Subhash Kar

Abstract Comedy Others

3  

Subhash Kar

Abstract Comedy Others

সীমান্ত-শহরে রাষ্ট্রপতির নামবিভ্রাট (শারদ সংখ্যার জন্যে)

সীমান্ত-শহরে রাষ্ট্রপতির নামবিভ্রাট (শারদ সংখ্যার জন্যে)

5 mins
220



আশির দশকের একেবারে গোড়ার দিক। আমার জন্ম এবং কর্মস্থল ত্রিপুরার রাজধানী-শহর আগরতলায় টেলিভিশন ব্যাপারটা তখনো স্রেফ এক গল্পগাঁথার উপাদান। তিনদিকে বাংলাদেশ পরিবেষ্টিত এই রাজ্যের একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা এই শহরে হাতে-গোণা কিছু বিত্তশীল পরিবারে গোটাকয় টিভি সেট থাকলেও সেগুলির ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণ বিদেশনির্ভর, মানে শুধুই বাংলাদেশের টিভি সেন্টারের প্রোগ্রাম টিউন করে চলা। হবেই বা না কেন? নিজ দেশে ব্যাপক স্তরে ট্র্যান্সমিশনের কোন ব্যবস্থাই তখন অব্দি হয়ে উঠেনি যে!


তবে অচিরেই ১৯৮২-র এশিয়াডের প্রস্তুতিপর্বকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশেও পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাপক উৎসাহে ও নির্দেশে ‘দূরদর্শন’ তখন সীমিত সংখ্যক মহানগর /নগরের বাইরে দেশের প্রতিটি শহরাঞ্চলকে টেলিকাষ্টিং এর আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর। গোটা দেশব্যাপী রাজ্যে রাজ্যে ট্র্যান্সমিশন-স্টেশন বসানোর কাজ শুরু হয়ে গেল। অনুষ্ঠিতব্য এশিয়াডের হাতছানিতে ঘরে বসেই চলন্ত ছবি দেখবার আশায় অনুপ্রাণিত হয়ে সেই প্রথমবার আগরতলা শহরের বেশ কিছু অল্পস্বচ্ছল নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার টেলিভিশন সেট কিনতে শুরু করে। এই নতুন উদ্দীপনায় নানা কোম্পানির ছোটবড় সাইজের সাদাকালো টিভি যারাই ঘরে নিয়ে আসতে পারল, তাদের সামাজিক স্ট্যাটাস হঠাৎই বেশ বড়মাপের হয়ে উঠল। 


শহরে বেশ কিছু টিভি-সেট তো এসে গেল ঠিকই; কিন্তু প্রস্তাবিত দূরদর্শন কেন্দ্রটি নানা কারণে পূর্বসূচিত সময়ের মধ্যে স্থাপিত হতে পারছিল না। সরকারী কাজে যেমনটি হয়ে থাকে, বারবারই ব্যর্থতার পর শুধু নতুন নতুন তারিখের প্রতিশ্রুতি মিলত। অবশেষে নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আগরতলা শহরে স্টেশনটি চালু হতে হতে একেবারে বিরাশী সালের শেষদিক এসে গেল। এশিয়াডের উদ্বোধন তখন একেবারে নাকের ডগায়। 


নতুন কেনা টিভি-সেটগুলি অবশ্যি এতদিন বেকার বসে থাকে নি। মাঝখানে প্রায় দীর্ঘ এক /দেড় বছর সীমান্তপারের শক্তিশালী ঢাকা-কেন্দ্র থেকে ধরা পড়া টেলিকাষ্ট প্রোগাম দেখে বিনোদনের স্বাদ মোটামুটি পাওয়া যাচ্ছিল বৈকি। দেশবিদেশের নানা সংবাদের সাথে কিছু তথ্যসমৃদ্ধ ফিচার ও ধারাবাহিক, এবং কদাচিৎ বাংলাদেশের কতিপয় আঞ্চলিক সিনেমাও দেখা যেত।


এদিকে পাড়ায় পাড়ায় এক একজনের ঘরে যেই না একটি ‘বাক্স-সিনেমা’ আসছে, অমনি তাকে কেন্দ্র করে এলাকার দশ-পনের-বিশ ঘরের মানুষ নিজেদের উদ্যোগেই খোদ টিভি-মালিকের ঘরে বিনোদনের আসর বসিয়ে দিচ্ছে। ঘরে রাখা বড়দের চেয়ারগুলি বাদ দিয়ে বাকি সব টুল, মোড়া, খাট-চৌপায়া, জলচৌকি ইত্যাদি দখল হয়ে যেত। শেষ অব্দি বাড়ির সব মেয়েছেলে ও বাচ্চাদের জন্যে ঘরের মাঝখানটায় বেতের পাটি বা মাদুর পেতে বসার ব্যবস্থা করতে হ'ত। বাংলাদেশ চ্যানেলে চালু প্রোগ্রামের সময়সীমা অবশ্যি খুব বেশী ছিল না- সকাল-বিকেল মিলিয়ে মাত্র ঘন্টাকয়েকের অনুষ্ঠান। ভাগ্যিস আরো বেশী সময় নিয়ে অন্যকিছু দেখার কোন সুযোগ ছিল না- নইলে গৃহস্থের কপালে দুর্গতির শেষ থাকত না। 


বাংলাদেশ টিভিতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে খুব ঘনঘন খবর পরিবেশনের রেওয়াজ ছিল। সংক্ষিপ্ত ও বিস্তৃত সংবাদ বারেবারেই নানা আঙ্গিকে পরিবেশিত হ'ত। সেই সময়টায় সেদেশের শাসনব্যবস্থা একটা অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাদখলকারী স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি ছিলেন জেনারেল হুসেন মহম্মদ এরশাদ। তিনিই ছিলেন সেদেশের একাধারে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক সর্বেসর্বা। গোটাদেশের নীতি প্রণয়নে তিনিই ছিলেন শেষ কথা। প্রতিবারের খবরে কতবার করে যে ‘রাষ্ট্রপতি এরশাদ’কে দেখানো হ'ত এবং কতবার যে উনার নামটি উচ্চারিত হত তার কোন ইয়ত্তা ছিল না। 


কোন দর্শকই, এমনকি প্রতিবেশীদের ঘরবাড়ী থেকে আসা বাচ্চাগুলি পর্যন্ত পরবর্তী অনুষ্ঠান দেখার লোভে এই ‘এরশাদ-সর্বস্ব’ খবর ছেড়ে উঠে যেত না, তা তাদের কাছে যত একঘেয়ে আর নীরসই লাগুক না কেন। সবারই ভয় ছিল- একবার বাড়ী ফিরে গেলে যদি আবার এখানটায় আসতে কোন বাধা পড়ে যায়! অবশ্যি ঘরে ঘরে তখনো রেডিও-র খবর শোনাটাও ব্যাপকভাবে চালু ছিল, যা ছিল মূলতঃ বিশুদ্ধ দেশী উৎস অর্থাৎ আকাশবাণী পরিবেশিত সংবাদের আকর্ষণে। কিন্তু টিভি দেখার স্বাদ পেয়ে (হোক না বিদেশী ট্র্যান্সমিশনই) বিগত বছর দেড়েক ধরে বাচ্চাদের কাছে আকাশবাণীর বিশেষ কোন চাহিদাই আর রইল না- একমাত্র রোববার সকালে ‘শিশুমহল’ অনুষ্ঠানটির আকর্ষণ ছাড়া। শুধু ‘অডিও এফেক্ট’ যে ‘অডিও-ভিডিওর সংযুক্ত এফেক্ট’-এর কাছে কতটা অকিঞ্চিৎকর তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ ঢাকার টিভি-প্রোগ্রামের সামনে বাচ্চাদের এই একটানা বসে থাকা। কিন্তু এর যে মারাত্মক প্রভাব স্থানীয় সমাজে পড়ল তা শুনলে এদেশের দেশপ্রেমিক যেকোন নাগরিকেরই বিরাট লজ্জা ও দু:খ পাবার কথা। সেকথায় একটু পরে আসছি।


শেষ অব্দি বিরাশীর অক্টোবরের শেষ নাগাদ আগরতলায় ট্র্যান্সমিশন-স্টেশন স্থাপিত হলে আগরতলা দূরদর্শনের বদান্যতায় আমরা সমস্ত শহরবাসী মিলে নভেম্বরে প্রায় দুসপ্তাহ ধরে দিল্লীর এশিয়ান গেমস খুব উপভোগ করেছিলাম। সোনা, রূপো ও ব্রোঞ্জ মিলিয়ে ভারতের পদকের সংখ্যা যখন হাফ-সেঞ্চুরী ছাড়িয়ে গেল, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সকলের সেকি উন্মাদনা! দলগতভাবে মহাদেশে আমাদের দেশের স্থান ছিল পঞ্চম; তবে সকলেই আশাবাদ ব্যক্ত করল- এভাবে বারকয়েক ‘হোষ্ট’ হতে পারলে ভবিষ্যতে পদকের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকবে। কিন্তু এরই মধ্যে একটা দিন সবাইকে অপ্রস্তুত করে টিভির এপারে বসা আমাদের বিনোদনের আসরে সেই বিশেষ লজ্জাজনক ঘটনাটাও ঘটে গিয়েছিল।


