STORYMIRROR

Baishakhi Biswas Debnath

Horror Tragedy Classics

5.0  

Baishakhi Biswas Debnath

Horror Tragedy Classics

শ্লীলতা শেষ পর্ব

শ্লীলতা শেষ পর্ব

32 mins
939

সমর উঠতেই যাবে;এমন সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে আসে। সো সো করে ঝড়ো বাতাস বইতে থাকে । খুব জোরে জোরে বাজ পড়ে । মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশ টা হঠাৎ করে ঘন কালো কালবৈশাখীর মেঘে ছেয়ে গেছে ।সমর বলে...." স্যার এবার আপনি বলুন এই দুর্যোগের সময় আমি কিভাবে বাড়ি ফিরব??"...

স্যার বললেন." ঠিকই তো!! আমি বা কি করে বাড়ি ফিরব!! আজ গাড়িটাও!!".. বলে চুপ হয়ে গেলেন।

সমর একটু হেসে বলে..." তাহলে আর গিয়ে কাজ নেই। তার থেকে স্যার আপনি আরও এক কাপ চা অর্ডার করুন।"

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট টা বার করে টেবিলের ওপর রাখা ফোন হাতে নিয়ে স্যার ক্যান্টিনে ফোন করলেন..." হ্যাঁ হ্যালো বেশ ভালো করে ঘন দুধের দুধ চা পাঠিয়ে দাও তো আমার কেবিনে। আর হ্যাঁ সঙ্গে দুটো টোস্ট বিস্কুট দিও।"

ফোনটা রেখে সমর কে একটা সিগারেট অফার করলেন। সমর সিগারেট ধরালো। মনে তৃপ্তিতে দুটো টান দিয়ে স্যার বললেন.." তাহলে দেরি করে কি হবে!নেক্সট গল্পটা শুরু করো। বৃষ্টি থামার আগেই আশাকরি তোমার গল্প শেষ হয়ে যাবে!"....

কাচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সমর বলল

" আজকের বৃষ্টি থামবে বলে আমার মনে হয় না। বহু বছর পর এত ঘন কালো মেঘ করে কালবৈশাখী ঝড় হতে দেখছি।"

স্যার ও জানলার দিকে তাকিয়ে সমরের সঙ্গে একমত হলেন। আবার ফোনটা হাতে নিয়ে বাড়িতে একটা ফোন করলেন।" হ্যাঁ শুনছো!! প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তোমরা সাবধানে থেকো। আমি রাতে ক্যান্টিনে খেয়ে নেব। আমার জন্য রান্না করো না। বৃষ্টি কমলে আমি বাড়ি ফিরে যাব।"

সমর দিকে তাকালেন। দরজায় টোকা পড়লো। ওয়েটার এসে দু'কাপ চা এবং বিস্কুট দিয়ে গেল। ঘর থেকে যাওয়ার আগেই ভালো করে স্যারের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিল ওয়েটার।

স্যার বললেন.." নাও চা টা গরম গরম খাও।"

দুইজনের চা খাওয়ার পর্ব শেষ হলে স্যার বললেন..

" নেক্সট গল্পটা শুরু করো নাকি!!"..

এই বলে স্যার পকেট থেকে চিরুনি বার করে চুল আঁচড়াতে লাগলেন। সমর বলল....

" আপনার বয়স হয়েছে!তাও তো একটা চুল পাকেনি!!"

স্যার একটু হেসে বললেন..." কি যে বল!! অল্প বয়সে চুল পেকে যায়? আমার তো পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে!! কালার কালার বুঝলে!!"

কথাটা বলেই থমকে গিয়ে সমরের দিকে তাকিয়ে বললেন..." দাঁড়াও দাঁড়াও! তোমার পরবর্তী গল্পের আভাস পাচ্ছি মনে হচ্ছে!! এই পরবর্তী গল্প নিশ্চয়ই মাথার চুল নিয়ে??".

সমর একটু হেসে বলে.." এতক্ষণ ধরে আমার গল্প শুনে, আপনি একটু হলেও যে আমার পদ্ধতি বুঝতে পেরেছেন!!তার জন্য সত্যিই আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনি একদম ঠিক ধরেছেন। আমার পরবর্তী গল্প.....


"এলোকেশী"


সালটা ১৯৭০। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের প্রথম কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে আজ। সাত পুরুষের পর পরিবারের প্রথম কন্যার আগমন ঘটেছে। আতুর ঘর থেকে ধাইমা বেরিয়ে খবরটা দিলেন জমিদার রাজনারায়ন চট্টোপাধ্যায় কে..." কর্তা ঘরে লক্ষ্মী এয়েচে!"

একগাল হাসি নিয়ে গলার সোনার চেইন টা খুলে ধাই মার হাতে ধরিয়ে দিলেন রাজনারায়ন চট্টোপাধ্যায়। তারপর প্রশান্তচিত্তে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন

" এই কে আছিস!! গ্রামে ধ্যেরা পিটিয়ে দে... প্রত্যেকের ঘরে গিয়ে রসগোল্লা দিয়ে আসবি। একটা ঘর যেন বাদ না যায়। সাত পুরুষের পর ঘরে লক্ষী এসেছে।"

তারপর বললেন..." কে কে আছো ঘরে এসো!"

রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়; চট্টোপাধ্যায় বংশের প্রবীণ জমিদার। তারা তিন ভাই। প্রত্যেকের ঘরে তিন তিনটে করে পুত্রসন্তান। রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এর ছোট পুত্র রাজীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে লক্ষ্মী আগমন ঘটেছে। তাও আবার পাঁচ পাঁচটি পুত্রের পর। সকলে মিলে ভীষণ খুশি। সবার প্রথমে কে দেখতে যাবে তাই নিয়ে পরস্পরের মধ্যে বচসা বেঁধে গেল। এ বলে আমি আগে দেখব!!ও বলে আমি আগে। রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় হুকুম দিলেন.." আমি চাই আমার ঘরের সকল বউমা রা আগে দেখে আসুক।"

জমিদারবাবু মুখের উপর কথা বলার মত স্পর্ধা কারো নেই। প্রত্যেক বৌমা মিলে খুশি মনে রাজীব এর স্ত্রীর আতুর ঘরে গেলেন। "কই দেখি দেখি!!"

বললেন বড় বৌমা। তারপর ছোট্ট ফুটফুটে কন্যা সন্তানকে দেখে উনি বললেন..." একি!!! করবি... তোমার মেয়ের মাথায় দেখি একটাও চুল নেই??"

মেজো বৌমা দেখে বললেন..." হ্যাঁ গো দিদি ঠিক বলেছ! আমাদের বংশে প্রত্যেকটা ছেলের মাথায় ঘন চুল। এত বছর পর যাও একটা মেয়ে হল সেও টাক!!"

সকলের মুখ ভার দেখে জমিদারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন

" কি ব্যাপার!! তোমাদের মুখ ভার কেন??"

বড় বৌমা বললেন..." আপনি একবার দেখে আসুন বাবা !!তাহলেই বুঝতে পারবেন।"

জমিদার বাবু বললেন.." আহ কি যে বল!! ওটা আঁতুড়ঘর! এক মাসের আগে ওখানে পুরুষদের ঢোকা মানা। যাইহোক আমার নাতনি কেমন হয়েছে দেখতে? আমি কিন্তু জানতাম রাজিবের ঘরে এবার মেয়ে হবে। আমি পঞ্জিকা দেখে নাম ও ঠিক করে রেখেছি!!"

মেজ বউ মা বললেন.." কি নাম ঠিক করেছেন বাবা!"

জমিদার বাবু বললেন..." আমাদের ঠাকুরদালানে শ্যামা কালীর মাথার এলোকেশ গুলো দেখেছো তোমরা!!

মা শ্যামা হলেও তার রূপের কত ছটা। আর মেয়েদের রূপ চুল;না থাকলে প্রকাশ পায়!! সেই কারণে আমার বংশের প্রথম কন্যা সন্তানের নাম আমি রেখেছি কুন্তল।"



সালটা 2000.......

চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান রঘুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের শুভ বিবাহ। ৭ দিন আগে থেকেই বিরাট আয়োজন শুরু হয়েছে। বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ হওয়ার জন্য সকলের নয়নের মনি রঘুনাথ। চট্টোপাধ্যায় বংশের এই প্রথম রঘুনাথ;যে নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করবে। আধুনিকতার সাথে মানে নিতে শিখে গেছেন বাড়ির অন্যান্য সদস্য গণ। শুধুমাত্র একজন বাদে। তিনি হলেন রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। বয়সের ভারে শরীর অকেজো হয়ে পড়লেও মস্তিষ্ক এখনো সতেজ। বাড়ির সদস্যগণকে বারবার বলে দিয়েছেন

" এই বাড়িতে যতদিন শ্যামা মায়ের মূর্তি পূজিত হবে; ততদিন পর্যন্ত বাড়ির নিয়ম-নীতি কেউ অগ্রাহ্য করতে পারবে না।"

কিন্তু উনার কথা পাত্তা দেবার মত কোন সদস্যই নেই। তাছাড়াও ইয়ং জেনারেশনের বুদ্ধির বিকাশে ওই বয়স্ক মানুষ টার বুদ্ধি কখনোই সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারে না। সবাই মিলে বেশ কায়দা করে রঘুনাথের বিয়েটা অ্যারেঞ্জ করে ফেলেছে। রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের এখনো জানেন না রঘুনাথ নিজের পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করে আনবে।

বিবাহের ঠিক ৩ দিন আগে থেকে সমস্ত আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে আনাগোনা শুরু করেছেন। জমিয়ে চলছে খাওয়া-দাওয়া। বাড়ির সমস্ত মহিলারা মিলিয়ে এক জায়গায় জটলা পাকিয়ে পরনিন্দা পরচর্চা নিয়ে ব্যস্ত। কার বাড়ির বউ মা কি করলো!! কোন ছেলে তার মা-বাবাকে মারল??.. কার বর, কার বউ পরকীয়া করে বেড়ালো এইসব.....

