Sanhita Ghosal

Abstract Romance

4.0  

Sanhita Ghosal

Abstract Romance

পুরী ও রঘুরাজপুর

পুরী ও রঘুরাজপুর

4 mins
414



আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে স্কুল ছুটির পর পিঠে ঝোলা চাপিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বর্ষায় সমুদ্র দেখতে।পুরী যাব বলে সকাল বেলায় ব্যাগ গুছিয়ে সোজা স্কুলে গেলাম। এরপর সারদিন ক্লাস নেওয়ার পর ক্লান্ত শরীরে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছোলাম। সন্ধ্যা সাতটায় হাওড়া স্টেশন থেকে জগন্নাথ এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা। আমি রাতের খাবার কিনে অপেক্ষা করতে লাগলাম ট্রেনের জন্য। আমি একাই ট্রেন ধরব। আমার স্বামী দিল্লিতে কর্মরত। তাই একা ট্রেন ধরা। হুম মনে হতে পারে একা পুরীর সমুদ্র দর্শন? আছে আছে গল্প অনেক বাকি আছে।

   ওমা, সন্ধ্যা সাতটা পনেরো বেজে গেল ট্রেন ক‌ই? আমার দুশ্চিন্তা দূর করে দীর্ঘদেহী যান্ত্রিক শুঁয়োপোকা প্ল্যাটফর্মে এল। শুরু হল ডার‌উইনের মতবাদ পরীক্ষা করে দেখা, মানে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম পরীক্ষা করার। ঠেলাঠেলি করে ট্রেনে উঠে সিট খুঁজে বসে তবে শান্তি।সাইড লোয়ার এসি টু টায়ার।উফ্ আমার প্রিয় সিট।পা মেলে দিয়ে বসলাম এস ওয়াজেদ আলীর ব‌ই ' পশ্চিম ভারত' নিয়ে। ট্রেন ছাড়ল সাতটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে। ট্রেনের কোলে দুলতে দুলতে পেরিয়ে গেলাম একেরপর এক স্টেশন এবং সঙ্গে আমার ব‌ই। শুরু হল আমার দারুন সফরনামা। সাড়ে নয়টায় অনুভব করলাম পেটে ছুঁচো মশাই এর অস্থিরতা। হাওড়া স্টেশনে কেনা খাবারগুলো পেটে চালান করে দিয়ে ছুঁচো মশাইকে ঘুম পারালাম।ওমা আমার দুই চোখে ঘুম পরীরা তখন নাচ করতে শুরু করেছে।রাত দুইটায় অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। অ্যালার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে গেছে। চেয়ে দেখি ট্রেন ছুটছে অন্ধকার ভেদ করে। মাঝে মধ্যে আলোর ঝলকানি।এর ঘন্টা খানেক পর ভূবনেশ্বর পৌঁছোলাম। স্টেশনে তখন অপেক্ষারত আমার স্বামী। আসলে যে মানুষটির হাত ধরে ঘুড়ে বেড়ানোয় হাতে খড়ি তাকে ছাড়া ঘোরা অসম্ভব। কর্মক্ষেত্রের জন্য আলাদা থাকা।দিল্লি থেকে সোজা উড়ে হাজির ওখানে। 


    স্টেশনে মুখ হাত ধুয়ে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম কোনারক মন্দির দেখতে। মন্দিরের বহু অংশ দূষণের গ্রাসে। দুজনে ছোট বেলায় দেখা কোনারকের স্মৃতির টুকরোগুলো বারবার দেখে নিতে চাইছিলাম আর বারবার এটা বলছিলাম হয়তো আর কয়েক বছর পর এটাও ইতিহাস ব‌ইএ ছবি হয়ে থেকে যাবে। সমুদ্র সৈকতের দিকে গিয়ে নোনা হাওয়ায় ভারী হয়ে যাওয়া মনটাকে খানিকটা হাল্কা করে পুরীর উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়লাম। সকাল নয়টায় হোটেলে ঢোকার পর সমুদ্রে স্নানের উদ্দেশ্যে গেলাম। স্নান যত না হল উত্তাল সমুদ্র দেখে বেলাভূমিতে বালি নিয়ে ব্যস্ত থাকা শ্রেয় মনে হল‌ আমার। আসলে ছোট বেলায় ডুবে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এখনও ভুলতে পারিনি। তারপর মধ্যাহ্ন ভোজের পর এক ঘুম দিয়ে সন্ধ্যায় পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির দর্শনে গেলাম।বিগ্রহ দেখা গেল না। স্নান যাত্রার পর জ্বর হয়েছে ওনার। আসলে কোয়ারেন্টাইন চলছে। ওনাকে বিরক্ত না করে গুন্ডিচা মন্দিরে গেলাম। এখানে রথযাত্রা করে এসে জগন্নাথ দেব অবস্থান করেন। হোটেলে ফিরে এসে রাত কাটিয়ে পর দিন খুব তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে পূজো দিয়ে দেখতে গেলাম রথ তৈরী। কতজন লোক মিলে কি অসম্ভব সুন্দর করে তৈরী করছেন রথ।

     আমার পতিদেবতার মাথায় হঠাৎ তখন মনে হল পুরীর কাছে অন্য কোথাও যাওয়া যায় কিনা। এক্ষেত্রে ভরসা গুগল মামা। আমরা ঠিক করলাম রঘুরাজপুর যাব।পুরী থেকে ১৪ কিমি দূরে।অটো করে পৌঁছোলাম রঘুরাজপুর। উড়িষ্যার পটচিত্রের গ্রাম। আরেকটি পরিচয়‌ও আছে,ওড়িশি নৃত্য শিল্পী গুরু কেলু চরণ মহাপাত্রের জন্মস্থান।অটো করে পৌঁছে যেই এক দুটি দোকানে ঢুকেছি ড্রাইভার গোঁ ধরল তার চেনা দোকানে যেতে হবে। অগত্যা তাকে মূল্য দিয়ে বিদায় করলাম। আমরা এবার দুজনে গ্রামের এক একটি বাড়ি ঘুরে দেখলাম। গ্রামের মানুষ অত্যন্ত সরল এবং আন্তরিক ভাবে দেখাতে লাগলেন কিভাবে তাল পাতার ওপর কালি দিয়ে আঁকা হয়।তবে এখানের পটচিত্রের সাথে পশ্চিম বঙ্গের পটচিত্রের পার্থক্য আছে। এখানের পটচিত্র মূলত মহাকাব্য,দেব-দেবীর উপাখ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের পটচিত্রে সামাজিক জীবনের ছবি পাওয়া যায়। ঘরের দেয়ালে সুন্দর করে শ্রী কৃষ্ণ লীলা,দশ অবতার কাহিনী, রথযাত্রা চিত্রিত আছে। অনেক শিল্পী রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রাপ্ত কিন্তু শিল্প সংরক্ষণ ও বিস্তারের সুযোগ কম বলে তরুণ প্রজন্ম খানিক হতাশাগ্রস্ত, তবে লড়াই তারা আজ‌ও করে চলেছে এই শিল্পকে ধরে রাখতে।তিন ঘণ্টা সময় কাটিয়ে টুকরো কিছু সংগ্রহ করে শুভেচ্ছা জানিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম আর বলে এলাম আবার দেখা হবে কারণ দিল্লি ও কলকাতায় বিভিন্ন মেলায় ওনারা আসেন, তাই সুযোগ রয়েছে দেখা হ‌ওয়ার।

   দুপুরের খাবার খেয়ে সোজা দৌড় মন্দিরে ধ্বজা উত্তোলন দেখতে।কি অসীম দক্ষতায় মন্দিরে ধ্বজা উত্তোলিত হল। তারপর প্রসাদ নিয়ে হোটেলে এসে দেখি উনি নেই। বিস্তর খোঁজ করে দেখলাম সমুদ্রের নানা ভঙ্গিমা উনি ফ্রেম বন্দী করতে ব্যস্ত। আমার তাড়া লাগানোয় খানিক হতাশ হয়ে হোটেলে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে বের হল।পুরী এক্সপ্রেস ধরলাম। ট্রেনের গতি বৃদ্ধির সাথে সমানুপাতিক হারে মন খারাপ বৃদ্ধি পেল।ভূবনেশ্বর আসতে মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো।ও নেমে গেল স্টেশনে আর আমি হাওড়ার উদ্দেশ্যে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে হাত নেড়ে বেড়িয়ে গেল আর রেখে গেল দীর্ঘ প্রতীক্ষা। ট্রেনের সিটে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লাম । ঘুম ভাঙলো ওর ফোনে। দিল্লিতে প্লেন ল্যান্ড করেছে। আমি তখন ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম হাওড়া ঢুকছি। সকালে হাওড়ায় নেমে আমি ঢুকে গেলাম ছক বাঁধা জীবনে , ছুটে গেলাম আমার অন্যতম ভালো লাগার জায়গা আমার স্কুলে ছাত্রীদের মাঝে।আর এই দুটি দিন ভ্রমণ পিপাসু মনের তৃষ্ণাকে পরিতৃপ্ত করে দিয়ে গেল।আজ ঠিক দুই বছর পর আমি সেই স্মৃতি আবার দেখলাম।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract