শিক্ষক-দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি
শিক্ষক-দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি


ThankYou Teacher
# শিক্ষক-দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি:-
শিক্ষকদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার কোন শেষ নেই। স্নেহ আর শাসনের সংমিশ্রণে পরম যত্নে নানা বিষয়ে আমাদের অজ্ঞানতা দূর করা কত কত শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাদের মনের গভীরে শ্রদ্ধার স্থায়ী আসন তৈরী করে নিয়েছেন। আজ তাঁদের উদ্দেশ্যে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করছি।
এই মুহূর্তে আমার জীবনে কত শিক্ষক-শিক্ষিকার অবদানই যে খুব বেশী করে মনে পড়ছে ! তাদের সবার কথা তো এই ছোট পরিসরে বলা সম্ভব নয়, তবুও অন্তত: দু'জনের কথা পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই; আর উনাদেরকে জড়িয়ে যে বিশেষ ঘটনা দু'টো মনে খুব বেশী করে দাগ কেটেছিল সেগুলিও বলতে চাই।
১) আমাদের গৌরাঙ্গ স্যার
১৯৬২ সাল নাগাদ বছরের প্রথম দিকটায় আমাদের আগরতলার সরকারী বয়েজ হাইস্কুল উমাকান্ত একাডেমীতে ক্লাশ এইটের অঙ্ক পড়াচ্ছিলেন শিক্ষক শ্রীযুক্ত গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহা। উনার ক্লাশ আমাদের জন্যে সেবারই প্রথম। একেবারে প্রথম দিনটিতেই ক্লাশে এসে উনি বলে রাখলেন প্রতিটি প্রশ্নমালার কিছু বাছা অঙ্ক প্রথমদিকে উনি আমাদেরকে করিয়ে দেবেন- তারপর এর ভিত্তিতে আমরা যেন অন্য সবগুলি অঙ্ক নিজেরাই করে নিতে চেষ্টা করি। যদি কেউ কোন অঙ্ক নিজে করতে না পারে তবে ক্লাশের অন্য কেউ, যে সেটা পেরেছে, তাকে সাহায্য করে দেবে। এরপরও যদি বিশেষ কিছু অঙ্ক নিয়ে অসুবিধে থেকে যায় তবে স্যার সেগুলো নিজেই করিয়ে দেবেন। কিন্তু এটা যেন সুনিশ্চিত হয় যে প্রত্যেক প্রশ্নমালার প্রতিটি অঙ্ক সবাই করেছে।
প্রথম তিনচার সপ্তাহ এভাবেই ক্লাশ চলল। কিন্তু এরপর হঠাৎই একদিন ছন্দপতন! সেবছর কলকাতার কোন এক নামীদামী স্কুল থেকে একটি নতুন ছেলে তার বাবার এখানে বদলি হয়ে আসার কারণে আমাদের সাথে এসে ভর্তি হয়েছিল। পড়াশুনায়, বিশেষতঃ অঙ্কে সে বেশ তুখোড় ছিল। কিন্তু ছাত্র ভাল হলে কি হবে, ছেলেটির ছিল খুব হামবড়া ভাব। সে নতুন হয়েও আমাদের কাউকেই বিশেষ পাত্তা দিত না। তাই আমরাও তার কাছে অঙ্কের ব্যাপারে কোন সাহায্য চাইতাম না।
ওর বাবা ছিলেন একজন বড় ডাক্তার। আমরা দু:খের সাথে লক্ষ্য করতাম কিছু সংখ্যক স্যার ওর কোন অন্যায় আচরণ দেখেও ততটা শাসন করতে চাইতেন না; এক অজ্ঞাত কারণে কতকটা যেন না দেখার ভাণ করে থাকতেন। অবশ্যি গৌরাঙ্গ স্যার ছিলেন এসব ব্যাপারে পুুুুরো ব্যতিক্রমী। স্কুলের সব ছাত্রের প্রতি তাঁর ছিল সমদর্শিতা।
যাই হোক, সেদিন অঙ্ক ক্লাশে গৌরাঙ্গ স্যার নতুন একটা প্রশ্নমালা ধরেছেন। নিয়মাবলী সংক্রান্ত প্রাথমিক বক্তব্যের শেষে উনি প্রশ্নমালার প্রথম দিক থেকে উনার নিজের বাছাই করা একটা অঙ্ক করাতে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে যাচ্ছিলেন। ঠিক এমন সময় সেই নতুন ছেলেটি বলে উঠল, “স্যার, এত সোজা অঙ্কগুলি করিয়ে মিছেমিছি সময় নষ্ট করে লাভ কি? তার চাইতে শেষের দিকের একটু কঠিন অঙ্কগুলির থেকে করানোই কি ভাল নয়?"
