শেষ অধ্যায়
শেষ অধ্যায়
সকালটা অদ্ভুতভাবে শুরু হয়েছিল।
রণজয় বিছানায় চোখ খুলতেই দেখল দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির কাঁটা থেমে আছে ৩:১৭-এ। অথচ বাইরে গাড়ির হর্ন, দোকানের ডাকে মনে হচ্ছে শহর স্বাভাবিক। সে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করল আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি নেই।
ঠিক সেই মুহূর্তে টেবিলের উপর রাখা ডায়েরিটা নিজের থেকেই খুলে গেল। কাগজের পাতায় এক লাইনের লেখা
“আয়না শুধু বাস্তবকে ধরে না, অদৃশ্যকেও ধরে রাখে।”
রণজয়ের বুক কেঁপে উঠল।
দিনগুলো অদ্ভুতভাবে একে একে খুলে যাচ্ছিল।
সে যেখানে যেত, সেখানেই একটা মেয়ে যেন তাকে অনুসরণ করত। কখনো রাস্তার মোড়ে, কখনো ট্রেনের জানালার বাইরে, কখনো ভিড়ের ভেতরে অচেনা চোখের আড়াল থেকে।
প্রথমে ভেবেছিল কাকতালীয়। কিন্তু এক রাতে, হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়া অন্ধকারে, হাওয়ার ফাঁকে শোনা গেল ফিসফিস
“আমি মায়াবী। তোমাকে মনে করিয়ে দিতে এসেছি।”
রণজয় আতঙ্কে আলো জ্বালতেই কেউ নেই।
ডায়েরির লেখা প্রতিদিন পাল্টাচ্ছিল।
সে যখন ঘুম থেকে উঠত, নতুন নতুন অধ্যায় যোগ হয়ে যেত।
আজকের লেখায় স্পষ্ট লেখা
“রণজয় শীঘ্রই বুঝতে পারবে, সে নিজেই গল্প।”
এবার আর সহ্য হলো না। ডায়েরি নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল জানালা দিয়ে।
কিন্তু পরদিন সকালে চোখ খুলতেই দেখে ডায়েরি আবার টেবিলেই আছে, নতুন বাক্যসহ।
“তুমি যতই আমাকে ফেলে দাও, আমি ফিরে আসব। কারণ আমি-ই তোমার শেষ অধ্যায়।”
মায়াবী ধীরে ধীরে বাস্তবে উপস্থিত হতে লাগল।
প্রথম দেখা হলো বৃষ্টিভেজা এক বিকেলে। সে হঠাৎ রণজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল
“তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো না, তাই না? অথচ আমি তো সেই যে তোমার জীবনের প্রতিটি স্মৃতি লিখেছি।”
রণজয় থতমত খেয়ে বলল “আমি কেন নিজের জীবন লিখতে পারব না?”
মায়াবীর ঠোঁটে রহস্যময় হাসি
“কারণ তোমার কাছে জীবন মানে ভোগা। কিন্তু আমার কাছে জীবন মানে লেখা। তুমি বেঁচে আছো, শুধু যেন আমার লেখা সত্যি হয়ে ওঠে।”
একদিন রণজয় চুপিচুপি মায়াবীকে অনুসরণ করল।
সে ঢুকে গেল পুরোনো একটি গ্রন্থাগারে। ভেতরে সারি সারি ধুলো জমা বই। মায়াবী একটা ভারী খাতা খুলে বসে লিখছে।
রণজয় তাকিয়ে দেখল
সে যা লিখছে, তা একইসাথে রণজয়ের চোখের সামনে বাস্তবে ঘটছে।
উদাহরণস্বরূপ অদিতি লিখল, “রণজয়ের শরীর হঠাৎ কেঁপে উঠল।”
ঠিক তখনই রণজয়ের শরীর কেঁপে উঠল।
সে চিৎকার করে উঠল “থামো!”
মায়াবী থামল না। শুধু বলল “শেষ অধ্যায় না লেখা পর্যন্ত তুমি মুক্ত নও।”
রাতের পর রাত, রণজয়ের ঘুম হারাম হয়ে গেল।
স্বপ্নে সে দেখতে লাগল একটা ট্রেন অসীম অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে। ট্রেনে কেউ নেই, শুধু একটি সিটে বসে আছে মায়াবী। জানালার বাইরে লেখা
“Next Stop: The Last Chapter.”
একদিন, হঠাৎ ডায়েরি নিজেই লিখতে শুরু করল।
শব্দগুলো ঝরে পড়ছে কালি ছাড়া পাতায়—
“লেখক আর চরিত্রের সীমা মুছে যাচ্ছে। এবার রণজয় বুঝবে লেখকও বন্দি হতে পারে।”
রণজয় হতবাক হয়ে লিখল উল্টো করে
“যদি আমি চরিত্র হই, তবে লেখককেও আমি লিখতে পারি।”
পাতা মুহূর্তেই রক্তলাল হয়ে উঠল। ঘর কাঁপতে লাগল। মায়াবী ছুটে এসে বলল “না, এটা কোরো না!”
রণজয় চোখ মেলে দেখল সে আর তার পুরোনো ঘরে নেই। বরং এক বিশাল কক্ষে, দেয়ালজোড়া তাকভর্তি হাজার হাজার ডায়েরি। প্রতিটি ডায়েরির নাম
“শেষ অধ্যায়”।
সে একটি খুলল
দেখল, তার নিজের গল্প আগেও বহুবার লেখা হয়েছে, অসংখ্য ভিন্নভাবে। কখনো সে বাঁচে, কখনো সে মরে, কখনো মায়াবীকে হত্যা করে, কখনো মায়াবী তাকে মুছে দেয়।
কিন্তু একটাই মিল প্রতিটি বইয়ের শেষে লেখা থাকে একই বাক্য—
“শেষ অধ্যায়ে তুমি আমায় চিনবে, অথবা ভুলে যাবে।”
রণজয় বুঝল এটাই শাশ্বত চক্র।
সে যতই লিখুক, যতই বদলাক, প্রতিটি পথ ঘুরে ফিরে নিয়ে যায় “শেষ অধ্যায়”-এ।
কিন্তু এবার ভিন্ন হলো।
সে শেষবার কলম হাতে নিল, আর লিখল
“এই গল্পের লেখক পাঠক নিজেই। আমি শুধু ছায়া।”
পাতা বন্ধ হতেই আলো নিভে গেল।
বইয়ের মলাটে স্পষ্ট দেখা গেল নতুন নাম লেখক: তুমি।
