প্রতিদান
প্রতিদান
রোদেলা দুপুর, ঢাকার এক ছোট্ট ব্যস্ত গলির ভিতর আরিয়ান হাঁটছে নিঃশব্দে। চারপাশে গাড়ির হর্ন, মানুষের চিৎকার, দোকানদারদের হাঁকডাক—কিন্তু সে যেন এসবের কিছুই শুনছে না। মাথার ভেতর একটা কণ্ঠ বারবার বলে যাচ্ছে—"সে আর আমার নয়..."
আরিয়ানের জীবনের গল্পটা সাধারণ হলেও তার ভালোবাসা ছিল অসাধারণ। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার, কিন্তু সেই স্বপ্নের রঙ লাল-নীল হয়নি—ছিল মেহুল নামের একটি মেয়ের চোখের গভীরতা।
মেহুল—তার ছোটবেলার বন্ধু, স্কুলের প্রথম বেঞ্চে বসা সেই মেয়ে, যার একটুখানি হাসি দেখার জন্য আরিয়ান দিনের পর দিন টিফিন না খেয়ে কাটিয়ে দিত। তারা একসাথে বড় হয়েছে, একসাথে স্বপ্ন দেখেছে, কিন্তু মেহুল কখনো বুঝতেই পারেনি, এই নীরব ছেলেটি কতটা গভীরভাবে তাকে ভালোবাসে।
আরিয়ান কখনো সরাসরি বলেনি কিছু। ভেবেছে, সময় হলে সে বুঝবে, তার সমস্ত ‘চেষ্টা’, ‘ত্যাগ’ একদিন হয়তো মেহুলের হৃদয়ে পৌঁছে যাবে।
কিন্তু সময় তো সবসময় মন চায় না।
কলেজ জীবন শুরু হলো, আরিয়ানের চোখে তখন একটাই লক্ষ্য—নিজেকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যেন সে মেহুলকে গর্বিত করতে পারে। সে জানে, তার পরিবার সীমিত সামর্থ্য নিয়ে বাঁচে, কিন্তু নিজের শ্রমে, মেধায়, আর কিছুটা ভাগ্যে সে অনেক দূর যেতে পারে—তবে সবকিছুর পেছনে একটি নিঃশব্দ অনুপ্রেরণা, মেহুল।
মেহুল ছিল সুন্দরী, আত্মবিশ্বাসী, স্বপ্নবাজ এক মেয়ে। সে নিজেও উচ্চশিক্ষা নিতে চায়, ক্যারিয়ার গড়তে চায়। আরিয়ান চুপচাপ দেখত, মেহুল কী চায়, কী নিয়ে চিন্তা করে। তার পাশে না থেকেও, সবসময় পাশে থাকার চেষ্টা করত।
একবার মেহুলের বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসার খরচ উঠবে না, মেহুল ভেঙে পড়েছিল। আরিয়ান কিছু না বলে নিজের জমা রাখা স্কলারশিপের টাকা দিয়ে দিল। নিজের পড়াশোনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হলেও সে পিছপা হয়নি। মেহুল জানতে পারেনি কিছুই।
কিছুদিন পর, কলেজে তাদের পুনর্মিলন হলো এক পুরনো বন্ধুদের আড্ডায়।
— "আরিয়ান, তুমি কি সত্যিই এখন এক কোম্পানির ইন্টার্ন হয়েছো?"
— "হ্যাঁ, সামান্য কাজ… শেখার চেষ্টা করছি।"
— "তুমি সবসময় এত নিঃশব্দ কেন? কারো জন্য কিছু করো, কাউকে কিছু বোঝাও না?"
আরিয়ান শুধু হাসে। মেহুল হয়তো বোঝে না, তার প্রতিটি উত্তরের পেছনে কতটা ভালোবাসা জমে থাকে।
একদিন, মেহুল জানাল সে বিদেশে পড়তে যেতে চায়।
আরিয়ান রাতভর জেগে ইন্টারনেট ঘেঁটে তার জন্য ইউনিভার্সিটি খুঁজে দিল, SOP লিখে দিল, এমনকি প্রয়োজনীয় ফান্ড খুঁজে বের করে মেহুলকে সাহস জোগাল।
তাকে একবারও বলেনি—
"তুই গেলে আমি একা হয়ে যাব। তুই আমার সব।"
মেহুল গেল। আরিয়ান তাকে হাসিমুখেই বিদায় দিল।
কিন্তু সেই রাতে, ছাদে বসে থাকা আরিয়ান শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল—
"তুই যেন ফিরে এসে আমায় চিনিস…"
দুই বছর পর…
বিমানবন্দরে একটা গাড়ি এসে থামে। মেহুল ফিরেছে বিদেশ থেকে, ডিগ্রি শেষ করে। চোখে মুখে সাফল্যের ছাপ, কথাবার্তায় পরিণত ভাব।
আরিয়ান খবর পেয়েছে আগেই, কিন্তু দেখা করতে যায়নি। শুধু দূর থেকে একবার দেখতে চেয়েছিল—তাকে নিয়ে গড়া সেই স্বপ্ন কতটা বদলেছে।
মেহুল নিজেই ফোন করল,
— "আরিয়ান, দেখা করবি না?"
— "হ্যাঁ... কোথায়?"
— "পুরনো কফিশপে।"
সেদিনের সেই কফিশপ। জানালার পাশে বসা মেহুল, হাতে কফি কাপ। আরিয়ান ধীরে ধীরে এসে বসল।
— "তুই একদম বদলাইনি।"
— "তুই অনেক বদলে গেছিস। চোখে অনেক আত্মবিশ্বাস…"
— "আত্মবিশ্বাস নয় আরিয়ান, বাস্তবতা। জীবন অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে।"
— "আমি জানি।"
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর হঠাৎ মেহুল বলল,
— "আমি বাগদত্ত। শুভ নামে একজনের সঙ্গে। সে বিদেশেই কাজ করে, খুব ভালো মানুষ। সিকিউর, সাপোর্টিভ…"
আরিয়ান হাসল, ঠোঁটের কোণে একটুখানি কাঁপন।
সে শুধু বলল,
— "তুই সুখী থাকিস।"
মেহুল বলল না, শুভর কথা সে কখনো আগে বলেনি আরিয়ানকে। কারণ হয়তো সে জানত—কেউ তাকে চুপচাপ ভালোবাসে, নিঃস্বার্থভাবে, প্রমাণ চায় না, প্রতিদান চায় না।
কিন্তু জীবন কি সবসময় এই ভালোবাসার মূল্য দেয়?
সেদিন কফিশপ থেকে বেরিয়ে মেহুল একবার পিছনে তাকায়, দেখে আরিয়ান দাঁড়িয়ে নেই।
সে বুঝে যায়, কিছু মানুষ জীবন থেকে চলে যায়—অভিমান করে নয়, ভালোবেসে।
বিয়ের পর মেহুল চলে যায় বিদেশে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে শুভ আর মেহুলের ছবি—সফল, সুখী, নির্ভার জীবন।
আরিয়ান এসব দেখে না। দেখার চেষ্টাও করে না।
সে নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে—চাকরি, পরিবার, দায়িত্ব।
তবে মনে কোথাও একটা শূন্যতা, যা আর ভরাতে পারে না কেউ।
তিন বছর পর...
একদিন হঠাৎ একটি ফোন আসে।
— "আরিয়ান... চিনতে পারছিস?"
— "মেহুল?"
— "হ্যাঁ। দেশে এসেছি। একটু দেখা করবি?"
আরিয়ান চমকে যায়। সময়, পরিস্থিতি—সব বদলে গেছে। তবু সে রাজি হয়।
এক সন্ধ্যায় তারা আবার দেখা করে। এবার আর কফিশপ নয়, এক শান্ত পার্কের বেঞ্চে।
মেহুল কেমন নিঃশব্দ, চোখে কালি, মুখে ক্লান্তির ছাপ।
— "তুই কেমন আছিস?"
— "ভালো। তুই?"
— "তুই জানিস, শুভ আর আমি এখন আলাদা থাকি। ছয় মাস হলো..."
— "...আমি দুঃখিত।"
মেহুল হঠাৎ বলল,
— "আমি অনেক খুঁজেছি তোর মত কাউকে। যে বিনা শর্তে ভালোবাসবে, যে নিজের কিছু না চেয়ে শুধু আমাকে দেবে। শুভ ভালো মানুষ, কিন্তু আমার কাছে সবসময় হিসেব ছিল। আর তুই ছিলি নিঃস্বার্থ। আমি কখনো বুঝিনি।"
আরিয়ান চুপ করে ছিল।
— "আরিয়ান, আমি কি তোর জীবনে খুব দেরিতে ফিরলাম?"
আরিয়ান মাথা নিচু করে বলল,
— "তুই দেরি করিসনি। তুই এসেছিস ঠিক সময়েই... নিজেকে চিনে ফেলার সময়।"
মেহুল কিছু বলছিল না।
আরিয়ান এবার তাকাল তার চোখে, তারপর বলল,
— "তোর জন্য আমি অনেক কিছু করেছি মেহুল। শুধু তোকে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুই আমার ছিলি না—এটাই আমার প্রতিদান।"
তারপর সে উঠে দাঁড়ায়।
মেহুল চেয়ে থাকে, চোখে জল।
আরিয়ান ধীরে ধীরে চলে যায়—শান্ত, স্থির, নীরব।
একটা ভালোবাসা শেষ হয় না, কিন্তু তার প্রতিদান হয়ত কখনো আসে না।
শেষ
"প্রতিদান" শুধু এক নিঃশব্দ প্রেমের গল্প নয়, এটি এক আত্মত্যাগী হৃদয়ের জ্বলন্ত প্রমাণ, যে ভালোবাসে বলেই দাবি করে না কিছু, আর হেরে গিয়েও জিতে যায়—কারণ সে ভালোবেসেছিল নিখাদ ভাবে।
#Mohioshi_mayabi.