সারা ক্লাশ থমথমে। স্যারের প্রতিক্রিয়া কি হয় দেখবার জন্যে আমরা ভয়ে উদগ্রীব। স্যার কিন্তু না রেগে ওকে বসতে বলে শান্তভাবে আমাদের সবার কাছ থেকে জানতে চাইলেন আমরা ঠিক কি চাই। আমরা জানালাম আগের কিছু অঙ্ক না করিয়ে দিলে পরেরগুলি করতে তো আমাদের অসুবিধেই হবে। স্যার তখন ছেলেটিকে বুঝিয়ে বললেন যে, উনি মেনে নিচ্ছেন সে হয়ত খুবই মেধাবী। কিন্তু তাকে জানতে হবে যে, স্কুলটা শুধু মেধাবীদের জন্যে নয়- সকলের জন্যেই। তাই তাকে অনেকটাই ধৈর্যবান্ হতে হবে। আর যদি আগের অঙ্কগুলি তার কাছে এতটাই সোজা মনে হয়, তবে সে একটা কাজ করতে পারে। এখন থেকে সে-ই যেন টিফিন আউয়ারে কিছু সময় বের করে নিয়ে ক্লাশের সব বন্ধুদের আগে থেকেই পরবর্তী প্রশ্নমালার নিয়মাবলী বুঝিয়ে দেয় এবং প্রথমদিকের কিছু অঙ্কের সমাধানও দেখিয়ে রাখে। সে এই প্রস্তাবে রাজী হলে তবেই স্যার এখন থেকে প্রতি প্রশ্নমালার শুধুই শেষের দিকের অঙ্কগুলি করাবেন, আর সেক্ষেত্রে অঙ্কের সিলেবাসটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করে উনি আবার রিভিশনও করিয়ে দেবেন।
ছেলেটি তখন কেমন যেন একটু দমে গেল। আমতা আমতা করে বলল- "না স্যার, এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক না। তেমন কিছু ক্ষতি তো নেই"। আমরা অন্যসব বন্ধুরা মিলে চোখে চোখে তৃপ্তির ও কিছুটা বিদ্রুপের হাসি বিনিময় করছিলাম। টের পেয়ে সে ইনিয়ে বিনিয়ে স্যারকে আরো বোঝাতে চাইল আসলে সে নাকি সবার ভালর জন্যেই কথাটা বলেছিল। স্যার কিন্তু এবার রেগে গেলেন। স্পষ্ট করে বললেন, “এবার কিন্তু তুমি মিথ্যাচার করছ। তুমি খুব ভাল করেই জানো তুমি শুধু নিজের স্বার্থের কথাই ভেবেছিলে- অন্যদের সুবিধে-অসুবিধের কথা তোমার মাথায় মোটেও ছিল না; এখন বর্তে যাওয়া দায় ও তজ্জনিত পরিশ্রম এড়াতে বাধ্য হয়েই পরোপকারের ভাবনার দোহাই পাড়ছ। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে বাবা, জীবনে ছাত্র হিসেবে আরেকটু খারাপ হলেও ততটা ক্ষতি নেই- যতটা ক্ষতি এমন স্বার্থপর আর মিথ্যাচারী হলে”।
স্যারের প্রতি শ্রদ্ধায় আর কৃতজ্ঞতায় আমাদের মন ভরে গেল। আর আশ্চর্য, ছেলেটির চোখেমুখেও জীবন সম্পর্কে একটা নতুন দিশা পাবার ইঙ্গিত ফুটে উঠল! এরপর থেকে সে কেমন পাল্টে গেল। আমাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশতেও শুরু করল। পরে একদিন সমাজে সে নিজেও একজন বড় ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রোগী-দরদী হিসেবে তার খুবই সুনাম হয়েছিল। সেই ডাক্তার বন্ধু বহু বছর পরে একদিন একান্তে আমাদেরই এক ক্লাসমেটকে বলেছিল, “গৌরাঙ্গ স্যারের সেই ভর্ৎসনায় মেশানো পথদর্শী আলোই আজ আমাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে”। উপলব্ধিটা আমাদের সবার জন্যে কমবেশী একই ছিল।
২) আমাদের পূর্ণিমা দিদিমণি
পূর্ণিমা দিদিমণি ছিলেন আমাদের উমাকান্ত একাডেমী সংলগ্ন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। ১৯৫৯ সালে আমাদের ক্লাশ ফাইভে তিনি ইতিহাস পড়াতেন। একদিন ক্লাশে একে একে সবার কাছ থেকেই বাড়ী থেকে শিখে আসতে বলা আগের দিনের পড়া ধরছিলেন। সাধারণত: আমি নিয়মিতভাবে সব বিষয়ের হোম টাস্ক করেই আসতাম- কিন্তু ঠিক সেদিনই না জানি কেন গাফিলতি করে ইতিহাস পড়াটা শিখে আসিনি। আর যাই কোথায়! কানে ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়াতেই হল। ক্লাশের প্রায় অর্ধেক ছেলেমেয়েরই এই দশা। স্বভাবতঃই দিদিমণির ভীষণ রাগ তো হল বটেই, তার চাইতেও বেশী হল মন-খারাপ। আমার দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে বললেন, “শেষ অব্দি তুইও পড়া না শেখার দলে ভর্তি হলি?” আমি মাথা নীচু করে প্রায় কেঁদে ফেলি আর কি।
ওইভাবে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ লজ্জা লাগছিল। দিদিমণি মনের দু:খে বললেন আজ আর নতুন কিছু পড়ানোর মুড নেই, বিরতির ঘন্টা বাজা অব্দি এইভাবেই সবাইকে বসে-দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কাল সবাই এই পড়া দিতে পারলে তবেই পরের চাপ্টারে যাওয়া হবে।
কেন জানিনা, আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হ'ল, বিশেষ করে তাদের কাছে, যারা আজ পড়া শিখে এসেছে। তারাও তো বিনা দোষে একমতো শাস্তিই পাচ্ছে, কারণ দিদিমণি তাদেরকেও নতুন চাপ্টার পড়াচ্ছেন না এবং তা আমাদের জন্যেই। দিদিমণির কাছে অনুমতি চাইলাম কানদু'টোর থেকে আমার হাতদু'টো ছেড়ে দিয়ে ইতিহাস বইটা হাতে নিয়ে দাঁড়াতে পারি কিনা। দিদিমণি একটু অবাক হলেন, তারপর কি যেন ভেবে অনুমতি দিয়ে দিলেন।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খুব মনোযোগ দিয়ে মিনিট দশেক বইয়ের সেই বিশেষ হোমটাস্কের অংশটা পড়লাম। তারপর দিদিমণিকে পড়া নিতে অনুরোধ করলাম। দিদিমণি এবারও প্রথমে কি একটু ভেবে শেষে আমাকে সুযোগ দিলেন। তিনি যা যা জিজ্ঞেস করলেন আমি সবকিছুরই সঠিক উত্তর দিতে পারায় এত খুশী হলেন যে আমাকে সহ অন্যসবাইকেও বসার অনুমতি দিয়ে দিলেন।
এবার দিদিমণি আমাদের সবার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন- আজ ক্লাশে এসে পড়াশুনায় আমাদের গাফিলতি টের পেয়ে প্রথমে উনার মন খুবই খারাপ হয়ে গেছল। কিন্তু পরে একটি ছেলের (আমাকে দেখিয়ে) আচরণ উনাকে মুগ্ধ করে দিয়েছে। তিনি চান সবার চরিত্রে এই রকমের ভাল জেদ কাজ করুক। আরো বললেন- মানুষ হিসেবে আমরা কোন ভুল করেও ফেলতে পারি, কিন্তু তাকে সংশোধন করবার মতো এমন দৃঢ় মানসিকতা যেন সবার মধ্যে তৈরী হয়। আমার নাম ধরে কয়েকবারই বললেন- ‘অমুক’ আমাদেরকে আজ সেটা সামনাসামনি শিখিয়ে দিয়েছে।
দিদিমণির কথা শুনতে শুনতে একটু আগের পড়া না শেখার লজ্জার পর আমার আবারো নতুন করে একটা অন্যরকমের লজ্জা লাগছিল; কিন্তু দিদিমণির আশ্চর্য যাদুকাঠিতে সে লজ্জায় যেন মিশে গিয়েছিল ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের এক প্রেরণা, যা পরবর্তীতে আমার চলার পথে সর্বদাই এক পাথেয় হয়ে রয়েছে।
---------•---------
সুভাষ কর।