নভেম্বরের শেষ দিক। সম্ভবত এশিয়াডের তৃতীয় বা চতুর্থ দিন। আমাদের ঘরে বড় টেবিলটায় রাখা দাদার নতুন কেনা ‘সাটার’ ওয়ালা ‘ভিডিওকন’ টিভির পর্দায় ঝুঁকে পড়ে প্রায় জনাত্রিশেক অত্যুৎসাহী দর্শক মিলে নানা ইভেন্ট দেখছিলাম। উদ্বোধনী দিনের তুলনায় জাঁকজমক ততটা না থাকলেও সুসজ্জিত বৃহদাকার ডায়াসে সেদিনও দেশী-বিদেশী বহু ভিআইপি /ভিভিআইপির সমারোহ। প্রথম দিন থেকেই হিন্দী ও ইংরাজীতে পালা করে ধারা-বিবরণী চলছিল। সেদিন একটা সময়ে হিন্দী ভাষ্যকার যেই বললেন, “অভি হমারে মাননীয় রাষ্ট্রপতি জৈল সিং-জী এশিয়াড মঞ্চপে প্রধার রহে হেঁ ...” আমরা সবাই তখন একটু নড়ে চড়ে বসলাম, কারণ খবরের কাগজে ছবি দেখা ছাড়া মাস চারেক আগে অভিষিক্ত এই রাষ্ট্রপতিকে টিভিতে লাইভ দেখার সুযোগ আর হয়নি। রাষ্ট্রপতির আগমনে গোটা পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে উঠতেই হঠাৎ অবিশ্বাস্যভাবে পাশের বাড়ীর সাত-আট বছরের একটা বাচ্চা ছেলে উত্তেজনায় স্থানীয় ডায়লেক্টে বলে উঠল, “ওমা, কিতা যে কয়! তাইনে বুলে রাষ্ট্রপতি! হি হি! রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্যান জানি আইতে পারছে না, আর ঐ মাইকওলা মানুষটা এই পাগড়িওলা মানুষটারেই রাষ্ট্রপতি কইয়া চালাইয়া দিতাছে। হি হি!” আরো কয়েকটা বাচ্চাও সেই নিরপরাধ নির্মল হাসিতে সমর্থনসূচক সায় দিল। আসলে এদের কেউই কিন্তু খুব অশিক্ষিত ঘরের ছেলেমেয়ে ছিল না- পড়াশুনায়ও খুব যে খারাপ তাও নয়। কিন্তু এই বিষয়টাতে তারা এতটাই অজ্ঞতা দেখাচ্ছে?


আমরা বড়রা হাসব না কাঁদব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। মনে হ'ল- এ তো আসলে আমাদেরই সম্মিলিত লজ্জা!


একটু ভাবতেই বিষয়টা পরিষ্কার হ'ল। এ হ'ল এতদিন ধরে একনাগাড়ে প্রতিবেশী দেশের তথা ঢাকার টিভি প্রোগ্রাম দেখে যাওয়ার ফল। বাচ্চাগুলি ভারত-বাংলাদেশ, দিল্লী/ কোলকাতা বা ঢাকার জটিল প্যাঁচে ঠিকঠাক ঢুকতে না পেরে নিজেরা ভেতরে ভেতরে নিশ্চিতভাবে জেনে বসে আছে- আমাদেরই রাষ্ট্রপতির নাম বুঝি এরশাদ। স্রেফ নাম কিংবা ফটো না-দেখাশোনা বা খুব কম দেখাশোনার কারণে আমাদের নব নির্বাচিত মাননীয় রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং-জী এই বাচ্চাদের মানসপটে একেবারে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে গেছেন। দিনের পর দিন তাদের চোখে ‘রাষ্ট্রপতি এরশাদ’ নামক সত্তাটির ক্রমাগত ভাসা বা কানে বিঁধে যাওয়ার দাপটে আসল রাষ্ট্রপতি জৈল সিং সাহেব কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। 


এরমধ্যেও ভরসার কথা এটাই যে, বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হওয়া গেল ওদের কাছে তখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাননীয়া ইন্দিরা গান্ধীই স্বনামে অক্ষত রয়ে গেছেন। ভাগ্যিস, বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট সেই সময়টায় প্রধানমন্ত্রী পদটিরই অবলুপ্তি ঘটানো হয়েছিল। তাই ঐ পদে আসীন অন্য কোন ব্যক্তির চেহারা বা নাম ঐসব কচিমনে দাগ কাটার মত করে বিগত দিনগুলিতে বারবার দৃশ্যমান বা উচ্চারিত হয়নি।

যাই হোক, রাষ্ট্রপতির নামবিভ্রাটের শিকার ঐসব বাচ্চাদের বছর দেড়েক ধরে ধোলাই হয়ে আসা মগজগুলিকে এশিয়াড-অনুষ্ঠানের এই কয়েক দিনে আবার স্বস্থানে ফিরিয়ে আনা গেল। তাদের ধ্যানে-জ্ঞানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে এরশাদের জায়গায় জৈল সিং-জীর চেয়ারটা পাকাপোক্ত করে আমরা আমাদের সম্মিলিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলাম।

এশিয়াড’৮২-র সবগুলি ইভেন্ট-আইটেম সম্পর্কে আমার পূর্ণজ্ঞান ছিল না সত্যি; কিন্তু আমাদের সীমান্ত-ঘেঁষা শহরটিতে ‘জৈল সিং বনাম এরশাদ’ এর মিউজিকেল চেয়ারের মতো একটি দুর্ভাগ্যজনক প্রতিযোগিতাও যে এভাবে সেটির একটা অলিখিত আইটেম হয়ে যাবে তা কে জানত?

-------•-------


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract