Manasi Ganguli

Romance Tragedy Classics

4.7  

Manasi Ganguli

Romance Tragedy Classics

শৈলবালা

শৈলবালা

3 mins
709



   ছোটবেলা থেকেই নিজের মামার বাড়ির থেকে মায়ের মামার বাড়িটাই ছিল রত্নার বেশি পছন্দের,আর ছিল মায়ের দিদিমার প্রতি অদ্ভুত টান। বড়মা না বলে নাম ধরে শৈলবালা বলেই ডাকত তাঁকে। বড়মা অবশ্য খুশিই হতেন তাতে। কত স্মৃতি তার শৈলবালার সঙ্গে। আর ছিল শৈলবালার বাল্যবিধবা বোন ভগবতী,দিদির কাছেই থাকতেন তিনি। তাঁকেও রত্না নাম ধরে ভগবতী বলেই ডাকত। যখন ছোট ছিল প্রতি গরমের ছুটি কাটত তার মায়ের মামারবাড়িতে,বর্ধমানের জামালপুর গ্রামে। কত ছোট তখন,সেসময় থেকেই শৈলবালার মুখে একটাও দাঁত ছিল না। তাই খাবার পর পান সেজে হামানদিস্তেয় সে পান ছেঁচে খেতেন। তার একটু ভাগ পেয়ে রত্না যে কি খুশি হত তা তার মুখ চোখের অভিব্যক্তিই বলে দিত। রকমারি ফল উঠত সেসময়। অন্য কিছু না খেয়ে ফল দিয়েই জলখাবার হত তখন। শৈলবালাই সেসব গুছিয়ে খেতে দিতেন ওকে। আর ছিল মজা রাতে শৈলবালা ও ভগবতীর মাঝে শুয়ে গল্প শোনা। দুজনেই গল্প বলতেন তবে শৈলবালার গল্প বলার কায়দা ছিল বেশ রসিয়ে। ছোট্ট রত্না সে গল্প শুনতে খুব মজা পেত। ছোট থেকেই খেতে খুব ভালবাসত রত্না,তাই মায়ের মামা,ওর মামাদাদু,তখন পুকুরে,দীঘিতে মাছ ধরাতেন ওর জন্য। একবার এক বিশাল বড় মাছ ধরা পড়লে মামাদাদু বাড়ি নিয়ে এলে শৈলবালা হুকুম দিলেন,"আমার পুতিমণির জন্য এই মাছের গোটা মুড়ো রান্না হবে,পুতিমণি তৃপ্তি করে খাবে,আমি দেখব"। হ্যাঁ রত্না সম্পর্কে ওনার নাতনির মেয়ে তাই পুতি,আর ঐ নামেই ওকে ডাকতেন শৈলবালা। তা রত্না খুঁটে খুঁটে থালাজোড়া সেই মাছের মুড়ো পরিষ্কার করে খেয়েছিল। বয়স তখন ওর বড় জোর বছর ছয়েক হবে। তাই দেখে শৈলবালা হেসে খুন,বলেই ফেলেন,"ওমা এ যে একেবারে যজ্ঞির বেড়াল"। সেই থেকে ওবাড়িতে ওর নামই হয়ে গেল যজ্ঞির বেড়াল।

   বড় হবার পর পড়াশোনার চাপে বিশেষ যাওয়া হয়ে ওঠেনি সেখানে। তারপর বিয়ে হয়ে গেলে একবারই গিয়েছিল ওবাড়িতে। মা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল জামাই দেখাতে,তবে থাকেনি, ঘুরে চলে এসেছিল। সেসময় শৈলবালা ওবাড়িতে ছিলেন না,মেয়ের বাড়ি অর্থাৎ মায়ের মাসির বাড়ি ছিলেন। আর ভগবতী কয়েকমাস আগেই মারা গিয়েছিলেন। দুজনের কারও সঙ্গেই দেখা না হওয়ায় রত্নার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। এরপর প্রথম দু'চার বছর বরের সঙ্গে আদরে আহ্লাদে কাটানোর সময় মনেও পড়েনি শৈলবালার কথা। হঠাৎই দুদিন আগে স্বপ্নে শৈলবালাকে দেখে রত্না অস্থির হয়ে ওঠে ওনাকে দেখার জন্য,বরের কাছে আবদার করে, "উইকএন্ডে জামালপুর নিয়ে চল, শৈলবালার জন্য খুব মন কেমন করছে"। সমর বলে,"যে আজ্ঞে মহারানী"। মাঝে দুটো দিন রত্নার যেন কাটতেই চায় না। অবশেষে অপেক্ষার হল শেষ। 

     কিন্তু যতটা উৎসাহ নিয়ে রত্না ছুটে গিয়েছিল,সেখানে গিয়ে সে উৎসাহ সে হারিয়ে ফেলল। অনেকদিন পর শৈলবালাকে দেখেই জড়িয়ে ধরবে ভেবেছিল ও কিন্তু অতীতের সে শৈলবালা তখন বয়সের ভারে নুব্জ্য। আগে রত্নার সঙ্গে কত মজা করতেন আর তখন কেমন চুপচাপ হয়ে গেছেন। রত্নার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কত আনন্দ করে এসেছিল তার ছেলেবেলা খুঁজতে,মনে হয়নি যে ছেলেবেলাও তার বড় হয়ে গেছে। তবু সবার সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠার চেষ্টা করে,গল্পগুজব করে। রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসঙ্গে বেশ হাসি মশকরা চলছিল। যদিও আগের সে জমক আর নেই,বাড়ির সর্বত্র যেন দৈন্যদশা,তবু টেবিল সেজেছে নানাবিধ খাবারে। খাওয়া শেষে পায়েসটা ভালো লেগেছে বলায় টেবিলে রাখা বোল থেকে হাতায় করে মামিমা তার বাটিতে আবার পায়েস ভরে দেন তারপর শৈলবালা তার বাঁ হাতে করে হাতা দিয়ে আর একটু পায়েস নেবার ইছায় হাত বাড়াতেই পাশে বসা মামা মানে শৈলবালার নাতি পায়েসের বাটিটা সরিয়ে দূরে রাখেন। রত্না -সমর হতচকিত হয়ে তাকায় সেদিকে। রত্নার দু'চোখ ভরা জল,পেট ভরে গেছে বলে উঠে পড়ল মিষ্টান্ন না খেয়েই। ভেবেছিল পরের দিনটাও থাকবে,তখন সে ইচ্ছা আর রইল না তার।

    মামা বললেন,"তোর খুব খারাপ লাগলো না রে রত্না? কি করব বল! আমাদের যে আগের অবস্থা আর নেই,আমিও তেমন বড়সড় চাকরি করি না। বাড়ির এতগুলো মেম্বার,বাবা-মায়েরও বয়স হয়েছে,ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা,আমিই তো একমাত্র রোজগেরে,সব সামাল দিতে আমি নাজেহাল। কাকা বিদেশ থেকে ঠাকুমার জন্য প্রতি মাসে অনেকগুলো টাকা পাঠান তাতে অনেকটা সুরাহা হয়,তাই ঠাকুমাকে যতদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়। এই বয়সে বেশি খেয়ে ঠাকুমা তাড়াতাড়ি মরে গেলে আমরা পথে বসব রে "।

  রত্না হাঁ করে সব শুনল, শৈলবালার জন্য বুকভরা কষ্ট নিয়ে পরদিন ফিরে এলো নিজের বাড়ি।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance