সৈকত আলি
সৈকত আলি
তখন আমার স্বীকারোক্তি করার পালা । বারে বারে ওই শেক্সপিয়ারের কথাটা মনে পড়ছিলো , " দেয়ার আর মোর থিংস ইন দ্য হেভেন অ্যান্ড আর্থ হোরেশিও , দ্যান আর ড্রেমট অফ ইওর ফিলোসফি । "
অলৌকিক বিশ্বাস আমি করতাম না , না করতাম ভগবান বিশ্বাস । গত শনিবার সোদপুরে গিয়েছিলাম এক আত্মীয়ের বাড়ি । বাসস্টপ থেকে রিক্সা ধরে বেশ দশ মিনিট মতো যেতে হয় । সময়টা ধরুন ওই সকাল ৮টা । একটা রিক্সাই দাঁড়িয়ে স্ট্যান্ডে । উদ্দেশ্য বলতে রাজি হয়ে গেলো রিক্সাচালক ।
রিক্সায় উঠে বসলাম মা আর আমি । জিজ্ঞাসা করতে যাবো যে , " কত ভাড়া ? " যদিও যেকোনো ভাড়া চাইলেই দিতে হবে কারণ স্ট্যান্ডে রিক্সা নেই । ওমা ভদ্রলোক মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন , " প্রথম বৌনি আপনি , যা মন চায় দেবেন । "
" দশ দেবো । ঠিকাছে তো ? "
" হ্যাঁ বাবু ঠিকাছে । শুধু তো রিক্সাই চালাই না এই তো বেলা হলে প্লেন চালাবো , দুটো ফ্লাইট আছে আজ । "
মনে মনে ভাবছি " খেয়েছে সক্কাল সক্কাল । "
কিন্তু টালমাটাল ভাব নেই , কথায় জড়তা নেই । পরে ভাবলাম গাঁজা টাজা হলে তো সেসব বোঝা যাবে না ।
আমি পাশের ফ্ল্যাটগুলো হচ্ছে দেখছি । মনে মনে রেট কীরকম হতে পারে প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে । পকেটে মোবাইলে হাতটা সবে গেছে , ওমা লোকটা বলেন শুনি , " এসব তো আমার হাতে বানানো । ২ লাখে তিন বেডরুম দিয়ে দেবো , বলবেন শুধু আমাকে । "
" এ কেমন হলো ? " ভাবছি মনে মনে ।
চমকের বেশকিছু তখনও বাকি । রাস্তার দুধারে টাটকা আনাজ দেখে বেশ ভালো লাগছে । বাড়ির কাছে এতটাও টাটকা সবজি দেখি না ।
" আপনারা যেখানে যাবেন ওইখানে মসজিদের পাশে বাড়ি আমার । আমার বাগান আছে , আপনারা গাড়ি আনলে বোঝাই করে দেবো । "
এবার আমি প্রথম মুখ খুললাম , " তুমি তো অদ্ভুত লোক হে ? একাধারে রিক্সা চালাও আবার প্লেন চালাও , আবার বলছো প্রোমোট করো বাড়ি , এদিকে আবার বাগান আছে বলছো ! "
" ওই আরকি । ভগবান দিয়েছেন । আপনি যদি গাড়ি কেনার কথা ভাবছেন ? এই এলাকায় বড় একটা শোরুম আছে , শুধু ওখানে সৈকত আলির নাম করবেন ব্যাস । "
গাড়ি একটা কিনবো কিনবো মনে করছিলাম অনেকদিন ধরেই । কিন্তু উনি জানলেন কী করে ? বললাম , " তোমার নাম করলে কী হবে ? "
" ওই আরকি একটু কম হবে ? বেশী মাসের ই.এম্.আই করতে পারবে । আমায় সবাই চেনে । "
পথ শেষ হতে দেখলাম তখনও বাকি । বেশ অনেকটা পথ । বলেছিলো অবশ্য সবাই দশ মিনিট লাগবে । মনে মনে খুব খারাপ লাগলো , দশ টাকা ন্
যায্য নয় ।
নামার পর ওকে শটান ত্রিশটাকা হাতে ধরালাম । উনি বললেন , " না বাবু , দশের বেশী আমি নেবো না । কথার নড়চড় করি না আমি । "
" আরে এতটা পথ আমি থুরি জানতাম ! নাও নাও রাখো ত্রিশই রাখো । "
" না বাবু ও আমি নিতে পারবো না । দশ বলেছেন তাই-ই নেবো । "
অগত্যা তাই দিলাম । যে আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম তারা শুনে বললো , " অ্যাঁ দশ টাকা ! কোন রিক্সা গো ? তিরিশের কম নেয় না । "
পরে সব ঘটনা বলতে ওনারা বললেন , " নির্ঘাত ও নেশাভাঙ করেছিলো । নইলে এমন ভাড়া কেউই চায় না আর এমন আজগুবি গল্প কেউই বলে না । "
বেরোনোর সময় মাকে বললাম , " চলো ওই মসজিদের পাশটা দেখে আসি । "
মা বললো , " তোর বাপু বেশী বেশী । "
মাকে জোর করে নিয়ে গেলাম । মসজিদের কাছে এসে একটা লোককে জিজ্ঞাসা করলাম , " সৈকত আলির বাড়ি কোথায় জানেন ? "
" কে ? সৈকত আলি ? ও বুঝেছি । এক সৈকতকে আমি চিনি । সে এই মসজিদের পাশেই থাকতো । কিন্তু দাদা উনি তো বেঁচে নেই । "
" কী বলছেন দাদা ? আরে রিক্সা চালায় , রোগা করে সরু দাড়ি গলা অবধি নেমে এসেছে । "
" হ্যাঁ হ্যাঁ ওরকমই দেখতে । ঠিক বলেছেন , লোকজনকে বলে বেড়াতো প্লেন চালাই ফালাই । একটু মাথার গণ্ডগোল ছিলো । তবে প্রচুর গরীব লোকের সেবা করেছে । ওর বাগান থেকে লাভ হত ভালোই । এখনও খানিক অবশেষ আছে বেঁচে ওই বাগানের । "
" কী যাতা বলছেন ? প্রমাণ আছে কোনো , ছবি কোনো ছবি ? "
" উমম দাঁড়ান । তিনবছর আগের ক্লাবের কালীপুজোর একটা ছবি ... অ্যা এই যো । " বলে ফোনটা থেকে একটা ছবি বের করে দেখালেন ।
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম , " হ্যাঁ ইনি , এনাকেই তো সকালে ... "
" আপনি দেখতে পেয়েছেন নাকি ? "
" বলছি কি একটা অটো ডেকে দেবেন , শরীরটা কীরকম খারাপ লাগছে । "
" দাঁড়ান দাঁড়ান । ওই তো এই অটো । "
তখন আমার গায়ের প্রতিটা রোম কথা বলছে । অটোওলার সাথে শুধু একবার কথা হলো , " কী হয়েছিলো দাদা সৈকত আলির ? "
" রোড অ্যাক্সিডেন্ট দাদা । চিনতাম , বেশ ভালো লোক ছিলো । আমায় প্রচুর হেল্প করেছে । "
আমি সেদিনই স্বীকার করেছিলাম মায়ের কাছে যে সত্যিকারের অলৌকিক বলে কিছু একটা আছে । আমি তারপরেও একবার গেছি ওই আত্মীয়ের বাড়ি , কল্পনা করেছি সৈকত স্ট্যান্ড নিয়ে রিক্সা নিয়ে আসছে । আমি চালকের মুখ দেখে নিয়েছি এই ভয়ে যে সৈকত নাকি ? হয়তো ও জানে আমার মসজিদের পাশে যাওয়ার কথা । একদিন ফের দেখা হবে ।