Supratik Sen

Abstract Others

3  

Supratik Sen

Abstract Others

সন্দীপ মোটেও একা থাকে না

সন্দীপ মোটেও একা থাকে না

5 mins
315



আপনি একা থাকেন?

না। 

আর তো কাউকে দেখিনা।

আসলে আমার পরিবার পাটনাতে থাকে, মাঝে মাঝে যাওয়া আসা করে। 

ও, তার মানে বেশির ভাগ সময় আপনি একাই থাকেন, তাই তো ?

তা বলতে পারেন। 

বৌকে ছেড়ে থাকেন কি করে মশাই? 

কষ্ট করে। 

হা হা হা ! ভাল বলেছেন। বেশ রসিক মানুষ দেখছি। 

আচ্ছা, আজ আসি একটু তাড়া আছে। 

আরে যাচ্ছেন কোথায়? বলছি, রান্নাবান্না কে করেন? 

আমি সব নিজেই করি। এই তো এখন বাজার করে ফিরে রান্না করে বেরুতে হবে আপিসে। 

বলছিলাম সন্ধ্যায় আসবো নাকি? একটু বসা যেত। 

আমি ওসব খাই না। আচ্ছা, আসি। 

এই বলে সন্দিপ হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। ও আসার পর থেকেই লোকজনের নানা প্রশ্ন। পাড়াপড়সি থেকে কাজের লোক, এমন কি মিস্তিরি, সবজিওয়ালা, ফেরিওয়ালা সবাই জানতে চায় সন্দীপ কেন একা থাকে। আর ও সবাইকে বলে যে ও একা থাকে না। লোকমুখে বলাবলি করতে শোনে অনেক কথা, 

'আরে দেখো গিয়ে হয়ত কোন কান্ড ঘটিয়েছে, বলে পরিবার আসে, কিন্তু আজকাল যা হচ্ছে, যে আসে সে যে পরিবার তার কি কোন প্রমান আছে?' ইত্যাদি প্রভৃতি। 

সেদিনই তো একজন ভদ্রলোক সন্দীপের কাছে জানতে চাইল ওর ঘরটা ফাঁকা পাওয়া যাবে কিনা। 

একে একা থাকার জ্বালা, সব কিছু তাকেই করতে হয়, কখন বাড়ি আসে কখন যায় তাতে কারুর কিছুই যায় আসেনা, খেতে বসে চোদ্দবার উঠতে হয়, গরম করো রে, খাবার বাড় রে, খাবার পর সাটোন আটন করো রে, বাসন মাজ রে, কত কী! একদিন তো খেতে বসে দেখলো নুনিই নেই, নুনের কৌটোতে নুন শেষ। বাড়াভাত রেখে রবিবার ঠাটা পোড়া রোদ্দুরে বেড়িয়ে নুন এনে তবে পাতে নুন নিয়ে খেল। তবে সেদিন সন্দীপ কাঁদেনি। ও কেঁদেছিল সেইদিন যেদিন ওর রান্না করতে ইচ্ছে করছিল না, পেটে দাউ দাউ খিদে, অর্ডার আউট করল। 

মটন কশা খালি, তিনশো ষাট প্লাস জিএসটি। খাবার এলো রাত সাড়ে দশটায়। খাবার খুলে দেখল মাংস, ডাল, তরকারি ঘেটে দ, একটা ডিম্ দেখতে পেল, হাত দিয়ে দেখে ওটা রসগোল্লা, ঝোল আর রসে মিশে একাকার। সন্দীপের মনে হল ঠিক বিয়ে বাড়ির পর ভিখারিরা যেমন আবর্জনা থেকে খায়, সেইরকম। কান্নায় ভেঙে পড়ে জল খেয়ে শুয়ে পড়েছিল সেদিন সন্দীপ। 

সাধারণ জিনিসই কিরকম অসাধারণ মনে হয় এখন তার, কলিং বাজিয়ে ঘরে ঢোকার আনন্দ যে কি, সেটা সে ভুলেই গেছে আজ বহুদিন। বাড়ির দরজার সামনে ছোটবেলায় আগে চটির ভিড় থাকত, সে সব এখন ইতিহাস। 

কাজের লোক রেখে আরেক অশান্তি, কাজের লোক ওকে বলে, 'দাদা, আমার ছাদ দিয়ে জল পড়ছে, টাকার দরকার, দেবেন? আপনি যা বলবেন করবো', 

ওপরে থাকেন একজন মহিলা, তার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগত সন্দীপের, তার একটা ছোট্ট নাতি, ছুটির দিনগুলি তাদের সাথে বেশ কাটছিল সন্দীপের, একদিন রবিবার দুপুর বেলা উনি এলেন একা, এসে বলেন যে উনি ছত্রিশ বছরে বিধবা হন, তারপর সেলাই করে ছেলে মেয়েদের বড় করেন, নিজের শরীরের খিদে কিছুই মেটাতে পারেননি। সন্দীপ কিছু বোঝার আগেই সে দেখে ওই মহিলা সন্দীপের গায়ের ওপরে। কি করবে বুঝতে না পেরে ও ঐরকম ভাবেই পড়ে রইল, তারপর উঠে পড়ে ওনাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওপরে পাঠান। বলাই বাহুল্য তারপর থেকে ওদের আসা বন্ধ হল। 

শুধু পাড়াপড়শিরা নয়, বন্ধুবান্ধব, কলিগ, আত্মীয়স্বজন সবাই গাজিগাজী করে ধরে। ওর এক পিসতুত দাদা ওর বাড়ির চাবি রাখত, সে অনেক আগের কথা, তখন তো সন্দীপ সাফল্যের শিখরে, ভেবেছিল কলকাতার এই ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দেবে। তখন জানতো না, নিয়তির কি লিখে রেখেছে ওরে জন্য। ও তাই ওর পিসতুত দাদাকে বলেছিল ওই ফ্ল্যাটটা, যেখানে ও এখন থাকে, সেটা বিক্রি করে দিতে। উনি স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করেন। এখানে আসার পর সন্দীপ একদিন ওর বাড়ি গিয়ে দেখে একটা চকচকে কাঠের আলমারি, ও হাত বুলিয়ে বলে বৌদিকে, 

- এটা বেশ ভাল তো!' বৌদি তৎক্ষণাৎ বলে, 'আর বলোনা, তোমার দাদার এই পরোপকার স্বভাব, এটা তো তোমার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে, বুঝতেই পেরেছি নিশ্চই?

- না বৌদি আমি বুঝতে পারিনি। তা এটা এখানে এলো কেন?

- ও তোমার দাদাকে জিজ্ঞেস করো, আমার ঘরে জায়গা জুড়ে আছে, ভালো লাগেনা।

- দাদাকে কেন জিজ্ঞেস করবো? এটা আমাকে ফেরত দিয়ে দিতে বল, দাদা তো নেই বাড়িতে, আমিই ফোন করে বলব, তোমায় কিছু বলতে হবেনা। 

এসে সেদিন রাতে ফোন করে সন্দীপ,

- রুপুদা!

- হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি শুনেছি, তোর যখন ইচ্ছে নিয়ে যাস। 

- আমি নিয়ে যাব? তুমি পাঠাবে না? 

ও বৌদির কথা শুনতে পায়, 'এই আলমারিটা এখন নিয়ে গেলে আমার খুব অসুবিধে হবে, ওকে বলেছ, সবাই কিন্তু জিজ্ঞেস করেছে ও কেন হঠাৎ এতদিন পর এখানে একা এসে আছে, আমি কিন্তু মুখ খুলিনি।'

- রুপুদা, আমিই নিয়ে আনার ব্যবস্থা করবো। 

তার পর দিনিই সন্দীপ ঠেলা ভাড়া করে আলমারিটা নিয়ে আসে। কাউকে কোনোদিন কিছু বলেনি ও। এই রূপুদার কাছে ও চিরকৃতজ্ঞ। কেননা উনিই সন্দীপকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে চাকরি দেন। আর এ কথাও সত্য যে উনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বাড়িটা বিক্রি করার জন্য, এই একটা ঘটনা দিয়ে তাকে কখনই বিচার করা যায়না। আর ভালোই তো হয়েছে বিক্রি হয়নি, নাহলে কোথায় থাকত আজ সে? পাটনা থেকে আসার পর সন্দীপের দাদা প্রদীপ ওকে ন মাস আশ্রয় দেয়। তারপর আস্তে আস্তে নিজের ফ্ল্যাটে আসে সন্দীপ, নিজের জগৎ, যেখান থেকে ওকে কেউ কোনোদিন চলে যেতে বলবেনা। 

এইরকম নানান টুকরো টুকরো ঘটনার মোকাবিলা করতে করতে প্রায় দু বছর পর সন্দীপ একটু শক্ত সমর্থ হয়েছে। তার একা থাকার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। আজ ও সবাইকে বলে ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে। হ্যাঁ, ও একা। কে দোষী, কেন ডিভোর্স হয়েছে এ সব প্রশ্ন ওকে আজকাল কেউই করেনা। জানে উত্তর পাবেনা। 

ওর বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট দালান আছে, সেখানে নানান রকম পশু পাখি আসে, বুলবুলি, টুনটুনি, চড়াই, টিয়া, কাক, শালিক, কাঠবেড়ালি, কুকুর, বেড়াল ইত্যাদি প্রভৃতি, তাদের নিয়েই ওর সময় কাটে, কিছু গাছ আছে। যখন ওদের জল দেয়, ওদের সাথে কথা বলে সন্দীপ, পাখিদের খেতে দেয়, কখন বিস্কিট, কখন ভাত ডাল, কখনো মাংস, ডিম্। পাখিদের খাবার এটিকেট দেখে ও কত কিছু জানতে পারে, সবচাইতে আগে খায় কাক, তারপর আসে, চড়াই, তারপর শালিক, আর সবশেষে আসে কাঠবিড়ালিরা। 

ওদের সাথেই কথা বলে, অনেকে ওকে জিজ্ঞেস করে, 'তা কার সাথে কথা বলেন আপনি?' সন্দীপ হেসেই উড়িয়ে দেয়। তবে যখন ও প্রেসার কুকার, থালা, বাসন, গেলাসের সাথে কথা বলে, তখন সত্যিই মনে হয় বাড়িতে কেউ আছে! 

'তোমার কোন কান্ডজ্ঞান নেই? বলছি আসছি, এরই মধ্যে তিনটে হুইসিল দিতে হলো? এখন দেখতো, গলা ভাত খেতে হবে আমাকে!' মাইক্রোওয়েভ থেকে গরম খাবার বার করতে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে, 'ওরেব্বাবা! এতো গরম? তোর মাথায় কোন বুদ্ধি নেই? বলি থামতে জানিস না? ঘুরেই চলেছে, ঘুরেই চলেছে ! এতো গরম কেউ খেতে পারে?' ওয়াটার পিউরিফায়ার থেকে যখন জল গড়িয়ে পরে, ও ঘর ঝড় দিতে দিতে চিৎকার করে বলে, 'পরেই যাচ্ছে, পরেই যাচ্ছে দেখো, দেখছিস ভরে গেছে, তবুও পরেই যাচ্ছিস, অন্ধ নাকি?' গমগম করে টিভি চালিয়ে রাখে সন্দীপ, ওর মনে হয় বাড়িতে ভর্তি লোক। 

ওর প্রতিবেশীরা খুবিই ভাল লোক। সবাই এক প্রকার মেনেই নিয়েছে যে সন্দীপ মোটেও একা থাকে না। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract