STORYMIRROR

Supratik Sen

Tragedy Others

3.4  

Supratik Sen

Tragedy Others

মাসিমণি

মাসিমণি

4 mins
336


আমার মাসতুতো বোন। আমার মা সম্পর্কে একটা খুব কুরুচিকর মন্তব্য করে, একটা হোয়াটসঅ্যাপ ফ্যামিলি গ্রুপে। এই গল্পটা সেই নিয়েই। 

আমি আমার মায়ের কাছে শুনেছি, তার দাদুকে নিয়ে তার দাদারা হাসিঠাট্টা করতো, তাকে নিয়ে গানও বেধেছিল। সেই গানটার কিছুটা অংশ গেয়ে রেকর্ড করে পোস্ট করেছিলাম। এখান থেকেই এই ছোট গল্পের সূত্রপাত।


- এই গানটি শুনেছি আমার মামারা বানিয়েছিল ওদের দাদুকে খেপানোর জন্য। ভারী মজার গান। তোমাদের কি কারুর মনে আছে?

(ওডিও রেকর্ডিং) 

আমার মাসতুতো বোন উত্তর দিল খানিকটা এইরকম:

- নাঃ কোনদিন শুনিনি। Unfortunately, যে কোন কারণেই হোক বিশেষ তেমন কোন ঘটনা বা কোন কিছুই জানিনা । মামনি ((আমার মাসতুতো বোন নিজের মাকে মামণি বলে সম্বোধন করে) মাসিমণির মতো গপ্পি নয় কোনদিনই।চুপচাপ কাজ করে যেতো। কথা বলতে পারতো না কোনদিনই । [...] সেদিক থেকে মাসিমণি অনেক রসিয়ে acting করে নানান গল্প বলতো।


ওর মাসিমণি, আমার মা গপ্পি, এক্টিংকরে, আর নিজের মা সম্পর্কে তার খুবই শ্রদ্ধাশীল মন্তব্য, 'চুপচাপ কাজ করে যেত'। অনেক ভেবে মনে হয় আমার ওই গানটা রেকর্ডিং করে পাঠানোতেই বোধহয় এ হেন নিষ্ঠুর মন্তব্য, যেই মাসীমণি মারা গিয়েছেন বহু বছর আগে, তাঁর সম্পর্কে! ওই গ্রুপটা আমিই ক্রিয়েট করেছিলাম, সেই জন্য আমার বোন প্রচন্ড আপত্তি জানিয়েছিল। 'তোর কী দরকার, তুই তো মামাবাড়ির, ওই ফ্যামিলির তুই কে যে ফোপরদালালি করছিস?’

প্রসঙ্গত বলে রাখি আমার মা চিরকালই ফ্যামিলির ব্ল্যাক পিটার । আশ্চর্য এই যে De mortuis nil nisi bonum, যার বাংলা মানে করলে হয়, 'মৃত ব্যক্তির সম্পর্কে ভালো ছাড়া কিছু বলনা', এই লাতিন প্রবাদটা বোধহয় আমার মায়েদের মত লোকেদের জন্য নয়। 

কাজেই , আমার বোন ভেবেই নিয়েছিল আমার মা সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য বোধহয় ওই গ্রুপে অনেকেই এপ্রুভ করবে, বা এপ্রিশিয়েট করবে। কিন্তু সেটা একেবারেই ভুল কেননা অনেকেই আমাকে ফোন করে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এরপর থেকে, আমার গল্পের গরু গাছে চড়েছে। বোধহয় চরম দুঃখের বহিপ্রকাশ। মোনোলগ।


- তোর এ ধরনের মন্তব্য শুনে আমার বিদ্যাসাগরের কথা মনে পড়ছে জানিস। এক ব্যক্তি যখন ওনাকে তিরস্কার করছিলেন, বিদ্যাসাগর বলেন, 'আমি নির্ঘাত কোনো সময়ে আপনার কোন উপকার করেছিলাম!' 


এ্যাঁ, কি বলছিস? মাসিমণি তোর কি উপকার করেছেন? তা এখন যে তুই হল্যান্ডে সুখে শান্তিতে সংসার করছিস, পারতিস? আমার মা যদি আমার পিসতুতো দাদার সাথে তোর চুটিয়ে প্রেম করা বন্ধ না করতো? 


কী বলছিস? কবে? মনে নেই? সারা দুপুর তুই টুবুদাকে গান শোনাতিস, 'বিতিনা বিতায়ি', 'পিয়া বিনা, পিয়া বিনা,', 'রেয়না বিত যায়ে, শ্যাম না আয়ে'? তখন আমার মাই তো তোকে রক্ষা করেছিল, চীৎকার করে, এক্টিং করে, কেঁদে কেটে। সব ভুলে গেলি?


কী? আমিও আমার মায়ের মতোই হয়েছি? ঝগড়ুটে? ঠিকই বলেছিস রে! আমি ত সবই হারিয়েছি, কিন্তু বড়দের অশ্রদ্ধা করার শিক্ষা আমার মা আমাকে দেয়নি, তুই মেশোমশাইয়ের সন্তান ভাবতে আমার কষ্ট হয়

। আমার মা তোর চোখে যাই হোক, আমার কাছে উনি দেবী। আমার মা যেমন গৃহকর্মে নিপূণা ছিলেন তেমনই আবার আমার বাবার কাঁধে কাঁধ রেখে চিত্রাঙ্গদার মত আজীবন উপার্জনও করেছেন। সকাল সাতটায় বেড়িয়ে যেতেন, আর রাত সাড়ে আটটার পর ফিরতেন। যবে থেকে বিয়ে হয়েছে শুধু উদয়াস্ত খেটেই গেছেন। 


কি পরিবার থেকে কী পরিবারে বিয়ে হয়েছিল জানিসনা? পাগল ভাসুর, শয্যাশায়ী শ্বশুর, কোমড়ভাঙা শ্বাশুড়ী, দুজন অবিবাহিত ননদ। হাসিমুখে না হলেও মেনে কিন্তু নিয়েছিলেন। আমার মাসীমণি, মানে তোর মা, যখন যা বানাতেন, পুতুল হোক, সস, জ্যাম, বা কেক যাই হোক, আমার মা তার স্কুলে গিয়ে, আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করে দিত, মনে আছে? কাউকে কোনো দিন বলেছিস? জানিস আমার বাবার ক্ষমতা খুব সীমিত থাকায় আমার জেঠুকে ইনস্টিটিউশনালাইস করতে পারেনি, ওনার ঘরটা ছিল আমাদের বাথরুমে যাবার ঠিক মুখে, আমরা প্রত্যেকবার বাথরুমে যাবার আগে জেঠুকে দেখতাম হয় আমাদের গায়ে থুতু ফেলছেন নয়ত হাতের সামনে যা আছে ছুড়ে মারছেন, এটা আমার মা যখনই দেখত হাউহাউ করে কাঁদত, আমি বলতাম, কেঁদ না, আমার গায়ে কিছু লাগেনি। তোদের কারুর ছোটবেলা এরকম ভাবে কেটেছে? তবে আজ বহু বছর পর নতুন করে যেন এই থুতুটা অনুভব করলাম। তোর মাসীমণির আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকা সত্ত্বেও তো তোদের মাসের পর মাস রেখেছে রে, ভুলে গেছিস? আমার তো স্মৃতিতে নেই যে তোদের বাড়িতে কোনোদিন ছিলাম বলে, গরমের ছুটিতে ওই কয়েকদিনের জন্য ছাড়া? আর এতো বড় কথা তুই তোর মৃত মাসীমণির সম্পর্কে বলতে পারলি? আর তাও অতজনের একটা গ্রুপে? তুই কি জানিস আমার মায়ের USP ঠিক কি ছিল? শুধু ভালবাসা। আজ ওঁর এই ভালবাসার জন্যই বোধ করি মৃত্যুর পরেও প্রতিবেশী অপর্ণা দির বাড়ি গিয়ে দেখি, মায়ের ছবি টাঙানো, যা আমরা সচরাচর নিজেদের মা বাবাদের টাঙিয়ে রাখি। অবাক হচ্ছি দেখে ওনার স্বামী আমাকে বলেন, 'জানো প্রতীক, আমি এইরকম ভালবাসা কারুর থেকে পাইনি, এক কাপ চা করলেও ডেকে বলতেন, 'সুভাষ এতো কাজ করতে হবেনা, একটু চা খেয়ে যাও, উনি নিজে হাতে যা রান্না করতেন আমাদের সবাইকে দিতেন, উনি আমার মায়েরই মত।' 

কি বলছিস? আমি কি চাই? 


অশেষ ধন্যবাদ জিজ্ঞেস করার জন্য। আমি জানি তুই তোর মাসীমণির সম্পর্কে যা ভাবিস তা তুই ভাববিই, একটাই অনুরোধ,আমার অবর্তমানে বলিস, আমার সামনে বলিস না, আমার তো মা। আমি কখনই তোর মায়ের সম্পর্কে তোকে কেন কাউকেই কিছু বলবো না, আজ আমি একা থাকি দেখে অনেক আদর পাচ্ছি ওনার থেকে, যখনই যা কিছু ভালমন্দ রান্না করেন, আমাকে ডাকেন, দুপুরে ডাকলে রাত্রের খাবারও প্যাক করে দেন। আমি আমার মা মারা যাবার পর এতো ভালবাসা কারুর থেকে পাইনি। আমার মায়ের মতোই স্নেহশীল উনি, আমার মায়ের থেকে কোনো অংশে কম নন। আমি ওনার কণ্ঠস্বরে মায়ের গলা শুনি, ওনার হাতের ছোঁয়ায় মায়ের আদর অনুভব করি, ওনার গায়ে আমি আমার মায়ের গন্ধই পাই। 


এই গল্পটা লেখার জন্য ওনাকে আমি একটা কথাই বলতে চাই, আমায় ক্ষমা করো মাসীমণি।


ডিসক্লেইমার: এই গল্পের অনেক কিছুই সত্যি না। গল্পের খাতিরে লেখা। উদাহরণ স্বরূপ বলতে গেলে বলতে হয় যে প্রতীকের মাসতুত বোনের ওই মন্তব্যের জন্যে কেউই তাকে ফোন করে কোনোরকম বিরক্তি প্রকাশ করেননি।  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy