STORYMIRROR

Bhattacharya Tuli Indrani

Classics

3  

Bhattacharya Tuli Indrani

Classics

সেরা প্রাপ্তি, শান্তি-নীড়

সেরা প্রাপ্তি, শান্তি-নীড়

5 mins
879


আলো ঝলমলে হলটাতে ঢুকতে গিয়ে একটু থমকে গেল ঐশ্বর্য। বড় বড় গাড়ি থেকে নেমে সুসজ্জিতা, সালঙ্কারা রমণীরা তাদের প্রিয়জনের হস্তলগ্না (কন্ঠলগ্না বা বক্ষলগ্না হওয়ার মত আধুনিকতা এখনও ছুঁতে পারেনি এই অভিজাত যুগলদের) হয়ে দলে দলে প্রবেশ করছেন প্রেক্ষাগৃহে। চোখের কোল ভিজে ওঠে ঐশীর। এই সঙ্গীত সভাতে সাথ সঙ্গত করার জন্যে কেউ নেই তার সাথে।

'খুব বড় মিউজিক কনফারেন্স হচ্ছে কলামন্দিরে, যাবে?'

'না।'

কথা শেষ হওয়ার আগেই সন্দীপন 'না' বলে দেয়। অফিস ছাড়া ঘর থেকে বেরনোতেই তার এলার্জি, বিশেষ করে স্ত্রীর সঙ্গে। ঐশ্বর্যের তো তাই মনে হয়। এই তো অফিস ট্যুরে সাউথ কোরিয়া ঘুরে এল, বেশ ক'দিনের জন্যে। কাজের সঙ্গে সঙ্গে প্রমোদ ভ্রমণও তো হয়েই গেল। অনেকেই তাদের স্ত্রীদেরও নিয়ে গিয়েছিলেন। ঐশ্বর্য তো কিছু মনে করেনি, বলেওনি। বলার ক্ষমতাই বা কোথায়? পুরুষের অধিকারে হস্তক্ষেপ! তাদের যা ইচ্ছে তা তারা করতেই পারে। মেয়েদের বেলায় লক্ষ্মণের গণ্ডী টানা। বিয়ের আগে কিন্তু এমন ছিল না সন্দীপ। মাসে-দু'মাসে তিন-চার দিনের জন্যে দেখা হত তাদের। ঐশীর কলেজের সময়টুকু চুটিয়ে উপভোগ করত তারা। কই, তখন তো সন্দীপের মনে হত না সিনেমা যাওয়াটা শিয়ার ওয়েস্টেজ ওফ টাইম এ্যান্ড মানি। তখনকার কথা অবশ্য আলাদা। সিনেমা হলে নাকি সে তার আদরের ঐশুকে নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় কাছে পেত… বিয়ের পরে তো আর দরকার হল না সেই সান্নিধ্যের খোঁজে সিনেমা হলে যাওয়ার, সে তো তখন হাতের মুঠোতে।

এই দেহ-আকর্ষণে সমান ভাবে সাড়া দিতে পারেনি ঐশ্বর্য, কখনই। শরীর সর্বস্ব বলে মনে হয়েছে তার, তার স্বামীকে… যে মনের কোনও খবর রাখতেই চায় না।

কখনও সখনও অফিস পার্টিতে দেখা হয় সন্দীপের সহকর্মী- দম্পতিদের সঙ্গে। সেই স্বামীরা যখন তাদের স্ত্রীদের চেহারা, চাকরি অথবা রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে তখন কী ঐশ্বর্যের বুকে কাঁটা বেঁধে না? সকলের সামনে প্রশংসা করা তো দূরস্থান, বিয়ের একমাসের মধ্যেই সন্দীপ কেমন দূরে সরে গেল। ঐশ্বর্যের শীতলতাই কি তার কারণ? কে জানে। কিন্তু শারীরিক মিলনটাই কি সবকিছু! রাতগুলো কী নিষ্প্রাণ, নির্জীব লাগে ঐশীর। উদ্দাম মিলনের নেশায় মেতে ওঠে সন্দীপ, আর তার পরেই পাশ ফিরে তলিয়ে যায় সুপ্তির অতলে। তার পাশেই যে তার প্রিয়া একা না হয়েও একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে, তার খবর রাখে কে!

সারাদিন কেটে যায় কর্মব্যস্ততা আর আলসেমীর মিশেলে। ছুটির দিনেও কথা বলার, গল্প করার সময় বা ইচ্ছে কোনটাই হয় না সন্দীপের। অভিযোগের উত্তরে সে বলে সব কথা নাকি শেষ হয়ে গেছে। ঐশীর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিরশিরে ভয়ের স্রোত নেমে যায়… তাহলে! বাকী জীবনটা কাটবে কীভাবে, এত তাড়াতাড়ি সব ফুরিয়ে গেল? কথা যদি শুরুও হয় কখনও, এসে পড়ে ঘুরে ফিরে সেই অফিসের গল্প। যে ব্যাপারে তিলমাত্র আগ্রহ নেই ঐশীর। একই কারণে মনযোগ হারিয়ে ফেলে সন্দীপও। বই পড়া, গান শোনার মত তুচ্ছ বিষয়ের প্রতি কোনও রকম ভালবাসা গড়ে ওঠেনি বিরাট পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্দীপনের। পড়ার মধ্যে পড়ে খবরের কাগজ আর প্রোফেশনাল জার্নালস। ঐশী কয়েকবার চেষ্টা করে দেখেছে তার পড়া বই বা ভাল লাগা গান নিয়ে আলোচনা করবার। বুঝতে পারত সে, কিছুই শুনছে না সন্দীপ, সে ব্যস্ত থাকত টিভির চ্যানেল সার্ফিং এ, বা ট্যাবে অফিসের কাজ করতে।

সন্দীপের সহকর্মীদের বাড়ি যেতেও ভাল লাগে না ঐশীর, ওই কতগুলো পালিশ করা বোকা- ন্যাকা পুতুলের শাড়ি-গয়নার গল্প শুনতে… একদমই সহ্য হয় না, হাঁফিয়ে ওঠে সে। তাছাড়া বোঝার ওপর শাকের আঁটি, সন্দীপের সন্দেহপ্রবণতা, যার হদিশ পায় না ঐশ্বর্য। পার্টি থাকলে বাড়ি ফেরার সময়ে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে সে।

'ভোজওয়ানির সঙ্গে এত হাসি- মশকরার কোনও দরকার ছিল কী? নিজেকে এত খেলো কোর না। গাম্ভীর্য বজায় রাখবে।'

প্রতিনিয়ত একই কথা শুনতে শুনতে বর্ষাকালের মৌরলা মাছের মত উচ্ছল মেয়েটা আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কখন যেন ঢুকে পড়ে নিরাপদ খোলের মধ্যে।

'সুয্যিমামা না?'

অতি পরিচিত এক অন্তরঙ্গ কন্ঠস্বরে সম্বিত ফেরে ঐশ্বর্যের।

'ওমা! দিব্যেন্দুদা... তুমি, কলকাতায়? এখন কী এখানেই থাক? কবে এলে?'

'ধীরে বন্ধু ধীরে। এত প্রশ্ন বাণে জর্জরিত কোর না গো… উত্তর দিতে দিতে ঘেমে যাব। তারপর, হায়দ্রাবাদ ছাড়লে কবে?উত্তরে ঐশী একটু হাসে শুধু।

দিব্যেন্দুর গায়ে লেপটে থাকা মহিলাটির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, 'বৌদি?'

দিব্যেন্দু প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে পালটা প্রশ্ন তোলে, 'তুমি একা...কর্তা কোথায়?'

তাঁর এইসব ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই...'

'চল, একটু কফি খাওয়া যাক।'

'উঁউউউউউ, আঁমার পা ব্যঁথা করছে। আঁমি কফি খাঁ বনা...ঘুম হবে না।'

সঙ্গিনীর গালে আলতো একটা টুশকি মেরে দিব্যেন্দু বলে, ‘চল তোমাকে বসিয়ে দিয়ে আসি।'

'নাঁআআআআআ, তুমিও চল। দিব্যেন্দুর হাত আরও জোরে আঁকড়ে ধরে সে। তার চোখে ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ জমা হতে দেখে ঐশ্বর্য।

'তুমি যাও ইন্দুদা। আমার বন্ধুরা আছে, আমি যাই।'

সেই দিব্যেন্দু, যে একসময় ঐশীকে চক্ষে হারাত। কখন কীভাবে যে তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হল, আজ আর মনেও পড়ে না ঐশীর। কিন্তু তখন খুব কেঁদেছিল সে, প্রাণ দিয়ে দেওয়ার কথাও মাথায় এসেছিল। বাঁচিয়ে ছিল প্রাণের বন্ধু মৌসুমী।

'ছি! কে না কে! একটা অপোগণ্ড! তোর ভালবাসা পাওয়ার অযোগ্য যে, তার জন্যে নিজেকে শেষ করে দিবি? কক্ষনো না।'

ভিজে ওঠে চোখ দুটো। রুমালের কোণা দিয়ে আলতো করে মুছে নিয়ে এগিয়ে যায় টয়লেটের দিকে।

ও বাবা! কারা দাঁড়িয়ে সেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন কোণের দিকে? দিব্যেন্দুদা না? কিন্তু তার সঙ্গিনী বদলে গেছে মনে হচ্ছে। গৌরাঙ্গী, খর্বাকৃতীর যায়গা নিয়েছে শ্যামলী-দীর্ঘাঙ্গী...শাড়ি বদলে গেছে সালোয়ার কামিযে...

উল্টোপায়ে, প্রায় দৌড়ে হল থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। শীতের রাতেও তার কপালে ঘাম জমতে শুরু করে। একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে উঠে পড়ে ঐশী। 'নিউ আলিপুর।'

দরজা খুলে দিয়ে আর দাঁড়ায় না সন্দীপন। এখন অনেকদিন কথা বার্তা বন্ধ থাকবে। সে কোথাও নিয়ে যাবে না ঐশীকে, ঐশী একা গেলেও তার মুখ ভার। এ যে কী পরিস্থিতি!

কলকল করে ওঠে ঐশী...'ভাল লাগল না জান, তোমার জন্যে খুব মন খারাপ লাগছিল। আর কখনও যাব না কোত্থাও তোমাকে ছেড়ে।'

সন্দীপকে আঁকড়ে ধরে, নিজেকে গুটিয়ে ছোট করে তার প্রশস্ত বুকে আশ্রয় খোঁজে সে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics