সাইকেল
সাইকেল
সুধার সঙ্গে শিবশঙ্কর এর বয়েসের তফাৎটা বেশ কিছুটা হলেও, মানসিকতার তফাৎটা যেন আরো বেশি। আর তা যেন দিন দিন বাড়ছে। নামটা যেমন বুড়ো বুড়ো, মেজাজটাও হয়েছে একেবারেই বুড়োটে। বরাবরই তেমনি ছিল, আজকাল যেন আরো বেড়েছে। এই মধ্য পঞ্চাশেই গ্যাস, অম্বল, প্রেসার, সুগার, তার সঙ্গে ধীর স্থির হাঁটাচলা, সামান্য দু চারটে কেজো কথা, তাও যেন না বলতে পারলেই ভালো, বাড়ি থেকে বেরোতে প্রবল অনিচ্ছা - সব মিলিয়ে সত্তরের বুড়ো মনে হয়। সুধার অসহ্য লাগে। সুধার আটচল্লিশের মন প্রাণ এখনো তাজা, বেরোতে, ঘুরতে, কেনাকাটা করতে, বাড়ি সাজাতে, নতুন নতুন পদ রান্না করতে এখনো দিব্যি লাগে। কিন্তু এসব করা কার জন্যে ! কি খেলাম - চচ্চড়ি না চাইনিজ - যে খেয়ালই করে না, তার জন্যে রেঁধে সুখ কোথায় ? আগে তাও বাজারটুকু যেত। মাছ টাছ আনত এটা সেটা নিজে দেখেশুনে। আজকাল সেটুকুতেও অনীহা। সেটাও চাপিয়েছে সব সময়ের লোক দাশরথির ওপর। সকাল থেকে খবরের কাগজটা মুখের সামনে সেঁটে বসে থাকবে। কোনো কথার হুঁ-হাঁ ছাড়া জবাব নেই। যেন দুটো কথা বলাটাও অকারণ পরিশ্রম।
এক কালের কলেজের প্রফেসর শিবশঙ্কর এর মধ্যেই ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিয়েছেন, সুধার আপত্তি সত্ত্বেও। এতো তাড়াতাড়ি রিটায়ারমেন্ট এর কি দরকার ছিল সুধা বুঝতে পারেনা। শিবশঙ্কর এর বক্তব্য ছেলে মানুষ হয়ে গিয়েছে, নিজে রোজগার করে, আর খেটে কি হবে? অতএব আজকাল সারাদিন বাড়িতে বসে খবরের কাগজ, গল্পের বই, দুপুরে খাওয়ার পর একটি দিবানিদ্রা, বিকেলে সামনের পার্ক এ কয়েক চক্কর হাঁটা, সন্ধ্যেবেলা টিভি তে খবর - সুধার কথায় এই "বুড়োটে" রুটিন। ইদানিং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কম্পিউটার এ নানারকম খবর/ নিবন্ধ ঘাঁটা। বেঙ্গালুরু তে চাকরি করা ছেলে বাবা কে একটা ল্যাপটপ কিনে দিয়েছে। শুধু বই, কাগজে চলছিল না! গোদের ওপর বিষফোঁড়া ওই ল্যাপটপ টা দেখলে রাগে সুধার গা রি-রি করে।
সব ব্যাপারেই সুধার উল্টোদিকে হাঁটাই যেন শিবশঙ্করের উদ্দেশ্য। সুধার পছন্দ ঘন দুধ চা, শিবশঙ্কর আজকাল ধরেছেন লিকার চা, দুধ চায়ে নাকি অম্বল হয়! জলখাবারে পাঁউরুটির বাইরে নড়বেন না, বিকেলেও মুড়ি শশা কিংবা সামান্য ফল। অতএব এটা ওটা খাবার বানানো বা খাওয়ার শখ জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে সুধা কে। রেস্তোরাঁ তে গিয়ে খাওয়ারও বালাই ঘুচেছে। যাবে কার সঙ্গে? শিবশঙ্কর কে নড়ানো হিমালয় হেলানোর শামিল। তার স্কুল কলেজ সব বেনারস এ, সেসব বন্ধুরা কেউ কলকাতায় থাকে না। কোনোকালে চাকরি বাকরিও করেনি, চিরকাল ঘর সাংসার নিয়েই থেকেছে। ঘোরা বেড়ানো সবই চিরকাল স্বামীর সঙ্গে। তাছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা রেস্তোরাঁ করার মতো আধুনিক সে কোনোদিনই ছিল না। আর দরকারও পড়েনি। শিবশঙ্কর চিরকাল এমন ছিলেন না। ছোটোখাটো শখ আহ্লাদ মেটানো নিয়ে কোনোদিন সুধাকে অভিযোগের সুযোগ দেননি। বেড়াতে যেতে সুধা ভীষণ ভালোবাসে। এককালে ঘুরেছেও তারা অনেক। আজকাল বেড়াতে যাবার নাম করলে খবরের কাগজ থেকে মুখটুকুও তোলেন না শিবশঙ্কর।
মাঝে মাঝে কান্না পায় সুধার। ভাবতে অবাক লাগে যে এই মানুষটার সঙ্গে এককালে তার প্রেম করে বিয়ে, আর সেও নেহাত জোলো পানসে প্রেম নয়। তাদের সময়কার যাকে বলে বেশ চুটিয়ে প্রেম। সুধার পরিবার দুই প্রজন্ম ধরে কাশীবাসী। সুধা যখন বি. এ. পড়তে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি তে ঢুকেছে, শিবশঙ্কর তখন সেখানে পদার্থবিদ্যায় রিসার্চ করে। পড়াশুনোয় সুবিধে হবার নাম করে সুধা মাঝে মাঝে বান্ধবীদের হোস্টেলে রাতে থেকে যেত। কত সন্ধ্যে তাদের ঝিল এর পাড়ে বসে, ডিপার্টমেন্ট এর ছাদে বসে, সারা ক্যাম্পাস শিবশঙ্কর এর সাইকেল এর রড এ বসে ঘুরে কেটেছে। কখনো কখনো দুজনে মিলে দশাশ্বমেধে সন্ধ্যারতি দেখে ঘড়ি দেখতে দেখতে দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি ফেরা, কখনো শীতের দুপুরে ক্লাস কেটে রাজা ঘাট কিংবা তুলসী ঘাটের সিঁড়িতে বসে বাদামভাজা খাওয়া। সুধার বাড়ি খুব যে রক্ষণশীল ছিল তা নয়, প্রেম করে ধরা পড়লে গর্দান যাবার ভয় ছিল না। কিন্তু তাদের সময়ে ছেলেমেয়েদের আজকালকার মতো এমন খোলাখুলি প্রেম করার সাহস ছিলনা। রাখঢাক টাই দস্তুর ছিল। তারই মধ্যে তারা প্রেমের রসটুকু নিংড়ে উপভোগ করেছে প্রাণ মন ভরে। আজকাল সেসব কথা মনে পড়লে বুক ভেঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ওঠে সুধার। সেই প্রেমের তলানিটুকুও কি থাকতে নেই জীবনে?
এ হেন "বুড়োটে" লোকের গৃহিণী তাই বেশ অবাক হল যখন শিবশঙ্কর বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে বেড়াতে যেতে রাজি হলেন। বন্ধু মানে সমবয়েসী পড়শী দু চারজন, সবারই ছেলেমেয়ে বড়, তবে রিটায়ার আর কেউই করেনি। শিবশঙ্কর পার্কে হাঁটাহাঁটির পর কিছুক্ষন গল্পগাছা করেন এদের সঙ্গে, আর মাঝে মধ্যে সন্ধ্যের দিকে এর তার বাড়িতে আড্ডা বসে। বাকিরা সদলবলে পুজো বা শীতের ছুটিতে কখনো সস্ত্রীক কখনো সপরিবারে বেড়াতে যায়। শিবশঙ্করকে হাড়েহাড়ে চেনে বলে বিশেষ বলেনা যাবার কথা। বললেও শিবশঙ্কর বলেন - "না ভাই এই বয়েসে আর টো-টো করতে বোল না। এক সময়ে অনেক করেছি।"
"এই বয়েস"! হুঁহ। ...এই কথাটা শুনলেই সুধার গা জ্বালা করে।
প্রথমে সুধার একটু অভিমান হয়েছিল তার নিজের এতদিনের আবদার, অভিমান, রাগারাগি কে পাত্তা না দিয়ে শেষে বন্ধুরা বলতে রাজি হলেন বলে। পরে মনকে প্রবোধ দিল - যাক কানা মামাই সই। যাওয়া তো হবে।
বেরোন ষষ্ঠীর দিন। খুব দূরে কিছু নয়। রাঁচি-হাজারীবাগ। দশমীর দিন ফেরা। এখনো মাস খানেক দেরি আছে। কিন্তু এর মধ্যেই শিবশঙ্করের মধ্যে হালকা একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে সুধা। যেন একটা উৎসাহের আভাস। পার্ক এ ১৫ মিনিট বেশি হাঁটা। বাড়িতে আবার একটু যোগব্যায়াম শুরু করেছেন। অবশ্য এটা বেড়াতে যাবার প্রস্তুতি নাকি নিজের গর্তে আরো বেশি করে ঢুকে পড়ার চেষ্টা সুধা জানেনা। সুধার সঙ্গে কথোপকথন সেই হুঁ-হাঁ তেই সীমাবদ্ধ। গোছগাছ করার সময়ে তো সুধা রেগে বলেই ফেলল - "বেড়াতে যাওয়া নিয়েও যদি একটু মন খুলে আলোচনা করতে না পারি তো কাজ নেই আমার গিয়ে। তুমি যাও বন্ধুদের সঙ্গে।" শিবশঙ্কর এর যথারীতি কোনো হেলদোল নেই।
হাজারীবাগ এর টুরিস্ট বাংলোটা ছিমছাম খোলামেলা। লেক দেখা যায়। ফুলে ঘেরা বাগানের ফাঁকে সুরকির রাস্তা। অনেক দিন পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুধা আনন্দে ডগমগ। তিনটি দম্পতি। সকাল থেকে সাইটসিয়িং, দুপুরে কোনো হোটেল বা ধাবাতে খেয়ে নেওয়া, সন্ধ্যেবেলা আড্ডা গান। অনেকদিনের না-পরা ভাল শাড়িগুলো আলমারি থেকে বার করে ইস্তিরি করে এনেছে সুধা। অনেকদিন পর সাজগোজের সুযোগ হয়েছে। কি ভাগ্যিস চেহারাটা এখনো আগের মতোই ছিপছিপে রয়েছে,তাই ব্লাউজ গুলো আলাদা করে গায়ে বাড়াতে হয়নি। শিবশঙ্কর এর মুখেও সেই ট্রেন এ ওঠার থেকে একটা হালকা হাসি ঘোরাফেরা করছে। সুধা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে - যাক, কথা না বলুক অন্ততঃ গোমড়া মুখো বর নিয়ে বেড়াতে হবে না। কথাও যে শিবশঙ্কর একেবারে বলছেন না তা নয়। বেরোবার আগে - "হয়েছে তোমার?", রাতে খেতে যাবার আগে - "যাবে নাকি?" - এই অনেক ! এমনকি খেতে বসে ডাল টা মাংস টা এগিয়েও দিচ্ছেন। সকালে চান সেরে একটা মেরুন শাড়ি পরে বেরোতে একটু বেশি সময় ধরেই যেন তাকিয়ে ছিলেন। কি জানি, সুধার মনের ভুল ও হতে পারে ...
শাড়ি পরে সেজেগুজে সুধা রেডি - শিবশঙ্কর বললেন শরীরটা ভাল লাগছে না, আজ বেরোবেন না। কি আবার হল, সকাল থেকে তো সব ঠিকই ছিল। সুধা চিন্তিত হয়ে পড়লো। বাকিদের প্ল্যান ক্যানসেল করতে বারণ করলেন শিবশঙ্কর। বাকিরা একটু আমতা আমতা করে শেষে বেরিয়েই গেল, ক'দিন এর জন্যে বেড়াতে এসে কে-ই বা হোটেল এ বসে থাকতে চায়। সুধার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আজ জোনা ফলস যাবার কথা। অনেক শখ করে মেরুন শাড়িটা পরেছিল সে। কি আর করা যাবে, শিবশঙ্কর কে একা ফেলে বাকিদের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে বাধো বাধো ঠেকলো। শরীর যদি আবার বেশি খারাপ হয় সে চিন্তাও আছে।
কিন্তু তারপর থেকে আর শরীর খারাপ নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেন না শিবশঙ্কর। সেই যে বইটা নিয়ে শুলেন, একেবারে দুপুরে খাওয়ার আগে উঠলেন। খেয়ে দেয়ে আয়েশ করে একটা ঘুম লাগালেন। সুধার মুখ হাঁড়ি - শরীর খারাপ না ছাই, বুড়ো বর আবার তার গর্তে সেঁধিয়েছে। জোর করে বেড়াতে আনলে যা হয়।
ধাক্কাটা এলো সন্ধ্যে নামার মুখে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সুধারও চোখটা লেগে এসেছিল। ঘুম ভাঙ্গতে দ্যাখে শিবশঙ্কর ঘরে নেই। একতলার ঘরের লাগোয়া বারান্দাটা বাগানের দিকে খোলে। সেখানে আছেন কিনা দেখার জন্যে বারান্দার দরজাটা খুলে বেরোতেই বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলো সুধা।
কোথা থেকে একটা সাইকেল জোগাড় করেছেন শিবশঙ্কর। তার ওপর চড়ে বসে ক্রিং-ক্রিং করে বেল বাজাচ্ছেন হাসিমুখে। এমন অনাবিল হাসি শিবশঙ্কর এর মুখে বহুদিন দেখেনি সুধা। তাকে দেখে বললেন - "আর কি, বসে পড়ো সামনের রড এর ওপর। সেই আগের মতো।"
হতভম্ব সুধার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল - "এই বয়েসে ?"