STORYMIRROR

Indranil Majumder

Children Stories Horror Thriller

4  

Indranil Majumder

Children Stories Horror Thriller

ব্রাহ্মণমশাই

ব্রাহ্মণমশাই

8 mins
4

ব্রাহ্মণমশাই 
→ ইন্দ্রনীল মজুমদার 

শীতের দুপুরে বাড়ির বাগানে রোদের নীচে খবরের কাগজটা উল্টে পাল্টে দেখছিলেন অমলেশবাবু। শীতের রোদ গায়ে মাখলে বেশ আরাম লাগে। আর সেই সময় খবরের কাগজ বা বই পড়লে তো কথাই নেই। অমলেশবাবু খবরের কাগজটা পড়ছিলেন এমন সময় চোখ খবরের কাগজের ওপরে রেখে দেখলেন গেটের বাইরে সাইকেলে চড়ে যাচ্ছেন মানিকলাল। মানিকলাল তপাদার— সুন্দরবনের কোনও একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন আজ বহুবছর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহে একটি ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করতে শুরু করেছেন। এদিকে অমলেশ রায়ও কলকাতার একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে দীর্ঘ বছর কাজ করে আজ অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। অমলেশবাবুর স্ত্রী গত হয়েছেন। তাঁর মেয়ে, জামাই, নাতি সহ বিদেশে থাকেন। এই অবসরের জীবনে বলা যায় পাড়ায় মানিকবাবুই তাঁর বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছেন। মানিকবাবু ছাত্রছাত্রী পড়িয়েই প্রায় জীবনটা কাটালেন। বিয়ে ও সংসার আর করলেন কোথায়? দু'জনের নির্জন ঝাঁট জীবন। তাই, ওঁদের মধ্যে বন্ধুত্বটা বেশ গাঢ়ই হয়েছে। তা, বাগানে চেয়ারে খবরের কাগজ পড়ারত অমলেশবাবুর দৃষ্টি এড়োয়নি মানিকবাবুর। সাইকেল থেকে নেমে মানিকবাবু বললেন, "আরে কি হে রায়বাবু, কী খবর?" 

— আরে, মানিকবাবু আসুন, আসুন। এই রমা আরেকটা চেয়ার আন তো। 

রমা অমলেশবাবুর বাড়িতে কাজ করেন। বলার সাথেই একটি চেয়ার নিয়ে বাগানে রাখলেন। অমলেশবাবু তাঁকে দু'কাপ চা ও কিছু বিস্কুট আনতে বললেন। মানিকবাবু সাইকেলটা রেখে চেয়ারে বসলেন। কুশল বিনিময় করার পর অমলেশবাবু বললেন, " মানিকবাবু, সুন্দরবনে তো আপনার বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে। আচ্ছা, কোনোদিন কোনও ভৌতিখ অভিজ্ঞতা হয় নি? না, মানে জলা জঙ্গলের জায়গা তো!" 

মানিকবাবু বেশ ভেবে বললেন, " তা, একবার হয়েছিল, বৈকি। তখন আমি সুন্দরবনের স্কুলে সদ্য চাকরি পেয়েছিলাম। ঘটনাকি ঘটে তখন।" 

— আরিব্বাস! শীতের দুপুরে ভূতের গল্প বেশ ভালোভাবে জমে যাবে। 

এমনসময় চা বিস্কুট এলো। এবার সত্যিই জমবে ভৌতিক গল্প।

— নিন, চা-বিস্কুট খেতে খেতে শুরু করুন। 

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভৌতিক ঘটনাটি বলা শুরু করলেন মানিকলাল তাপাদার। 

