স্বাবলম্বী হওয়ার আন্দোলন
স্বাবলম্বী হওয়ার আন্দোলন
আজ থেকে নব্বই বছর আগে পরাধীন ভারতে এমন একটি আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল যা শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনের দিশাই দেখায়নি বরং এর সাথে স্বাবলম্বী হওয়ার পথও দেখিয়ে দিয়েছিল। এই আন্দোলন হল ১৯৩০ সালের ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন। ১২ই মার্চ, ১৯৩০ গুজরাটের সবরমতী আশ্রম থেকে মহাত্মা গান্ধী ৭৮ জন সত্যাগ্রহীকে নিয়ে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত ডান্ডির দিকে এক ঐতিহাসিক পদযাত্রা শুরু করেন।
ডান্ডি সবরমতী আশ্রম থেকে দু’শো মাইল দূরে অবস্থিত। ইতিহাসের পাতায় ‘ডান্ডি মার্চ’ খ্যাত এই পদযাত্রা অভিনন্দিত লাভ করেছিল। অনেকে যোগ দিয়ে এই পদযাত্রাকে উৎসাহ দেন। ভারতীয় সংবাদপত্রগুলিতে এই পদাযাত্রার ছবি ও বিবরণ প্রকাশ হওয়ার ফলে সারা দেশে এই আন্দোলন এক উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। গান্ধীজি ও তাঁর অনুগামীরা দীর্ঘ পঁচিশ দিন পদযাত্রা করার পর ৫ই এপ্রিল ডান্ডিতে এসে পৌঁছন। একদিন উপবাস ও প্রার্থনা করে কাটানোর পর ৬ই এপ্রিল সকাল সাড়ে ৬’টায় গান্ধীজী সমুদ্রস্নানের পর সমুদ্রের তীরে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে আরব সাগরের জল থেকে লবণ তৈরি করেন।
এইভাবে তিনি তৎকালীন লবণ আইন ভেঙে সমগ্র দেশবাসীকে খাদ্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উপাদান লবণ তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এই আন্দোলনের রেশ গুজরাট থেকে অন্য জায়গায় যেমন বোম্বাই, বিহার, বাংলা, ওড়িশা, মাদ্রাজ, আসাম, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মালাবার সহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার মেদিনীপুরের কাঁথি,তমলুক, চব্বিশ পরগণার মহিষবাগান,ডায়মন্ডহারবার,কালিকাপুর সহ সারা দেশের সমুদ্রতীরবর্তী জায়গায় বিপুল হারে লবণ তৈরি করা হয়।
যে সকল জায়গায় প্রাকৃতিক কারণে লবণ তৈরি করার উপায় ছিল না সেখানে বিদেশি দ্রব্য বর্জন,করদান বন্ধ, বিদেশি পণ্য বিক্রি করে এমন সব সরকারি দোকানের সামনে পিকেটিং, ধর্মঘট সহ নানা শান্তিমূলক আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল। হাজার হাজার আন্দোলনকারী যাঁদের এক বিপুল অংশ ছিলেন মহিলারা সবাই গ্রেপ্তার হন। এই লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন ইংরেজ সরকারের একচেটিয়া লবণ নীতির বিরুদ্ধে এক করদান-বিরোধী প্রতিবাদী আন্দোলন যা সম্পূর্ণরূপে অহিংস ও শান্তিমূলকভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব অনেকটাই বদলে দিয়েছিল।
এই আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছিল যে ভারতীয়রা বিদেশী সরকারের কৃপাপ্রার্থী নয়। তারা নিজেরাও সমস্ত দরকারী সামগ্রী তৈরি করতে সক্ষম। আমরা স্বাবলম্বী। আসলে, নব্বই বছর আগের এই আন্দোলন ছিল স্বাবলম্বী হওয়ার আন্দোলন। আজ যখন বেকারত্বের হাহাকার, 'চাকরি,চাকরি' করে আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি তখন এই আন্দোলন আজকের দিনেও আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে চাকরীর কৃপাপ্রার্থী না হয়েও শুধুমাত্র উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল বুদ্ধি প্রয়োগ করে আমরা কিভাবে নানা জিনিস উৎপাদনের মাধ্যমে দেশ ও দশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, দেশকে আরো সমৃদ্ধশালী করতে পারি।সে করোনা মহামারী হোক, ডেঙ্গু,ম্যালেরিয়া মোকাবিলা হোক কিংবা পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ যাই হোক না কেন স্বদেশী উপায় কিভাবে একত্রিত হয়ে কাজটি সম্পন্ন করা যায়, মানুষ ও সমগ্র জীবজগৎ এমনকি পরিবেশকে কিভাবে বাঁচানো যায় তা এই আন্দোলনই আমাদের অনেকাংশ শেখায় বা অনুপ্রেরণা জোগায়।
এই আন্দোলন আমাদের শেখায় এও শেখায় যে দেশের প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক সম্পদ দিয়ে আমরা নানা সামগ্রী উৎপাদনের মারফতে আয়ের মাধ্যমে নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে পারি। এই আন্দোলন থেকে শেখা বা অর্জন করা এই স্বাবলম্বীতাই হোক মহাত্মার ১৫০তম জন্মবার্ষিকীর প্রতি আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধার্ঘ্য।