সাথী
সাথী


চৌকাঠে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে টুটু উঁকি মারছে ঘরের ভেতরে। টুটু আমার খেলার সাথী। তবে ঘরে কিন্তু ঢুকে পড়ছে না হুড়মুড়িয়ে অন্য দিনের মতো। বাবা বারণ করেছে যে, "টুটু, তুমি একদম দিদির কাছে আসবে না, দিদির শরীর খারাপ খুব।"
ও, আমার নামই তো বলা হয় নি। আমি চকলেট। বাবা রেখেছে আমার এই নামটা, আমি চকলেট খেতে খুব ভালোবাসি কিনা! তবে আমি কিন্তু একলা চকলেট খাই না, টুটুকে দিয়েই খাই সবসময়। টুটু আমার থেকে ছোট হলে কী হবে, আমার খুব ভালো বন্ধু, আমার সাথে কত্ত খেলা করে, ছুটোছুটি হুটোপুটি করে। বাবা মাও খুব ভালোবাসে টুটুকে। এখন আমার শরীর খারাপ তো, তাই টুটুকে আমার কাছে আসতে দিচ্ছে না বাবা-মা।
টুটু বাইরে থেকেই করুণ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যায় মুখ নীচু করে। আমি তখনও জ্বরে বেহুঁশ, টাইফয়েডে। ক'দিন পরে জানি না, জ্বরটা তখন একটু কমের দিকে, কমেছে দৃষ্টির ঘোলাটে ভাবটাও... হঠাৎ বিছানার পাশের জানালায় চোখ পড়তেই দেখি কুচকুচে কালো চকচকে চোখ জোড়া মেলে টুটু একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার খুব ইচ্ছে হোলো তখনই টুটুকে জড়িয়ে ধরে চটকে আদর করি, কিন্তু বাবার বকুনির ভয়ে টুটুকে কাছে ডাকলাম না। টুটুও বোধহয় বাবার ভয়েই জানালার বাইরে থেকেই দেখে আমায়, নয়তো দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়েই দূর থেকে কেমন এক মায়াভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই ভালোবাসা জানায়।
এরপর আমি সুস্থ হয়ে উঠতে থাকলাম, প্রায় একমাস পরে আমায় শক্ত খাবার দেওয়া হবে, মাটন স্ট্যু দিয়ে গলা ভাত। এই খাবারটা টুটুরও খুব প্রিয়, মাকে বললাম। মা বললো, "টুটুও খাবে একটু পরে, তুমি আগে খেয়ে নাও।" অতদিন ভুগে তখন আমি একটু খিটখিটে, কাঁদতে শুরু করে দিলাম।
বাবা বাড়িতে নেই, ঠাকুমা ঠাকুরঘরে, বড়মা কোনো কাজে বাইরে কোথায় যেন গেছে আর দাদু তখনও নিজের চেম্বারে রুগী দেখছে। মা দিশেহারা, আমাকে থামাতে পারছে না। টুটু তখনও দু'চোখে করুণ আর্তি নিয়ে চৌকাঠেই দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মূহুর্ত কী ভেবে নিয়ে মা ডাকলো টুটুকে। টুটু ছুট্টে এসে আমার দু'পা চেটে লেজ নেড়ে নেড়ে সে কী আদর! আমার ছোট্ট খেলার সাথী, আমার এই প্রিয় বন্ধুটাকে আমিও আদরে আদরে ভরিয়ে দিলাম।
ঠিক দু'শীত আগের এক সন্ধ্যে হবো হবো সময়ে আমি টুটুকে মুখার্জি বাড়ির পাশের চাঁপা গাছের তলার বাঁধানো বেদীর তলা থেকে তুলে এনেছিলাম। অবশ্যই ওর মা তখন কাছেপিঠে ছিলো না। সেই থেকে টুটু আমার খেলার অক্লান্ত সাথী, পরমাত্মীয় আদরের পোষ্য!
(বিষয়: খেলা)