— স্কুলের পোস্টিং পেয়ে সুন্দরবনের দিকে রওনা হলাম। ক্যানিং থেকে সুন্দরবন যাওয়ার পথে যেতে গিয়ে ট্রেন অহেতুক লেট করায় বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। সে বহুকাল আগের কথা, চল্লিশ বছরের ওপর তো হবেই। হরিবাবু বলে আমার এক দূরের আত্মীয়ের বাড়িতে আপাতত কিছুদিনের জন্যে স্থান নিয়েছিলাম। তারপর স্কুলের কাছাকাছি চলে যাব সেরকমই ভাবনা ছিল। তখন সুন্দরবন মানে ঘোর জঙ্গল ও অঁজ গ্রাম্য জায়গা। আর আমি সেই জঙ্গলের কাছে অঁজ গাঁয়ে গিয়ে পড়েছিলাম। হরিবাবুর বাড়িটা ছিল সুন্দরবনের কোনও এক অঁজ পাড়া গাঁয়ে। গ্রামটার নাম মণিপুর। সেসময়েও ছিল শীতকাল। তা সেই গ্রামের কাছাকাছি যখন পৌঁছলাম তখন রাত হয়ে গিয়েছিল। সেরকম যানবাহনই পেলাম না। বহু প্রতীক্ষার পর একটা গরুর গাড়ি বহুকষ্টে জোগাড় করা গেল। গ্রামে গঞ্জে একেই রাত হলে পথঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। তার ওপর আবার শীতকাল! জঙ্গল এরিয়া। কোনোরকমে তাও একটা গরুর গাড়ি জোগাড় করতে পেরেছি, বেশি ভাড়া দিয়ে তাকে হরিবাবুর বাড়ি পর্যন্ত যেতে রাজিও করিয়েছি। বেশ কিছুটা রাস্তা এগিয়ে যাওয়ার পর একটা গলির কাছে এসে গাড়ির চালক আর এগোতে চাইল না। সে বলল, "গরুরা এত রাতে আর ওদিকে যেতে পারবিনে, বাবু। আপনি এই পথ ধরে সোজা চলে গেলেই একটা মন্দির পড়বে আর তার পাশেই হরিবাবুর বাড়ি পেয়ে যাবেন।" আমি বললাম, "এই সেরেছে। আর যেতে পারবে না যে! আমি যে এখানকার প্রায় নতুন। অনেক বছর পর কাজের সূত্রে আসতে হল। পথঘাট তেমন কিছুই জানি না।" সে আশ্বস্ত করে বলল, "হরিবাবুর বাড়ি যেতে বেশি সময় লাগবে না। মিনিট পনেরোর মতো হাঁটলেই পেয়ে যাবেন।" তারপর সে একটু আস্তে করেই বলল, "ইদানিং এখানে চোর-ডাকাতের উপদ্রবও বেড়েছে। একে রাত্রিবেলা। তাই, সাবধানে যাবেন। জ্যোৎস্নায় যেতে অসুবিধা হবে না তবুও দেখে যাবেন গো বাবু। দুগ্গা দুগ্গা।" আমি নিজেকে আশ্বস্ত করেই বললাম, "জ্যোৎস্নায় যেতে অসুবিধা হবে না। সাবধানে চলে যেতে পারব আশা করি।" অতএব, পথ হাঁটা শুরু হল। শেয়াল কুকুরের ভয় তো আছেই। কখনো বাঘের মুখে পড়ার ভয়ও পেতে হয়। আবার, লেজুড় হল চোর-ডাকাতের উপদ্রব। কত কিছুর ভয় আছে এখানে। তা একটা আলপথ ধরে চলেছি। জ্যোৎস্নায় কোনোকিছু দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। বেশ কিছু বাড়ি, গোয়ালঘর ও খামার চোখে পড়ল। তারপর পুরো ফাঁকা মাঠ, ক্ষেতজমি। তা কিছুদূর যাবার পর এমন সময় হঠাৎ মনে হল কারা বেশ যেন পিছু নিয়েছে। জ্যোৎস্নার আলোয় রাস্তায় আমার ছায়ার সাথে তাদেরও ছায়া পড়েছে। পেছনে ঘুরে দেখলাম কিছু নেশাখোর যুবক কিসব বিড়বিড় করে উল্টোপাল্টা বলতে বলতে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। ওরা জনা পাঁচেক হবে। অতএব, দ্রুত পা চালানো ছাড়া আর অন্য কোনও রাস্তা নেই। আমি যতই এগোচ্ছি, ওরাও ততই এগোচ্ছে। একেই শীতের রাত তার ওপর এই জঙ্গলের গ্রাম্য পথে কেমন যেন গা ছমছমে ভাব। এরই ওপর আবার তেনাদের উৎপাত। পারা যায়! আর এ রাজ্যের পুলিশদের যা করুণ অবস্থা! এখনকার দিনেও কোনও গ্রাম তো দূর অস্ত এমনকি নগর বা শহরে রাতে তাদের দেখা পাওয়া ভার আর তখনকার দিনে তো ছেড়েই দিলাম। তার ওপর চোর-ডাকাত থাকলে এরা তো দেখি ভয়ে উল্টো দিকে থাকে। কেন কে জানে? যাইহোক, এক সময়ে মনে হল, পেছনে কে যেন গ্যাং-এর বাকিদের বলে উঠলো, "ওরে ছুরিটা বের কর্ তো। মনে হচ্ছে মালটা গাঁয়ে নতুন। একে ঘায়েল করতে হবে।" এই শুনে আমার বুকটা ধক্‌পক্‌ করে উঠলো, দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাণপনে সোজা দৌঁড়ালাম। ওরাও দেখি ছুটে আসছে। যে একটু আগে আমাকে ঘায়েল করার কথা বলেছিল সে ব্যাটাই মনে হয় সর্দার। সে আবার তার চ্যালাদের আজ্ঞা করল, "ধর্! পাকড়াও কর মালটাকে।" আমার তো হয়ে গেছে! প্রায় বেহুঁশ হওয়ার অবস্থা। তবুও দৌঁড়েই চলেছি। এমন সময়ে এক বেলগাছের তলায় আর দৌঁড়তে না পেরে যেন আঁচড়ে পড়লাম। ক্রমাগত হাঁপাচ্ছি। ওরা পাঁচজনও হাজির। এইবার কী হবে?

আমার প্রায় দিকশূন্য হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অবস্থা। চোখ প্রায় অন্ধকার হয়ে আসছে এমন সময় এক অদৃশ্য গলা শোনা গেল,—"ওঠো বাবা। তোমার কোনও ভয় নেই। আমি তো আছি।" কণ্ঠস্বরটি খুব শান্তশিষ্ট, যেন পিতৃসুলভ স্নেহপরশে মাখা। খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে সামনের দিকে ওপরে চোখ মেলে তাকাতেই চমকে গেলাম। এক ধব্‌ধবে শুভ্র বর্ণের সুপুরুষ চেহারার ব্রাহ্মণ। সাদা ঝকঝকে পৈতেধারী তিনি। পড়েছেন সাদা ধুতি, হাতে রয়েছে মালা। গলায় তাঁর রুদ্রাক্ষের মালা। তাঁর মুখে গোঁফ দাড়ি নেই। দু’পায়ে রয়েছে খরম। বলতে গেলে তিনি যেন এক প্রকাণ্ড ছায়ামূর্তি। তাঁকে দেখে বেশ শ্রদ্ধা, ভক্তি হয়েছিল। বেশ খানিকটা আশ্বাস পেয়ে আস্তে আস্তে পেছনে ফিরে তাকালাম আর দেখলাম যে ওই পাঁচটা উচ্ছিষ্ট লম্পট লুটেরাগুলো এই ব্রাহ্মণমশাইকে দেখে ভয় থরথর করে কাঁপছে। পরক্ষণেই সেই ব্রাহ্মণমশাই জোড়ে ধমকের সুরে ওদের বললেন, "যা! চলে যা! দূর হয়ে যা! আর খবরদার! আর কারুর ক্ষতি করবিনে। কথাটা মনে থাকে যেন। ভাগ এখান থেকে।" ওই লম্পট পাঁচমূর্তি ভয়ে দৌঁড়ে পালালো। আমি সেই দেবতূল্য দিভ্যমূর্তিকে চোখ বুজে ভক্তি শ্রদ্ধা ভরে দু'হাত জুড়ে প্রণাম করলাম। স্নেহপরশ এক কণ্ঠে শুনলাম, "এখন নির্ভয়ে যাও। সামনে ওই মন্দিরের পাশে হরির বাড়ি। আশীর্বাদ রইলো, ভালো থেকো।" চোখ মেলতেই দেখলাম, কোথায় সেই দিব্যপুরুষ ব্রাহ্মণমশাই? কেউ কোথাও নেই। কেবল জ্যোৎস্নার আলো বেলতলায় পড়ে চিক্‌মিক্ করছে। আবার সেই অদৃশ্য হওয়া দিব্যপুরুষকে প্রণাম করে এগোতে লাগলাম। মনে কিন্তু একটা খটকা থেকেই গেল— কে এই ব্রাহ্মণমশাই? কীভাবে জানলেন নারায়ণবাবুর বাড়ি যাচ্ছি? ইনি আর যাই হোন, মানুষ তো নন।" 

অনেকক্ষণ কথা বলে মানিকবাবু একটু থামলেন। চা-বিস্কুট প্রায় শেষ হয়ে গেছে। রমাও কাজ সেরে অমলেশবাবুকে যেতে যেতে বলেন, " খাবার সব রেডি হয়ে আছে। খেয়ে নেবেন বাবু। আজ আসলাম।" অমলেশবাবু বলেন, "হ্যাঁ, আয়। সাবধানে যাস।" এরপর তিনি মানিকবাবুর দিকে ফিরে বলেন, "তারপর। তারপর কী হল?" মানিকবাবু খানিকক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, "তারপর, কিছুটা এগিয়ে মন্দিরের পাশে একটি মাটির কুটীরে সামনে দেখলাম হরিবাবুকে– হাতে লণ্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছেন। বহুবছর পর দেখলাম। যাক্, অবশেষে পৌঁছানো গেল। হরিবাবু আমায় দেখে খুব খুশি হলেন। তবে, হয়তো এত রাত হয়ে গেছে দেখে বেশ চিন্তিত হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, " এত দেরি হল যে! আপনার বাবার চিঠি পেয়ে আজ আসবেন জেনে আপনার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। ট্রেন নিশ্চয়ই লেট ছিল?" আমি বললাম, " তা তো ছিলই তবে সেটা তেমন কিছু ব্যাপার নয়। তার থেকেও..." হরিবাবু বেশ চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "আসতে কোনোরকম অসুবিধা হয়নি তো?" আমি জুতো খুলতে খুলতে বললাম, "হয়েছিল বৈকি। তবে একজনের কৃপায় বেঁচে গিয়েছি। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে..." হরিবাবু আর শুনলেন না। আমার কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললেন, "অনেক দূর থেকে এসেছেন। আগে হাত মুখ ধুয়ে নিন। তারপর খেতে খেতে সব শুনব।" এর কিছুক্ষণ পর খেতে খেতে হরিবাবু ও তাঁর স্ত্রীকে রাস্তায় ঘটা অলৌকিক ঘটনার সমস্ত বিবরণ বলতে দেখলাম ওঁরা চমকে উঠলেন। লণ্ঠনের আলোয় দেখলাম হরিবাবুর চোখে জল এলো। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দু'জনেই নিজেদের কপালে দু'হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। আমি বেশ কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলাম, "ব্যাপারটা কী? আর সেই ব্রাহ্মণমশাই কে?" হরিবাবু বললেন, "আপনি যাঁর দর্শন পেয়েছেন, তিনি একজন ব্রহ্মদৈত্য। তবে, কারুর কোনও ক্ষতি করেন না বরং বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধার করে উপকারই করেন।" আমি বেশ চমকে উঠে বললাম, "ব্রহ্মদৈত্য!" হরিবাবু বললেন, "হ্যাঁ। এ গ্রামের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতমশাই ছিলেন শ্রীধর গোস্বামী। বছর পঁচিশ-ত্রিশ কি তারও আগে ওদিকের মাঠে এক প্রবল বৃষ্টিতে মাথায় বাজ পড়ে তিনি মারা যান। শ্রীধরবাবু খুবই ভালো লোক ছিলেন, বড় পরপোকারীও ছিলেন বটে। অপঘাতে মৃত্যুর জন্যে তিনি ব্রহ্মদৈত্যে পরিণত হয়েছেন বটে কিন্তু স্বভাবখানা তাঁর যায়নি। এখনও সেই পরোপকারী স্বভাব থেকে গেছে। কেউ অসুবিধায় বা কোনও সঙ্কটে পড়লে থাকতে পারেন না। লোকের বিপদে এসে দর্শন দিয়ে বিপদমুক্ত করে চলেছেন আজও। এই তো বছর কয়েক আগে ওপারের তারকদার মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল না টাকার অভাবে। সকালে তারকদা দাঁতন করতে করতে দেখেন বাগানে এক পুঁটলি সোনা কে যেন ফেলে দিয়ে গেছে। বুঝতে অসুবিধা রইলো না যে এ হল সেই ব্রহ্মদৈত্যের কাজ। ব্যস, ভালোভাবে মেয়ের বিয়ে দেওয়া গেল। সেই মেয়ের ঘরে আজ দুই সন্তান স্কুলে পড়ছে— সুখের সংসার। আরে তাই তো বলি, শ্রীধর গোস্বামী এ তল্লাটের, এ গ্রামের সাক্ষাৎ ভগবান। সেই ভগবানের সাক্ষাৎলাভ করে ও তাঁর কৃপা পেয়ে ধন্য হয়েছেন আপনি। এখন আপনি খেয়েদেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ুন। অনেক দূর থেকে এসেছেন। ঘোর বিপদে বলা ভালো মৃত্যুর মুখে পড়তে যাচ্ছিলেন তবে উনি রক্ষা করেছিলেন। এখন বিশ্রাম নিন। রাম রাম...।"

মানিকবাবু অনেকক্ষণ বলার পর থম মেরে বসে রইলেন। হয়তো স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে স্মৃতির সাগরে হারিয়ে গেলেন। অমলেশবাবুই নীরবতা ভাঙলেন। "তারপর কী হল? মানিকবাবু, এরফর কী হল?" মানিকবাবু যেন আবার ফিরে এলেন এই দুনিয়ায়। তিনি বলতে আরম্ভ করলেন— "তারপর আর সেরকম কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। হরিবাবুর বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর স্কুলের কাছে একটি মেস বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিলাম। কয়েকজন মাস্টারমশাই মিলেই থাকতাম। বেশ কিছু বছর পর ওখানে একটা বাড়ি করি আর দরিদ্র শিক্ষার্থীদের একেবারে স্বল্পমূল্যে বা বলা ভালো বিনা পয়সায় পড়ানোর জন্য একটি কোচিং সেন্টার স্থাপন করি। ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েই আর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে জীবনটা কাটিয়ে দিই। কত রকমের বিচিত্রময় অভিজ্ঞতাই হল। তবে এই অভিজ্ঞতা একেবারেই বিরল। সুন্দরবনের বাড়িটাতে আজও সপ্তাহের শেষে যাই। ওখানে আজও পড়াই। অবশ্য স্থানীয় শিক্ষিত কয়েকজনের ওফর কোচিং সেন্টারের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওঁরাই বেশ ভালোভাবে চালাচ্ছেন। আমি ওই সপ্তাহের শেষে গিয়ে পড়িয়ে আসি, বাকি দিনগুলোর জন্য ওঁরাই আছেন। একদিন যাবেন আমার সাথে সুন্দরবনের বাড়িটাতে। বেশ কিছুদিন কাটালে আপনার বেশ ভালোই লাগবে।" 

— নিশ্চয়ই যাব। আচ্ছা, ওই লম্পট ডাকাতগুলো আর বিরক্ত করেনি তো?

— না ওদের আর ও তল্লাটে দেখা যায়নি। ওরা কোথায় যেন হারিয়ে গেল তারপর।

— আর সেই ব্রাহ্মণমশাই-এর আর দর্শন পেয়েছিলেন? (বেশ উৎসুকভাবেই জিজ্ঞেস করলেন অমলেশবাবু।)

— নাঃ। তাঁর দেখা আর কোনোদিন পাইনি। বেশ কয়েক বছর হল হরিবাবু গত হয়েছেন। বেশ নির্বিঘ্নেই কেটে গেল এতগুলো বছর। কত স্মৃতি মনের অন্দরে জমা হল কিন্তু উক্ত ঘটনার স্মৃতি বা বলা ভালো উপকারী ব্রহ্মদৈত্য ব্রাহ্মণমশাই-এর স্মৃতি একটা দাগ রেখে গেল। সেই ব্রাহ্মণমশাই না থাকলে সেদিন হয়তো ওই ডাকাতদের হাতে শেষ হয়ে যেতাম। জানেন মশাই, আজও সেই ব্রাহ্মণমশাইকে দু'হাত জুড়ে ভক্তি ও শ্রদ্ধাভরে প্রণাম করি।" 

মানিকবাবু ঘটনা বলার পর দু'হাত জুড়ে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন সেই পবিত্র আত্মা রক্ষাকর্তা ব্রাহ্মণমশাই-এর উদ্দেশ্যে। অমলেশবাবুও তাই করলেন।

সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই সেই ব্রাহ্মণমশাইকে। 





Rate this content
Log in