Sanghamitra Roychowdhury

Classics

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

সিঁদুরের দাম

সিঁদুরের দাম

9 mins
791


সকাল থেকে চিল চিৎকার চলছে মল্লিকবাড়ীতে।

পারিবারিক দুর্গোৎসব পালিত হয় এবাড়ীতে। দোলা এবাড়ীর নতুন বৌ। বিয়ে হয়েছে সবে মাস চারেক। মল্লিকবাড়ীর ছোট ছেলে বিক্রমের বৌ দোলা, ভালো নাম দোলনচাঁপা। সাংবাদিকতার চাকরি করে, ওরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই। বেরোতেই হোলো আজ ওদের, ডিউটি আছে যে। নবমীর রাতের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে, বিক্রমের মা দোলাকে ডেকে বললো, "কাল আর তুমি কোনো ডিউটি নিও না। কাল বিজয়া দশমী। এটাই তোমার বিয়ের পরে প্রথম পুজো। কাজেই কাল বাড়ীর সব আত্মীয় স্বজন আর অন্যান্য এয়োস্ত্রী বৌ মেয়েদের সাথে সিঁদুরখেলায় যোগদান করবে। এই নিয়ে তুমি আর কোনো কথা বাড়িও না। সবসময় সবজায়গায় তোমার ঐ বাচালতা চলে না, বুঝলে? বিয়ের পরে স্বামী সংসারের কল্যাণ অকল্যাণ বলে একটা কথা আছে, তা জানো তো?" লম্বা চওড়া এই ভাষণটি দোলাকে শুনিয়ে বিক্রমের মা, অর্থাৎ দোলার শাশুড়ি চলেই যাচ্ছিলো। দোলা ঘুরে এসে শাশুড়ির পথ আটকে দাঁড়ালো।


দু'কোমরে হাত রেখে মাথার ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে দোলা হড়বড় করে বললো, "কিন্তু মা, খুব স্যরি, কাল তো আমি থাকতে পারবো না। তোমার ছেলে কিছু বলে নি তোমায়? কাল তো তোমার ছেলের আর আমার দু'জনেরই একসাথে কভারেজ আছে। আমরা সকাল সাতটাতেই বেরিয়ে যাবো। ওবি ভ্যান আসবে সাতটার মধ্যেই। তুমি আগে বলে রাখতে পারতে তো ছেলেকেই? আসলে এই কলকাতার বনেদি বাড়ীর পুজো আর বারোয়ারি পুজোর বরণ- বিসর্জন ইত্যাদির মধ্যে একটা তুলনামূলক ধরনের প্রতিবেদন নিয়ে একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে কাল আমাদের। আর এটা তো আমাদের বিয়ের আগেই আমরা পেয়েছি, মা।" মুখ দিয়ে একটু চুক চুক করে আওয়াজ করে, দোলা শাশুড়ির রাগ আরো চতুর্গুণ বাড়িয়ে দিলো।


দুমদুম করে নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে অগতির গতি নিজের স্বামীর ওপর চোটপাট করতে শুরু করেছে বিক্রমের মা। আর সেই চিল চিৎকারের রেশটাই বেশ সুন্দর পাড়া মাথায় করে ফেলেছে। বিক্রমের বাবা চিরকালই স্ত্রীর বিক্রমের কাছে মুখ নীচু করে বসে নীলকন্ঠের মতো সব হলাহল হজম করে। উপায়ই বা কী? মিতাহারী মিতভাষী মিতব্যয়ী মল্লিকমশাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে, "কথায় কথা বাড়ে, আর ভোজনে বাড়ে পেট।" চুপচাপ মশারি খাটিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে মুক্তি পেলো মল্লিকবাড়ীর সাতেপাঁচে থাকতে না চাওয়া কর্তা। তবে মল্লিকগিন্নীও ছাড়বার পাত্রী নয় সহজে। বারান্দায় বসে রাগে গরগর করতে করতে অপেক্ষা করতে লাগলো ছোট ছেলে বিক্রমের জন্য। আর বিক্রমও পাড়ার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, আর দোলার মেসেজের অপেক্ষা করছে, মা শুতে গেছে নাকি। খানিকক্ষণ ধরে একাএকাই বকবক করে, আর প্রচুর মশার কামড় খেয়ে অবশেষে গজগজ করতে করতে গিয়ে নিজেদের শোবার ঘরে ঢুকলো মল্লিকগিন্নী। আর বিক্রমও পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এসে ঘরে ঢুকে পড়লো। আর ঘরে ঘরে বাকী ছেলে, ছেলের বৌরা তো খুশীতে গদগদ। বাহ্, বাহ্, বেশ হয়েছে। এরা কেউ শাশুড়ির পক্ষেও নয়, দোলার পক্ষেও নয়।


দশমীর সকাল সাতটার মিনিট পাঁচেক আগেই মল্লিকবাড়ীর সামনে এসে বিক্রম আর দোলার চ্যানেল "কলকাতা থেকে"র ওবি ভ্যান দাঁড়ালো। আর ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাতটায় বিক্রম আর দোলা গাদাকখানেক ব্যাগপত্র নিয়ে দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে, চেঁচিয়ে, "মা, বাবা, আমরা আসছি", বলেই ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গিয়ে ওদের ওবি ভ্যানে উঠে পড়লো। তারপর মল্লিকগিন্নী স্বামীকে আরেকপ্রস্থ বাক্যবাণ বিঁধিয়ে, বাড়ী সুদ্ধু সবাইয়ের ওপর অকারণ হম্বিতম্বি করে, গোটা পাড়া আরেকবার মাথায় করে শেষমেশ গুম মেরে গেলো। নাক টিপলে এখনো দুধ বেরোবে, এরকম একটা দু'দিনের ছুঁড়ির কাছে এমন পরাজয়? সব দোষ ঐ নিজের পেটের ছেলেটার। বৌকে মাথায় করে ধিনিকেষ্টর মতো নেচেই আছে সর্বক্ষণ। আসুক আজ!


তারপর পুজোবাড়ীর মেলাই কাজের ভিড়ে কখন যেন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বরণের পরে মা দুর্গার প্রতিমা নিয়ে রওনা হয়েছে বাড়ীর সবাই, আত্মীয় কুটুম্ব, পাড়া প্রতিবেশী। বাড়ীটা একেবারে যেন খাঁ খাঁ করছে। নীচের সদর দরজা আর টানা গেটে তালা দিয়ে মল্লিকগিন্নী চণ্ডীমণ্ডপে উঠে মাটির বড়ো প্রদীপখানায় ঘি ভর্তি করে, সলতেটা ভালো করে উস্কে, মায়ের উদ্দেশ্যে গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করে, ওপরের ঘরে চলে গেলো। ফাঁকা বাড়ীতে একলা, মনটা তার হুহু করে উঠলো। মনে হোলো, পুজো আচ্চার দিনে অমন করে মেয়েটাকে না বললেই হোতো। ওর চাকরির যে এমনই ধারা সেসব জেনেই তো ছোট ছেলে বিক্রমের বিয়েতে রাজী হয়েছে তারা। কে জানে সারাদিনে খাবার টাইমটুকু পেয়েছে কিনা? আউটডোর থাকলেই খাওয়াদাওয়ার কষ্ট!


তার আর কী করবার আছে? যার যেমন কপাল! একা একা বোরিং অবস্থা। টিভি চালিয়ে পাদুটো মোড়ায় তুলে, সোফায় ভালো করে হেলান দিয়ে, আরাম করে বসে রিমোট টিপে টিভি চালালো মল্লিকগিন্নী। খুলতেই খবরের চ্যানেল। এই বুড়ো কর্তা কী যে করে, সবসময় খবর। চ্যানেল পাল্টাতে গিয়ে মল্লিকগিন্নীর চোখ আটকে গেলো টিভির পর্দায়, দোলা আর বিক্রম, মাইক হাতে করে কিসব বলছে দোলা। টিভির ভলিউমটা বাড়িয়ে দিলো মল্লিকগিন্নী। বাহ্, দোলাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! আজ রাগারাগির জন্য বেরোবার সময় দেখা হয় নি। লাল হলুদে কাজ করা জামদানিটা পরেছে। দুহাতে সোনার বালা, কপালে লাল টিপ, গুছিয়ে চুলে ক্লিপ লাগানো। আর দুগালে সিঁদুর লাগানো। মল্লিকগিন্নী চোখ ফেরাতে পারছে না। এবার দোলা বিসর্জনের ঘাট, সাবেকি পুজোর কর্মকর্তা আর পারিবারিক পুজোর বাড়ীর লোকেদের দেখিয়ে কথা শুরু করেছে। মল্লিকগিন্নী পিঠ টান করে বসলো। ইস্, অনেকক্ষণ ধরে চলছে মনে হয়, আর একটু আগে টিভিটা চালালেই হোতো!


দোলা মুখের সামনে মাইক ধরে বলছে, "সিঁদুরখেলা কথাটি আমার মতে কিন্তু বড্ডো সীমিত.... যে সধবা মেয়েটি বাসনমাজুনি, অথবা সস্তার হোটেল চালায়, কিম্বা সব্জি বা মাছ বাজারে বসে বিকিকিনি করে, সেও কিন্তু যোগদান করে না এই সিঁদুর খেলায়। কারণ এই দু-তিন ঘন্টা ব্যয় করার মতো পর্যাপ্ত সময় নেই তার হাতে। আমার বাপের বাড়ীতে দোল থেকে দুর্গোৎসব সবই হোতো কয়েক বছর আগে পর্যন্ত। আজকাল ভাটা পড়েছে, জনবলের অভাবে। সেখানে কিন্তু প্রত্যেক পুজোতেই বাড়ীর মেয়েরা প্রতিমা বরণ এবং সিঁদুর দিয়ে একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময়ও করতো। কিন্তু কিছু বছর ধরে এই সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতেই দেখা যাচ্ছে দুর্গাপুজোর দশমীতে সিঁদুর খেলার ধুম যতটা না সিঁদুর খেলায়, তার থেকে বেশী, কে কত বেশী নিষ্ঠাবতী তা প্রমাণ করার এক প্রতিযোগিতায়। বেশ, তর্কের খাতিরে ধরেই নেওয়া গেলো, যাঁরা এতো হৈহৈ করে সিঁদুর খেলে নিজেকে জাহির করছেন, তাঁরা সত্যিই অত্যন্ত নিষ্ঠাবতী, তবে তাঁদের এই সিঁদুর খেলাখেলির ছবি ফেসবুকে না পোস্ট করলেও তো চলে। যখন ছবি পোস্ট করার হিড়িক ছিলো না, তখন আমি আমার পাড়ার বা পাশের পাড়ার প্যান্ডেলে কিন্তু এমন উদ্দাম সিঁদুর খেলার দৃশ্য দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। যে উৎসব একান্ত নিষ্ঠার তার পালনেও নিষ্ঠাই থাকা উচিৎ । আজো বয়োজ্যেষ্ঠ প্রত্যেকেই আমাদের কপালেও সিঁদুর ছুঁয়ে শুভকামনা জানান, তা তিনি সধবা হোন বা বিধবা। ছোটবেলায় আমার ঠাকুমাকে বা পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠাদের আমরা গালে সিঁদুর ছুঁইয়ে দিতাম। এবং তাঁরাও পাল্টা বলতেন খেয়াল রেখো, মাথায় দিও না। এটা মনে হয় খানিকটা নিজস্ব সংস্কার ও মানসিকতার উপরেও নির্ভরশীল। সিঁদুরখেলা রীতি বা উৎসব যাই হোক, তাতে ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের উদ্যোগটাই বোধহয় আসল হওয়া উচিৎ। যিনি বিধবা তিনি যদি সত্যিই না চান সিঁদুর খেলতে, তাকেও যেমন কিছু বলার নেই, তেমনি সধবা যে মহিলাটি সিঁদুর খেলছেন তিনিই সার্থক পত্নী, আর যিনি সিঁদুর খেললেন না, তিনি পত্নীই হয়ে উঠতে পারেন নি, এমন ভাবার কারণ কিন্তু নেই। এসব ভেবে সময় ব্যয় করার অবকাশ হয়তো আমাদের মতো যতো অত্যাধুনিক ফেসবুক ব্যবহারকারীদের আছে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে গ্রাসাচ্ছাদনের লড়াইয়ে নিয়োজিত পতি অন্ত প্রাণ পত্নীটির কাছে আছে কি? ভাববার বিষয়!!" থেমেছে দোলা।


হাঁ করে অবাক হয়ে শুনতে শুনতে মল্লিকগিন্নী ভাবছে, "সত্যিই তো, দোলা তো একটা কথাও ভুল বলে নি। আমি তো নিজের চোখেই দেখলাম, বড়ো মেজো সেজো, তিন বৌইই নিজের নিজের ঘরে ঢুকে যেন আরো বেশী বেশী করে সিঁদুর মেখে ছবি তুলছিলো। হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছি। বড়ো বৌয়ের বোন এসেছে। দু'বোনের তো বিরাট ছবি তোলার ধুম! মেজোবৌ আর সেজোবৌ তো দু'জনেই দু'জনকে দিয়ে ছবি তোলাচ্ছিলো। ঠিক কথা! অতো ছবি তোলার আছেটা কি? এদিকে মালতী, পুঁটির মা, জয়া... ওরা তো তখন ভোগের বাসনকোসন মেজে ঘষে তুলছিলো ভাঁড়ারে। ওরাও তো সধবা, এয়োস্ত্রী, কিন্তু সিঁদুর খেলতে পারলো কই, কাজের চাপে?" মনটা ধীরেধীরে নরম হচ্ছে মল্লিকগিন্নীর। দোলা সত্যি সত্যিই অন্যধাঁচের মেয়ে যে!


এবার অবাক হয়ে মল্লিকগিন্নী দেখলো, তার ছোট ছেলে বিক্রম, আজ পায়জামা পাঞ্জাবি পরেছে, হাতে মাইক নিয়ে বলছে, "রইলো বাকী, সিঁদুরখেলা কী সবাই নির্বিশেষে খেলতে পারবে? সেই সুযোগ কী থাকা উচিৎ? বিতর্কিত প্রশ্ন। তবে যদি সিঁদুর খেলায় অংশগ্রহণ করতে না পেরে, সত্যিই কেউ যদি দুঃখ পেয়েছেন বলে আমার কাছে প্রকাশ কেউ করেন, তবে আমি তাঁকে সামিল করবো, আনন্দ উৎসবে, প্রতিকূলতা থাকলেও। কিন্তু আমি নিজে থেকে কিছুতেই এটা ভেবে নেবো না, তিনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। কারণ এই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া লেন দেনে আমি বিশ্বাস করি না। আমার বাড়ীতেও এখনো দুর্গোৎসব হয়। যখন আমার মনে থাকার মতো বয়স তখনই আমরা বাড়ীতে আমাদের বাল্যবিধবা পিসিমা, বড়দিদাকে সিঁদুরখেলায় গালে কপালে সিঁদুর পরিয়েছি আমরা সবাই। তাঁরাও পরিয়েছেন। এতে কোনো হৈহৈ রৈরৈ, গেলো গেলো রব, আমার পরিবারের মধ্যে আমি দেখি নি। ঐ জন্যই তো বলতে পারি, এই রীতি বা উৎসব যাই বা হোক, তা কেমন ভাবে পালিত হবে তা সম্পূর্ণই নির্ভর করে ব্যক্তিগত সংস্কার বা মানসিকতার উপরেই। যদি কেউ মনে করেন, তাঁর সহনাগরিক কোনো বৈষম্যের শিকার হবেন না, তবে তিনি অবশ্যই ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই বিভেদ বৈষম্য দূর করার সাধু উদ্যোগ নিতেই পারেন।

সে যেমনই হোক সেটা একটা উদ্যোগ হবে। আর যাঁর কথা ভাবা হচ্ছে তিনি দুঃখিত কিনা, তাঁকেও তাঁর দুঃখের কথাটুকু মুখফুটে সর্বসমক্ষে জানাতে হবে। এবং প্রয়োজনে নিজের ভালোলাগার কাজ নিজেকেই করতে হবে।


আগে একসময় বিধবারা সাদা থান পরতো, এখন রঙীন পরে। আগে সম্পূর্ণ নিরাভরণ থাকতো, এখন গয়নাগাটি পরে। আগে একান্নে নিরামিষ খেতো, এখন সবই খায়। তো সময়ের প্রভেদে সবই হতে পারে। তবে তাতে করে মনটি কী উন্নীত হোলো? কোনোপক্ষেরই? সার্থক শিক্ষা অবশ্যই কুসংস্কার সরাবে একদিন। আমার একান্ত ভাবে খুব ব্যক্তিগত মতামত, আমি মনে করি যা কিছু দেখনদারি তাই খারাপ। সিঁদুরখেলার কি আদৌ কোনো বৈজ্ঞানিক মাহাত্ম্য আছে? কেবলই ঠুনকো লোকাচার ব্যতিরেকে? মানুষ নিজের প্রয়োজনে নিয়ম বানিয়েছে, সেই নিয়মের শৃঙ্খলে দমবন্ধ লাগলেই নিয়ম ভাঙতে চাইছে। যে আচার রীতি নীতির যৌক্তিকতা প্রশ্ন চিহ্নের সামনে, সেই নিয়ম পালনের যৌক্তিকতাই বা কী? যদি কেউই সিঁদুর না খেলে, তাহলেও কী এই সৃষ্টির খুব কিছু যাবে আসবে? সত্যিই? নয়তো আরেক কাজ করা যেতে পারে, অনেকেই সিঁদুরখেলায় অংশ নিতে পারছে না বলে, সিঁদুরখেলাকেও সার্বিক বয়কটের ডাক দেওয়া যেতেই পারে! অভিনব আন্দোলন হয়ে উঠতে পারে তাতে! কারুরই সিঁদুরখেলার দরকার নেই! এটা বোধহয় ভাবার সময় এসেছে, আসলে সিঁদুরও আর পাঁচটা সাজগোজের উপকরণের মতোই, যেমন ফেসপ্যাক লিপস্টিক বা কাজলের মতোই। তবে ঐ কথাই বারবার ঘুরেফিরে আসছে, মনের উন্নয়ন! কুসংস্কার সব দূর হোক। এতো নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল কী একুশ শতকের কথা? যখন মানুষ চন্দ্র বা মঙ্গল অভিযান করছে। সিঁদুরখেলা একটা সাধারণ উৎসব, যেমন দোল বা হোলি। না খেললেও কিছুই যায় আসে না কারোর। তেমনি সিঁদুর না খেললেও কিছুই হয় না, এই বোধটাই দরকারি.... আজকের এই একুশ শতকের পৃথিবীতে, কলকাতাবাসী হিসেবে আমার অভিমত।"


ছেলের কথা শুনে থম মেরে বসে বসে মল্লিকগিন্নী ভাবছে, "এরা নতুন যুগের ছেলেমেয়ে। কত আলাদা ভাবনা চিন্তা। কিন্তু ভুল বা অযৌক্তিক তো নয় একটাও!" তার মাথার মধ্যে তখনও দোলা আর বিক্রমের কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে। চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে গেলো ঢাক আর কাঁসর ঘন্টার আওয়াজে। বিসর্জন সেরে ফিরে এসেছে ওরা।


তাড়াতাড়ি নীচে নামলো মল্লিকগিন্নী, দরজার তালা খুলতে। একপাশে দাঁড়িয়ে মল্লিকগিন্নী। সবাইকে ঠেলেঠুলে হুড়মুড় করে ঢুকছে দোলা। দু'হাত ভর্তি সিঁদুর নিয়ে মল্লিকগিন্নীর দু'গাল ভর্তি করে চিৎকার শুরু করলো, "শুভ বিজয়া মা, শুভ বিজয়া।" হতবাক মল্লিকগিন্নী, "এই, তুমি কোত্থেকে এলে? এই তো টিভির ভেতর ছিলে!" "ওহ্ মা, তোমাকে নিয়ে না আর পারি না। আরে বাবা, ওটা কী লাইভ প্রোগ্রাম ছিলো নাকি? ওটা রেকর্ডেড। আমরা বিকেলের মধ্যেই আমাদের কাজ শেষ করে দিয়ে এসেছি। টেলিকাস্ট হোলো এখন। আমরা তো সন্ধ্যের খানিকটা পরেই সোজা একদম ঘাটেই চলে গিয়েছিলাম। দেখলে তো, কেমন ম্যানেজ করে ফেললাম সব?"


দোলার চিবুক ছুঁয়ে চুমো খেয়ে মল্লিকগিন্নী এবার বললো, "খালি যতো জ্ঞানের কথা টিভিতে? আর এই এতো রাত্তিরে দিলে তো বেতো বুড়িটাকে আবার সিঁদুর মাখিয়ে ভূত করে? এবার আবার আমায় জল ঘাঁটতে হবে যে!" বাড়ী সুদ্ধ সবাইয়ের চোখ গোল, মুখ হাঁ, একী সত্যিই মল্লিকগিন্নী? বাব্বাহ্!


দোলা আবার চেঁচালো, "আরে বাবা, কোনো চিন্তা নেই, তোমায় জল ঘাঁটতে হবে না। মেকাপ রিমুভার আছে তো!" মল্লিকগিন্নী আঁতকে উঠলো, "ও বাবা, সেতো অনেক দামী, শেষে সিঁদুর তুলতে?" দোলা শাশুড়ির গালে গাল ঘষে, "সে তো মায়ের সিঁদুরের দাম বুঝতে পারার দামের থেকে কমদামী গো!" আজ মল্লিকগিন্নীর পেটের মেয়ে না থাকার দুঃখ মিটে গেলো, সিঁদুরের দামে!!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics