Sayantani Palmal

Romance Tragedy Classics

2.5  

Sayantani Palmal

Romance Tragedy Classics

সেনোরিটা

সেনোরিটা

11 mins
342



আমি নিভার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কল্পকের স্টাডির দরজা দিয়ে ওকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। চেয়ারে বসে কল্পকের ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী কিছু একটা করছে। মাত্র কয়েক দিন হল নিভা কল্পকের সেক্রেটারির কাজ শুরু করেছে কিন্তু কেন জানি না আমার মনে হয় ও কল্পকের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। কল্পক এখন দিনের অনেকটা সময় নিভার সঙ্গে কাটায়। কল্পক নতুন যে প্রজেক্টটায় যুক্ত হয়েছে তার জন্যই অফিস থেকে নিভাকে কল্পকের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে কিন্তু তাও আমার ভালো লাগে না। নিভার শরীরটা বোধহয় আমার চেয়ে বেশি যৌন আবেদন পূর্ণ। আচ্ছা আমি কি হিংসুটে হয়ে যাচ্ছি? 


" কফি।"

" ওহ, থ্যাংকস। রিয়ালি ইউ আর আমেজিং সেনোরিটা। আমার কখন কি দরকার তুমি ঠিক বুঝে যাও।" কল্পক আমার দিকে তাকিয়ে ওর ঝকঝকে অথচ শান্ত হাসিটা উপহার দিয়ে বলল।

" টায়ার্ড?" আমি বুঝতে পারছি কল্পক বেশ ক্লান্ত।

" হুম, তা তো কিছুটা টায়ার্ড অবশ্যই। প্রচুর কাজের প্রেসার আছে এখন। তা আমি কি একটু ম্যাডামের সেবা পেতে পারি?" ভ্রু নাচিয়ে দুস্টুমি ভরা চোখে বলল কল্পক। উত্তরটা যে সব সময় ইতিবাচক হবে ও ভালো করেই জানে। আমি আলতো হেসে ঘাড় নেড়ে ওর বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। কল্পক ওর বেডরুম নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে। লোকে বাড়ির ড্রয়িং রুম সাজায় আর কল্পক সাজায় ওর বেডরুম। কিছুদিন ছাড়া ছাড়া বেডরুমের ইন্টিরিয়ার বদলায়। আমি বেডরুমের কাবার্ড থেকে ম্যাসাজ অয়েল আর স্ট্রেস রিমুভিং ভাইব্রেটরটা বের করে বেড সাইড টেবিলে রাখলাম। ইতিমধ্যে কফি শেষ করে কল্পক চলে এসেছে। পরনের পোষাকগুলো খুলে দিয়ে কল্পক বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমিও আমার কাজ শুরু করলাম। 

" উফফ, সেনোরিটা। ইউ আর ফ্যান্টাস্টিক। একদম ঝরঝরে লাগছে।" কথা বলতে বলতে কল্পক ওর ডান হাতটা দিয়ে আমাকে কাছে টেনে নিল। প্রথমে আমার লাল টুকটুকে ঠোঁট দুটো ছুঁল

 আর তারপর আমার নাকটা আলতো করে টিপে দিয়ে বলল, " ইউ আর এ ভেরি গুড কম্পেনিওন সেনোরিটা।"

আস্তে আস্তে কল্পক আমার শরীরে ডুবে যেতে লাগলো। সবকিছু তো যেমনটি হওয়ার কথা ঠিক তেমনিই আছে। নিভার আগমনে কিছুই তাহলে বদলায় নি। 

 আমি কি ইনসিকিওর ফিল করছি? 




" সেনোরিটা, রিতেশের ফেভারিট স্যান্ডউইচ বানিয়ে স্টাডিতে পাঠিয়ে দিও আর আমার জন্য ব্ল্যাক কফি।" 

" ওকে।"

এই 2050 সালে সব রকম খাবার দাবারই প্রিজার্ভ করা অবস্থায় বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কিংবা অন লাইনে অর্ডার করলেই পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে যায় কিন্তু কল্পকের প্রিজার্ভ করা খাবার একদম পছন্দ নয়। নিজেও খায় না আর অন্যকেও খাওয়াতে পছন্দ করে না। আমি ওদের খাবারগুলো তৈরি করে স্টাডিতে নিয়ে গেলাম। রিতেশ কল্পকের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলছে, " কি করে নিজেকে মেন্টেন করিস তুই? এই মিড ফরটিতেও তোকে দেখে মেয়েরা পাগল হয়ে যাবে। অবশ্য যাবে মানে যায় কিন্তু তুই তো কাউকে পাত্তাই দিস না।" 

" কেন পাত্তা দিই না সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস।" কেমন একটা উদাস কণ্ঠে বলল কল্পক।

" ইয়েস, আই নো দ্য কজ। ইওর সেনোরিটা।"

" হুম।"

কল্পক কোনও মেয়েকে নিজের জীবনে আসতে দেয় না তার কারণ আমি! আমার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিচ্ছে। আমি কি খুশি হয়েছি কথাটা শুনে? 



আমি কল্পককে ম্যাসাজ দেওয়ার জন্য বেডরুমে অপেক্ষা করছি কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল কল্পক আসছে না। ওকে ভীষন ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাই ওকে ম্যাসাজের কথা বলে আমি চলে এসে ছিলাম। আমি বেরিয়ে এলাম বেডরুম থেকে। কল্পক চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বারান্দায় বসে আছে। আমি এগিয়ে গেলাম।

" তোমার একটা স্ট্রেস ফ্রী ম্যাসাজের প্রয়োজন।"

" তুমি এখন যাও। আমাকে একটু একলা থাকতে দাও।" আমার দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর ভাবে বলল কল্পক। কল্পকের কাছ থেকে এই ধরণের ব্যবহার পেতে আমি অভ্যস্ত নই। কল্পক একজন হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, পজিটিভ মাইন্ডেড মানুষ। সব সময় ওর মুখে হাসি লেগে থাকে কিন্তু আজ ওর আচরণে এই পরিবর্তনের কারণ কি? কল্পকের সঙ্গে নিভার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। গতকাল এ বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় নিভা আমাকেও বিদায় জানিয়ে গেছে। কল্পকই বলছিল যে নিভা এবার মিস্টার মোহনের সঙ্গে কাজ করবে। কল্পক কি নিভাকে মিস করছে? ওর জন্যই কল্পকের এত মন খারাপ নাকি অন্য কোনও কারণ? আমি কল্পকের কম্পেনিয়ান ও আমার সঙ্গেও শেয়ার করছে না এমন কি কারণ? 

আমি কি দুশ্চিন্তা করছি?



কে এই মেয়েটা? কল্পককে এভাবে জড়িয়ে ধরে আছে? কল্পক ভার্চুয়াল স্ক্রিনটা অফ না করেই বাথরুমে ঢুকেছে। পুরো রুম জুড়ে ছবিটা ভাসছে। একটা পলাশ গাছের তলায় কল্পক আর একটা মেয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আছে। মাথার ওপর নীল আকাশ।  আমি কফি দিতে এসে ছিলাম তখনই চোখে পড়ল। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম ছবিটা কল্পক হিডেন ফোল্ডার বানিয়ে তার মধ্যে রেখেছিল। এই ছবিটা এত গোপন করে রাখার কারণ কি? কল্পক বেরিয়ে আসার আগেই আমি রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। কারুর গোপন জিনিস দেখা মোটেই ঠিক কাজ নয়। ছবিটা দেখে আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমি কি দুঃখ পাচ্ছি ছবিটা দেখে?




অস্থির ভাবে পুরো ঘরময় পায়চারী করছে কল্পক। আমাকে কিছু খাবার বানাতে বলেছিল। আমি বানানো শেষ করে কল্পকের কাছে এলাম। 

" কিছু বলবে? কল্পক আমাকে প্রশ্ন করল।

আমি মুখে কিছু না বলে ঘনিষ্ঠ ভাবে প্রথমে কল্পককে জড়িয়ে ধরলাম তারপর ওর ঠোঁটে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে বললাম, " আয়াম ইওর কম্প্যানিয়ন। ইউ ক্যান শেয়ার এভরিথিং উইথ মী। কি হয়েছে তোমার? কয়েকদিন ধরেই তুমি খুব স্ট্রেসড আছো কিন্তু তোমার স্ট্রেসড আউট করার কোনও সুযোগ আমাকে দিচ্ছ না। ফিজিক্যাল রিলেশনেও কোনও আগ্রহ দেখাও নি। এই সবকিছু ইন্ডিকেট করছে যে তুমি খুব বড় কোনও সমস্যার মধ্যে আছো। হোয়াটস দ্য প্রবলেম?"

কল্পক আমার প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর না দিয়ে প্রথমে আমার বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত হল তারপর আমার মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলল, " তুমি বুঝবে না।"

কল্পকের কি এমন প্রবলেম হতে পারে যেটা বোঝার সাধ্য আমার নেই!



কলিং আলার্টটা বেজে উঠল, " রিতেশ লোহিয়া কামস উইথ আ স্ট্রেঞ্জার।" 

আমাকে কিছু না বলে, কোনও রকম চেক না করেই কল্পক রিমোট নিয়ে মেন গেট খুলে দিল।

" হি ইজ কামিং উইথ আ স্ট্রেঞ্জার! ইট মে বি ডেঞ্জারাস।" কল্পক যে প্রোজেক্টে কাজ করছে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওর সাবধানে থাকা উচিত। এই ধরণের নেগলিজেন্সি একদম ঠিক নয়। যদিও রিতেশও একই প্রোজেক্টে আছে কিন্তু কেউ রিতেশকে তো বাধ্য করতে পারে। কল্পক উন্মুখ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কথার কোনও উত্তর দিল না। সঠিক ভাবে বলতে গেলে পাত্তাই দিল না। 

আমি কি অপমানিত বোধ করছি?



কল্পক আর মেয়েটা একে অপরের দিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে। দুজনে যেন চারপাশের সব কিছু ভুলে গেছে। এই মেয়েটা আর কল্পকের হিডেন ফোল্ডারের মেয়েটা যে একই ব্যক্তি সেটা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে শুধু ছবিতে বয়সটা কম ছিল। দুজনের চোখের কোণেই জল জমা হচ্ছে। রিতেশ হাসি হাসি মুখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। 

" সোনালিকা!"

" কল্পক!"

" কেন সোনালিকা? কেন?"

" আমার কোনও উপায় ছিল না।" 

" কেন?"

" আমি যা করেছি তোমার জন্য করেছি।"

" আমি তো তোমাকে ছাড়া ...। কল্পক কথা শেষ করতে পারল না। ওর দু চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ছে । কল্পকের মতো হাসিখুশি একজন মানুষ কাঁদছে! 

মেয়েটাও কাঁদছে। হঠাৎ করে কল্পক ধরা গলায় ডাকলো, " সেনোরিটা।" আমি এগিয়ে যেতে যাচ্ছিলাম কিন্তু রিতেশ আমাকে বাধা দিল। নিচু গলায় বলল, " ও তোমাকে নয় সোনালিকাকে ডাকছে।" আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কল্পকের হিডেন ফোল্ডারটার নাম ছিল, " সেনোরিটা।" তারপরেই দেখলাম কল্পক আর সোনালিকা নামের মেয়েটা পরস্পরের আলিঙ্গনাবদ্ধ। মেয়েটা কল্পকের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদছে আর কল্পক ওকে প্রবল ভাবে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। 

" ওদের একটু একলা ছেড়ে দাও। আমরা অন্য দিকে যাই। কল্পক আমাকে বলেছিল সোনালিকার পছন্দের খাবার তৈরি করতে বলেছে তোমাকে। আমরা কিচেনে যাই। খাবার নিয়ে গিয়ে টেবিলটা সুন্দর করে সাজাই।" রিতেশ নিচু স্বরে আমাকে বলল। আমি একবার কল্পক আর মেয়েটার দিকে তাকালাম। আমার সামনে কল্পক ওর সঙ্গে এভাবে ঘনিষ্ঠ হল! আমার কি অভিমান হচ্ছে?





সোনালিকা ছাদের ধার ঘেঁষে একলা দাঁড়িয়ে আছে। কল্পক কি একটা কারণে নীচে গেছে। একটা আঙ্গুলের টোকাতেই ওর শরীরটা নীচের স্লেট পাথর বাঁধানো চত্বরটায় পড়ে যাবে। তারপর ওর শরীরে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা টেন্স টু জিরো। 

আমার কি রাগ হচ্ছে ওর ওপর?

কল্পকের কাছ থেকে ওকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার হান্ড্রেড পার্সেন্ট সুযোগ আছে আমার কাছে কিন্তু আমি তা পারব না। কল্পক ছাদে উঠে এলো। হাতে পাইন আপেল ফ্লেভারের আইসক্রিম। কল্পকের নির্দেশে আইসক্রিমটা আমিই বানিয়ে ছিলাম। তখন জানতাম না ওটা সোনালিকার জন্য বানাচ্ছি। আমাকে দেখে কল্পক একটু অবাক হল তারপর হেসে বলল, " সোনা, তোমার ফেভারিট এই আইসক্রিমটা কিন্তু সেনোরিটা বানিয়েছে।"

সোনালিকা কল্পকের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা ধরা ধরা গলায় বলল, " তোমার এখনও সব মনে আছে!"

কল্পক সোনালিকার কাছে গিয়ে ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, " আমার তো সব মনে আছে। তুমি বুঝি সব ভুলে গেছ? তাহলে আমি কিন্তু ভীষন রাগ করব। কান্নাকাটিও করতে পারি।" ওর কথা বলার ভঙ্গিতে সোনালিকা হেসে ফেলল তারপর ওর চোখ পড়ল আমার দিকে।

" সেনোরিটা, থ্যাংকস আ লট। এত বছর ধরে তুমি কল্পকের কম্পেনিয়ান হয়ে ওর এত সুন্দর খেয়াল রেখেছ। ওকে ভালো থাকতে সাহায্য করেছ। ওর আর আমার না হওয়া সংসারটা সাজিয়ে রেখেছ।"

" ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম সোনালিকা।"

আমি ছাদ থেকে আস্তে আস্তে নেমে এলাম।

" আমার কি কষ্ট হচ্ছে?"




আমি আর কল্পক গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের চির বিচ্ছেদ ঘটবে। আমি কল্পকের জীবন থেকে চিরদিনের জন্য সরে যাচ্ছি। কাল থেকে ওর জীবন শুধু সোনালিকার জন্য। ইচ্ছে করেই আমি চলে যাওয়ার জন্য আজকের দিনটা বেছে নিয়েছি কারণ কালকে এলে হয়ত সোনালিকাও আসত সঙ্গে কিন্তু শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি শুধু কল্পকের সঙ্গ চেয়েছি। সেদিন সোনালিকা আর রিতেশের সঙ্গে কল্পকও বেরিয়ে গিয়েছিল। অনেক রাতে ফিরে আমাকে ওর বেডরুম ডাকে। সাধারণত অত রাত্রে কল্পক আমাকে বেডরুমে ডাকলে যা ঘটা উচিত সেই মত আমি গিয়ে কল্পককে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে ছিলাম কিন্তু কল্পক আমার কাছ থেকে এমন ভাবে সরে গিয়েছিল যেন আমি কোনও নিষিদ্ধ কাজ করছি। তারপর আমাকে বসতে বলেছিল। আমি বসার পর আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, " সেনোরিটা, আমি তোমাকে শুধু আমার কম্পেনিয়ান নয় আমার বন্ধু বলে ভেবে এসেছি। গত দশ বছরে তুমি খুব সুন্দর ভাবে আমার পাশে থেকেছ তাই আজ আমার জীবনের যে তথ্যগুলো তুমি জানো না সেগুলো তোমাকে জানাতে চাই হয়ত কোনও প্রয়োজন নেই কিন্তু তাও জানাতে চাই। " এই বলে কল্পক ওর ল্যাপটপটা অন করলো। খাটের ঠিক ওপরে বিশাল ভার্চুয়াল স্ক্রিনে সেই ছবিটা ফুটে উঠল।

" আজ তো সোনালিকার সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে। সেনোরিটা, সি ইজ মাই ওয়াইফ।"

আমি আস্তে করে বললাম, " এই তথ্যটা তো আমার জানা ছিল না।"

" হুম, বললাম তো আমার জীবনের অজানা দিক গুলো তোমাকে জানাতে চাই। জানো, আমরা দুজনে দুজনকে ভীষন ভালোবাসতাম মানে আজও বাসি। আমাদের জীবনের গল্পটা অনেকটা ওল্ড ইন্ডিয়ান ফিল্মের স্টোরির মত। অনেকটা কেন প্রায় পুরোটাই। আমি মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ইন্টেলিজেন্ট স্টুডেন্ট আর সোনালিকার বাবা নামী পলিটিশিয়ান। আমাদের আলাপ হওয়া, প্রেম হওয়া এসব গল্প আর অকারণে তোমাকে বলছি না। সবটা তুমি বুঝতেও পারবে না হয়ত। যাইহোক ওর বাড়ি থেকে বাধা আসতে পারে বুঝতে পেরে আমরা গোপনে বিয়েটা সেরে ফেলি। আজকের দুনিয়াতে এসেও ইন্ডিয়াতে এসব হয়। ধনী-দরিদ্রের ভাগটা বোধহয় কোনও কালেই মোছার নয় যাইহোক আমি একটা কাজের অফার পেয়ে এক বছরের জন্য নেদারল্যান্ড যাই। সোনালিকার সঙ্গে আমার বলতে গেলে প্রতি মুহুর্তে যোগাযোগ ছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। তারপর আমাদের এক কমন ফ্রেন্ড জানালো যে সি ইজ নো মোর। ইট ওয়াজ আ্যন আ্যকসিডেন্ট। বিশ্বাস করতে মন না চাইলেও বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম কারণ ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। সোনালিকা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না এটা ভাবতেই পারিনি। এসব আজ থেকে পনের বছর আগের ঘটনা। আর দেশে ফিরতে ইচ্ছে করেনি আমার। আমি বিদেশেই থেকে যাই। ধনী পলিটিশিয়ানের কাছে আমার দাম না থাকলেও বিদ্বান মহলে আমার এই মাথাটার দাম আছে তাই আমার চাকরির অভাব হয়নি কোনও দিন। তারপর রিতেশ জার্মানি আসতে আমিও ওর ডাকে চলে আসি। তুমি তো জানো রিতেশ আমার ছেলেবেলার বন্ধু। কলকাতায় এক পাড়াতেই বাড়ি আমাদের। সোনালিকার খবরটা পাওয়ার পর থেকে আমার জীবনটা শূন্যতায় ভরে গিয়েছিল। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতাম শুধু। রিতেশ আমাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। ওর উৎসাহেই আমি জীবনটাকে নতুন করে সাজাতে আরম্ভ করি। সোনালিকার সঙ্গে যেমন যেমন স্বপ্ন দেখে ছিলাম ঠিক তেমনি করে এই বাড়ি, বাড়ির ইন্টিরিয়ার সবকিছু সাজাই। ও বলত বেডরুমের সাজসজ্জা ঘনঘন বদলাবে ও। আমিই তাই করতাম। তারপর তুমি এলে। আজ সোনালিকা তোমাকে যে কথাটা বলল সেই কথার সূত্র ধরেই বলি ওর আর আমার না হওয়া সংসারটাকে পূর্ণতা দিয়েছিলে তুমি। ওকে আমি আদর করে সেনোরিটা বলতাম তাই তোমাকেও ওই নামেই ডাকতে শুরু করি আমি।"

" সোনালিকা তো জীবিত আছে।" এতক্ষণে আমি কথা বললাম।

" হুম, ওর বাবা আমাদের ব্যাপারে জেনে যান। একজন পলিটিশিয়ানের উঠতি পলিটিশিয়ান ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়ে দেন জোর করে। আমার ব্যাপারে থ্রেট করেন ওকে তাই ও আমার ভালোর জন্য নিজের মৃত্যুর খবর পাঠায় আমাকে কারণ ও অন্য কাউকে বিয়ে করেছে এটা আমি সহ্য করতে পারব না। তাছাড়া ও ভেবেছিল আমি হয়ত নতুন করে কিছু ভাবতে পারব। যাইহোক ওর বিবাহিত জীবনের এক্সপিরিয়েন্স খুবই ভয়াবহ হয়। আজকের দিনে মেয়েরা এসব মোটেই সহ্য করে না কিন্তু ও বোকার মত আমার বিপদের কথা ভেবে সহ্য করে যাচ্ছিল। একবার প্রায় মৃত্যুর মুখে চলে যাওয়ার পর ওর বাবার শিক্ষা হয়। আল্টিমেটলি ও ডিভোর্স নিয়ে নেয় আর তারপর সোনালিকাও অতীত ভুলতে দেশ ছেড়ে বিদেশে বাস করতে আরম্ভ করে। বোকা মেয়েটা ভেবেছিল আমি হয়ত বিয়ে করে সংসার করছি তাই কোনও রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করে নি। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমাকে খুঁজে পাওয়া খুব একটা কষ্টকর মোটেও ছিল না। 

আমার ভাগ্য ভালো যে শেষ পর্যন্ত হঠাৎ করেই রিতেশ ওকে একটা স্টোরে দেখতে পায় তারপর ওকে খুঁজে বের করে। এই হল কল্পক আর সেনোরিটা মানে সোনালিকার ফিল্মি লাভ স্টোরি।"



আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। কল্পক আলতো ভাবে একবার আমাকে জড়িয়ে ধরল, " থ্যাংকস ফর এভরিথিং সেনোরিটা।" আমি কল্পকের দিকে তাকিয়ে বললাম, " গুড উইশেস ফর ইউর ফিউচার।" আমি নিভাকে আমার প্রতিপক্ষ ভেবে বসেছিলাম কিন্তু ভাবতেই পারিনি যে কোনও মানুষ আমার প্রতিপক্ষ হতে পারে। আমি, নিভা আমাদেরকে আমাদের কাজের জন্য নিখুঁত করে বানানো হয়েছে। সে আমাদের কৃত্রিম শরীর হোক বা মাথায় বসানো তথ্যে ঠাসা লক্ষ লক্ষ চিপ সবই ক্রুটিহীন। আমাদের কোনও কাজে কোনও ত্রুটি হয় না। সে নিভার মত অফিসের কাজ সামলানো হোক কিংবা আমার মতো কম্পেনিয়ান হয়ে একজন মানুষের ঘর, সংসার সামলানো বা জৈবিক চাহিদা মেটানো হোক। কিন্তু মানুষের কাছে বোধহয় আমাদের মতো নিখুঁত যন্ত্রের চেয়ে জরা, ব্যাধি, দোষ-গুণ সবকিছু সম্বলিত মানুষ অনেক দামী। কল্পক কেন আমার মতো যৌবনের সমস্ত উপাদানে পরিপূর্ণ দশ বছর ধরে পঁচিশ বছর বয়সে আটকে থাকা যন্ত্রমানবীর ভাস্কর্যের মতো শরীরটা বাদ দিয়ে সোনালিকার বিয়াল্লিশ বছর বয়সী গত যৌবনা শরীরটা বেছে নিচ্ছে তার উত্তর আমার কোনও চিপে ভরা নেই। গত দশ বছর ধরে প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা আমার বদলে কেন সোনালিকার মত একটা মানুষকে কাছে টেনে নিচ্ছে, তাকে নিজে হাতে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছে তার উত্তরও আমার মধ্যে ভরা নেই। রুলস অনুযায়ী কোনও অবস্থাতেই নিজের স্বার্থে কোনও যন্ত্রমানব কোনও মানুষের ক্ষতি করতে পারে না তাই আমি সেদিন সুযোগ পেয়েও সোনালিকাকে ছাদ থেকে ফেলতে পারিনি। আসলে আমার মতো যন্ত্রমানবী মানুষের কাজ করে দিতে পারে, মানুষকে সুখ দিতে পারে কিন্তু তার নিজস্ব কোনও রাগ, অভিমান, দুঃখ, কষ্টের অনুভূতি থাকতে পারে না, থাকার জায়গা নেই। তাই তো কল্পক যখন আমায় জানালো যে তার সত্যিকারের সেনোরিটা এসে গেছে তাই তার জীবনে সেনোরিটা নামের কম্পেনিয়ান হিউম্যানয়েডের ভূমিকা শেষ আমি কোনও প্রতিবাদ ছাড়াই ওর সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম। একবারও প্রশ্ন করলাম না যে গত দশটা বছর কি মিথ্যে ছিল? কল্পক বলেছিল যে আমাকে " রোবোটেন ইন্টারন্যাশনাল" এর রিসাইকেল সেন্টারে দিয়ে আসবে আবার কোনও কল্পকের সেনোরিটা হওয়ার জন্য কিন্তু আমি ওকে অনুরোধ করলাম যে আমাকে রিসাইকেল সেন্টারের পরিবর্তে হাইবারনেশন সেন্টারে দিয়ে আসতে যেখানে আমার কৃত্রিম মস্তিষ্কের কোঠরে কল্পকের স্মৃতি ভরা চিপগুলো নিয়ে আমি চিরঘুমে তলিয়ে যাবো।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance