অসমাপ্ত সমাপ্তি
অসমাপ্ত সমাপ্তি
শহরটা ছোট হলেও মানুষের কানে কানেই বড় বড় কথা ছড়ায়। এখানে কারো সম্পর্কে কিছু বললে তা মুহূর্তের মধ্যেই অলিগলির আড্ডা থেকে চায়ের দোকানে পৌঁছে যায়। শহরের মানুষ একদিকে সরল, অন্যদিকে গুজবের নেশায় মত্ত।
এই শহরেই বাস করত অরিন্দম। শান্ত, ভদ্র, নির্লিপ্ত এক তরুণ। বই পড়তে ভালোবাসত, মানুষের উপকার করত, কিন্তু নিজের জীবন নিয়ে খুব বেশি কিছু বলত না। চারপাশের মানুষের কাছে সে যেন ছিল একটু অন্যরকম।
তার জীবন বদলালো যখন অনন্যার সাথে পরিচয় হলো। অনন্যা হাসলেই মনে হতো চারপাশ আলোয় ভরে উঠছে। অথচ তার ভেতরে ছিল ভাঙনের ক্ষত। আগের সম্পর্কের আঁচ এখনও তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। অরিন্দম সেই সব জানত, তবুও সে ভালোবেসেছিল।
ভালোবাসার শুরুতে সবকিছু ছিল নির্মল চিঠি, ফোন, লুকিয়ে দেখা, অকারণ হাসি। কিন্তু খুব বেশি দিন তা টেকেনি। হঠাৎ করেই অনন্যার পুরোনো প্রেমিক শহরে ফিরে এলো। সেই পুরোনো সম্পর্কের ভাঙা টুকরোগুলো যেন আবার নতুন করে জ্বালিয়ে দিল আগুন।
অরিন্দম কখনও কিছু বলেনি, কোনো অভিযোগ তোলেনি। সে শুধু চেয়েছিল অনন্যা যেন ভালো থাকে। কিন্তু শহরের মানুষ কি তা মেনে নেয়?
একদিন থেকে গুজব শুরু হলো
“ওই ছেলেটা নাকি প্রতারণা করছে।”
“শুনেছো, ও নাকি মেয়েটাকে ফাঁসিয়েছে।”
“ওর চরিত্রই খারাপ।”
গুজবের আগুনে নাম জ্বলতে লাগল অরিন্দমের। অথচ সে জানত, এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করতে চাইলো না।
সবচেয়ে বড় আঘাত এলো যখন অনন্যার নিজের পরিবার থেকেও ফিসফিসানি শুরু হলো। তার মা নিজেই বললেন, “ও ছেলেটার সাথে মিশলে তোমারই ক্ষতি।”
অরিন্দম নির্বাক হয়ে গেল। সে তো কোনো ক্ষতি করেনি। বরং অনন্যাকে আগলে রেখেছিল, অতীতের আঘাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। তবুও দোষী সে-ই হলো।
দিন কেটে গেল। সম্পর্ক ভেঙে গেল। অনন্যা দূরে চলে গেল।
অরিন্দমের জীবনে নেমে এলো দীর্ঘ নীরবতা। প্রায় এগারো মাস সে আর কোনো খবর পেল না, শুধু শহরের লোকজনের দৃষ্টি তার ওপর ঝুলে থাকল।
কেউ বিশ্বাস করল না তার নীরবতাকে।
কেউ পড়ল না তার চোখের গভীরে জমে থাকা সত্যটুকু।
টুইস্টের শুরু
একদিন শহরের মেলায় অদ্ভুত কিছু ঘটল। ভিড়ের ভেতর অনন্যার পুরোনো প্রেমিক যে একসময় তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল হঠাৎই চিৎকার করে বলল:
“আমি-ই সব গুজব ছড়িয়েছিলাম! আমি চাইনি কেউ অনন্যার জীবনে জায়গা পাক। আমার ঈর্ষা, আমার হিংসাই সবকিছুর কারণ।”
মুহূর্তের মধ্যে ভিড় স্তব্ধ হয়ে গেল।
যে ছেলেটিকে সবাই দোষী ভেবেছিল, সেই অরিন্দম আসলে নির্দোষ।
অনন্যার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার চোখে জল গড়িয়ে পড়ল। সে বুঝল যাকে সে এতদিন সন্দেহ করেছিল, যে সম্পর্কে ভাঙন ধরেছিল, সে-ই আসলে একমাত্র মানুষ যে তাকে নিঃশর্ত ভালোবেসেছিল।
কিন্তু এবার আর দেরি নেই কি?
অরিন্দমের চোখে কোনো রাগ ছিল না, ছিল শুধু ক্লান্তি।
সে নীরবে বলে উঠল
“যখন আমাকে বিশ্বাস করার প্রয়োজন ছিল, তখন করনি। আজ সত্যটা জানলেও আমার ভেতরের সব শেষ হয়ে গেছে।”
শহরের বাতাসে ভেসে রইল সেই প্রশ্ন
“অপরাধী কে?”
গুজব ছড়ানো মানুষ?
নাকি গুজব শুনে বিশ্বাস করা প্রিয়জন?
নাকি সেই নীরব তরুণ, যে প্রতিবাদ না করে সব সহ্য করেছে?
কেউ কোনো উত্তর পেল না।
শুধু ছায়ার ভেতর সত্যটা লুকিয়ে রইল
এতটাই গভীর যে সহজে কেউ বুঝে উঠতে পারল না।