হঠাৎই সেখানেই রঘুনাথের ছোট কাকিমা যিনি এত বছর বিদেশে কাটিয়েছেন তিনি বললেন..." কুন্তল কে তো দেখছি না?? সে কোথায়??"

রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় পেছনের সারিতে বসে ছিলেন। তিনি স্পষ্টতই কথাটা শুনতে পেয়েছিলেন। বয়স হয়ে গেলেও;ওনার কান সম্পুর্ন সজাগ। চিৎকার করে বলে উঠলেন..." জয় মা তুমি পাপ নিও না মা!! ও বেচারী জানেনা! তাই ভুল করে নাম নিয়ে ফেলেছে!!"

ছোট কাকিমার মতো অন্যান্য মহিলারা ও বেশ অসন্তোষ এর মধ্যে পরলো। সেখানেই বড় জেঠিমা বললেন

" যা বলেছো বলেছো আর বোলো না!! যার নামে বাড়িতে উচ্চারণ করা হয়না!!"

রঘুনাথ ফোনে কথা বলছিল। এমন একটা প্রাসঙ্গিক আলোচনা শুনে ফোনটা রেখে ছোট কাকিমাকে ডেকে পাঠালো।" ও ছোট কাকি!! মেজ কাকি জানেনা!! ওই নামটাই বাড়িতে যে নেওয়া হয় না!"

ছোটকাকি বললেন.." কি যে বলিস কি করে জানবে!! বিয়ের পর দিনই বিদেশে চলে গেছে!! বেচারা শ্বশুর বাড়িতে আসতে পেরেছে কোনদিনও!! তোর বিয়ে উপলক্ষে তো জোর করে মেজ ভাসুরকে বলে বলে ওকে আনিয়েছি!!"

মেজ কাকিমা সত্যিই অবাক। হাতের কাজ মিটিয়ে কালবিলম্ব না করে সে ছুটে গেল রাজিব এর ঘরে।

রাজিবের স্ত্রী গত ৩০ বছর ধরে কোমায় আক্রান্ত। রাজিব মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। পাঁচ-পাঁচটা পুত্র ছিল তারাও বেঁচে নেই। কোমায় আক্রান্ত নিজের শরীরটাকে নিয়ে বিছানায় পড়ে আছে রাজীবের বিধবা স্ত্রী করবি। সবার সব কথায় সে শুনতে পায়;কিন্তু বলতে পারেনা। ডাক্তার জানিয়েছেন.... শরীর সুস্থ থাকাকালীন চোখের সামনে এমন কিছু ঘটে যেতে দেখেছেন যেটা মাথায় প্রবল আঘাত এনেছে। যার জন্য উনি কোমায় চলে গেছেন।

কাকতালীয়ভাবে মেজ কাকিমার নাম ও করবি। বৌভাতের পরের দিনই স্বামীর সাথে সে বিদেশে চলে গিয়েছিলো। বাড়ির প্রাচীন নিয়ম মেনে মেজ কাকি মা এবং মেজ কাকুর সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়। সেই কারণেই বাড়ির সদস্যদের সম্পর্কে কিছু না কিছু জানতেন মেজ কাকি মা করবি। রাজিবের ঘরে গিয়ে উনি দেখেন

বিছানায় শুয়ে আছি জীর্ণ মানুষটা। উনার কাছে গিয়ে হাত দুটো ধরে মেজো কাকিমা করবি জিজ্ঞাসা করে

" কি এমন হয়েছিল বলতো!! যার জন্য এই বাড়িতে কুন্তল নামটা পর্যন্ত কেউ উচ্চারণ করে না!!"

কোমার পেশেন্টরা শুনতে পায়। রাজীবের বিধবা স্ত্রী ও মিজু কাকিমা করবি সব কথাই শুনতে পাচ্ছিল। মেজ কাকি মা দেখেন... রাজীবের স্ত্রীর চোখ থেকে টপটপ করে জল পরছে। তিনি বলেন.." চোখের জল ফেলছ!! এত বছর ধরে শরীরটা নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছো!! আমি জানি তুমি অনেক কিছুই জানো!! একবার চেষ্টা করে দেখো না!!"....

প্রায় মিনিট পনেরো চেষ্টা করার পরও রাজীবের স্ত্রীর শরীর থেকে কোন সারা শব্দই পাওয়া যায় না। করবি ঘর থেকে চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক সেই সময় ওর চোখে পড়ে একটা ৩ পায়া বেবি কট। যেটা বিছানার 7 থেকে 10 হাত দূরে রাখা ছিল। বেবি কটটার দিকে হাত দিয়ে করবি জিজ্ঞাসা করে.." এটা কেমন ধরনের বেবি কট!! বিদেশেও কোনদিন এমন ধরনের মডেল দেখিনি তো!!"

কথাটা বলতে বলতেই এক পা দু পা করে বেবি কটটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।


"আহঃ করবি!! তুমি কি করছো এই ঘরে!!"

করবি চমকে উঠে পিছন দিকে তাকায়। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর স্বামী। বেশ রাগান্বিত কন্ঠে উনি বললেন

" তুমি খাবার খেয়েছো!! রাত তো কম হলো না! দুদিন পর বাড়িতে বিয়ে। নিজের শরীরের খেয়াল না রাখো;পেটে যে বড় হচ্ছে তার খেয়াল তো রাখবে!!"

ঘাড় নিচু করে মেজ কাকিমা করবি বলেন

" কিছু না এমনি এসেছিলাম। এই বেবি কট টা দেখেছো!! মডেল টা কেমন না!"

এইবার চিৎকার করেই হাত ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে চলে গেলেন ওর স্বামী। ধমকে ধমকে বললেন..." তোমাকে না কতবার বলেছি এই ঘরে না ঢুকতে। 24 ঘন্টা এখানে একজন আয়া কাজ করে। তোমার পেটে আমাদের বংশের প্রদীপ বড় হচ্ছে। যার তার ঘরে ঢুকে নিয়ম-নীতি কেন ভাঙ্গো করছো!!"

মুখ ভার করে করবি স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে

" তোমরা কেন এরকম করো। এর আগেও আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি কুন্তল এর কথা। ওর নাম তোমরা কেন নিতে চাও না!! আমি শুনেছিলাম;তোমাদের সাত পুরুষের পরে বংশের প্রথম কন্যা সন্তান হয়ে জন্ম নিয়েছিল কুন্তল!

এই নামটা জমিদার রাজনারায়ন চট্টোপাধ্যায় এর ই রাখা ছিল!! তাহলে কেন??"

"তোমার সাথে এই বিষয় নিয়ে আমি তর্ক করতে চাই না" বললেন করবির স্বামী। "এখন খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়বে চলো।"

করবির ঘুম আসছে না। বিছানায় শুয়ে কেবল এদিক-ওদিক করছে। হঠাৎ তন্দ্রা লেগে আসে। ক্যাচ ক্যাচ করে কেমন একটা শব্দ কানে ভেসে আসে। ঘুমটা ভেঙে যায় করবি। বিছানায় উঠে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে.. সেই ৩ পায়া বেবিকট টা। খিলখিলিয়ে একটা বাচ্চার হাসির শব্দ ভেসে আসছে। করবি বিয়ে বাড়ির ঝাঁ-চকচকে আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে একটা ছোট্ট শিশু শুয়ে শুয়ে খেলা করছে। শিশুদের বয়স ছয়-সাত মাস হবে। বেবিকট এর হাতল টা হাত দিয়ে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে ছোট্ট শিশুটা। নিষ্পাপ মুখ। একগাল হাসি। আরো বেশী সুন্দর লাগছে মাথায় চুল নেই বলে। আহ্লাদের সাথে বিছানা থেকে উঠে, দরজা খুলে শিশুটার কাছে এগিয়ে যায় করবি।

" ওলে বাবালে!! কি সুন্দর সোনাটা!! এত রাত হয়ে গেছে তুমি ঘুমাওনি কেন!! এখনো খেলা করতে হয় নাকি!! এসে তো সোনা আমি ঘুম পাড়িয়ে দিই!"



আলতো করে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয় করবি। তারপরই হয় বিপত্তিটা। "একিই সোনা!! তোর শরীর এত ঠান্ডা কেন!! আরে কি তোর সারা শরীর রক্তে ভেজা কি করে???".... কথা শেষ করে বেবি কটটার দিকে তাকিয়ে চোখ বিস্ফোরিত হয়ে যায় করবির!!!.......


"একই বৌমা তুমি কি করছো ওখানে। তোমার কোলে ওটা কি!!!".. বললেন রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়।

করবি বলে.." এই বাচ্চাটাকে দেখুন।কি অবস্থা!!! দেখে যান!!"

ওর কথা শুনে এগিয়ে যান রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় তারপর বলেন...." তোমার মাথা ঠিক আছে তো!! এই বেবি কটটা এখানে এলো কি করে!!""

করবি বলে..." আমিতো জানিনা! দেখুন না বাচ্চাটা কি সুন্দর!! একটাও চুল নেই বলে আরো বেশী সুন্দর লাগছে!! এত রাত হয়ে গেছে; আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুমটা ভাঙতেই জানালায় নজর পড়ে।তারপর দেখি এই বাচ্চাটা কে!!.....

আমি বুঝতে পারছি না ওর সারা শরীর রক্তে ভাসছে কি করে!!"

"তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?? বাচ্চা কোথা-থেকে আসবে???সেটা তো!! কত বছর আগে!"..

বলে চুপ হয়ে গেলেন রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। এদিকে করবি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে শিশুটিকে নিয়ে।

."ইস....... বাচ্চাটার মাথাটা পুরো কেটে গেছে।হে ভগবান এটা কেমন ধরনের বেবি কট। বেবি কটের ভেতরে কাটার সিস্টেম করা।.. একই!!! মাথার বালিশের ভিতর সুই ঢুকানো!!! বাচ্চাটাকে তো পুরো মেরে ফেলার তাল। আমার এক্ষুনি যেতে হবে!!বাচ্চাটাকে ডাক্তারের কাছে দেখাতে হবে!!..... একি!!!এই সোনা!!!এই ওঠ!!..

কি হলো বাচ্চাটা উটছে না কেন?? বাড়ি ভর্তি লোক এর মধ্যে কারো চোখে পড়লো না!!! সারা শরীরটা বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেছে!!... ও মাগো........"..…

পরদিন অচৈতন্য অবস্থায় বারান্দা থেকে করবি কে উদ্ধার করা হয়। ডাক্তার এসেছেন। মিনিট 15 আগে জ্ঞান ফিরেছে করবির। বারবার একটা বাচ্চাকে দেখতে চাইছে ও। কিন্তু বাড়িতে অত ছোট বাচ্চা কারো নেই। করবি বলছে..." তোমরা বাচ্চাটাকে ডাক্তার কাছে নিয়ে যাও। আমাকে যেতে দাও। ওকে তাড়াতাড়ি ডাক্তার না থাকলে ও বাঁচবে না। কি মারাত্মক বেবি কট!!বাপরে বাপ!!.. জেনেশুনে বেবি কটের বালিশের ভিতর কেউ সুই ভরে রেখেছিল। যাতে বাচ্চা তার মাথার ভেতরে সুইয়ের আঘাতে রক্তপাত হয়। প্লিজ আমাকে যেতে দাও।"

করবির অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে শুরু করেছে। এদিকে নিজে অন্তঃসত্ত্বা। কথাটা পাড়ায় রোটে গেছে। সবাই বলছে করবি পাগল। কিন্তু সত্যি কি তাই!

করবির অবস্থা এতটাই খারাপ যে শুরু করে যে; ওকে নিয়ে বিদেশ চলে গেছে ওর স্বামী। করবি কিন্তু কিছুতেই যেতে চাইনি। সে রাজনারায়ন চট্টোপাধ্যায় কাছে গিয়েও মিনতি করেছে.." আপনি তো দেখেছেন বলুন! আমি কি ভুল বলছি!! আমার সাথে আপনিও তো বাচ্চাটা কে দেখেছিলেন, কিন্তু আপনি কেন সবার সামনে বলছেন না!! ও খুব অসুস্থ; ওকে ডাক্তারকে দেখাতে হবে। কোন ভাবে ওর মাথাটা কেটে গেছে, চিকিৎসা করালে সুস্থ হয়ে যাবে আপনি একটু বলুন প্লিজ!!!"...

করবি স্বামীকে গিয়ে রাজনারায়ন বলে এসেছেন..

" তোমার স্ত্রীর মস্তিষ্কটা সত্যিই খারাপ হয়ে যেতে চলেছে। যত তাড়াতাড়ি পারো চলে যাও। আর কোনদিন এখানে আসবে না।"

উনি যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে করবি সব বুঝতে পেরেছিল।

বিদেশে যাওয়ার আগের দিন রাতে করবি রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে গিয়ে তাকে বলে এসেছে.." আপনার কুকর্মের দিন শেষ। আপনি কি করেছেন আপনি ভালো করেই জানেন। আমার মাথা খারাপ হয়নি। আমি যাকে দেখেছি ঠিকই দেখেছি। কোলে নিয়ে স্পর্শ করেছি। এখানে আমার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। কিন্তু আমি জানি আপনি বিশ্বাস করেছেন সেই কারণেই সাততাড়াতাড়ি বিদেশ পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আপনি যেটা করেছেন তার ফল আপনাকে ভোগ করতেই হবে। যে বাড়িতে এলোকেশী শ্যামা মায়ের পুজো হয় সেই বাড়িতে এত বড় পাপ কাজ!! সেই শ্যামা মা.…ই প্রতিশোধ তুলবে।"

বিবাহের দিন সমাগত। রঘুনাথ বিয়ে করতে যাচ্ছে। বাড়ির বড়রা সকলে মিলে আশীর্বাদ করছে। হঠাৎই সকলকে চমকে দিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছে রাজিবের কোমায় থাকা স্ত্রী। মাথার চুল এলোমেলো। দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে থাকার জন্য সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। শরীরের অবস্থা অত্যন্ত জীর্ণ। কিছু বলতে চাইছে কিন্তু কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় রাজিবের বৈধব্য স্ত্রী করবি বলে.." আর কত শাস্তি দেবে তোমরা! কি করেছিল আমার কুন্তল! মেরে ফেললে? বেবি কটের বালিশের ভিতরে বিষ মেশানো শুই রেখে মেয়েটার মাথা ফুটো করে রক্ত বের করে মেরে ফেললে। কি দোষ করেছিল আমার মেয়েটা। শুধু মাথায় চুল ছিল না বলে!!!"

রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় চিৎকার করে বলে ওঠেন.." এতদিন কোথায় ছিলে বলে মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে নাকি। কি উল্টোপাল্টা বলছো!! কে মেরেছে তোমার মেয়েকে!!!"

"আপনি মেরেছেন!... ওর অন্নপ্রাশনের দিন আমার বাপের বাড়ি থেকে যে বেবি কট টা উপহার দেয়া হয়েছিল !সেই বেবি কটের মাথার বালিশের ভিতর বিষ মিশানো সুঁই রেখে আপনি ওকে ঘুম পাড়িয়ে ছিলেন। ঘুমন্ত মেয়েটাকে কোলে করে তুলে নিয়ে রক্তাক্ত শরীরটা ওই মন্দিরের পেছনের দরজা দিয়ে ধুতরা গাছের তলায় আপনি পুঁতে রেখে ছিলেন। আমি পুরো ব্যাপারটা দেখেছিলাম। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম । নিজের মেয়েকে এভাবে চলে যেতে দেখে আমার হাত-পা কাজ করছিল না । কিন্তু একটু মাথাটা ঠিক হতেই যে আমি সবাইকে বলতে যাবো ঠিক সেইসময় আপনি আমাকে যে মাথায় মেরে অজ্ঞান করে দেন। আমার পাঁচ পাঁচটা ছেলে তারা সব জানত তারা নিজের চোখে দেখে ছিল পুরো ব্যাপারটা আপনি তাদেরকেও খাবারে বিষ মিশিয়ে এক এক করে মেরে ফেলেছেন। বড় যা প্রথমেই আমার মেয়েকে দেখে টাক বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। আপনি ওকে নয় মাস পর দেখেছিলেন। ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন কুন্তল। কুন্তল শব্দের মানে চুল। কিন্তু এতে আমার মেয়ের কি দোষ!! প্রতিটি সন্তান ঈশ্বরের প্রদান। বাড়িতে এত বড় শ্যামা মায়ের মন্দির থাকা সত্ত্বেও আপনি এই বা কাজ করতে পারলেন।"

কথাটা বলেই করবি অজ্ঞান হয়ে যায়। সারাবাড়ি আলোয় আলোময় ছিল কিন্তু কোথা থেকে দমকা হাওয়া এসে সবকিছু এলোমেলো করে নিয়ে যেতে থাকে। সারা বাড়িতে বসে আছে তাকে খিলখিলিয়ে বাচ্চার হাসির শব্দ। রঘুনাথ চিৎকার করে বলে....

" ঠাকুরদা! ঠাকুর টা তোমার কোলে ওকে!!"

রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেন ছোট্ট কুন্তল উনার দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে। মাথা বেয়ে পরছে ফোটা ফোটা রক্ত। কুন্তল এর ঠান্ডা শরীরটাকে স্পর্শ করে ভয়ে চিৎকার করে ওঠেন রাজনারায়ন চট্টোপাধ্যায়।" না!! এটা কখনো হতে পারে না! আমি নিজের হাতে পুঁতেছি দেহটাকে কি করে বেঁচে আসতে পারে!!".. ঝড়ো বাতাস দমকা হাওয়ার মাঝে রাজনারায়ন চট্টোপাধ্যায়ের স্বীকারোক্তি সবার কানে পৌঁছায়। শ্যামা মায়ের মন্দির তাই হঠাৎ করে যেন শত প্রদীপ জ্বলে ওঠে। ঘণ্টাধ্বনি ধ্বনিত হতে থাকে। ৩৩কোটি দেবতারা যেন অট্টহাসি করছেন রাজ নারায়ন চট্টোপাধ্যায় এর বিরুদ্ধে। তিনি বলেন..

" আমার বংশের প্রথম কন্যা সন্তান কি করে টাক হতে পারে। মেয়ে সন্তান টাক থাকলে কোনো মর্যাদা আছে নাকি!!"..

রঘুনাথ বলে.." এটা কেমন ধরনের কথা ঠাকুরদা!! কুন্তল টাক মাথা নিয়ে জন্মে ছিল বলেই ওর মাথায় কি চুল হতো না! তুমি সেই কারণে ওকে মেরে ফেললে!!"

"না না না!! আমি কিছু ভুল করিনি!!! আমি কিছু ভুল করিনি!!!"..

বলতে বলতে পাগলের মত হয়ে মন্দিরের দিকে ছুটতে থাকেন রাজনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। ঝড়ো হাওয়া বাতাস এর মধ্যেই তার দেহটা জানো আলোকবর্ষের বেগে ছুটছিল। মন্দিরের দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন উনি।

"বাবা দরজা টা খুলুন!!"

