STORYMIRROR

Ornate Blaise Pereira

Romance Classics Fantasy

4  

Ornate Blaise Pereira

Romance Classics Fantasy

বৃষ্টিভেজা স্মৃতির জানালা

বৃষ্টিভেজা স্মৃতির জানালা

18 mins
19

সালটা ২০৫০।

শহরটা যেন এক অচেনা আয়না। চারদিকে কাঁচের গগনচুম্বী অট্টালিকা, আকাশ ছুঁতে চাওয়া বিজ্ঞাপনের আলো, আর উড়ন্ত যানবাহনের গুঞ্জন। কখনো মনে হয় আমি স্বপ্নে আছি, আবার কখনো মনে হয়—এই স্বপ্নই আমাদের নির্মম বাস্তব।

তবুও, প্রকৃতি তার পুরোনো ছন্দে অটুট আছে।
সেই দিনটায় প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশে মেঘ জমে একেবারে কালো পর্দা টেনে দিয়েছে, আর তার ভেতর দিয়ে বিদ্যুতের রেখা ছুটে যাচ্ছে মুহূর্তে। টুপটাপ ফোঁটার শব্দ যেন পৃথিবীর এক অদৃশ্য সঙ্গীত।

আমি দাঁড়িয়ে আছি আমাদের ফ্ল্যাটের বারান্দায়।
শহরের উচ্চতায় আমরা থাকি এখন, চৌত্রিশ তলা ভবনের এক কোণে। নিচে তাকালে ছোট ছোট গাড়ি, মানুষ আর ছাতার নীল সমুদ্র। কিন্তু এত উচ্চতাতেও বৃষ্টি একইরকম—কাঁচে ধাক্কা খেয়ে টুপটাপ শব্দ তোলে, বারান্দার রেলিং ভিজিয়ে দেয়, আমার চোখে কুয়াশার মতো ঝাপসা আঁকে।

বৃষ্টির ভেতর দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হচ্ছিল—সময় এখানে থেমে গেছে। আমি যেন ২৫ বছর আগের সেই একই দৃশ্য দেখছি।

ঠিক তখনই তুমি ভেতর থেকে এলে।

হাতে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা।
তুমি সবসময়ই এভাবেই আসো—একটা ছোট্ট হাসি নিয়ে। চুলে সাদা রেখা পড়েছে, চোখে সময়ের রেখা, কিন্তু সেই হাসি আজও প্রথম দিনের মতোই। তুমি কাপটা আমার হাতে দিয়ে মৃদু স্বরে বললে,

— “আজ থেকে ঠিক ২৫ বছর আগে তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। আশ্চর্য, তুমি তখন যেমন অদ্ভুত ছিলে, আজও ঠিক তেমনই আছো।”

তোমার কথায় আমি চমকে উঠলাম।
বৃষ্টির শব্দ, চায়ের ধোঁয়া আর তোমার কণ্ঠ একসাথে মিশে যেন আমাকে টেনে নিয়ে গেল সেই প্রথম দিনের দিকে।

আমার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল সেই দৃশ্য—কলেজের সিঁড়ি, ভিজে থাকা ডায়েরি, আর তুমি ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছো।

আমি হাসলাম, চায়ের ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে বললাম—
— “তুমি কি জানো, এই বৃষ্টি শুধু আমাদের জন্যই নামে?”

তুমি হেসে উত্তর দিলে—
— “তুমি কি এখনো একইভাবে পৃথিবীর প্রতিটা জিনিসকে কবিতা ভাবো?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম—
— “হয়তো এটাই আমার অদ্ভুতত্ব। কিন্তু তুমি না থাকলে এই কবিতা কখনোই সম্পূর্ণ হতো না।”

তুমি চুপ করে আমার দিকে তাকালে। চোখে এক ধরনের শান্ত বিস্ময়। বাইরে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠলো, আর আমাদের বারান্দা ভিজিয়ে দিল হাওয়ার ছিটেফোঁটা।

আমি ভেতরে ভেতরে ভাবলাম—
সত্যিই, সময় এগোয়, মানুষ বদলায়, পৃথিবীও পাল্টে যায়, কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্তের অনুভূতি কখনো বদলায় না।

সালটা তখন ২০২৫।
বর্ষাকাল।

সকাল থেকেই আকাশটা ছিল মেঘলা। শহরের রাস্তাগুলো ভিজে চকচক করছে, গাছের পাতায় জমে আছে ঝুলন্ত ফোঁটা। কলেজের বড় গেটের ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো—পৃথিবী যেন সবুজ পর্দায় মোড়ানো। বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ ছন্দে পড়ছে ছাদের টিনে, পুকুরের জলে ছড়িয়ে দিচ্ছে গোল গোল ঢেউ।

ক্যাম্পাসটা তখন প্রাণবন্ত হলেও আজ অদ্ভুতভাবে নীরব। বৃষ্টির কারণে সবাই দৌড়ে ক্লাসরুমে ঢুকে পড়েছিল। করিডোরগুলো ফাঁকা, মাঝে মাঝে কেবল বুটজুতো ভিজে চপচপ শব্দ তুলে কারো ছুটে যাওয়া।

আমি তখন একা।
সিঁড়ির ধাপে বসে আছি। শরীর ভিজে গেছে, জামা-কাপড়ে জল জমে আছে, কিন্তু আমার কোনো তাড়া নেই। হাতে ধরা ছোট্ট কালো ডায়েরি। পাতাগুলো ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠছে, আর আমি তাতে আঁকিবুকি করছি অদ্ভুত সব লাইন—

“বৃষ্টি মানেই মনে হয়, আকাশ তার সমস্ত গোপন কথা মাটিকে বলছে।
আর আমি সেই গল্প শুনতে চাই, যতবার ভিজি ততবার নতুন করে লিখি।”

হঠাৎ মাথার ওপরে একটা ছায়া নামল।

আমি চোখ তুলে তাকালাম। তুমি দাঁড়িয়ে আছো। হাতে লাল রঙের ছাতা। মুখে একরকম বিস্ময়ের রেখা। সেদিন তোমার চেহারায় ছিল ভেজা চুলের ঘ্রাণ, চোখে অচেনা কৌতূহল।

তুমি বললে—
— “এইভাবে ভিজে বসে আছো কেন? অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

আমি হাসলাম।
— “আমি বৃষ্টি ভালোবাসি। ভিজলে মনে হয় আমি আকাশের কাছাকাছি আছি।”

তুমি ভ্রু কুঁচকে তাকালে।
— “ভালোবাসা মানে কি জলে ডুবে থাকা? অন্তত ছাতার নিচে দাঁড়াতে পারতে।”

আমি ডায়েরি বন্ধ করে উত্তর দিলাম,
— “ভিজে অসুস্থ হলে কবিতা বাড়বে। অসুখ আমার জন্য শাস্তি নয়, বরং উপহার।”

তুমি এক মুহূর্ত চুপ করে রইলে। তারপর মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বললে—
— “তুমি সত্যিই অদ্ভুত।”

সেই প্রথম আমি তোমার মুখে “অদ্ভুত” শব্দটা শুনলাম। আর অদ্ভুতই থেকে গেল আমার পরিচয়।


বৃষ্টি তখনও থেমে যায়নি।
ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে তুমি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকালে। তারপর ধীরে ধীরে ছাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিলে, যেন আমাকে ভিজে থাকা পৃথিবী থেকে একটু হলেও আড়াল করতে চাইছো।

আমি না করলেও তুমি বললে,
— “জানো, সবসময় বৃষ্টি হয় না। কিন্তু ভিজে গেলে শরীর ভেঙে যায়। কবিতার জন্য শরীর হারানো উচিত নয়।”

সেই মুহূর্তে তোমার চোখে আমি এক অদ্ভুত মায়া দেখেছিলাম। মনে হলো, বৃষ্টির ভেতর থেকেও কেউ আমাকে প্রথমবার সত্যিই গুরুত্ব দিল।


করিডোরে তখনো টুপটাপ শব্দ, জানালা বেয়ে নামছে ফোঁটা। কলেজের মাঠ ভিজে কাদায় ভরা, ছাত্রছাত্রীরা দূরে দূরে ছুটে যাচ্ছে ক্লাসে। অথচ আমি আর তুমি দাঁড়িয়ে আছি সেই সিঁড়ির ধাপে, যেন সময় থমকে গেছে।

আমার ভেতরে কেমন যেন আলোড়ন উঠল। ডায়েরির ভিজে যাওয়া পাতার ভেতর এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো—
আমাদের প্রথম পরিচয়।

প্রথম দিনের সেই সিঁড়ির ঘটনার পর থেকে তুমি আর আমি যেন অদৃশ্য এক সেতুতে বাঁধা পড়ে গেলাম।

ক্যাম্পাসের প্রতিটা কোণ ধীরে ধীরে আমাদের গল্পের অংশ হয়ে উঠতে লাগল। লাইব্রেরির ধুলো ধরা বই, ক্যাফেটেরিয়ার কোলাহল, মাঠের সবুজ ঘাস—সবই যেন আমাদের বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে উঠল।

একদিন বৃষ্টিহীন দুপুরে আমরা কলেজের ক্যাফেটেরিয়ার কোণে বসেছিলাম। চারদিকে কোলাহল, টেবিলে প্লাস্টিকের গ্লাসে চা, আর হাওয়ায় ভেসে আসা সিঙ্গাড়ার গন্ধ।

তুমি তখন আমার ডায়েরি হাতে নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছিলে। চোখে ছিল এক অদ্ভুত কৌতূহল।
— “তুমি প্রতিদিন লেখো?”

আমি হেসে উত্তর দিলাম,
— “প্রতিদিন না লিখলে মনে হয় আমি বেঁচে নেই।”

তুমি মাথা নেড়ে বললে,
— “অদ্ভুত তো বটেই। তবে মন্দ লাগছে না। তোমার লেখা পড়লে মনে হয়, পৃথিবীকে অন্যভাবে দেখা যায়।”

আমি চোখ তুলে তোমার দিকে তাকালাম। কাঁচের জানালার ওপাশে সূর্যের আলো তখন তোমার চুলে পড়ে সোনালি আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। মনে হলো—আমার লেখা যতই কবিতার মতো হোক, তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর লাইনটা তুমি নিজেই।

কিছুদিন পর আমরা প্রায়ই একসাথে লাইব্রেরিতে যাওয়া শুরু করলাম। বিশাল কাঠের টেবিলে বসে থাকতাম, তুমি পড়তে সংখ্যাতত্ত্বের বই, আমি পড়তাম কবিতার সংকলন।

মাঝেমধ্যে নীরবতার ভেতর তুমি হঠাৎ ফিসফিস করে বলতে—
— “তুমি কখনো সিরিয়াস হবে? ভবিষ্যতের কথা ভাবো।”

আমি মুচকি হেসে বলতাম,
— “আমার ভবিষ্যৎ মানে তোমার সাথে প্রতিদিনের কথোপকথন।”

তুমি বিরক্ত হওয়ার ভান করে বইয়ের পাতা উল্টাতে, কিন্তু আমি দেখতাম, তোমার ঠোঁটের কোণে অল্প হাসি লুকিয়ে আছে।

কলেজের মাঠে এক বিকেলে আমরা অনেকক্ষণ হাঁটছিলাম। চারপাশে কাদায় ভেজা ঘাস, আকাশে ভাসছে সাদা তুলোর মতো মেঘ।

তুমি হঠাৎ থেমে বললে,
— “জানো, তুমি অন্যদের মতো নও। সবাই যেখানে চাকরি, ক্যারিয়ার, প্রতিযোগিতা নিয়ে কথা বলে, তুমি সেখানে কবিতার মধ্যে বাঁচো। আমি ভয় পাই, তুমি এই পৃথিবীর সাথে মানিয়ে চলতে পারবে তো?”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম,
— “হয়তো আমি পৃথিবীর সাথে মানাতে পারব না। কিন্তু যদি তুমি থাকো, আমি পৃথিবীকে নতুন করে বানাতে পারব।”

তুমি চুপ করে আমার দিকে তাকালে। হাওয়ার ঝাপটায় তোমার চুল মুখে এসে পড়ল, তুমি হাত সরিয়ে নিলে। সেই মুহূর্তে আমাদের মাঝে এক অদৃশ্য চুক্তি হলো—বন্ধুত্বের চুক্তি।

আমরা তখনো একে অপরকে ‘বন্ধু’ বলেই জানতাম। কিন্তু সেই বন্ধুত্বের ভেতরে যে অদৃশ্য আলো জ্বলতে শুরু করেছে, সেটা দুজনেরই বোঝা শুরু হয়েছিল।

তুমি আমার ডায়েরিতে একটা লাইন লিখে দিয়েছিলে—
“কবিতা শুধু শব্দ নয়, কবিতা হলো মানুষকে অনুভব করার আরেকটি নাম।”

আমি ডায়েরির পাতায় সেই লেখাটা ঘিরে রেখেছিলাম লাল কালি দিয়ে। মনে হয়েছিল, আমার কবিতার ভেতর নতুন রঙ ঢুকে পড়েছে—যা আগে কখনো ছিল না।

কিছুদিন পর আবার বৃষ্টি নামল। ক্লাস শেষে আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। তুমি বললে—
— “এখনো কি ভিজতে ইচ্ছে করছে?”

আমি হেসে উত্তর দিলাম,
— “হ্যাঁ। তবে এবার একা না, তোমাকে নিয়েই।”

তুমি হাসলে, বললে,
— “তুমি একদিন সত্যিই আমাকে পাগল করে দেবে।”

আমরা একসাথে দাঁড়িয়ে ভিজে গিয়েছিলাম সেই দিন। আর আমি বুঝেছিলাম—আমাদের বন্ধুত্বের বীজ মাটির নিচে গজাতে শুরু করেছে, একদিন সে হয়তো বিশাল বৃক্ষে পরিণত হবে।

বারান্দার ছাদের নিচে সেই রাতের নীলাভ আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। আকাশে মেঘের খণ্ড খণ্ড ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে, আর দূরে কোনো অচেনা বেহালার সুর ভেসে আসছে যেন। এই সময়টা এক অদ্ভুত মোহ তৈরি করেছিল।

রিয়া জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কাঁচের ওপাশে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল, আর প্রতিটি ফোঁটা আলোয় ঝিকমিক করে উঠছিল যেন ছোট্ট কোনো হীরার মতো। রাহুল পাশেই বসে ছিল, চায়ের কাপ হাতে। ওরা দু’জন এখন বেশ ঘনিষ্ঠ—কিন্তু “ঘনিষ্ঠ” মানেই যে নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ, তা নয়।

— “তুমি এত চুপচাপ কেন রাহুল?” — রিয়া ধীরে ধীরে প্রশ্ন করল।
রাহুল প্রথমে কোনো উত্তর দিল না। শুধু কাপটা ঠোঁটে তুলল। তারপর বলল,
— “চুপ থাকা কি অপরাধ? সবসময় কি বলতে হয়?”

রিয়ার ভুরু কুঁচকে গেল।
— “তুমি জানো, আমি তোমার মধ্যে অনেক কথা খুঁজে পাই। যখন তুমি চুপ করে থাকো, মনে হয় তুমি আমাকে আড়াল করছো।”

রাহুল এক মুহূর্ত স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। বারান্দার বৃষ্টিভেজা বাতাস এসে ওর মুখে লাগছিল।
— “রিয়া, আমি আড়াল করছি না। আমি ভয় পাই।”

— “ভয়?” — রিয়া অবাক।
— “হ্যাঁ, ভয়। আমি জানি না আমাদের বন্ধুত্বটা কোনদিকে যাবে। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো, কিন্তু আমি ভয় পাই হয়তো তোমার জীবনের কোনো বাঁকে আমি জায়গা পাব না।”

রিয়ার চোখে একফোঁটা অশ্রু এসে ঝিকমিক করল।
— “তুমি কি মনে করো, আমি তোমাকে কেবল অচেনা একজন ভেবে রেখেছি? তুমি আমার জীবন, রাহুল। কিন্তু তুমিই যদি আমাকে দূরে সরিয়ে দাও, আমি কীভাবে বাঁচব?”

তাদের কথোপকথনের মাঝেই হঠাৎ একটা বিদ্যুতের ঝলকানি চারদিক আলোকিত করে দিল। বৃষ্টির শব্দ যেন আরো জোরে বাজতে লাগল। রিয়া হঠাৎ হাত বাড়িয়ে রাহুলের হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলল।

একটা দীর্ঘ নীরবতা। শুধু বৃষ্টির স্রোত, ঝিরঝিরে বাতাস আর হৃদয়ের অস্থির ধুকপুকানি।

রাহুলের গলা ভারী হয়ে এলো।
— “আমি তোমাকে হারাতে চাই না, রিয়া। কিন্তু জানি, সময় কখনো কখনো সবকিছু কেড়ে নেয়। আজ যে সহজ, কাল সেটা হয়তো দুর্লভ হয়ে যাবে।”

রিয়া চোখ মুছে তাকাল তার দিকে।
— “তাহলে তুমি চাও আমরা আলাদা হয়ে যাই?”

— “না! আমি চাই আমরা থাকি। কিন্তু আমি চাই না আমার অস্থিরতা তোমাকে কষ্ট দিক।”

এই কথাগুলো যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিল তাদের মাঝে। সম্পর্কের বাঁকে দাঁড়িয়ে তারা দু’জনই একে অপরকে চাইছিল, আবার ভয় পাচ্ছিল।

রাতটা কাটল না। ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গিয়েছিল। বৃষ্টির শব্দও তখন তাদের হৃদয়ের কথার মতো ভারী লাগছিল।

একটা মুহূর্তে রিয়া দাঁড়িয়ে বারান্দায় চলে গেল। চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল—কোনো উত্তর আছে কি সেখানে? আকাশ তখন কেবল কালো মেঘে ঢাকা। কিন্তু রিয়ার মনে হচ্ছিল, এ মেঘের নিচেই হয়তো তাদের ভবিষ্যৎ লুকানো আছে।

সে ঘুরে রাহুলকে বলল,
— “যদি বাঁক থাকে, আমরা একসাথে হাঁটব। তুমি কি প্রতিশ্রুতি দেবে?”

রাহুল ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
— “প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। যত বাঁকই আসুক, তোমার হাত ছাড়ব না।”

আর সেই মুহূর্তে বৃষ্টি যেন হালকা হয়ে এলো। যেন আকাশও সাক্ষী হয়ে গেল তাদের প্রতিশ্রুতির।

সকালবেলার হাওয়ায় হালকা ঠান্ডা। রিয়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, কুয়াশা ঢাকা শহরের দৃশ্য যেন একেবারে ঝাপসা আঁকা কোনো ছবি। সামনের রাস্তার দু’পাশে ভিজে পাতা পড়ে আছে, আর তাদের ভেতর দিয়ে ছুটে চলা বাস-রিকশার শব্দ যেন অদ্ভুত এক অস্থিরতা তৈরি করছে।

গত রাতের প্রতিশ্রুতি এখনও রিয়ার কানে বাজছে—“যত বাঁকই আসুক, তোমার হাত ছাড়ব না।” তবু কেন যেন আজ ভোরে ঘুম ভাঙতেই ওর বুকের ভেতর অচেনা শূন্যতা জমে উঠল।

রাহুল সেদিন সকালেই ফোন করেছিল।
— “রিয়া, আজ হয়তো দেখা হবে না। অফিসের কাজে বাইরে যেতে হবে।”
রিয়ার গলা শুকিয়ে গেল।
— “কোথায় যাচ্ছ?”
— “চট্টগ্রামে। হয়তো দু’সপ্তাহ।”
— “দু’সপ্তাহ?” — রিয়ার কণ্ঠে ক্ষীণ কষ্ট।
— “হ্যাঁ… কী করব বলো? কাজটা না করলে ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়ব।”

রিয়া কিছু বলল না। কেবল নীরবতা। ফোনের ওপাশ থেকে রাহুলের দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো।
— “রাগ কোরো না, রিয়া। ফিরে এসে সবকিছু পূর্ণ করব।”

ফোন কেটে গেলে ঘরটা যেন আরও ফাঁকা হয়ে গেল। বাইরে তখন ম্লান রোদ উঠেছে, কিন্তু রিয়ার মনে হলো অন্ধকার নেমে এসেছে।

দুপুরের ট্রেন। স্টেশন ভরা মানুষের ভিড়, চায়ের দোকানের ধোঁয়া, কাগজ বিক্রেতার হাঁক, আর ছুটে চলা মানুষের ব্যস্ততা। রিয়া এসেছিল তাকে বিদায় দিতে।

রাহুলের হাতে একটি ছোট ব্যাগ।
— “তুমি এসেছো? ভাবিনি।”
রিয়া ফ্যাকাশে হেসে বলল,
— “বিদায় না জানালে শান্তি পাব না।”

ট্রেনের বাঁশি বাজল। সময় ফুরোচ্ছে। রাহুল একটু এগিয়ে এসে রিয়ার হাতটা ধরল।
— “তুমি কি অপেক্ষা করবে?”
— “তুমি যদি সত্যিই ফিরে আসো, তবে আমি সারাজীবন অপেক্ষা করব।”

রাহুল কিছু বলল না, শুধু চোখে ভাসল গভীর আস্থা আর অদ্ভুত ভয়। ট্রেন ছাড়ল, আর ধোঁয়ার আবছা পর্দার আড়ালে হারিয়ে গেল রাহুল।

রিয়া স্থির দাঁড়িয়ে রইল। চোখের কোণে জমা জল চেপে রাখল, কিন্তু বুকের ভেতরটা যেন শূন্য হয়ে গেল।

পরের দিনগুলো যেন ধীরে ধীরে জমাট বাঁধা বরফ। রিয়া প্রতিদিন একই রুটিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে—অফিস, বাসা, বই, গান। তবুও রাহুলের অনুপস্থিতি প্রতিটি ক্ষণে তাকে আঘাত করছিল।

রাতে বৃষ্টির শব্দ শুনে রিয়ার মনে হতো—রাহুল কি এখন এই শব্দ শুনছে? কোনো হোটেল রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে? ওরও কি মনে পড়ছে সেই প্রতিশ্রুতির কথা?

একদিন চিঠি লিখতে বসল রিয়া—
"রাহুল, তুমি জানো, তোমার অনুপস্থিতি আমাকে ভেতর থেকে গিলে খাচ্ছে। তবু আমি বিশ্বাস করি তুমি ফিরে আসবে। সময় যতই দূরত্ব তৈরি করুক, আমাদের বন্ধন কি ভাঙতে পারবে?"

চিঠিটা লেখা শেষ হলেও পাঠানো হলো না। শুধু টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিল।

প্রথম সপ্তাহে রাহুল ফোন করত প্রায় প্রতিদিন।
কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহে ফোন আসতে দেরি হলো।
তৃতীয় সপ্তাহে একেবারেই আসা বন্ধ।

রিয়া নিজেকে বোঝাল—“হয়তো কাজের চাপ।”
কিন্তু বুকের ভেতর প্রশ্ন জমল—“কাজ এত বড় হতে পারে, যে ভালোবাসাকে হারিয়ে দেয়?”

রাতে রিয়া আকাশের দিকে তাকাল। তারা ঝিকমিক করছে, কিন্তু ওর চোখে কেবল মেঘ।
সেই মেঘ যেন কণ্ঠে জমে থাকা হাজারো অপ্রকাশিত কথার প্রতীক।

সন্ধ্যার শহরটা যেন আজ অদ্ভুত নীরব। কোলাহল আছে, যানবাহনের শব্দ আছে, দোকানপাটে মানুষের ভিড়ও আছে—তবু রিয়ার মনে হলো শহরটা নিঃশব্দ হয়ে গেছে।

রাহুলের ফোন আসছে না বহুদিন। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়ায় রিয়া, বৃষ্টি হোক বা শুকনো হাওয়া—তার কানে বাজতে থাকে সেই প্রতিশ্রুতি, “যত বাঁকই আসুক, তোমার হাত ছাড়ব না।” অথচ দিন দিন সেই হাতের স্পর্শ যেন আঙুল ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

একদিন অফিসের সহকর্মী মিতা এসে বলল,
— “শুনেছিস, রাহুল নাকি চট্টগ্রামে এক নতুন প্রজেক্টে কাজ করছে? ওখানে একটা মেয়ে নাকি ওর সঙ্গে সবসময় থাকে। খুব ঘনিষ্ঠ!”

রিয়ার বুক কেঁপে উঠল।
— “তুই এসব কোথায় শুনলি?”
— “আমার মামাতো ভাই ওই কোম্পানিতে কাজ করে। ওর মুখেই শুনলাম।”

কথাটা শুনে রিয়ার গলা শুকিয়ে গেল। মনে হলো বুকের ভেতর যেন তীব্র কোনো কাঁটা বিঁধল।

সেদিন রাতে ডায়েরিতে লিখল রিয়া—
"ভালোবাসার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রু কি দূরত্ব, নাকি ভুল বোঝাবুঝি? আমি জানি না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আমাদের মধ্যেকার সেই দেয়ালটা দ্রুত উঁচু হয়ে উঠছে।"

পরের দিন রিয়া সাহস করে ফোন করল।
অনেকক্ষণ রিং বাজল, তারপর রাহুল ধরল।
— “হ্যালো…” গলায় ক্লান্তি, অবসাদ।
— “তুমি এতদিন ফোন করলে না কেন, রাহুল?”
— “কাজের চাপ, রিয়া। তুমি বোঝো না।”
— “আমি বুঝি না? নাকি তুমি বোঝাতে চাও না?”

রাহুল চুপ।
রিয়ার কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো।
— “শুনেছি তুমি ওখানে কারও সঙ্গে সময় কাটাও…”

ওপাশে হঠাৎ নিস্তব্ধতা। তারপর রাহুল বলল,
— “তুমি কী বিশ্বাস করছো এসব?”
— “আমি জানি না। কিন্তু আমার বিশ্বাস যখন টলমল করছে, তখন তোমার নীরবতা কি প্রমাণ দিচ্ছে?”

রাহুল তীব্র গলায় বলল,
— “রিয়া, আমি ক্লান্ত। সবসময় জবাব দিতে পারব না।”

ফোন কেটে গেল।

রিয়া ফোনটা শক্ত করে ধরে বসে রইল অনেকক্ষণ। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু বুকের ভেতর জ্বালা থামল না।

এরপর দিনগুলোতে এক অদ্ভুত দূরত্ব নেমে এলো।
মাঝে মাঝে রাহুল ফোন করত, কিন্তু কথাগুলো হতো ছোট, শুষ্ক।
— “খেয়েছো?”
— “হ্যাঁ।”
— “ভালো আছো?”
— “হ্যাঁ।”

কোনো হাসি নেই, কোনো গল্প নেই, কোনো স্বপ্নের আঁচড় নেই।

রিয়া অনুভব করল—তাদের সম্পর্কের ভিতরে এক বিশাল দেয়াল দাঁড়িয়ে গেছে। ভালোবাসা আছে, কিন্তু পৌঁছনো যাচ্ছে না।

সেই রাতে প্রচণ্ড ঝড় এলো। জানালার কাঁচ ঝাঁকুনি খাচ্ছিল, গাছের ডাল ভেঙে পড়ছিল। রিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবল—“এই ঝড়ই কি আমাদের সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি? চারপাশে সবকিছু ভেঙে পড়ছে, অথচ আমি এখনও দাঁড়িয়ে আছি।”

সে নিজেকে প্রশ্ন করল,
"ভালোবাসা কি এতটাই ভঙ্গুর? নাকি মানুষের ভুল বোঝাবুঝিই তাকে ভেঙে দেয়?"

কোনো উত্তর পেল না। শুধু ঝড়ের গর্জনই যেন বলল—“তুমি একা নও, তবু একা।”

শীতের শেষভাগ। সকালবেলায় সূর্যের আলো যেন কুয়াশার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছিল। রিয়ার ঘর ভরে উঠেছিল সেই আলোয়, কিন্তু তার মনে এখনও ছিল অন্ধকার। গত কয়েক সপ্তাহের নীরবতা, ভুল বোঝাবুঝি, আর অচেনা দূরত্ব তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছিল।

তবু কোথাও একটা আশার স্ফুলিঙ্গ রয়ে গিয়েছিল।

সেদিন দুপুরে, রিয়া রান্নাঘরে ব্যস্ত। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেল।
চোখে বিস্ময় নিয়ে দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে রাহুল।

ধুলো-মলিন পোশাক, চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু সেই একই উষ্ণ দৃষ্টি।
রিয়ার চোখ ছলছল করে উঠল।
— “তুমি… হঠাৎ?”
রাহুল দুর্বল হাসি দিল।
— “চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে চমকে দিতে।”

কথাটা শেষ হতেই রিয়ার বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে এলো।
সে চিৎকার করে উঠল,
— “তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? একটুও কি মনে হয়নি আমি কেমন আছি?”

রাহুল নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
— “আমি জানি আমি ভুল করেছি। কাজের চাপের অজুহাতে তোমাকে অবহেলা করেছি। আমি জানতাম না তোমার ভেতর কতটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে।”

রিয়া রাগে-অভিমানে হাত ছেড়ে দিল।
— “তাহলে? আমার কষ্ট কি তোমার কাছে অমূল্যহীন ছিল?”
— “না, রিয়া। তোমার কষ্টই আমাকে ফিরিয়ে এনেছে। আমি যত দূরেই যাই, বুঝেছি তুমি ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”

রাহুল টেবিলের ওপর একটা ছোট বাক্স রাখল।
— “এটা তোমার জন্য এনেছি।”

রিয়া অবাক হয়ে বাক্স খুলল। ভেতরে একটা পুরোনো ডায়েরি—চামড়ার বাঁধানো।
— “এটা আমার মায়ের ডায়েরি। সবসময় বলতেন, সম্পর্কের যত বাঁকই আসুক, লেখা কথাগুলো সাক্ষী হয়ে থাকে। আমি চাই, তুমি আর আমি নতুন করে লিখি আমাদের গল্প।”

রিয়ার বুকটা কেঁপে উঠল।
সে ধীরে ধীরে রাহুলের চোখে তাকাল। সেখানে অনুশোচনা, ভালোবাসা আর প্রতিশ্রুতির আলো একসঙ্গে মিশে আছে।

— “তুমি কি সত্যিই বদলাতে পারবে, রাহুল? আর কোনো নীরবতা থাকবে না তো?”
রাহুল রিয়ার হাত ধরে বলল,
— “আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। ঝড় আসুক, দূরত্ব আসুক—আমি এবার লুকোব না।”

ঠিক তখনই বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। বারান্দার রেলিংয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝিকমিক করে উঠছিল।
রিয়া মনে মনে ভাবল—এই বৃষ্টি কি তবে নতুন শুরু?
মেঘের আড়াল থেকে যেমন আলো ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে, তেমনি কি তাদের সম্পর্কও আলোয় ফিরছে?

রাহুল বলল,
— “চলো, এক কাপ চা বানাও। তোমার হাতের চায়ের মতো আর কিছু নেই।”

রিয়া ভেতরে গিয়ে কেটলি বসাল।
চায়ের ধোঁয়া উঠতে থাকল, আর সেই ধোঁয়া যেন ধীরে ধীরে মুছে দিল দূরত্বের কুয়াশা।

চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়াল তারা দু’জন। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে, আকাশে সোনালি আলো ঝরে পড়ছে।
রাহুল ফিসফিস করে বলল,
— “রিয়া, আজ থেকে আমাদের গল্প নতুন করে শুরু হোক।”

রিয়া কোনো উত্তর দিল না। শুধু নীরবে মাথা রাখল রাহুলের কাঁধে।

তাদের নীরবতাই যেন সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি।

শীত কেটে গিয়েছে। ফাগুনের বাতাসে রঙের মেলা, গাছে গাছে কচি পাতা, শহরের রাস্তায় আলোর ঝলকানি। প্রকৃতিই যেন নতুন করে সাজতে বসেছে। রিয়ার মনেও একরকম নতুন সূর্যের আলো পড়ছে,

রাহুল ফিরে আসার পর থেকে প্রতিদিন রিয়ার সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করল।
পার্কের বেঞ্চে বসে ওরা পুরোনো দিনের মতো গল্প করে, রাস্তায় হেঁটে ফেরার সময় একসাথে আইসক্রিম খায়, আর সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে বৃষ্টির শব্দ শোনে।

রিয়া একদিন হেসে বলল,
— “তুমি তো এখন বদলে গেছো। আগের মতো নীরব নেই।”
রাহুল চায়ের কাপ হাতে বলল,
— “কারণ বুঝেছি, নীরবতা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র। সেটা আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়।”

রিয়ার মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মনে হলো—এই আলো যদি আবার নিভে যায়?

এক রাতে রাহুল হঠাৎ বলল,
— “রিয়া, আমি একটা কথা লুকিয়ে রেখেছিলাম।”
রিয়ার বুক কেঁপে উঠল।
— “কথা?”
— “চট্টগ্রামে সত্যিই একজন ছিল, অফিসের সহকর্মী। সে আমাকে সাহায্য করেছিল, আমি একা থাকতাম বলে ও অনেক যত্ন নিত। কিন্তু রিয়া, আমি কসম খাচ্ছি, আমার মনে কেবল তুমি ছিলে।”

রিয়ার চোখে জল এসে গেল।
— “তাহলে আমি যে শুনেছিলাম, সেটা সত্যিই ছিল?”
— “হ্যাঁ, কিন্তু তুমি যেমন ভেবেছিলে, তেমন নয়। আমি তোমাকে না জানিয়ে ভুল করেছি। সেই ভুলই আমাদের দূরত্ব বাড়িয়েছে।”

রিয়া দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
— “সত্যিই যদি আমাকে ভালোবাসো, তবে প্রতিটি সত্য আমার সঙ্গে ভাগ করে নেবে। অর্ধেক আলোতে বাঁচতে পারি না।”

রাহুল হাত ধরে বলল,
— “আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আর কখনো কিছু লুকোব না।”

সেই রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল। আলোয় ভিজে উঠেছিল ছাদ, গাছের পাতা আর রিয়ার মুখ।
রাহুল মনে মনে ভাবল—“যেমন এই পূর্ণিমা অন্ধকারকে মুছে দেয়, তেমনি আমিও রিয়ার হৃদয়ের সব অন্ধকার মুছে দিতে চাই।”

রিয়ার চোখে ভেসে উঠল অদ্ভুত শান্তি।
তবু সে জানে, সামনে এখনও অনেক পথ। বাঁক আছে, অজানা ঝড়ও আছে। কিন্তু আজ তারা দু’জনই প্রতিজ্ঞা করেছে—“অন্ধকার যতই আসুক, আলো একসাথে খুঁজে নেব।”

সন্ধ্যার আকাশ মেঘে ঢাকা, দূরে আলোর ঝলকানি। শহর যেন গভীর নিঃশব্দে ডুবে আছে।

রিয়া অফিস থেকে ফিরে এসে জানলার পাশে দাঁড়ায়। ফোনে রাহুলের কোনো খবর নেই। কয়েকদিনের নীরবতা তার মনকে কাঁপাচ্ছে। হঠাৎ মায়ের কণ্ঠ ভেসে আসে—
— “রিয়া, তোমার বাবা হাসপাতালে ভর্তি। রক্তচাপ বেড়ে গেছে। তুমি কি যেতে পারবে?”

রিয়ার বুক ভেঙে যায়। বাবা—যার কাছে ছোটবেলা থেকে সব আশা, সব ভালোবাসা—তার অবস্থা এত খারাপ। সে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে যায়।

হাসপাতালে রিয়া ভিজে গেছে, হাতে ছোট্ট ব্যাগ। রাহুল ফোন করলেও ধরছে না।
বেডের পাশে দাঁড়িয়ে বাবা ক্লান্ত মুখে তাকালেন—
— “বেটা, তুমি এলে ভালো লাগছে।”

রিয়ার চোখে জল, কিন্তু সে জোরে বলল—
— “বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি এখানে আছি।”

হাসপাতালের ঘরের বাইরে রাহুল ফোন করে।
— “রিয়া, আমি আসছি। কিন্তু ট্রেন বাতিল হয়ে গেছে। আজ আর আসতে পারব না।”
রিয়ার বুক ভেঙে যায়।
— “রাহুল… বাবা অসুস্থ। আমাকে দরকার।”
— “আমি জানি। আমি খুব দ্রুত চেষ্টা করছি।”

দূরত্ব, সময়, দায়িত্ব—সব একসঙ্গে তাদের উপর চাপ তৈরি করছে।

রিয়া যখন বাসায় ফিরে আসে, মায়ের সঙ্গে কথা হলো। মা বলল—
— “রিয়া, তুমি ওর সঙ্গে এত সময় ব্যয় করছো, কিন্তু ও কি তোমার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? সমাজও তো কথা বলবে।”

রিয়া হালকা কাঁপিয়ে বলল—
— “মা, আমি জানি। কিন্তু ভালোবাসা মানেই শুধু সমাজের কথা শোনা নয়। এটা প্রতিশ্রুতি, বিশ্বাস, বোঝাপড়া।”

মা অল্প হেসে বললেন—
— “তুমি ছোটবেলা থেকে সবসময় শক্ত, তবে এই ঝড়টা… বড়।”

রিয়ার মনে হলো, শুধু বাহ্যিক চাপই নয়—ভেতরের ভয়ও তাকে ভেঙে দিচ্ছে।

রাহুলের অফিসও চাপের মধ্যে। চট্টগ্রামের নতুন প্রজেক্ট, যেটা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে কাজের চাপ তাকে ফ্রস্ট্রেশন তৈরি করছে। সে চাইছে রিয়ার পাশে থাকুক, কিন্তু দূরত্ব, কাজ, দায়িত্ব—সব মিলিয়ে ওর মন ভেঙে যাচ্ছে।

ফোনে একদিন রাহুল বলল—
— “রিয়া, আমি চাই কিন্তু আর কিছু করতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমাদের ভালোবাসা পরীক্ষা নিচ্ছে।”
রিয়া উত্তরে বলল—
— “প্রেম মানেই কি সবসময় সহজ হবে? না, কখনো কখনো সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা নিয়েই বোঝা যায় সত্যি ভালোবাসা কতটা গভীর।”

এক বিকেলে বৃষ্টি পড়ছে। রিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে, চোখে অশ্রু। ফোন বাজল। রাহুল ফোনে কাঁপা কণ্ঠে বলল—
— “রিয়া, আমি এত দূরে থেকেও তোমাকে হারাতে চাই না। আমি জানি আমরা ঝড়ের মধ্যে আছি, কিন্তু আমি চাই প্রতিটি ঝড় কাটিয়ে আমরা একসাথে থাকি।”

রিয়া চোখ মুছে বলল—
— “আমিও চাই, রাহুল। তবে এই ঝড় আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছে। আমি ভয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারছি না, কিন্তু বিশ্বাস করব চেষ্টা করব।”

রাহুল দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বলল—
— “ঠিক আছে, আমরা একসাথে ঝড়ের মধ্যেও পথ খুঁজে বের করব। দূরত্ব, অসুস্থতা, সবই পার হব।”

বৃষ্টি ধীরে ধীরে থেমে গেছে। আকাশের মেঘের ফাঁকে সূর্যের আলো বের হচ্ছে।
রিয়ার মনে হলো—প্রতিটি ঝড়ের পরে আলো আসে। প্রতিটি পরীক্ষার পরে ভালোবাসা আরও শক্ত হয়।

রিয়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ভাবল,
"যে ঝড়ই আসুক, এই সম্পর্কের ভিত্তি এখন আরও দৃঢ়। আমরা পরীক্ষা দিয়েছি, এবার আলো খুঁজব একসাথে।"

২০৫০.......

বহু বছর পরও সেই পুরোনো বারান্দার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে রিয়া বৃষ্টির দিকে তাকাচ্ছে।
চোখে অজস্র স্মৃতি ভেসে উঠছে—ছোটবেলার ঝাপসা দুপুর, কলেজের সিঁড়ি, লাইব্রেরির নীরবতা, পার্কের ঘাসের গন্ধ, হাসপাতালের ঘর, দূরত্ব, ঝড়—সবই যেন একটি দীর্ঘ চলচ্চিত্র হয়ে তার জীবনের মধ্যে বাজছে।

আজও বাইরে বৃষ্টি নামছে। আকাশ গাঢ় মেঘে ঢাকা, বাতাসে কাঁচা মাটির গন্ধ। কিন্তু রিয়ার মনে অদ্ভুত শান্তি। কারণ সে জানে, আজ রাহুল আসবে।

রিয়া হাত দিয়ে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে, রেলিংয়ে ঝিকমিক করছে।
চায়ের কাপ হাতে তার জন্য কেউ এনেছে—

পিছন দিকে একটি পরিচিত ধাপের শব্দ।
চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই সে দেখতে পায় রাহুলকে। বয়সের ছাপ তার মুখে, চুলে কিছু সাদা রেখা, চোখে সেই উষ্ণতা।

রিয়া বিস্ময়ে বলল,
— “রাহুল… তুমি?”
রাহুল হেসে উত্তর দিল,
— “হ্যাঁ, রিয়া। আমি এসেছি। আজকে, ঠিক এই বৃষ্টিতে।”

রাহুল হাতে চায়ের কাপ ধরে এগিয়ে এলো।
— “এটা তোমার জন্য। যেমন প্রথমবার তুমি আমার জন্য চা এনেছিলে, আজও ঠিক তেমন।”

রিয়া চোখে অশ্রু ধরে বলল,
— “আজ থেকে ২৫ বছর আগে আমরা পরিচিত হয়েছিলাম। তুমি সেইদিন যেমন অদ্ভুত ছিলে, আজও ঠিক ‘তেমনই আছো।’”

রাহুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রিয়ার হাতটা ধরল।
— “আমাদের ভালোবাসা, রিয়া, সমস্ত বাঁক, দূরত্ব, ঝড়—সবই পরীক্ষা দিয়েছে। আর আজ আমরা একসাথে আছি।”

বৃষ্টির ফোঁটা তাদের মাথা ভিজাচ্ছে, বাতাসে ধুলো-মাটির গন্ধ মিশেছে। কিন্তু কেউ মনে করছে না কষ্ট, শুধু অনুভব করছে এক অদ্ভুত শান্তি।

দু’জন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন।
স্মৃতির লতা চারপাশে ছড়িয়ে আছে—কলেজের দিন, লাইব্রেরির ধুলো, হাসপাতালের অবস্থা, দূরত্বের ফোনকল, ঝড়ের রাত, প্রতিশ্রুতি, ফিরে আসার দিন। সব মিলেমিশে একটি চিরন্তন গল্প গড়ে দিয়েছে।

রিয়া ফিসফিস করে বলল,
— “আমরা আজও সেই একই রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে আছি, তবে এইবার হৃদয় শান্ত।”

রাহুল হেসে বলল,
— “আর কখনও দূরত্ব, ঝড় বা ভুল বোঝাবুঝি আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”

সেই বৃষ্টির ফোঁটা, বাতাসের কুয়াশা, বারান্দার কাঠের মৃদু শব্দ—সবই যেন তাদের ভালোবাসার সাক্ষী।
চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠে আসছে, ছাদে ভিজে থাকা পাতা ঝিকমিক করছে।

রিয়া হাত দিয়ে রাহুলের হাতে আঁকড়ে ধরল।
— “চলো, আজ থেকে নতুন করে শুরু করি। আমাদের বাকি জীবন, বৃষ্টি, স্মৃতি আর ভালোবাসায় ভরা।”

রাহুল চোখে জল ধরে বলল,
— “হ্যাঁ, রিয়া। আজকের বৃষ্টি আমাদের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে দিল। আমরা একসাথে থাকব—আজ, আগামীকাল, সবসময়।”

বৃষ্টি ধীরে ধীরে হালকা হয়ে এলো। আকাশে সূর্যের সোনালি রশ্মি ছড়িয়ে পড়ল।
রিয়া আর রাহুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে জানল—সব বাঁক, সব ঝড়, সব দুরত্ব তাদের ভালোবাসাকে শক্ত করেছে।

এবার সেই ভালোবাসা সময়ের কাছে অনন্ত হয়ে গেছে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance