ধূসর হাতে ধরা ভালোবাসা
ধূসর হাতে ধরা ভালোবাসা
গল্প: ধূসর হাতে ধরা ভালোবাসা
আজ অনেকদিন পর তাকে দেখলাম।
হঠাৎ করেই দেখা—শহরের ভিড়ভাট্টা পেরিয়ে, বইমেলার এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, পুরোনো বইয়ের গন্ধে ভেসে যাচ্ছিল মনটা। হঠাৎ একটা হাসির আওয়াজ কানে এলো। চেনা সেই হাসি। মন যেন থমকে গেল, সময় যেন আটকে গেল একটা ফ্রেমে। চোখ ঘুরিয়ে দেখি—সে, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক অচেনা পুরুষ।
সে হাসছে। তার চুল একটু এলোমেলো, চোখে পুরোনো সেই স্বপ্নের ছায়া, কিন্তু পাশে যে মানুষটা, তার হাত ধরে সে হেঁটে যাচ্ছে—সেই হাতটা ধরা, যা একসময় আমার ছিল।
আমি থেমে গিয়েছিলাম। মানুষ চলছিল পাশ দিয়ে, জীবন বয়ে চলছিল তার মতো করে। কিন্তু আমি যেন থেমে ছিলাম সেই এক মুহূর্তে।
তার চোখে আমার কোনো খোঁজ ছিল না।
আমার বুকের ভেতরে একটা শূন্যতা জমাট বাঁধছিল। ওর সেই নতুন মানুষের চোখ ছিল নির্ভরতার, চোয়ালে ছিল স্থিরতা—এক ধূসর ছায়ার মতো, যাকে হয়তো সে ভালোবাসে আজ।
আমি ভাবলাম—আমি কি তাহলে সত্যিই অতীত?
আমাদের সেই সিনেমার মতো সন্ধ্যাগুলো, বৃষ্টির পর ছাতা ভাগ করে হাঁটা, কবিতার পাতায় রাখা শুকনো ফুল—সবই কি ভুল?
সে হাত ধরে হেঁটে গেল—নতুন কোনো গল্পের দিকে।
আর আমি থেকে গেলাম, সেই পুরোনো পৃষ্ঠায়, যেটা সে হয়তো পড়েই ফেলেছে বহুদিন আগে।
সেদিন বইমেলায় তাকে হঠাৎ দেখে মনটা থমকে গেলেও, বাড়ি ফিরে এসে আর কিছুই ঠিকঠাক করতে পারলাম না। চা’টা ঠান্ডা হয়ে গেল, বইয়ের পাতা খুললাম ঠিকই—কিন্তু পড়া হলো না। সে যেন ছায়া হয়ে বসে রইলো পাশে।
এখনও মনে আছে—সেই প্রথমদিনটা।
আমরা তখন ক্লাসে নতুন, প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রী। পরিচিতির ভাষা তখনো ঠিকমতো তৈরি হয়নি। তবুও, তার চোখের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করতাম। সে চুপচাপ থাকলেও, তার চুপ থাকা যেন কথা বলত—গভীর, নির্ভেজাল।
একদিন ক্যাম্পাসের পুকুরঘাটে বসে ছিলাম আমি। হঠাৎ সে এসে বলেছিল,
"তুমি কি সবসময় একা থাকো?"
আমার মনের ভেতর যেন কেউ দরজা খুলে দিল সেদিন।
তারপর কেটে গেল বহু দিন—আড্ডা, ক্লাসের পর হাঁটাহাঁটি, সন্ধ্যায় রাস্তার ধারে চা, বইয়ের পাতায় লেখা দু'লাইনের কবিতা। আমি তাকে শুধু ভালোবাসিনি—তাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ দেখেছিলাম।
একবার বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। ছাতা ছিল না কারোরই। আমরা ভিজে গেছিলাম, কিন্তু সেই বৃষ্টিতে ছিল ভালোবাসার প্রথম ছোঁয়া। আমার হাত ধরেছিল সে—অস্ফুট ভাবে, অস্বস্তি নিয়ে, কিন্তু তাতেই ছিল পৃথিবীর সমস্ত উষ্ণতা।
সেই হাতটাই আজ দেখি ধরা অন্য কারো হাতে।
তবুও, মনে পড়ে তার বলা ছোট ছোট কথা, তার কণ্ঠের গলা নেমে যাওয়া যখন সে কষ্ট পেত, আর আমার পাশে বসে বলত,
"তুমি ছাড়া কারও কাছে আমি কিছু বলতে পারি না।"
তাহলে আজ কী হলো?
সে কি ভুলে গেল সেইসব দিন?
নাকি আমি নিজেই অতীত হয়ে গেছি তার ভবিষ্যতের ছায়ায়?
তারপর অনেক রাত জেগে কাটালাম। ঘুম আসেনি এক ফোঁটাও। বারবার তার মুখটা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে—আর তার পাশে সেই লোকটা, যার হাতে সে হাত রেখেছিল।
আমি নিজেকে বোঝাতে চাইলাম—"হয়তো সে শুধুই বন্ধু, হয়তো ভাই, কিংবা সহকর্মী..."
কিন্তু আমার মন বিশ্বাস করল না কিছুই। কারণ, যে দৃষ্টিতে সে তাকাচ্ছিল, সেটা ছিল নির্ভরতার, আর যে দৃষ্টিতে সে লোকটা তার দিকে তাকাচ্ছিল, সেটা ছিল অধিকারবোধের।
পরদিন ক্যাম্পাসে গেলাম। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম, হাসলাম সবার সঙ্গে, ক্লাসে উত্তর দিলাম—কিন্তু সবকিছুর নিচে ছিল একটা চাপা আগুন।
হঠাৎ করেই আমার বন্ধু রাহুল এসে বলল,
“শোন, তোর পুরনো সেই গল্পের মেয়ে… সে না কি আবার শহরে ফিরেছে। কিছুদিন আগেই এসেছে।”
আমি চমকে গেলাম,
“তুই জানিস?”
“হ্যাঁ রে, সে এখন একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। ওর অফিসে যে ছেলেটা ইদানীং ঘনিষ্ঠ—হয়তো সে-ই তোর দেখা মানুষ।”
আমার মাথা যেন ঘুরে উঠলো।
কী এক অদ্ভুত শঙ্কা কেঁপে উঠল হৃদয়ের কোণে।
আমার প্রেম, যাকে আমি ভেবেছিলাম চিরন্তন, সে কীভাবে এমন চুপিসারে অন্য কারো জীবনে ঢুকে গেল?
সন্ধ্যায় ফেসবুক খুলে তার প্রোফাইলে ঢুকলাম।
ছবিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম—এক ছবিতে সেই ছেলেটার মুখ আংশিক দেখা যায়, আর তার ক্যাপশনে লেখা:
“আলোকছায়ার পথ চলা, যেখানে পাশে থাকাটাই বড়…”
আমি তাকিয়ে রইলাম...
তার হাসিমাখা মুখের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়ামূর্তির দিকে।
হ্যাঁ, ছেলেটার মুখটা ধূসর নয়, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
ধূসর আসলে আমি—যে স্মৃতির ছায়ায় রয়ে গেছি, অতীতের অন্ধকারে।
সে আজ আলোর নিচে দাঁড়িয়ে, আর আমি কেবল ছায়া।
ভাঙন হঠাৎ করে হয় না।
সে আসে ধীরে ধীরে—নীরবতার মতো, যন্ত্রণার মতো। একটা সময় পরে তুমি বুঝতে পারো, কথার জায়গায় চুপ থাকে, আর ভালোবাসার জায়গায় এসে জমে ওঠে অচেনা দূরত্ব।
আমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল।
তখনও আমরা একসঙ্গে ছিলাম—কিন্তু একই ছাদের নিচে দাঁড়িয়েও যেন দু’জন আলাদা দেয়ালে ঝুলছিলাম। তার চোখে আমি দেখতে পেতাম না আগের সেই উচ্ছ্বাস। আমার প্রতিটা কথা তার কাছে হয়ে উঠছিল ক্লান্তিকর।
একদিন, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“তুমি কি কিছু বলবে? আমি জানি, তুমি কিছু লুকাচ্ছো…”
সে বলেছিল,
“সব কথা কি বলা যায়? বললেই কি সব বোঝা যায়?”