" ঠাকুরদা দরজাটা খোলো!"

সবাই মিলে দরজা ধাক্কালে ও দরজা খোলে না। কিছুক্ষণ পর একটা বিকট চিৎকারে শব্দ। দরজা ভেঙে সবাই ভেতরে গিয়ে দেখেন.….. সব ঠিক আছে। শ্যামা মায়ের মূর্তি.. তার হাত..... অস্ত্রশস্ত্র সব ঠিক আছে কেবল মাত্র মায়ের যে হস্তে মহিষাসুরের মাথা থাকে সেই জায়গায় মহিষাসুরের মাথার বদলে ঝুলছে জমিদার রাজনারায়ন চট্টোপাধ্যায়ের শিরশ্ছেদ মস্তিষ্কটা। সেই চুলগুলোকে মাটির মূর্তি টা এতটাই শক্ত করে ধরে রেখেছে যেটা ছাড়ানো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রকৃতিকে অবহেলা করলে শাস্তি প্রকৃতি দেবে। নারী হলো আদ্যা শক্তি। সবদিক থেকে সে সুন্দর। শিশু অবস্থায় সে অত্যন্ত পবিত্র এবং কোমল নিষ্পাপ। সেই শিশুকে আঘাত করলে আদ্যা শক্তি কি করে চুপ থাকে!!!....

"সত্যিই তো প্রকৃতিকে আঘাত করলে প্রকৃতি তার জবাব দেয়। ভালো লিখেছ ভাই।"... বললেন স্যার।

"তোমার গল্প শুরু হয় এক রকম ভাবে। আমি বলতে চাইছি গল্প শুনতে শুনতে আমি মনে মনে কল্পনা করে ফেলি হয়তো সমাপ্তিতে এমন হতে পারে; কিন্তু না!সমাপ্তিটা হয় অন্যরকম হবে যেটা আমি কল্পনাও করি না।" বললেন স্যার।

"কি যে বলেন স্যার!..... এটা আবার এমনকি!".. বলে সমর। "স্যার বৃষ্টি টা কমেছে কিনা দেখব!! বাড়ির লোকের সাথে দেখা করে আসবেন!!"... স্যারের দিকে তাকিয়ে বলে সমর।

স্যার বললেন.." বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করে আসবো মানে!! কি বলতে চাইছো!!"


তুমি কিসের ইঙ্গিত করছে সমর। বাড়ির লোকের সঙ্গে শেষ দেখা মানে?"... বললেন স্যার।

সমর একটু হেসে বলল.." আসলে খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে তো। দিনের আলোয় কত অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে আজকের প্রবল দুর্যোগ!! সেই কারণেই বলছিলাম।"

"যাই হোক স্যার!! আমার পরবর্তী গল্পটা শুরু করি!"

বলে সমর।

স্যার বললেন..." আমার যদি ভুল না হয় তাহলে এইবার তোমার গল্পের বিষয়বস্তু টা মেয়েদের বক্ষ ঘিরে! আমি কি সঠিক বললাম!!"

সমর বেশ খানিকক্ষণ হেসে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে

" আমার গল্পের রেস আপনার মস্তিষ্ককে বেশ ভালোভাবে আচ্ছাদিত করে দিয়েছে। লেখা প্রকাশ হোক বা না হোক সত্যিই একজন লেখক হিসাবে আজ আমার চরম প্রাপ্তি হল। আপনি একেবারে ঠিক ধরেছেন! আমার পরবর্তী গল্পের নামই "শ্লীলতা"।...

একটি মেয়ের জীবনের বাস্তব সত্য ঘটনা অবলম্বনে। মেয়েদের বক্ষ সৌন্দর্য তাদের নারীত্বের বিকাশ ঘটায়। পুরুষের দৃষ্টি সেখানে যায় না আমি তা বলবো না। কিন্তু সব মেয়ের বক্ষস্থল সমান হয় না। সেটা আমরা প্রত্যেকটা পুরুষ মানুষই বুঝতে পারি; আমাদের দৃষ্টি শক্তি দিয়ে। প্রত্যেকটি মানুষ ঈশ্বরের সন্তান।সামান্য শারীরিক ত্রুটি যখন চরম শাস্তির হয়ে ওঠে;তখন কেমন লাগতে পারে!! আমার এই গল্পটি সেই মেয়েটিকে নিয়ে ।".....

"আমি কি শুরু করতে পারি স্যার??".... বলে সমর।

কিন্তু স্যার অন্যমনস্ক হয়ে আছেন।

"স্যার আপনাকে একটা জিজ্ঞাসা করতে পারি??" .. বলে সমর ।

স্যার অন্যমনস্ক হয়ে ছিলেন। সমরের কথাটা খেয়াল করেননি। আনমনে বলতে থাকেন....

"সমর তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। আজকে অফিসে আসার সময় আমার গাড়িতে একটি ছেলের ধাক্কা লাগে। আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম জানো তো!!

সেই কারণে জোরে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে আসি। আমার সহকর্মী পরে আমাকে জানান আজ গাড়ি এক্সিডেন্টে একটা অল্প বয়সী ছেলে মারা গেছে। গাড়ির চালক দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তাই তাকে দেখা যায়নি। সহকর্মীর কাছে এমন কথা শুনে আমার সত্যি খারাপ লাগছিল কারন আমি জানতাম এই অ্যাক্সিডেন্টটা আমি করেছিলাম। কিন্তু এই সত্যিটা আমি এড়িয়ে যাই। আসলে এই বয়সে পুলিশ কেস আমি নিতে পারবো না। তুমি অল্প সময়ের মধ্যে আমার কতটা আপন হয়ে গেছ। তোমার কাছে ভুল ভ্রান্তি স্বীকারোক্তি করতে এতোটুকু আপত্তি হচ্ছে না আমার। আমি জানি আমি চরম ভুল করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো সমর আমি নিজের স্বজ্ঞানে এই ভুল করিনি। ব্যাপারটা সম্পুর্ন অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘটে গেছে। গাড়ি আমি একমনে চালাচ্ছিলাম কিন্তু হঠাৎ নন্দিনীর ফোন আসে।"...

এই পর্যন্ত বলেই সমর দিকে তাকালেন। কিন্তু সমর সেখানে ছিল না। ডাকতে শুরু করলেন উনি

" কোথায় গেল ছেলেটা! সমর কোথায় গেলে??"

কেবিন থেকে উঠে টয়লেটের দিকে খোঁজ করতে গেলেন কিন্তু সেখানেও সমর ছিল না। অ্যাসিস্ট্যান্ট কে ডেকে পাঠালেন।

তাকে হুকুম করে বললেন.." এখানে আমার সঙ্গে যে ছেলেটি ছিল; তাকে কি তোমরা অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছো!"

অবাক চোখে অ্যাসিস্ট্যান্ট বলে..." আপনি কোন ছেলের কথা বলছেন স্যার!"

বিরক্তির সঙ্গে স্যার বললেন.." আহা ঠাট্টা করছ কেন!! এতক্ষন ধরে যে আমাকে গল্প শোনাচ্ছিল। এইতো এইতো টেবিলে ডায়েরী টা পড়ে আছে!"

বলতে বলতেই নন্দিনীর ফোনটা আবার আসে।

"এক মিনিট"...বলে ফোন রিসিভ করলেন স্যার।

ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসছে...." তুমি শিগগিরই বাড়ি এসো। নন্দিনী আত্মহত্যা করেছে। ওর সঙ্গে যে ছেলেটার এতদিন সম্পর্ক ছিল সে আজ সকালেই গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছে।".....

হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায় ওনার। চিৎকার করে বলে ওঠেন.." এ তুই কি করলি!"

"কি হয়েছে স্যার এনি প্রবলেম??"....

বললেন অ্যাসিস্ট্যান্ট।

স্যার বললেন.." আমাকে এক্ষুনি বাড়ী যেতে হবে। তুমি একটা গাড়ির বন্দোবস্ত করে দাও।"

বাড়িতে একটা ফোন করে ভিডিও কলে স্ত্রী সাথে কথা বললেন।.......

বৃষ্টি তখনো কমেনি। সমরের ডাইরি টা ব্যাগের মধ্যে ভরে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠলেই স্যার। "ড্রাইভার তাড়াতাড়ি আমার বাড়িতে চলো"...... বললেন স্যার।

ড্রাইভার বললেন.." নিশ্চয়ই!! বাড়িতে তো যাবেন তার আগে শেষ গল্পটা শুনে যান।"


বিস্ফারিত চোখে ড্রাইভার এর সামনের আয়নাতে স্যার দেখতে পেলেন সেখানে সমর বসে আছে। কিছু বলার আগেই গাড়ি স্টার্ট করে দিল সমর। এবং শুরু করলো শেষ গল্প....…



" শ্লীলতা".....



অষ্টাদশী নন্দিনী আজ খুব খুশি। ওর দাদার পাকা দেখা আজকে। কমবেশি আত্মীয়স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশী ঘিরে বাড়িটা গমগম করছে।

" নন্দিনী এই নন্দিনী!!নিচে আয়".. ডাকলেন নন্দিনীর মা সুতাপা দেবী।

নন্দিনী-"আসছি মা আর পাঁচ মিনিট"

মা- "জানিনা বাবা সকাল থেকে কি যে এত সাজগোজ করছিস!ওরে আজ তোর দাদার পাকা দেখা বিয়ে তো দেরি আছে??"

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে নন্দিনী বলে...." যতই হোক আমার একমাত্র দাদা আমি সাজবো না।"

দাদা ঋষি-" মা তুমি বোনকে একদম কিছু বলবেনা। সুন্দরী বোন আমার।একটু সাজুগুজু করছে তো! তাতে কি হয়েছে??"

এক মস্ত বড় বই প্রকাশনী সংস্থার মালিক অখিলেশ চৌধুরী।অখিলেশ বাবুর সংসারে এই চারজন সদস্য। স্ত্রী সুতাপা, বড় ছেলে ঋষি এবং কনিষ্ঠা কন্যা নন্দিনী।

বয়সের ভারে অখিলেশ বাবুর দাড়ি এবং চুলে পাক ধরলেও মনের রঙে উনি এখনো রঙিন। নতুন নতুন লেখকদের লেখা সংগ্রহ করে নিজের নামে প্রকাশ করতে এতোটুকু কুন্ঠিত বোধ হয় না। জীবনে অনেক লেখকের এর স্বরচিত লেখনি নিজের নামে প্রকাশ করেছেন বহু অর্থের বিনিময়। যে সমস্ত লেখক এর লেখা চুরি করেছেন;তারা প্রত্যেকেই আর্থিক দিক থেকে হয় দুর্বল না হলে পারিবারিক দিক থেকে অসহায়। এক কথায় বলতে গেলে লেখা জোচ্চুরি করা। প্রকাশনী সংস্থা 42% অংশীদার হিসেবে লেখকদের নিযুক্ত করে তারপর তাদের সাথে অকথ্য খারাপ আচরণ করে তাদের স্বরচিত লেখা চুরি করাটা এখন একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজ ওনার জ্যেষ্ঠ পুত্রের পাকা দেখা। উনার দুই সন্তানকে অত্যন্ত যত্নে পরম স্নেহে লালন-পালন করেছেন। অর্থ মান যশ কোন কিছুরই অভাব নেই ওনার। শারীরিক কোনো ত্রুটি ও নেই। সবার সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবে মেলামেশা করার স্বভাবের জন্য বেশ প্রশংসা আছে ওনার। কিন্তু ওনার চরিত্রের একটা নগ্ন দিকও আছে যেটা সবার সামনে সব সময় প্রকাশ করে না। সেই বিকট চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ভাগ্যহীন সেই লেখক গোষ্ঠীর উপর।

ঋষি কে উনি ওনার ব্যবসার থেকে দূরে রেখেছেন। ঋষির নিজস্ব ফার্ম আছে। নন্দিনী এখনো পড়াশোনা করে এই গত বছর H.S কমপ্লিট করেছে। দুমাস আগে কলেজে ভর্তি হয়েছে। মেয়ের বিয়ের জন্য সম্বন্ধের কথা বললেই সে বলে..." বাবা মা তোমাদের দু'জনকেই বলছি আমাকে কিন্তু বিয়ে দেবে না।আমি আগে বড় হবো,চাকরি করব।

তারপর... দাদার বিয়ে হবে, আমি পিসি হব। পরে ভেবে দেখব বিয়ে নিয়ে।"

ছেলেমানুষ নন্দিনীর কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে। মা বাবাকে নিয়ে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে যাতে কোনদিনও তারা ওর বিয়ের কথা না বলে। এমনিতেই বাড়ির কনিষ্ঠ সন্তান সবার খুব আদরের হয়। আর নন্দিনীর দাদা নন্দিনীকে খুবই ভালবাসত। ভাইবোনের মধ্যে খুনসুটি সবসময় লেগেই থাকত। কিন্তু নন্দিনী অসুস্থ হলে বা বিপদে পড়লে ঋষির মতো উতলা আর কেউ হত না।

বিয়ে উপলক্ষে নিজে পছন্দ করে বোনের জন্য প্রচুর শপিং করেছে ঋষি। আজ সকালে বোন কে বলেছে

" এই বোন... গতকাল যে সালোয়ার কামিজটা নিয়ে আসলাম না! ওটা পরবি আজকে। আজ আমার পাকা দেখা তো!"

নন্দিনী ওদাদার আবদার রাতে সালোয়ার কামিজ পড়ে হালকা সেজে নিচে এসেছে।

আশীর্বাদ পর্ব শুরু হয়েছে। পাত্রীপক্ষ আজ পাকা কথা দিয়ে ছেলেকে আশীর্বাদ করে যাবেন। নন্দিনী ওর দাদার পাশেই বসে ছিল। সময়টা জ্যৈষ্ঠের দুপুর ভীষণ গরম পরেছে। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে নন্দিনী ওড়না দিয়ে হাওয়া খেতে থাকে। হঠাৎই ওড়নাটা বুকের কাছ থেকে সরে যায়। নন্দিনী সবার দিকে তাকিয়ে সেটা সামলে নেয়। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে একজনের দিকে তাকিয়ে বলে..." ওটা দিয়েও কোন লাভ নেই!! যেজন্য ওঠার প্রয়োজন সেটা তোর মধ্যে নেই!'

পাত্রীপক্ষ নন্দিনী দিকে তাকিয়ে আছে । এই পরিস্থিতিতে অপ্রত্যাশিত বাক্যটি শুনে নন্দিনী সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থান ত্যাগ করে।

নন্দিনী আর পাঁচটা সাধারণ ঘরের মেয়ের মতোই থাকে। সাধারণের মধ্যে অসাধারণ কিছু লুকিয়ে থাকে। নন্দিনী পড়াশোনার সাথে সাথে গান বাজনা এবং রান্নাবান্না সিদ্ধহস্ত ছিল। কোন অসামঞ্জস্য নেই ওর মধ্যে কেবলমাত্র একটি ত্রুটি!!!!

দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় নন্দিনী। মা-বাবা ব্যস্ত থাকায় তারা বুঝতে পারেন না। নন্দিনী জানিয়ে আত্মীয়-স্বজনরা ওকে কোন বিষয় নিয়ে বলতে চাইছে। কলেজে সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে উঠেছে নন্দিনীর;কিন্তু এই শারীরিক ত্রুটির কথাটা এর আগেও অনেকবার ওর কর্ণগোচর হয়েছে। বিবস্ত্র হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে নন্দিনী। টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে থাকে বিন্দু বিন্দু জল কনা।

বিপত্তিটা সবথেকে বেশি হয় ঋষির বিয়ের দিন।



আজকে ঋষির বিয়ে। সারাবাড়ি আলোকসজ্জায় আলোকিত। আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ে বাড়িটা গমগম করছে। পাড়া-প্রতিবেশীরা বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছে। ঋষির মা কাকিমা জেঠিমা এবং অন্যান্য পাড়া-প্রতিবেশীরা মিলে বিবাহের সব কাজ কর্ম সুষ্ঠুভাবেই নিষ্ঠার সাথে পালন করছে। ঋষির বাবা অখিলেশ বাবু খুব ব্যস্ত। যতই হোক বাড়িতে এই প্রথম বিয়ের কাজ হচ্ছে। আজ থেকে প্রায় 32 বছর আগে তিনি ঋষির মাকে বিয়ে করে বাড়ি এনেছিলেন। সেটা হয়েছিল বহু বছর আগের কথা। প্রথম সন্তানের বিয়ের অনুষ্ঠান বলে কথা এতোটুকু ত্রুটি রাখেনি অখিলেশ বাবু। কাছের দূরের সব আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়ে নিজে গিয়ে নিমন্ত্রণ করে এসেছেন। অখিলেশ বাবুর মত স্বনামধন্য ব্যক্তির; আমন্ত্রণ অস্বীকার করার মতো সাহস কারো নেই। কাছের ও দূরের মিলেমিশে প্রায় হাজার দেড়েক মানুষের নিমন্ত্রণ আজকে। বিরাট বড় বাড়িটার সামনে আছে একটা গেস্ট হাউস। এছাড়াও অনেকগুলো হোটেলের ঘর বুক করে দিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনদের থাকার জন্য। সকাল থেকেই চলছে খাওয়া-দাওয়ার বিরাট ব্যবস্থা।.....

" নন্দিনী হল তোর! আরে জল সাঁজতে দেরি হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি কর!!'... বললেন নন্দিনীর মা।

"একটু দাড়াও আসছি।".....বলে নন্দিনী।

"কি জানি বাবা সকাল থেকে কি যে এত সাজগোজ শুরু করেছিস!!'...বলেন মা।

" মা দাদার বিয়ে বলে কথা,একটু সাজবো না তুমিও সব বুঝবে না চলো চলো!"...বলে নন্দিনী।

" তোর মাকে দোষ দিসনা। মায়ের তো বয়স হয়েছে বল!!তোদের মত আমরাও যখন ছোট ছিলাম;তখন আমরাও সাজগোজ পছন্দ করতাম।সবই বয়সের সাথে"..

বললেন আত্মীয়দের মধ্যে একজন।

ব্যান্ড পার্টির বাজনা বাজাতে বাজাতে সবাই মিলে জল সাঁজতে গেলেন।

মহাসমারোহে পালিত হলো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান পর্ব।

"মা আমি কিন্তু হলুদ নিয়ে যাব!".. বলে নন্দিনী।

"তুই জানবি না তো কে যাবে!!আরে তুই তো বড় কর্তা। যা বৌদিকে একবার দেখে আয়".... বললেন নন্দিনী খুড়তুতো দাদা।

সন্ধ্যেবেলায় ঋষি বিবাহের জন্য যাত্রা করল। নন্দিনী তো সঙ্গে আছেই আরও আছে আত্মীয় কুটুম এরা।

নন্দিনীর হবু বৌদি শ্রীময়ী,খুব লক্ষ্মী মেয়ে। দেখতেও লক্ষ্মী প্রতিমার মত। রুপ-লাবণ্যে মোহময়ী মোহিনীর মত। উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে। পান দিয়ে মুখ ঢেকে শ্রীময়ী ঋষির সামনে আসে। ঋষি শ্রীময়ীর থেকে দৃষ্টি সরাতে পারে না। সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ এর দ্বারা দেবতাদের সাক্ষী রেখে শুরু হয় বিবাহের পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ। "প্রজাপতি ব্রহ্মা আর কি খেলা!কেমন মানিয়েছে দুদিকে।এবার পড়ে রইল আমাদের নন্দিনী!"

বললেন নন্দিনীর জেঠিমা।

" হ্যাঁ তা যা বলেছ দিদি!নন্দিনীর ভালো ঘরে বিয়ে হয়ে গেলে অখিলেশ দাদা একেবারে মুক্ত হন।"...

বললেন নন্দিনীর কাকিমা।

দুজনের আলোচনার মাঝে বড় বৌদি বলে উঠলেন

" সবই তো বুঝলাম ;কিন্তু নন্দিনীর দিকে ভালো করে একবার লক্ষ্য করেছো কি সবাই। ঋষির বউ রুপ-লাবণ্যে সবদিক থেকেই শ্রীময়ী কিন্তু নন্দিনী!! বুঝতে পারছ আমি কি বলছি!!"...

মেয়েরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে চাওয়া চাওয়ি করে। সবার অলক্ষ্যে এই কথাগুলি নন্দিনীর কান স্পর্শ করেছিল।কারণ এদের আলোচনা সভার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়েছিল নন্দিনী।ওর বুঝতে বাকি রইল না ওর বড় বৌদি কি ইঙ্গিত করছেন!!!

সুন্দর বিবাহের পরিবেশটায় নন্দিনীর হৃদয় এক অজানা কষ্টে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ও মনে মনে বলে ..

"ছি ! একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের প্রতি কি জঘন্য দৃষ্টিভঙ্গি। অত্যাধুনিকতার যুগে ;এইসব বালাই কেউ ভাবে!!"

ঋষির বিয়ে সম্পন্ন হয়। নতুন বউকে নিয়ে রাতে ওরা শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। গাড়িতে নতুন বৌদির পাশে বসেছিল নন্দিনী। বারবার বৌদিকে ভালো করে প্রত্যক্ষ করছিল মেয়েটা।কিন্তু কোন কথা বলতে পারছিল না। বিবাহ সভায় উপস্থিত সব মেয়েদের আলোচনা প্রসঙ্গটা বার বার মস্তিষ্কে আঘাত করছিল।

নতুন বউ বরণ করার পর;দৌড়িয়ে নিজের ঘরে চলে যায় নন্দিনী।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলতে থাকে।

দুদিন পর বাড়িতে ঋষির রিসেপশন এর অনুষ্ঠান। সবভুলে নন্দিনী আনন্দে মেতে আছে। নতুন বৌদি ওর ঘরেই রয়েছেন। মা বললেন....

" বৌমা!! তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নাও। দুপুর বারোটার মধ্যে তোমাকে ভাত কাপড় দেওয়া হবে।"

শ্রীময়ী ওর নম্র আচরণ এর দ্বারা এই দুদিনের মধ্যেই শাশুড়ির মনে জায়গা তৈরি করে ফেলেছে। সে বলে

" হ্যাঁ মা!আমি নন্দিনীর ঘরেই স্নানটা সেরে নিই। সারা বাড়িতে আত্মীয় স্বজন রয়েছে তো। নন্দিনীর ঘরটা আমার কাছে সম্পূর্ণ সেভ।"

" এটা আবার বলতে হয় বৌদি!!"... বলে নন্দিনী।

নন্দিনীর মা চলে যাওয়ার পরে শ্রীময়ী ওর ব্যাগ খোলে। নন্দিনী ও বৌদির সাথে জামা কাপড় বের করার কাজে হাত লাগিয়ে ছিল। আচমকাই বৌদির অন্তর্বাস। নন্দিনী শিঁউরে ওঠে সেটার স্পর্শে। ছুড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে। শ্রীময়ী বলে.." এই দেখেছো আমি এটাই খুঁজছি!! দাওতো,স্নান করতে যাবো তো!!স্নান করে পড়বো!"

নন্দিনী মেঝেতে পড়ে যাওয়া অন্তর্বাসটা তুলে বৌদির হাতে দেওয়ার সময় ভালো করে বৌদিকে পর্যবেক্ষণ করে। শ্রীময়ী স্নান করতে ঢোকে। নন্দিনীর ঘরের বাথরুমের দরজায় ছিটকিনি খারাপ ছিল। নন্দিনী নিজেই ইউজ করতে বলে ওর প্রবলেম হতো না।কিন্তু শ্রীময়ী বলে "এই নন্দিনী দরজা আটকানো যায় না!"

"না গো বৌদি!! দুদিন আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। মনে হয় আমার বাথরুমটাকে ইউজ করতে গিয়েই এ প্রবলেমটা করেছে কেউ! বিয়েবাড়িতে কাকে ধরি বলতো!"..

বলে নন্দিনী। শ্রীময়ী বলে.." ও ঠিক আছে!তুমি ঘরে থাকছো তো তাহলেই হবে! আর কাউকে আসতে দিও না!"

বাথরুমের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে স্নান শুরু করে শ্রীময়ী। বিন্দু বিন্দু জলের স্পর্শে শীতল করে শরীর। নন্দিনীর বুকের ভেতরটা কেমন যেন হতে থাকে। কি একটা আশঙ্কায় ওর চোখ দুটো ভিজে যাওয়া বাথরুমে দরজা টাকে পর্যবেক্ষণ করে। বারবার মনে হয়...

" একটু দরজা টা খুলে দেখবো! কিন্তু না; বৌদি কি ভাববে...আমাকে!"

তাও নিজের মনকে সামলাতে পারেনা নন্দিনী। অন্যায় ভাবে দরজাটা আলতো করে খুলে বৌদিকে পর্যবেক্ষণ করে।

শ্রীময়ী স্নান করে চলে যায়।.. উলুধ্বনি শঙ্খ ধ্বনি দিয়ে শ্রীময়ী দাদা ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নেয়। বাড়ির মেয়ে বৌ দের উপস্থিতিতে সবার হাসিঠাট্টার মাধ্যমে সে অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হচ্ছিল একদিকে; আর অন্যদিকে নন্দিনী আয়নার সামনে নিজের অনাবৃত্ত দেহটার সাথে বৌদি তুলনা করছিল।ভাবছিল সত্যিই তো নারী কত সুন্দর!!আর আমি কেন এমন!!!..

সন্ধ্যেবেলায় সাজানোর জন্য পার্লার থেকে লোক এসেছে।" দাদার পছন্দ আছে সত্যিই!আপনি খুব সুন্দরী। বেশি মেকাপ এর প্রয়োজনী হলো না!!..".. জিনি সাজাতে এসেছিলেন তিনি কথাটা বললেন।

শ্রীময়ীর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। সে বলল

" কি যে বলেন দিদি! আপনি আমার ননদিনী কে একটু ভালো করে সাজিয়ে দিন তো!!"

বৌভাতের অনুষ্ঠানে পরার জন্য ঋষি নন্দিনীকে একটি খুব সুন্দর লেহেঙ্গা কিনে দিয়েছিল। সেই লেহেঙ্গা পরেই সেজে ওঠে নন্দিনী।

" কই রে তোদের হলো!!এবার তো আয়!প্রথমে একজন ছিল এবার আরেকজন এসে জুটেছে। এই দুটোকে নিয়ে আমি আর পারিনা। কি যে এত সাজে এরা?? বৌমা নিচে এসো! তোমার বাপের বাড়ি থেকে লোকজন এক্ষুনি চলে আসবে!!".. বললেন ঋষির মা।

মিনিট পনেরো পরে নন্দিনী এবং শ্রীময়ী সিড়ি দিয়ে নেমে আসে। "ভীষণ সুন্দর লাগছে দুজনকে!".... বলে নন্দিনীর দাদা। তারপর নতুন বউকে সঙ্গে নিয়ে রিসেপশনের আসরে বসানো হয়। কন্যাযাত্রী লোকজন চলে এসেছেন। নন্দিনী নিজের দায়িত্ব করে সমস্ত আত্মীয়-স্বজন দেখাশোনা করছেন। কন্যাযাত্রী লোকের জন্য স্পেশালি তালের শাঁসের শরবত এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিজে হাতে সবাইকে সেই শরবত বিতরণ করছিল নন্দিনী হঠাৎ প্রদ্যুৎ এর সঙ্গে দেখা❤️....


"আরে নন্দিনী!! কত বড় হয়ে গেছো তুমি??"( প্রদ্যুৎ)

" প্রদ্যুৎ তুমি!! তুমি কি আমার বৌদির আত্মীয় হও নাকি?"..(নন্দিনী)

" আরে আত্মীয় না প্রতিবেশী বলতে পারো

কত বছর পর দেখা হল বল। সেই মাধ্যমিকের সময় আমাদের স্কুলে তোমাদের সিট পড়েছিল মনে আছে!!!"

... বলে প্রদ্যুৎ।

" হ্যাঁ যা বলেছ?তা কেমন আছো তোমরা!!".. (নন্দিনী)

" এই ভালো আছি।চাকরি করছি একটা প্রকাশনী সংস্থায়। তোমার খবর বল"..( প্রদ্যুৎ)

" আমি এই ফার্স্ট ইয়ার"..( নন্দিনী)

" বাহ ভালো!! তা বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি!"( প্রদ্যুৎ)

একটু হেসে নন্দিনী বলে.." না এত তাড়াতাড়ি কিসের??সবে তো ভর্তি হয়েছি। দাদার বিয়ে হচ্ছে।এর পরে পিসি হব।চাকরি করব।তারপর ভাববো!! এত তাড়াতাড়ি এনগেজ হয়ে গেলে ;সব ম্যাচকার হয়ে যাবে বুঝলে!!

" তাই নাকি!!".... এই বলে হেসে নন্দিনী আবাদ মস্তক ভালো করে দেখি নেয় প্রদ্যুৎ।

ঋষি প্রবেশ করে।..." আরে কেমন আছিস কত বছর পর দেখা বলতো??"

" ভালোই হলো তুই তো আর নিমন্ত্রণ করলি না তাই শ্রীময়ীর হয়েই কন্যা যাত্রীর পক্ষ থেকে চলে এলাম!".. বলে প্রদ্যুৎ।

" বেশ করেছিস ভাই!! কফি খেয়েছিস??দেখ নিজের মনে করে খাবি!সব রকম খাবারের স্টল করেছি!".. বলে ঋষি।

" তোকে একদম চিন্তা করতে হবে না। নন্দিনী আছে তো ও আমার দেখাশোনা করবে!".. বলে প্রদ্যুৎ।

ঋষি বিষয়টাকে ক্যাজুয়ালি নিয়েই সেখান থেকে চলে যায়।

এই ঘটনার দিন সাতেক পরে নন্দিনী কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে দেখে.. বাড়িতে এসে প্রদ্যুৎ এসেছে মা বাবাকে নিয়ে। নন্দিনীর মা সুতাপা দেবী ছুটে এসে নন্দিনীকে বলেন.." সোনায় মোড়া কপাল তোর! পাত্রপক্ষ নিজে থেকেএসেছে বিয়ের পাকা কথা বলতে,প্রদ্যুৎ তোকে বিয়ে করতে চায়।"

কলেজ থেকে ফিরে এমন একটা খবর নন্দিনী সত্যি আশা করেনি। একটু ইতস্তত হয়ে ওর মাকে বলে

" মা তোমার সাথে আমার কথা আছে। একটু বাইরে এসো।"

" আবার কি হলো চল!!'..(সুতপা)

" মা তোমাকে অনেকদিন ধরে একটা কথা বলব বলব ভাবছি। সাহস হয়নি। মা আমার সঙ্গে একটা ছেলের পরিচয় হয়েছে ও না খুব ভালো গল্প লিখতে পারে। তুমি বাবাকে বলে একটু চেষ্টা করো না ওর লেখা গল্পগুলো বই হিসেবে প্রকাশ করতে।"...(নন্দিনী)

" ও এই ব্যাপার!! ঠিক আছে সে না হয় বলবো খনি। তা মা তুই প্রদ্যুৎ কে বিয়ে করতে রাজি তো!!"...(সুতপা)

একটু চুপ করে নন্দীনি বলে....." তোমরা যখন কথা দিয়ে দিয়েছো তখন আমার কথার আর মূল্য থাকে। আমি প্রদ্যুৎ এর সঙ্গে একটু একা কথা বলতে চাই!"

" বেশতো বল আমি ডেকে দিচ্ছি ওকে!"( এই বলে সুতপা ঘরে গিয়ে প্রদ্যুৎ কে বললেন বাইরে নন্দিনীর সাথে কথা বলতে)

সহাস্যবদনে প্রদ্যুৎ এগিয়ে আসে নন্দিনী দিকে।

নন্দিনী প্রদ্যুৎ এর দিকে তাকিয়ে বলে এই..." আমার বিশ্বাসের এই মর্যাদা দিলে তুমি!! তোমাকে না বলেছিলাম আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না তাহলে কেন এসব করলে!!"..

নন্দিনীর খুব কাছে এগিয়ে এসে প্রদ্যুৎ বলে..." যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছিলাম সেদিন থেকেই তোমায় ভালোবাসি। ঋষির বিয়ের দিন তোমাকে দেখে ভেবেছিলাম মনের কথাটা সেদিনই বলে দেবো, কিন্তু বলা হয়নি। তুমি আমার কাছে থেকেও পড়াশোনা করতে পারবে বিশ্বাস করো আমি অন্য ছেলেদের মত না। বিয়ের আগে এক বিয়ের পরে অন্য রকম কথা বলব।"..

প্রদ্যুৎ এর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারে না নন্দিনী। কিন্তু প্রদ্যুৎ এর কথার মাঝখানেই যে মস্ত বড় ব্যবধান ছিল সেটা ধরতে পারেনি মেয়েটা।

অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায়।

বৌভাতের রাতে.....

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে প্রদ্যুৎ। ধীরে ধীরে নন্দিনীর কাছে এগিয়ে আসে। নন্দিনী চুপ করে খাটে বসে ছিল। প্রদ্যুৎ আস্তে আস্তে বলে..." কত বছরের অপেক্ষার অবসান আজকের রাত। স্বপ্নে তোমায় কত দেখেছি কতবার কাছে গিয়েছি কিন্তু আজ সত্যি সত্যি!!"

প্রদ্যুৎ এর উষ্ণ নিঃশ্বাসের স্পর্শে নন্দিনীর গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। ধীরে ধীরে প্রদ্যুৎ অনাবৃত করতে শুরু করে নিজেকে তারপর নন্দীনি কে।

" একি নন্দিনী!!... তোমার ব্রেস্ট এমন কেন??.."( প্রদ্যুৎ)

নন্দিনী আলোকিত ঘরের মাঝে ফুলশয্যার বিছানায় নিরাবরণে শুয়েই চাদরটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে..." তুমি কি বলতে চাইছো??"

" আমি কি বলতে চাইছি তুমি বুঝতে পারছনা!! ঋষির বিয়ের সময় তোমার পোশাক আশাক দেখে তো আমার সবকিছু ঠিকঠাক মনে হয়েছিল!"( প্রদ্যুৎ)

" ছি প্রদ্যুৎ!! তুমি আমায় ভালোবাসো। এসব কি বলছ তুমি!! শরীরের বাসনা টাই কি সব!!"(নন্দিনী)

" দেখো নন্দিনী আমি সেসব বলিনি!! আমি বাইরে থেকে যেরকম দেখিয়েছিলাম এখন তো বুঝতে পারছি সেটা সবই সাজানো ছিল!!"( প্রদ্যুৎ)

" হ্যাঁ!! দাদা রিসেপশনের দিন পার্লারের এক দিদি আমাকে সাজিয়ে দিয়েছিল।"( নন্দিনী)

" হে ভগবান!! সবই কি নকল প্রসাধনী দিয়ে সাজানো যায়!! ছি ছি ছি ছি ছি আমি কি করলাম!"( প্রদ্যুৎ)

পরের দিন সকালে অষ্টমঙ্গলায় যাওয়ার জন্য তৈরি হয় নন্দিনী। ওরা দুজনেই বাপের বাড়ি চলে যায় ঠিকই কিন্তু প্রদ্যুৎ শ্রীময়ী কে বলে আসে..." নন্দিনী এখনো পবিত্র। আমি কি বলতে চাইছি ঠিকই বুঝতে পারছ। দেখো আমি বাইরে থেকে ওর আবরণে বুঝতে পারিনি ওর শরীরের একটা ত্রুটি আছে। তুমিও একটা মেয়ে আর বুঝতে পারছ আমি কি বলতে চাইছি। পারলে তোমরা ওকে আর আমার সংসারে পাঠিও না। আমি ওকে মানতে পারছিনা।"

দরজার আড়াল থেকে নন্দিনী শব্দ শুনতে পায়। প্রদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরে শ্রীময়ী ব্যাপারটা সুতপাকে জানান। সেই দিনের পর থেকে বাড়ির সকলেই নন্দিনীর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করে। একদিন নন্দিনী একা একাই শপিংমলে যায়। সেখানে ওর দেখা হয় সেই লেখক এর সঙ্গে।

" আরে নন্দিনী বিয়ে করে ফেললে আমাকে বললে না!"

(লেখক)

" আর বিয়ে!কেমন আছেন??"(নন্দিনী)

" যাই বলো নন্দিনী বিয়ের পরে তোমাকে কিন্তু খুব সুন্দর দেখাচ্ছে!"(লেখক)

লেখক এর মুখে রূপের প্রশংসা শুনে চোখে জল চলে আসে নন্দিনীর।

"একি তুমি কাঁদছো কেন?? আমাকে বন্ধু মনে করে বলতে পারো। কথা দিচ্ছি আমি অত খারাপ লোক নই!! যে কথাগুলো তুমি আমাকে বলবে:সেগুলো কোনদিন আমি কাউকে বলবো না। আমার মনে হয় গম্ভীর হয়ে না থেকে চাপা কষ্ট প্রকাশ করে দেওয়াটা উচিত!"

লেখক বন্ধুর কথা শুনে নন্দিনী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেই শপিং মলের ক্যান্টিনে বসে তারপর সেই লেখক বন্ধুকে সবকিছু খুলে বলে। কথা বলতে বলতে রাত হয়ে যায়। শপিং মল ও বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে বাইরে প্রবল ঝড় বৃষ্টি ওঠে।

" নন্দিনী এখন কোথায় যাবে তুমি!!"(লেখক)

নন্দিনী লেখাকের হাতদুটো ধরে বলে..." যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে নিয়ে চলো!"

লেখক বলে.." এত ভরসা আমার ওপর!! যদি বলি তোমাকে নষ্ট করে দেবো!"

নন্দিনী নিজের ঠোঁট লেখকের ঠোঁটে রেখে বলে...." তোমার সাথে থাকলেও একটা আলাদা আনন্দ পাই। তোমার সাথে যখনই কথা বলিনি খুব শান্তি অনুভব করি। এত কম সময়ের মধ্যে তুমি আমার হৃদয়ের অনেক কাছে চলে এসেছে। নষ্ট হলেও ক্ষতি নেই!"

" সত্যি বলছো তো!! আমি কিন্তু নষ্ট জিনিস ফেলে দিই না। নষ্ট জিনিস দিয়ে নতুন করে তুলতে ভালবাসি! তুমি পালিয়ে যাবে নাতো!!"(লেখক)

" না!!কথা দিচ্ছি যতদিন তুমি থাকবে; ততদিন আমি থাকবো। কিন্তু হ্যাঁ যেদিন তুমি চলে যাবে সেদিন আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না!"(নন্দিনী)

কথা শেষ হতে না হতেই স্যার চিৎকার করে বলে ওঠেন

" চুপ করো সমর!! তুমি এ কার গল্প বলছো!!"

সমর বলে.." ভয় পেলেন নাকি স্যার!! চিন্তা নেই আপনাকে নন্দিনীর কাছে নিয়ে যাচ্ছি!! আজ আমার এই অবস্থার জন্য এবং আমার একমাত্র ভালবাসার করুণ পরিণতির জন্য কে দায়ী???"

" চুপ করো চুপ করো!! আমি কথা দিচ্ছি তোমার বই বিনামূল্যে ছাপাবো। আমাকে ছেড়ে দাও।" বললেন স্যার।

" সেটাতো আর সম্ভব নয়!! আমি বললাম না লেখা ছাপানো হোক বা না হোক আজ আমার জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি হয়েছে!!"..

হঠাৎই স্যারের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোন রিসিভ করে ওপার থেকে আমি শুনতে পান... খুব চেঁচামেচি শব্দ । উনার স্ত্রী বলছেন ..."হ্যাঁ গো শুনেছ প্রদ্যুৎ কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না!! সকাল থেকে একটা ফোন আসার পর থেকেই প্রদ্যুৎ এর কোন খবর ছিল না। একটু আগেই টিভিতে খবরে দেখালেও তোমাদের অফিসের ছাদের কার্নিশে ঝুলছে প্রদ্যুৎ এর দেহ। ওর বুক থেকে বেরোচ্ছে ফিনকি দিয়ে রক্ত। এমনভাবে ঝুলছে দেহটা উদ্ধারকারীরা উদ্ধার করতে পারছেন না। বুকের ঠিক মাঝখানে কার্নিসের সিক বেঁকে ঢুকে আছে। অস্পষ্ট গলায় প্রদ্যুৎ বলছে.." নন্দিনী আমায় ক্ষমা করো!"

শুনতে পাচ্ছ আমি কি বলছি। নন্দিনি তো মারা গেছে!!"

কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোন কেটে যায়। সমর গাড়ি চালাতে চালাতেই মাথাটা 360° ঘুরিয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে বলে......" ভৌতিক গল্প ছাপার আপনার খুব শখ তাই না। আমার গল্প কোন কিন্তু আমার পরিচিতি তেই ঝাঁপবেন। খবরদার অখিলেশ বাবু যদি এবারও লেখক হিসাবে নিজের নামটা উল্লেখ করেন তাহলে বুঝতে পারছেন যেমন অবস্থা প্রদ্যুৎ এর হয়েছে ঠিক তেমন অবস্থা আপনার হবে ও আর একটা কথা নন্দিনী আমার সাথেই আছে। সকালবেলা আপনি রাখুন ধাক্কা দিয়ে আমায় ফেলে চলে গেলেন তখন নন্দিনী সেটা দেখতে পেয়েছিল। বাড়িতে গিয়ে কাউকে কিছু জানায়নি। চুপচাপ দরজা বন্ধ করে;তারপর আমার কাছে চলে আসে। ওই দেখুন আপনার পাশেই বসে আছে।"

অখিলেশ বাবু তখন ভয়ে কাঁপছেন। প্রদ্যুৎ এর সাথে বিয়ে হওয়ার পরেই প্রদ্যুৎ যখন অষ্টমঙ্গলায় নন্দিনীকে বাপের বাড়ি রেখে চলে যায় এবং আর কোনদিনও না নিয়ে যাওয়ার কথা বলে যায় সেই দিন থেকেই পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের মুখে অখিলেশ বাবু অনেক নিন্দা শোনেন।

ধীরে ধীরে নিজের মেয়ের প্রতি ওনার ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে। বাড়ির সকলের মধ্যে কেবলমাত্র শ্রীময়ী এবং ঋষি নন্দিনীর সাথে একটু কথা বলতো। তাছাড়া নিজের মা-বাবা হয়েও ওনারা কখনো নন্দিনীর মনের ভাবটা বুঝতে চাননি।ওই টুকু শারীরিক ত্রুটি কখনো বিবাহবন্ধনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে না। অখিলেশ বাবুর অনেক টাকা উনি ওনার মেয়েকে সঠিক বিচার দিতে পারতেন। কিন্তু স্ট্যাটাস বজায় রাখতে গিয়ে তিনি সেটা করেননি। পাছে লোক জানাজানি হয়ে উনার বদনাম হয় মেয়ের শারীরিক ত্রুটির জন্য।

ভয়ে ভয়ে পাশের সিটে তাকান। নন্দিনী চুপ করে বসে আছে। গলায় একটা দড়ি দাগ স্পষ্ট। সে বলে

" বাবা!!!গল্পটা লিখো কিন্তূ। সমর এর প্রত্যেকটা গল্পের এই কোনো না কোনো নারীর দেহের সাথে হৃদয়ের যন্ত্রণা রয়েছে। কিন্তু মাথায় রেখো বাবা লেখক হিসাবে দেবে স্বর্গীয় সমর রায়।"

" হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ!! তাই হবে আমার বাঁচতে দাও। এর আগে যে সমস্ত লেখক এর লেখা আমি চুরি করেছি তাদের প্রত্যেকের পরিবারের কাছে গিয়ে আমি ক্ষমা চেয়ে আসবো। আমি কথা দিচ্ছি আমি সেই সমস্ত বইগুলো আবার পুন: প্রকাশ করব তাদের নাম দিয়ে। কথা দিলাম। এবার আর কথার খেলাপ করবো না।"

"স্যার ও স্যার পাগল হয়ে গেলেন কি বলছেন??"

অখিলেশ বাবু চোখ খুলে তাকান;দেখেন... উনিই সিটে বসে আছেন। গাড়ির ড্রাইভার ওনাকে ডাকছে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে উনি।

উনার স্ত্রী সুতাপা গাড়ির দরজা খুলে উনাকে বললেন

" কিগো কোথায় ছিলে এতোক্ষন!! চলো ঘরে চলো। তোমার মনে নেই আজকে নন্দিনীর বার্ষিকী। এক বছর হল মেয়েটা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।"

অখিলেশ বাবু কখনো ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। নন্দিনী ছবিটার দিকে তাকিয়ে উনি বললেন..

" সত্যিই তুমি নারী!! আদ্যা শক্তি মা জননী। জীবিত অবস্থায় তোমায় আমি ভুল বুঝে গেলাম। মনের কথাটা জানার চেষ্টাই করিনি। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস মা।"

নন্দিনী ছবির সামনে রজনীগন্ধা ফুলদানিতে নিচে দেখতে পেলেন একটা ডাইরি। ডায়রিটা খুলতেই দেখতে পেলেন সমরের সই করা। নন্দিনীর মা সুতপা দেবী চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন.." মেয়েটা আমাকে বলেছিল একটা ছেলে খুব সুন্দর গল্প লেখে ওর লেখা গল্পগুলো তোমাকে যেন আমি ছাপাতে বলি।ছেলেটা আর বেঁচে নেই জানো তো। বছরখানেক আগে একটা গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায়। এই ডাইরিটা নন্দিনীর ঘর গোছাতে গিয়ে আমি পেলাম যদি পারো ছাপিও।"

অখিলেশ বাবু চোখের সামনে সব দৃশ্যগুলো চলন্ত সিনেমার মতো দৃশ্যমান। মনে পড়ে সমরকে অফিসে নিয়ে এসেছিল যে ব্যক্তি সেই ব্যক্তি ছিলেন একজন লেখক যার লেখা চুরি করে নিজের নামে ছাপিয়েছিলেন অখিলেশ বাবু। একটা গল্প শুনতে শুনতে কথায় কথায় উনি সমরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সমর সেই ব্যক্তির দৈহিক গঠনের একটা চিত্র এঁকে দেখিয়েছিল অখিলেশ বাবু সেইসময় ঠিক বুঝতে না পারলেও আজকে উনি বুঝতে পারছেন।

অজান্তে করা ভুলের ক্ষমা হয় কিন্তু যে ভুল জেনেশুনে করা হয় সেই ভুলের যন্ত্রণা বিবেককে শেষ করে দেয়। অখিলেশ বাবু নিজের কৃতকর্মের জন্য সত্যিই দোষী।

এই ঘটনাটি তিনমাস পর...

একটা বড় প্রেস কনফারেন্সে নতুন একটি বই প্রকাশের কথা জানালেন তারপর বই মেলাতে সবার হাতে তুলে দিলেন সমরের লেখা বই "শ্লীলতা"।

নিজের সম্পর্কে অনেক কথা স্বীকার করলেন। সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। বললেন......" নিজস্ব সৃষ্টির মূল্য সত্যিই অমূল্য সম্পদ। আপনারাও লিখবেন যা আসে মনে। আমি কথা দিচ্ছি আপনাদের সেই অমূল্য সৃষ্টি আমি যত্ন করে তুলে দেবো শ্রোতা বন্ধুদের হাতে। সেই সৃষ্টি আপনাদের বাঁচিয়ে রাখবে অমর করে তুলবে সমর আর নন্দিনীর মত




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror