রবি সহায়
রবি সহায়


রাজেশের মাথায় জল পট্টি দিতে দিতে মহেশ্বরী দেবী মনে মনে বলছেন,"হে ভগবান তুমি কি হতভাগিনীকে কোনদিন ও মুখ তুলে চাইবে না,আমি কত পাপ করেছি ভগবান।.....আজ দুদিন হলো ছেলেটার জ্বর, ওষুধ কেনার টাকা তো দুরের কথা,সাবু কেনার মতো টাকাও নেই।আর একটা ছেলে তো সারাদিন পাগলের মতো কবিতা গান নিয়ে পড়ে আছে....."
এমন সময় পাশের রুম থেকে ভেসে এল এক তন্ময় কন্ঠের গান-----
"আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...."
আর স্থির থাকতে পারলেন না মহেশ্বরী দেবী। পাশের রুমে গিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন----
"আমি মরলে বুঝি তুমি এই পাগলামো থামাবে,তাহলে এক্ষুনি যাচ্ছি ডুবে মরতে....।"
বাস্তব জগতে ফিরে এলো সুজয়। রবীন্দ্র মায়ায় রচিত রবীন্দ্রলোকের দুনিয়া থেকে
বাস্তবের মাটিতে পদার্পণ করে সে দেখল যে একজন অপরাধী;যে ভাইয়ের ওষুধের ব্যবস্থা না করে, দুপুরে অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা না করে রবীন্দ্র ভেলায় চড়ে রবীন্দ্র লোকে বিচরণ করছে।
অপরাধের অভিব্যক্তির দরুন লজ্জার শিহরণ খেলে গেল সুজয়ের সারা শরীরে;--"রাজেশের জ্বরটা বুঝি কমেনি?"
____"তাতে তোমার আর কী! কাব্য চর্চা ছেড়ে অন্য কথা ভাববার সময় আছে তোমার?...."
রুপকথার গল্পে যেমন রাক্ষুসীদের সোনার কাঠির ছোঁয়ায় ঘুমন্ত রাজকন্যা জেগে ওঠত তেমনি ভাবে মানুষ যখন একা থাকে তখন তার নির্জন অবস্থা মনের স্মৃতি গুলোকে জাগিয়ে দেয়। সুজয়ের মনে পড়ল তার মা মহেশ্বরী দেবী কত কষ্ট করে তার কলেজের ফিস জোগাড় করতো, একসাথে চারটি বাড়িতে কাজ করে তাকে শহরের পড়াশোনা করিয়েছে। কলেজ পাশ করার পর সুজয় ভেবেছিল "এরপর মায়ের দুঃখ ঘুচে যাবে, শুধু আমার একটা চাকরি জোগাড় করার অপেক্ষা"। কিন্তু সেই অপেক্ষার অবসান আজ ও ঘটেনি। চাকরির মন্দা বেষ্টিত সমাজ সুজয়ের ভাবনা ব্যঙ্গ করে চলেছে আজ ও।
বেকারত্বের অফুরন্ত সময়ে সুজয়ের সঙ্গী হয় ওঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান।যখন রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতা পাঠ করে সুজয় তখন বাস্তব জগতের সাথে তার সম্পর্ক যেন আপনার আপনি ছিন্ন হয়ে যায়,সে পৌঁছে যায় এক সাদা মেঘের দেশে, যেখানে মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারিদিকে শুধু রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ।তখন নিজেকে ভুলে যায় সুজয়।এমন অনেক দিন আছে সুজয় বাজারে গিয়ে বাড়ি ফেরেনি,মহেশ্বরী দেবী তার খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন সুজয় রাস্তার পাশে ছোট্ট বন কিংবা মাঠে দাঁড়িয়ে বা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে চলেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গান। এমন অনেক দিন আছে রুমে বন্ধ হয়ে সারাদিন ধরে চলছে রবির সৃষ্টি বন্দনা
দু মাস পর।দৃঢ় সংকল্প নিয়ে নিয়েছে সুজয়।আজ রবীন্দ্রনাথের নাগপাশ থেকে সে মুক্ত হবেই। রবীন্দ্র রচনাবলী,সঞ্চয়িতা,গল্পগুচ্ছ গুলো
বিসর্জন দিতে নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে সুজয়।
নদীর কলকল ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে-
"আমাদের ছোট নদী চলে এঁকে বাঁকে...."__
না, না, আজ যে তাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে এই মায়া থেকে মুক্ত হতে হবে।
____"নমস্কার, মহাশয় একটু শুনবেন"
একটা অচেনা কন্ঠস্বরে পিছন ফিরল সুজয়।দেখল একজন প্রৌঢ় ও একটি কিশোর তার পিছনে দাঁড়িয়ে।
___"নমস্কার, কিছু বলবেন আমাকে"
___"আমার নাম রথীন বিশ্বাস, আপনাদের পাড়ার ভবতোষ বাবুর আত্মীয়, আমি একটা বিশেষ কারণে আপনার কাছে এসেছি,যদি আপনি দয়া করে আমার কথাটা শুনেন..."
__"হ্যাঁ, বলুন"
___"এই ছেলেটি আমার নাতি রাহুল, ও আপনাকে একদিন রাস্তার ধারে রবীন্দ্র সংগীত গাইতে ও কবিতা পাঠ করতে শুনেছে,সেই থেকে বায়না ধরেছে আপনার কাছে রবীন্দ্র সংগীত ও রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তি শিখবে,বড্ড জেদী ছেলে,ওর মাথায় যা ঢোকে ও সেটা নিয়ে ছাড়ে,দয়া করে আপনি যদি ওকে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা শেখাতে রাজি হয়ে যান তাহলে বড় নিশ্চিত হতে পারি,টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করবেন না, আপনি যা বলবেন আমি তাই দিতে রাজি আছি।"
___" ক্ষমা করবেন আমি রবীন্দ্রনাথকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসি, হৃদয়ের ভালোবাসা কে আমি টাকা পয়সায় ওজন করতে পারবোনা আর তাছাড়া আমাকে কাজের খোঁজে শহরে যেতে হবে,"(একটা মুটে বইবার কাজ ও আমি হাতছাড়া করবো না,মাকে এবার বিশ্রাম দিতেই হবে আর রাজেশের কলেজের ফিসটাও জোগাড় করতেই হবে __মনে মনে বলে যায় সুজয়।)
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রথীন বাবু বললেন__"ঠিক আছে আমি আপনাকে আপনার ভালোবাসাকে ব্যবসায় পরিণত করতে চাইনা, আপনি স্বেচ্ছায় আমার নাতিকে আবৃত্তি ও গান শেখাবেন, আর আমি আমাদের কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করবো। আপনি তো শহরেই যাচ্ছেন।আপনি আমাদের মৌবাজারে চলুন, ওখানে আমার কোম্পানিতে আপনার কর্ম সংস্থান করে দেবো,আর আপনি সময় পেলে আমাদের বাড়িতে এসে রাহুলকে আবৃত্তি ও গান করিয়ে দিয়ে যাবেন.."।
আকাশে উড়ে চলেছে ধবল বক, সাদা মেঘের ভেলা ছুটে চলেছে আকাশে,আর তাতে এক নতুন রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পেল সুজয়। রবীন্দ্র-বিসর্জন করতে আসা সুজয়ের মনে নতুন করে রবীন্দ্র বোধন করে দিলেন দুর শহরের এক অজানা প্রৌঢ় রথীন বাবু।