Biyas Roy

Classics Crime Thriller

4  

Biyas Roy

Classics Crime Thriller

শুয়োর

শুয়োর

4 mins
440


রোজকার মতো সূর্য্যাস্তের পর থেকেই বাংলোর সামনের টানা বারান্দাটায় বসে আছি চা নিয়ে। নদীর জলের কুলকুল শব্দ আর ঝিঁঝির ডাক..... মাঝে মাঝে পাতার সরসরানি, রাতচরা পাখির কর্কশ ডাক। সামনে কুয়াশার চাদরে মোড়া অমাবস্যার জঙ্গল। একটু পরেই বুড়ো চৌকিদার এসে ডাকবে খাবার দেওয়া হয়েছে বলে। এমন সময়ে সেই খুটখাট খড়মড় আওয়াজ টা আবার শুনতে পেলাম। নাহ্ , কাল সকাল হলে ব্যাপারটা দেখতেই হবে…….

আমি এখানে এসেছি মাস খানেক হলো, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেপুটি কনসারভেটর এর পদে বহাল হয়ে। প্রথম প্রথম এই নির্জন নির্বাসনে আমার শহুরে প্রাণটা হাঁপিয়ে উঠতো। এখন অনেকটা অভ্যেস হয়ে এসেছে। সারাদিন কাজের মধ্যে কেটে গেলেও সন্ধ্যের পর থেকে কিছু করার থাকে না। ঘরের আলো খুব জোরালো নয়, বই পড়া মুশকিল। অগত্যা বারান্দায় বসে জঙ্গল এর দিকে তাকিয়ে থেকে কিংবা চৌকিদারের সঙ্গে গল্পগাছা করে সময় কাটে। কখনো চৌকিদারের বাচ্ছা নাতি নাতনি দুটো ওদের ঘরের সামনে খেলা করে। টিমটিমে আলোয় ওদের খেলা দেখি। কখনো বাংলোর ভেতরে, আশেপাশে ঘুরে বেড়াই । অল্প আলো, বাইরে ঝুপসি অন্ধকার, ঝিঁঝিঁ র ডাক , পাতার সরসরানি..... বাংলোর দালানে, হাতায় ঘুরে বেড়াতে বেশ একটা রোমাঞ্চ হয়। জঙ্গলের ভিতর নদীর ধারে কিছুটা উঁচুতে ব্রিটিশ আমলের বেশ বড় বাংলো। উঁচু ছাদ। পাঁচ ছ-টা ঘর, প্রশস্ত বসার ঘর, খাবার ঘর জোড়া মেহগনি কাঠ এর টেবিল। সব ঘরেই পুরোনো আমলের কাঠ এর আসবাব। বেশিরভাগ ঘরই বন্ধ পড়ে থাকে। রোজ রোজ ঝাড়পোঁছ করার সামর্থ বুড়ো চৌকিদারের নেই। গুদাম ঘর জাতীয় এক দুটো ঘরে রাজ্যের অকাজের জিনিস, ভাঙা আসবাব, পুরোনো বাসনপত্র ডাঁই হয়ে আছে। 


 খাবার দাবার এর আয়োজন নিতান্ত সাদামাটা। কোনদিন ভাত ডাল এক রকম তরকারি, কোন কোনদিন ডিম্ বা মুরগির মাংস। মাছ এখানে বিশেষ জোটে না। কাছাকাছি নদী থাকলেও পাহাড়ি খরস্রোতা নদী। আশেপাশে লোকজনের বসতিও বিশেষ চোখে পড়েনি। যা দু এক ঘর আশেপাশে থাকে, নেহাতই গরীব, কাঠকুটো কুড়িয়ে তাদের সংসার চলে শুনেছি । জঙ্গল এখানে বেশ গভীর, বাজার হাট করতে মাইল তিনেক দূরে এক আধা-গঞ্জে যেতে হয়। চৌকিদারই যায়। 


বাংলোর হাতার মধ্যেই চৌকিদার সিয়ারাম তার পরিবার নিয়ে থাকে। পরিবার বলতে অল্পবয়সী পুত্রবধূ আর নেহাত শিশু দুই নাতি নাতনি। সিয়ারাম এর ছেলে মারা গেছে বছর দুয়েক আগে, বুনো শুয়োরের হাতে, বডি নাকি খুঁজেই পাওয়া যায়নি । এসব জঙ্গলে বুনো শুয়োরকে বাঘের থেকেও বেশি ডরায় লোকে। সিয়ারাম এর বয়েস হয়েছে, গত বছর রিটায়ারমেন্ট এর বয়েস পেরিয়েছে। ছেলে বেঁচে থাকলে হয়তো বা তদ্বির করে এই চাকরিখানা তাকে দেওয়ার ব্যবস্থা হতো। বুড়ো বয়েসে তাকে খেটে খেতে হতো না , কিন্তু তার কপাল মন্দ, এখন ছেলের সংসার তাকেই দেখতে হচ্ছে। ছেলে বেঁচে থাকতে এরা কিছুটা দূরে জঙ্গলের মধ্যে থাকতো। ছেলের রোজগারপাতি তেমন কিছু ছিল না, তার ওপর মাতাল, বৌ বাচ্ছার অর্ধেক দিন খাওয়া জুটতো না। ছেলে মারা যেতে এদের নিজের কাছে এনে রেখেছে সিয়ারাম। রিটায়ারমেন্ট এর পরে 'বাবু' দের অনেক ধরাধরি করে মানবিক ভিত্তিতে একটি এক্সটেনশন পেয়েছে। সন্ধ্যেবেলা বারান্দার থামে হেলান দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে এসব বলে সিয়ারাম। ওর জন্যে কষ্ট হয়। আমাদের পোড়া দেশে কত পরিবার এমন কত দুঃখ কষ্ট বুকে চেপে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটায়। ভাবলে বুকটা ভারী হয়ে আসে। 


পরদিন দুপুর থেকে আকাশের মুখ ভার। চারদিক থমথম করছে। আমি দুপুরে খাওয়ার পর আর বেরোইনি। খেয়েদেয়ে একটু গড়িয়ে নিয়ে সবে বাইরে এসে বসেছি.... আবার সেই খড়মড় আওয়াজ টা, জিনিসপত্র পড়ার শব্দও। বাংলোর পেছন দিকের কোনো একটা ঘর থেকে আসছে। সকাল থেকে আলসেমি তে পেয়েছে...আওয়াজ এর উৎস অনুসন্ধান করার কথাটা ভুলেই গেছিলাম। সিয়ারাম কদিন ধরে বলছিল একটা ভাম বাংলোর মধ্যে ঢুকছে… হয়তো সেটাই । সিয়ারাম কে ডেকে সাড়া না পেয়ে অগত্যা নিজেই উঠলাম। যে ঘরটা থেকে আওয়াজটা আসছে সেটা ওই গুদাম ঘরগুলোর মধ্যে একটা। বাইরে থেকে হুড়কো লাগানো থাকলেও তালা লাগানো নেই। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই বেশ বড়ো একটা ভাম জাতীয় জানোয়ার পাশ কাটিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেলো। সিয়ারাম এর অনুমান-ই ঠিক। ওকে বলতে হবে ঢোকার রাস্তাটা খুঁজে দেখতে।


দরজাটা বন্ধ করে চলে আসবো, হঠাৎ চোখ পড়লো মেঝেতে। ময়লা ছেঁড়া কাপড় জাতীয় - মনে হলো একটা জামার অংশ, একটা পকেট রয়েছে। ভামটার লাফালাফি তে গড়িয়ে পড়া কিছু জিনিসের সঙ্গে বেরিয়ে এসে ভামটার পায়ে জড়িয়ে দরজার কাছ পর্যন্ত চলে এসেছে। গড়িয়ে পড়া জিনিসগুলোর মধ্যে একটা ছেঁড়া মাদুর জাতীয় জিনিসে চোখ পড়লো, এতো ধুলো মাটি লেগে আছে যে মাদুর আর তাতে মোড়া জিনিসগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু পাশ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে যে খয়েরি হয়ে যাওয়া মাটি লাগা গোলাকার বস্তুটা সেটা মানুষের মাথার খুলি এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে এগিয়ে গেলাম। কালচে ছোপ ছোপ ময়লা ছেঁড়া জামার অংশ বিশেষ এখনো গায়ে জড়ানো, দাগ গুলো রক্তের না মাটির বোঝা দায়। কঙ্কাল টা বেশ লম্বা, পূর্ণবয়স্ক পুরুষের বলে মনে হোল । 


ঘোর ভাঙলো পেছনে সিয়ারাম এর গলা শুনে.....

কান্না বোজা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফ্যাসফ্যাসে গলা....


-“আমি রিটার কল্লি চাকরিটা তাকে দেবার জন্নি বড়োসাহেব কে ধরেকরে এসিছিলো , সত্যি মিথ্যে জানিনা বাবু। বৌ বাচ্ছা গুলোরে খেতি দিতো না, মারতো । আমারে ভয় দেখাতো তাড়িয়ে দেবে।“


-“তুমি যে বলেছিলে বুনো শুয়োর? বডি .... পাওয়া .... যায়নি…..” - আমার গলাটা ক্রমশ বুজে আসে…


 - “শুয়োরই তো বাবু.... দালানে হরিণ, শুয়োরের মাথা গুলো সাজানো আছে দেখেননি? ওই বড়ো দাঁতটা দিয়েই তো...তখন সে নেশায় চুর, ভালো করে দাঁড়াতি পজ্জন্ত পারছে না। মাথাটা কেমন যেন হই গেল। “


কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার পর গলার স্বর খুঁজে পাই। 

- “জঙ্গলে পুঁতে দিলে না কেন সিয়ারাম?”

 - “দিয়েছিলুম বাবু, বেশি গভীর গত্ত খুঁড়তে পারিনি, শরীলে সে সামথ্থি নেই। শেয়ালে টেনে তুলিছিল। বৌটা বল্লে ইদিকের ঘরে তো কেউ আসে না....”

বাইরে শোঁ শোঁ শব্দে ঝড় শুরু হলো। সিয়ারাম মাথাটা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদছে। আমি আলতো করে ওর পিঠে হাত টা রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।


Rate this content
Log in

More bengali story from Biyas Roy

Similar bengali story from Classics