পথে তো একাই ছিলাম
পথে তো একাই ছিলাম
সেদিন সকালটা ছিল একেবারে সাধারণ। আকাশে কোনো মেঘ ছিল না, সূর্যের আলো নরম, আর চায়ের কাপে ধোঁয়া ধীরে ধীরে উঠছিল। সবকিছুই যেন অন্যদিনের মতোই চলছিল। কিন্তু কে জানত, এই নিরীহ সকালে লুকিয়ে আছে এমন এক ঝড়, যা আমার ভেতরের সবকিছু ওলটপালট করে দেবে।
ও বসেছিল আমার ঠিক সামনে। চোখে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি যেন অনেক ভেবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আমাদের হয়তো একসঙ্গে থাকা ঠিক না।
প্রথমে ভেবেছিলাম, ও মজা করছে। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকাতেই বুঝলাম না, এটা কোনো রাগ, অভিমান বা ঝগড়া নয়; এটা এক বিদায়।
মুহূর্তটা হঠাৎ থেমে গেল। রুমের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। কফির গন্ধটাও যেন কষ্টে ঢেকে গেল। আমি কিছু বলতে পারলাম না শুধু তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
ও উঠে দাঁড়াল, ব্যাগটা কাঁধে তুলল, হালকা হেসে বলল, নিজের খেয়াল রাখো। তারপর দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল আমার সামনে।
সেই দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দটা আজও কানে বাজে যেন সেই মুহূর্তেই আমার এক টুকরো জীবনও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ও চলে যাওয়ার পর ঘরটা হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে গেল। চেয়ারটা খালি, দেওয়ালের ছবিগুলো নিস্তেজ। আমি বসে রইলাম ঠান্ডা হয়ে যাওয়া এক কাপ চা নিয়ে, আর ভাবতে লাগলামএকটা মানুষ কত সহজে চলে যেতে পারে, আর একটা ঘর কত দ্রুত ফাঁকা হয়ে যায়।
বাইরে আলো পড়ছিল গাছের পাতায়, অথচ আমার চোখে কেবল অন্ধকার। দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু সময় যেন থেমে ছিল। ঘড়ির কাঁটা চলত, কিন্তু আমার ভেতরের সময় সেই সকালের দরজার শব্দে স্থির হয়ে গেছে।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিই। অভ্যাসবশত মেসেঞ্জার খুলি কিন্তু কোনো বার্তা আসে না।
ওর শেষ দেখা সময়টা চোখে পড়ে Active 3 days ago। মনে হয়, সময়টা যেন আমাকেই নিয়ে উপহাস করছে।
অফিসে যাওয়ার পথে কানে ইয়ারফোন দিই। আগের প্রিয় গানগুলো এখন বুকের ভেতর ভারি হয়ে বাজে। ট্রাফিক লাইটে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখি সবাই ব্যস্ত, সবাই কারও না কারও কাছে ফিরছে।
আর আমি? আমি ফিরি একা ঘরে, যেখানে অপেক্ষা করে থাকে নীরবতা।
রাতগুলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।
ফোনটা বালিশের পাশে রাখি, কিন্তু আর কোনো ঘুমাওনি? আসে না। হোয়াটসঅ্যাপে লাস্ট সিন দেখি, আবার মুছে দিই। নিজেকে বোঝাই, সব শেষ, এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু মন তো এত সহজে মানে না।
প্রথমদিকে বন্ধুরা পাশে ছিল। চেষ্টা করত হাসাতে, বাইরে নিয়ে যেতে। আমি হাসতাম, কিন্তু সেই হাসির নিচে ছিল এক গভীর শূন্যতা যেন বাইরে মানুষ, ভেতরে ফাঁকা।
এক রাতে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর কথা মনে পড়ল বৃষ্টিতে ভিজে কফি খেতে ওর খুব ভালো লাগত। সেই স্মৃতিগুলো বুকের ভিতর বাজতে লাগল, আর আমি ভাবলাম, ও চলে গেছে, কিন্তু আমি এখনো ওর মধ্যে আটকে আছি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, একাকিত্ব শুধু কাউকে হারানোর যন্ত্রণা নয়; এটা নিজের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়ার সময়ও। প্রথমে ভয় লাগত, কিন্তু ধীরে ধীরে নীরবতায় একটা শান্তি খুঁজে পেলাম।
যে নীরবতাকে একসময় শত্রু ভাবতাম, এখন সেটাই আমার একমাত্র সঙ্গী।
সকালে জানালায় আলো পড়ে। আয়নায় তাকিয়ে দেখি চোখের নিচে ক্লান্তির দাগ আছে, কিন্তু মুখে একটা হালকা শান্তি। হয়তো ব্যথাটা একটু কমেছে, হয়তো আমি একা হাঁটা শিখছি।
বিচ্ছেদের পরের মাসগুলো ঝড়ের মতো কেটেছিল। কিন্তু একদিন ঘুম থেকে উঠে বুঝলাম ঝড় থেমে গেছে। বাইরে পাখির ডাক, হালকা বাতাস, আর আমার ভেতর নিঃশব্দ হলেও শান্ত।
আমি শুরু করলাম নিজেকে আবার চিনে নেওয়া।
যে কাজগুলো একসময় সময়ের অভাবে করতাম না, এখন সেগুলোতেই শান্তি পাই। সকালে হাঁটতে বেরোই, রাস্তার চায়ের দোকানে বসে চুপচাপ চা খাই। কেউ নেই পাশে, তবু আর খালি লাগে না।
একদিন পুরনো বইয়ের দোকানে গিয়ে একটা উপন্যাস হাতে নিলাম। ভাবলাম কতদিন পর নিজের জন্য কিছু কিনছি!
আগে সবকিছুতে ছিল আমরা, এখন কেবল আমি। আশ্চর্যভাবে এই আমি শব্দটা আর ভয় লাগায় না।
বন্ধুরা বলে, তুই অনেক বদলে গেছিস।
হয়তো সত্যিই বদলে গেছি। কারণ ব্যথা যেমন ভেঙে দেয়, তেমনি গড়ে তোলে। আমি শিখেছি সব সম্পর্ক টিকে না, কিন্তু প্রতিটি সম্পর্ক কিছু না কিছু শিক্ষা দেয়।
সন্ধ্যাবেলায় ছাদে বসে গিটার বাজাই। কোনো নির্দিষ্ট সুর নেই, কিন্তু তাতে আছে মুক্তির গন্ধ। ওর কথা আসে মনে, তবে কষ্ট দেয় না আর। মনে হয়, ও যেন পুরনো কোনো গান যেটা একসময় কাঁদাত, এখন শুধু হাসায়।
ধীরে ধীরে জীবন রঙ ফিরে পেল। মন, চিন্তা, ইচ্ছে সব কিছুই নতুনভাবে সাজিয়ে নিলাম।
শিখলাম ভালোবাসা মানে শুধু কাউকে পাওয়া নয়; নিজেকেও ভালোবাসা শেখা।
যে আমি একসময় ও ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারতাম না, আজ সেই আমি নিজের আলোয় বাঁচতে শিখেছি।
একা পথেও এখন ভয় নেই। বরং আনন্দ আছে নিজের সঙ্গ পাওয়ার আনন্দ।
রাত পেরিয়ে ভোর আসে। জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে নতুন দিনের আলো। মনে হয়, এই আলোটা শুধু ঘরে নয়, আমার ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ছে।
আয়নায় তাকিয়ে দেখি চোখের নিচে ক্লান্তি আছে, কিন্তু চোখে দীপ্তি। বহুদিনের অন্ধকার শেষে যেন আলোর দেখা পেয়েছি।
একসময় ভাবতাম, ও ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আজ জানি, অসম্পূর্ণতা কোনো মানুষে নয়; পূর্ণতা আসে নিজের সাহসে।
আজ সকালে কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানালার পাশে। রোদটা ঠিক আগের মতোই, কিন্তু অনুভূতিটা একেবারে নতুন।
আর সেই পথটা, যেটা একসময় আমাদের ছিল, এখন শুধুই আমার।
আমি হাঁটছি ধীরে, কিন্তু আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। রাস্তার ধারে ফুল ফুটেছে, বাতাসে গাছের পাতা নড়ে। আমি বুঝতে পারি জীবন সত্যিই সুন্দর, যদি আমরা থেমে না যাই।
একদিন ওর পাঠানো পুরনো গানটা বাজল হঠাৎ। বুকের ভেতর ব্যথা লাগল না, বরং হালকা হাসি এল ঠোঁটে।
কারণ এখন জানি ওর সঙ্গে কাটানো সময়গুলো হারানো নয়, শেখা।
আমি ফোন তুলে পুরনো ছবিগুলো মুছে ফেললাম। ঘৃণা থেকে নয় মুক্তির জন্য।
এটা কোনো প্রতিশোধ নয়; এটা শান্তি।
আজ আমি জানি, ভালোবাসা শেষ হলেও জীবন থেমে যায় না।
যে মানুষ একদিন আমার সুখের কারণ ছিল, আজ সে-ই আমার শক্তির কারণ।
আমি এখন একা, কিন্তু একা মানেই একা নই। আমার সঙ্গে আছে আমার সাহস, আমার অভিজ্ঞতা, আমার ভেতরের আলো।
সন্ধ্যায় ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখি। তারাগুলো একে একে জ্বলে ওঠে।
মনে মনে বলি
পথে তো একাই ছিলাম, তুই শুধু কিছুদূর সঙ্গে ছিলি।
আর সেই দূরত্বের পরেই শুরু হলো আমার নিজের যাত্রা
এক নতুন ভোরের, নতুন জীবনের,
যেখানে আমি হারিয়ে যাইনি,
বরং নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।
