রক্ত মাংসের পুতুল------
রক্ত মাংসের পুতুল------
মেয়েটা পুরুতঠাকুর ভেবে এক ঘোমটা কাপড় টেনে বিয়ের সপ্তম দিনে দক্ষিণ দিকের মাটির ঘরে ঢুকতেই, এক নিমিষেই মরে গেলো তার পুতুল বাটি সংসারের সাধ...!
তারপর স্বামী বলে যে মানুষটাকে পুজো দেয়ার সমাজে আগুন রীতি, সেই মানুষটাকেই মনে হতে লাগলো নোংরা জলের কালো সাপের মত.. !
দু-রাত অচেতন থাকার পর যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন নিজেকে স্রেফ এক বর্ষা জলের পাট ক্ষেতের উপর ভেসে থাকা জ্যান্ত লাশের মত মনে হয়েছিলো ! সাত গাঁয়ের মানুষ এসে তখন ঘিরে দাঁড়িয়ে বিনে পয়সায় এক টিকিটের দুই ছবি দেখছিলো...!
সেদিন কোনমতে নিজেকে সেই যে দাঁড় করালো শুক্লা মুখার্জি, তারপর থেকে এই সমাজকে থোড়াই কেয়ার... !
রাতের ট্রেনে চেপে সোজা সোনাগাছির ঘিঞ্জি গলি ! যে শরীর মরতে মরতে বেঁচে গেছে তার প্রতি ওয়াক থু...!
শহরের বাবুগুলো অন্তত নিজের স্বামীর থেকে ঢের ভালো, খুবলে খেলেও মায়া করে খায়, ভোতকা গন্ধ মুখে নিয়ে খোঁপায় বেলীফুলের মালা পড়ায় ! বিনিময়ে পয়সা মেলে, মাঝে সাঝে রঙ্গিন কাপড়...! এভাবেই দিনগুলো সময়ের বৈঠা বেয়ে বেয়ে কেটে যাচ্ছিলো.... !
পাড়ায় শুক্লার বেশ কদর আজকাল, পরশু এসে মাসি বলে গেছে, "এখন থেকে তোর রেট পঞ্চাশ টাকা বেশী, খদ্দেরদের বলে দিবি "..!
আজকাল একটা অদ্ভুত ব্যপার লক্ষ্য করছে পাড়ার সবাই, একটা শুটকো মতন ছেলে প্রায় প্রতিদিন শুক্লার ঘরে আসছে, ঠিক রাত দশ বেজে কুড়ি মিনিট...! শুক্লাও সেই সময় অন্য খদ্দেরদের মুখের সামনে সপাটে দরজা এঁটে দিচ্ছে..!
অজয়, একটা গাড়ির ওয়ার্কশপে কাজ করে, পয়সা কড়ি বেশ ভালোই কাটে রোজ ! তিন কুলে আছে বলতে, দক্ষিণ কোলকাতার বস্তি বাড়িতে পাড়ার এক নেড়ি কুকুর ! অজয় ওকে ভালোবেসে টাইগার বলে ডাকে ! রাতে বাড়ি ফেরার আগে পর্যন্ত ঘরের দরজায় টাইগার অপেক্ষা করে বসে থাকে, অজয়কে দেখলেই দু-পা উঁচিয়ে জড়িয়ে ধরে...! মানুষের চাইতে ওরা ভালো বন্ধু আজকাল অজয়ের কাছে, অন্তত পেছন থেকে তো কাটে না...!
রোজ রাতে এসে চুপচাপ মাথা নিচু করে বাংলা খেয়ে অপলক শুক্লার দিকে তাকিয়ে থাকে অজয় ! প্রথম প্রথম শুক্লা ছেলেটাকে অন্য সব খদ্দের ভেবে বুকের কাপড় ফেলে দিতো, কিন্তু ছেলেটা নির্বিকার হয়ে সেই কাপড় তুলে দিয়ে শুক্লার চোখে চোখ রেখে বলতো,
" একটা পান খাওয়াবি শুধু, আর কিছু না "..!
শুক্লাও আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলো ! রোজ নিয়ম করে রাত বারোটা অব্দি গল-গল করে শুক্লা কথা বলে যায়, আর অজয় ঘরের কোনে তেলচিটে বালিশে মাথা রেখে চুপ করে শোনে ! মাঝে মাঝে এটা-ওটা শুক্লার পছন্দের খাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে অজয়, তারপর দুজন মিলে খুব তৃপ্তি করে খায়...!
এযেন এক আজব সংসার, দুজনেই কেমন মুখিয়ে থাকে দিনের শেষে এই সময়টার জন্য.... !
আজ দীপাবলির রাত, অজয় আসবে বলে, শুক্লা এই প্রথম ঘরে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়েছে ! নিজের হাতে নারকেলের নাড়ু, লুচি,খাসির মাংস রান্না করেছে ঘরের ভেতর লুকিয়ে লুকিয়ে ! কাল সারারাত টানা খদ্দের টেনেছে আজ বাজারের খরচার জন্য ! সারাদিন রান্না করে, খদ্দের সামলে বিকেলের দিকে চান করে মাসিকে গিয়ে বলে এসেছে, আজ আর কোন লোককে যেন না পাঠায় ঘরে ! মাসি মুচকি হেসে শুধু শুক্লার গালে ঠোক মেরে বললো,
" মাগী, প্রেমে পড়েছিস, তুই তো মরবি রে হারামজাদি "...!
শুক্লার চোখে তখন অদ্ভুত এক সুখ খেলে গেছিলো...!
রাত দশটা কুড়ির আগেই আজ অজয় ঘরে ঢুকেছে ! অনেক্ক্ষণ ধরে দুজনেই চুপ করে বসে আছে, বাইরে একটু পরপর টাকার আগুনে আকাশ লাল নীল রঙ্গিন হয়ে উঠছে..!
অজয়ের আনা নীল শাড়িতে সেই আলোয় শুক্লাকে কেমন মায়াবতী মায়াবতী লাগছে..!
রাত যখন প্রায় বারোটা, তখন হঠাৎ অজয় হুট করে এসে দরজা খুলে বেড়িয়ে যেতে ছুটতেই, শুক্লা খপ করে অজয়ের হাত ধরে বুকের শার্টে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ! অজয় তখন ক্ষেপে গিয়ে ধাক্কায় সরিয়ে দিতে চাইলেই, শুক্লা অজয়ের চোখে চোখ রেখে বললো,
" আমি রাজি, কিন্তু এতোগুলো টাকা কোথায় পাবে তুমি..?"
অজয় তখন সুখের ঘোড়া, হাতের তালুতে শুক্লার মুখ উপরে টেনে বললো, "সে হয়ে যাবে ঠিক, আমি সব ব্যবস্থা করে নিয়েছি "!
শুক্লা তখন অজয়ের জামার বোতামে হাত বোলাতে বোলাতে চোখ বন্ধ করে সোহাগি সুরে বলে উঠলো,
" আমার কিন্তু একটা রক্ত মাংসের পুতুল চাই.."!
হো- হো করে পাড়া কাঁপিয়ে হেসে উঠলো অজয়...!
বাইরে তখন হাজার আলোয় রাতের আকাশ...!
এরপর অনেকটা দিন, সাত সাতটি বছর কেটে গেলো ! শুক্লার ছেলের বয়স এখন প্রায় ছয়, সাউথের এক ভালো স্কুলে পড়ছে ! ঝর্ণার মতো কুলকুল সুখ ভেজা ছোট্টো ঘরে হঠাৎ যেন একরাতের জোয়ার এসে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেলো সব...!
মেশিনের ভেতর অজয়ের হাত কেটে সেই থেকে ইনফেকশন, তারপর পুরো হাতটাই কেটে বাদ...!
সাত সাতটা বছর দীপাবলির আলো বড্ড আদরের ছিলো শুক্লা-অজয়ের ঘরে, কিন্তু এবারের আতশ আলোয় কেমন আঁধার হয়ে রইলো সেই ঘর... !
শুক্লা ছেলেকে পাড়ার বাচ্চাদের সাথে কটা তারাবাতি দিয়ে খেলতে পাঠিয়ে, চৌকাঠের প্রদীপের আলোয় হাঁটু শুইয়ে বসলো অজয়ের পায়ের সামনে ! অজয়ের চোখ দিয়ে তখন জল গড়িয়ে পড়ছিলো, শুক্লা তার ডান হাতের তালুতে সেই জল মুছে দিতে দিতে, হাসতে হাসতে বললো," তোমার পায়ে ধরি, তুমি আমায় না বলো না ! আমি তো আগেও শরীর খুলেছি বাইরে, তাই দেখেই তো তুমি আমায় একটা সংসার দিলে, আজ এই সংসার ভেসে গেলে আমাদের আর থাকলো কি বলো"...?
সেদিনের সারারাতের আকাশে ঠিক কতো টাকার আলো পুড়েছিলো তা জানা নেই, তবে একশো স্কয়ারফিটের একটি সাজানো সংসার বিক্রি হয়ে গেলো শুধু তিনটি পেটের দায়ে....!
শীতের প্রায় শুরু, দীঘার হোটেল ঘরের তিনটি কামরায় চারটা ছেলে..! এক ঘরের বিছানা সুন্দর করে ছিমছাম পাতা, পাশের জানালায় চোখ রাখলেই রাতের সাগরের নেশা ধরা রুপ ! বিকেল বিকেল এসেই জিনিসপত্র কিনে ছেলেরা রান্না চড়িয়েছে হোটেল কামরার কিচেনে, চিকেন, মটন, গ্রীল, আরও কতো কি...!
ঢেঁকুর তোলা তৃপ্তিতে ধবধবে সাদা বিছানায়, শুক্লা তখন সেই বর্ষাজলে ভেজা পাটক্ষেতের মৃত শরীর...!
প্রায় মাঝরাতে সাগর খুব শান্তির নিঃশ্বাসের মত ! সেই নিঃশ্বাসের শব্দে একটা টেপরেকর্ডার অন করার শব্দে চারপাশের কারও তেমন কিছু এলো গেলো না ! রেকর্ডারের রিলের ফিতে তখন কৃষ্ণ চক্রের মতো ঘুরছে, আর সেই ঘুর্নায়মান শব্দ যন্ত্রে একজন শুক্লা মুখার্জির কাঁপা কাঁপা নেশার কণ্ঠ, সুর তুলে অগ্নি মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করছে,
" আই লাভ ইউ অজয়,
আই লাভ ইউ অজয়,
আই লাভ ইউ অজয় ".......!
ভোরের সূর্যকে সাগরের বুকে দেখবে বলে সুখী মানুষের ভিড় কোলাহলের মাঝে, সেই শব্দ দেবী-শ্লোক হয়ে বাতাসের ভেসে ভেসে সূর্যের আলোর আগেই এক অদ্ভুত পবিত্রতা ছুঁয়ে দিচ্ছে তরঙ্গ উর্বশী সাগরের জলে......!