তার কথায় ছিল না কোনো স্পষ্টতা, কিন্তু ছিল অস্বস্তি। একটা অচেনা দেয়াল যেন দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল আমাদের মাঝখানে, আমি যেটাকে ভাঙার চেষ্টা করছিলাম, আর সে চুপচাপ সেটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত।
আরও একটা দিন মনে পড়ে—আমরা বসেছিলাম ক্যাফের এক কোণে। আমি তাকে বলছিলাম আমার স্বপ্নের কথা, একটা ছোট্ট বাড়ি, একসাথে সকালবেলা চা খাওয়া, ছাদে বসে কবিতা লেখা।
সে হঠাৎ বলেছিল,
“সব স্বপ্ন কি একসঙ্গে দেখা যায়?”
আমি চুপ করে গিয়েছিলাম।
তার চোখে তখন অন্য কিছু ছিল।
অন্য কোনো ভাবনা, হয়তো অন্য কোনো মানুষ...
আমি টের পেতাম, কিন্তু কিছু বলতাম না।
ভাবতাম, এই ফাঁক গুলো ঠিক হয়ে যাবে…
ভেবেছিলাম, ভালোবাসা সব ফাঁক ভরতে পারে।
কিন্তু না—ভালোবাসার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো “অবুঝ নীরবতা।”
আমি শুনতাম না, সে বলত না।
আর ভেতরে ভেতরে আমাদের মাঝখানের নদীটা শুকিয়ে যাচ্ছিল।
সেদিন আমি শুধু তার চোখে দেখেছিলাম এক অজানা ক্লান্তি।
আর বুঝেছিলাম—ভাঙন শুরু হয়েছে।
সেদিন আকাশটা ছিল ভারী, কিন্তু বৃষ্টি ছিল না।
আমি সেদিনও অপেক্ষা করছিলাম—যেমন করি প্রতিদিন।
সেই চেনা চায়ের দোকানে, যেখানে আমরা বসতাম।
সেই বেঞ্চিটা, যেটাতে তার চুল উড়ে এসে লাগতো আমার গালে, আর সে হাসত বলে—"অপছন্দ করছো না তো?"
সেই চা ঠান্ডা হয়ে গেছিল বহুবার,
কিন্তু সে আসেনি।
ফোন করেছিলাম—রিং হয়েছিল, কেউ ধরেনি।
মেসেজ পাঠিয়েছিলাম—“ভালো আছো তো?”
উত্তর আসেনি।
প্রথম দিন ভেবেছিলাম—ব্যস্ত হবে।
দ্বিতীয় দিন ভেবেছিলাম—হয়তো অভিমান করেছে।
তৃতীয় দিনে বুঝেছিলাম—সে আর আসবে না।
সে কিছুই বলেনি।
না বিদায়, না কারণ, না শেষ কোনো কথাও।
কয়েকদিন পর শুনেছিলাম—সে শহর ছেড়ে চলে গেছে।
চাকরির নতুন অফার, নতুন শহর, নতুন জীবন।
আমার কোনো অংশ ছিল না সেই "নতুনে"।
আমাকে রেখেই গিয়েছিল সে—আলো-ছায়ার মোড়ে দাঁড় করিয়ে।
একদিন সাহস করে আমি ওর এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
"সে কি ভালো আছে?"
বন্ধুটি শুধু বলেছিল,
"সে তোমার নাম শুনলে চুপ করে যায়… কিন্তু কিছু বলে না।"
তাহলে এই চুপ করাটা—আমার জন্য শাস্তি?
নাকি ওর ভালোবাসার শেষ ভাষা?
অনেক রাতে, ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আমি ভেবেছিলাম,
তুমি কি জানো, তুমি চলে যাওয়ার পর আমি আর শব্দে কথা বলিনি কারো সঙ্গে?
তুমি চলে যাওয়ার পর, আমি আর কোনো চায়ের কাপ শেষ করিনি।
তুমি কি জানো, আমি এখনও অপেক্ষা করি—
যেন কোনো এক সন্ধ্যায় হঠাৎ ফিরে আসবে তুমি,
হয়তো বলবে—
"সেদিন আমি চলে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু মনটা এখানে ফেলে এসেছিলাম..."
কিন্তু না…
তুমি বলোনি বিদায়।
আর আমি বুঝে গেছি, কখনো কেউ ফিরে আসে না,
যারা বিদায় না বলে চলে যায়—তারা আসলে চিরতরে চলে যায়।
সেদিন হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেল তার সঙ্গে—
না, সে না…
সে, যে ধূসর হাতে হাত রেখেছিল আমার ভালোবাসার মেয়েটার।
বইমেলার এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল সে,
একটা স্টলের সামনে, হাতে কিছু কবিতার বই।
চোখেমুখে একরকম নীরব আত্মবিশ্বাস,
আর চোখজোড়া?
না, সেগুলো খুব চেনা না হলেও… অচেনা বলতেও কেমন যেন দ্বিধা হচ্ছিল।
আমি এগিয়ে গেলাম।
হৃদয়টা কাঁপছিল, কিন্তু মুখে একরকম নিরপেক্ষ ভঙ্গি আনলাম।
— “আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
সে তাকাল আমার দিকে।
— “অবশ্যই।”
— “আপনি কি… ওর খুব কাছের কেউ?”
আমি নাম উচ্চারণ করিনি, তবুও সে বুঝে ফেলল।
একটা হালকা হাসি ফুটল তার ঠোঁটে।
— “হয়তো। আপনি ওকে চেনেন?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম।
— “চিনি। খুব ভালো করে। এক সময় ওর দিন-রাত আমার মধ্যে ছিল।”
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল,
— “ওর দিন-রাত এখনো কেউ ধরে রাখে না।
আমি শুধু পাশে থাকার চেষ্টা করি, ও চায় বলেই।”
আমি অবাক হলাম।
— “মানে?”
সে ধীরে ধীরে বলল,
— “আপনি ভাবছেন আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা?
না, আমি ওর একজন বন্ধুর মতো।
ওর জীবনে কিছু ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছিল—আপনাকে হারিয়ে।
আমি শুধু সেই শূন্যতাগুলো কিছুটা ভরার চেষ্টা করি।
হয়তো সে ভালোবাসা খুঁজে ফেরে না,
শুধু একটু ‘বোঝা’ খুঁজে।”
আমার বুকটা কেঁপে উঠল।
তাহলে… সে এখনো আমায় ভুলে যায়নি?
সে লোকটা এগিয়ে এলো।
— “আপনি যদি ওকে এখনো ভালোবাসেন, তবে ফিরে যান ওর কাছে।
সে কথা বলেনি, তাই তো?
কারণ ও বিশ্বাস করত, আপনি ভালো থাকবেন ওকে ছেড়ে দিলেই।”
আমার চোখে তখন ভেসে উঠছিল সেই মেয়েটার মুখ—
নীরবতা, চোখের গভীর গ্লানি, আর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা।
তার কোনো বিদায় ছিল না, কারণ তার ভাঙা মনটা চায়নি আমায় আটকাতে।
তাই সে কাউকে পাশে রেখেছে, ভালোবাসার জন্য না—টিকে থাকার জন্য।
সে লোকটা এক পা পেছনে সরে দাঁড়াল,
বলল—
“আপনার ভালোবাসা এখনো ওর গল্পের মধ্যে আছে।
আর আপনি যদি সাহস করেন… তবে একবার গল্পটা শেষ করে যান ওর পাশে বসে।”
আমি তাকিয়ে রইলাম, ধূসর ছায়াটা এবার আর অন্ধকার মনে হলো না।
সে তো ছিল না প্রতিদ্বন্দ্বী, ছিল একজন পাহারাদার।
যে পাহারা দিচ্ছে এমন এক হৃদয়কে—যেটা একদিন ছিল আমার।
সেদিন হঠাৎ সেই বন্ধুটি এসে একটা পুরনো খাম এগিয়ে দিল আমার দিকে।
— “ও তোমার জন্য এটা রেখে গিয়েছিল, কিন্তু পাঠায়নি কখনও।
বলেছিল, একদিন যদি তোমার সঙ্গে দেখা হয়, তখন দিয়ে দিতে।”
হাত কাঁপছিল।
চোখের সামনে দুলছিল একটা পুরনো হলুদ খাম, যার প্রেরক নেই,
কেবল আমার নামটা লেখা... হ্যাঁ, তারই হাতে।
আমি খামটা খুললাম।
ভেতরে একটা কাগজ, তার অচেনা হয়ে যাওয়া হাতের লেখা,
তবু প্রতিটি শব্দে যেন চেনা অনুভব, পরিচিত স্পর্শ।
"তোমাকে জানানো হয়নি বলে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমার নেই।
তুমি যখন আমার দিকে তাকাতে চেয়েছিলে, আমি চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম।
তুমি যখন বলেছিলে—সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি বিশ্বাস করতে পারিনি।
তোমার ভালোবাসাটা ছিল বিশুদ্ধ,
আর আমি তখন নিজের ভেতরের ধ্বংস দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম... কারণ তোমার সামনে আমি আর দুর্বল হতে পারছিলাম না।
আমি জানি তুমি ভাববে—আমি কাউকে ভালোবেসে গিয়েছি।
না... আমি শুধু কাউকে পাশে চেয়েছিলাম, যে আমাকে না ভালোবেসেও বুঝবে।
তুমি সেটা পারতে—আমি জানতাম।
তাই তোমার কাছেই আমি ভয় পেতাম বেশি।
তুমি আমাকে পুরোপুরি চিনে ফেলেছিলে,
এবং আমি নিজেকে আর তোমার চোখে দেখতে চাইনি।
তুমি যদি একদিন এই চিঠি পাও,
জেনে নিও—তোমাকে ভালোবাসা থেকে সরিনি।
আমি শুধু দূরে দাঁড়িয়ে থেকেছি,
যেখানে আমার ভালোবাসাটা তোমাকে কষ্ট না দেয়।
তোমার চোখে আমি হেরে যেতে চাইনি,
তাই চুপ থেকেছিলাম।
ভালো থেকো…
তোমার নিঃশব্দ চিঠির প্রেরক
—সে, যে বিদায় বলেনি কখনো…"
চোখের কোণে একটা বিন্দু কাঁপছিল,
কিন্তু ঝরে পড়ার আগেই আমি বুঝে ফেলেছিলাম,
সে চলে যায়নি—
সে কেবল নিজের হারিয়ে ফেলা সত্তাকে লুকিয়ে রেখেছিল আমার থেকে।
এই চিঠিটা কোনোদিন পোস্ট হয়নি,
কারণ তাতে ছিল না বিদায়,
ছিল একরাশ অপ্রকাশিত ভালোবাসা।
তাকে আমি দেখিনি বহুদিন।
চিঠিটা পাওয়ার পরেও সাহস হয়নি তাকে খুঁজে বের করার।
ভেবেছিলাম—যে চলে গেছে চুপচাপ, সে ফিরে এলেও নীরব থাকবে।
কিন্তু সময় কখনো কখনো নিজের নাটক নিজেই সাজায়।
সেদিন বিকেলে, ধানমণ্ডির এক পুরনো বইয়ের দোকানে,
হঠাৎ সে...
ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে।
হাতে এক পুরনো কবিতার বই, চোখে সেই পুরনো ক্লান্তি,
আর ঠোঁটে একটুখানি লুকনো কষ্টের হাসি।
আমি প্রথমে কিছু বলতে পারিনি।
সে-ই এগিয়ে এল।
— “তুমি কি... সেই চিঠিটা পড়েছো?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ।”
— “বেশি দেরি করে ফেলেছি, তাই না?”
— “হয়তো… হয়তো না।
তুমি জানো, আমি এখনো মাঝে মাঝে বসে থাকি সেই বেঞ্চটাতে?”
সে হেসে ফেলল হঠাৎ, চোখের কোনা একটু ভিজে উঠল।
— “আমিও একবার গিয়েছিলাম। দূর থেকে দেখেছিলাম তুমি চা নিয়ে বসে আছো,
কিন্তু সাহস হয়নি এগিয়ে আসার।”
আমি বললাম, “সাহস দরকার হয় না, যদি মনটা ঠিক থাকে।
তুমি কী খুঁজতে গিয়েছিলে অন্য হাতে, অন্য শহরে?”
সে চুপ।
— “ভালোবাসা নয়, কেবল বোঝা খুঁজেছিলাম।
যার কাঁধে মাথা রাখলে মনে হবে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না।
তুমি আমাকে প্রশ্ন করতে, কারণ তুমি আমাকে চিনতে চাইতে।
আর আমি তখন নিজেকেই চিনতাম না।”
আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।
— “তুমি জানো? আমার কাছে ভালোবাসা মানেই তুমি।
তোমার অনুপস্থিতি ছিল আমার হৃদয়ের সবচেয়ে ভারী প্রমাণ,
যে ভালোবাসা হারায় না, কেবল চুপ হয়ে যায়।”
সে হেসে বলল,
— “তবে এবার কি পারবো আবার শুরু করতে?”
আমি বললাম,
— “না… শুরু নয়।
কারণ তুমি আর আমি, আগের আমরা নেই।
আমরা শুধু জানি—ভালোবাসা সবসময় কাছে থাকে,
কখনো চোখে, কখনো চিঠিতে, কখনো শেষ বারের মতো দেখা হওয়া বিকেলে।”
সে আমার দিকে তাকাল,
চোখে ছিল এক অপার প্রশান্তি।
আমরা বিদায় নিলাম।
কেউ কিছু বলল না,
শুধু একবার চোখে চোখ…
আর এক অলিখিত অঙ্গীকার,
"ভালো থেকো, আমি রইলাম তোমার গল্পের ভেতরেই।"
ভেবেছিলাম ওর সঙ্গে শেষ দেখাটাই হবে আমাদের গল্পের শেষ অধ্যায়।
কিন্তু জীবন অনেক সময় শেষ থেকে একটা নতুন শুরু লিখে দেয়,
যেখানে না-পাওয়াটাই হয় আসল প্রাপ্তির প্রস্তুতি।
চিঠিটা এখনো আমার ডেস্কে পড়ে আছে।
ওর শেষ কথাগুলো মাঝেমাঝে পড়ে শুনি নিজেরই ভেতরে।
তবু আর কোনো অভিযোগ নেই।
কারণ আমি বুঝে গেছি—ভালোবাসা থাকলেও সব সম্পর্ক একসাথে থাকা হয় না।
সেদিন হঠাৎই ফোনে একটা মেসেজ এল।
"তুমি ঠিক বলেছিলে।
ভালোবাসা হারায় না, শুধু চুপ হয়ে যায়।
আমি এখন কথা বলতে শিখছি নিজের সঙ্গে—
আর তাতে তুমিও আছো কোথাও।
এই নতুন আমাকে ভালো লাগছে।
তুমি কেমন আছো?"
আমি অনেকক্ষণ ধরে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলাম।
এই প্রথমবার ও কিছু চাইলো না, ব্যাখ্যা দিল না,
শুধু ভাগ করে নিল একটুকরো নিজেকে।
আমি উত্তর দিলাম—
"আমি ভালো আছি।
আর তুমি?
যেখানে শেষ হয়েছিল, ঠিক সেখানেই শুরু করো—
শুধু আমাকে না রেখে, নিজেকে নিয়েই।
আমি তোমার গল্পে না থাকলেও,
তুমি থাকবে আমার প্রতিটি শব্দের ভেতরে।"
সে কোনো উত্তর দেয়নি।
তবে পরদিন সকালে, বারান্দায় রাখা বইয়ের ভেতর একটা গোলাপ পেলাম।
তাতে ছোট্ট একটা কাগজ আটকানো—
“একটা গল্প কখনো শেষ হয় না,
শুধু লেখকের কলম থেমে যায়।”
এই গল্পটা হয়তো আর প্রেমের ছিল না।
এটা ছিল গ্রহণ করার, নিজেকে বোঝার, ভুলে না যাওয়ার গল্প।
এটা ছিল সেই ভালোবাসার গল্প—
যেটা ধরা যায় না, তবু কখনো হাতছাড়া হয় না।
সন্ধ্যার আকাশে যখন নীল তারার মাঝে সূর্য ডুবে যাচ্ছিল,
আমি জানতাম—এবার সে কোথাও হারিয়ে যাবে,
নতুন কোনো শহরে, নতুন কোনো জীবনে।
সে আমাকে ভুলে যাবে, কারণ সে জানত, আমরা একে অপরকে চিরকাল ধরে রাখতে পারব না।
আমার বুকের ভেতর একটি গভীর শূন্যতা তৈরি হয়েছিল,
যে শূন্যতা মেনে নিতে হবে আমাকে,
যদিও আমি জানতাম—ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না।
সে থাকুক বা না থাকুক,
আমার ভেতরে তার ছায়া সর্বদা থাকবে,
যতদিন আমি নিজেকে মনে রাখব,
ততদিন সে আমার গল্পের একটি অংশ হয়ে থাকবে।
একদিন সকালে, আমি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থামলাম।
আবার সেদিনের মতো, সেই চেনা মুখ সামনে দাঁড়িয়ে।
সে, কিন্তু এবার কোথাও হারিয়ে যায়নি,
সে ছিল নিজেকে খুঁজে ফিরে, নিজের জায়গা তৈরি করতে।
একটা নতুন শহর, নতুন শুরু—তবে ছায়াটা ছিল চেনা,
যেমন সে, তেমনই আমি—একই গল্প, একই ভালোবাসা।
আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম,
তবে কোনো কথা বললাম না।
কথার অতিরিক্ত কিছুই নেই—চোখের মাধুর্যেই সব কিছু বলা হয়ে গিয়েছিল।
সে আসলে একটা নতুন জীবন শুরু করতে চেয়েছিল,
যেখানে সে নিজেকে অতিক্রম করতে পারে,
আর আমি, আমার পৃথিবী নিয়েই সুখী ছিলাম।
সে সেদিন কিছু বলল না।
তার নীরবতা যেন অমৃত,
যে অমৃত জীবনের নতুন দিকে তাকানোর সাহস দিল।
সন্ধ্যা হল, এবং সে হাঁটতে হাঁটতে সরে গেল।
এবার, আর কোনো বিদায় ছিল না—
কারণ আমাদের গল্পের শেষ ছিল না,
সে শুধু জানতো,
যতটুকু ভালোবাসা ছিল, তা থাকবে চিরকাল,
এবং তাকে পাওয়ার মতো কিছুই ছিল না,
যে তাকে থামিয়ে রাখতে পারবে।
আমি ফিরে তাকালাম,
একবার কেবল তাকিয়ে দেখলাম,
তার ছায়া কোথাও মিশে যাচ্ছে নতুন আলোতে।
শেষ……

