ।
অনিন্দিতার আর দিকবিদিক জ্ঞান থাকলো না । ডেকরেটরের বাঁশ হাতে তুলে নিল ।
তারপর থেকে শিবুর টোপর পরার রোগ চিরকালের মতো চলে গেলো ।
