Sanhita Ghosal

Inspirational Others

4.0  

Sanhita Ghosal

Inspirational Others

বিদায় উপহার

বিদায় উপহার

3 mins
693


             

              

আজ আমার বিদ্যালয়কে বড় অচেনা লাগছে। সারা বাড়ি কত রকম কাগজ ফুলে সেজে উঠেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকার সময় আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। আসলে দীর্ঘ তিরিশ বছর আর কয়েক ঘণ্টা পর ধূসর অতীত হয়ে যাবে আর সঙ্গে নিয়ে যাব হাসি কান্নার ,মান অভিমানের স্মৃতিপট।এই সব ভাবতে ভাবতে বিদ্যালয়ের মাঠ ধীরে ধীরে পেরিয়ে যেতে থাকলাম। বর্ষার জলে মাঠের ঘাসগুলো আরো সবুজ হয়েছে।নরম কলেবর নিয়ে আমার পা দুটো যেন পরম স্নেহে শেষ বারের মত জড়িয়ে ধরতে চাইছে।সব কিছু পিছনে ফেলে আমি এগিয়ে যাচ্ছি আমার ঘরের দিকে। ঘরের সামনে গিয়ে দেখি কত কচিকাঁচাদের ভীড়।প্রত্যেকে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ভেবে আশ্চর্য লাগছে আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ওদের দলে আমিও ছিলাম। অপেক্ষায় ছিলাম আমাদের প্রিয় সুতপাদিকে শেষদিনে শেষ বারের জন্য দেখার আশায়।আর আজ আমি সুতপাদির জায়গায়। আজকের দিনটার মত সেদিন‌ও কি  সুতপাদি মনে মনে ভেঙেচুরে গিয়েছিলেন নাকি শুধু এই সময়টাকে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন অখন্ড অবসরের দিকে। সেই প্রশ্নের উত্তর আজও আমার কাছে নেই। ছাত্রীদের শ্রেণীকক্ষে যেতে বললাম সাথে আশ্বাস দিলাম অনুষ্ঠানের পরবর্তী সময়ে ওদের সাথে কথা বলব।এরপর বিদ্যালয়ের কার্যভার হস্তান্তর করলাম আমার অনুজ কাজরী রায়ের হাতে। অন্যান্য শিক্ষিকা ও অশিক্ষক কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা সভা শেষে ওদের অনুরোধে বিদ্যালয়ের মঞ্চের দিকে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম।এই বিদ্যালয়ের মঞ্চটি আমি আসার পর তৈরী হয় ।আর সেই মঞ্চে আমার কর্মজীবনের শেষ দিন উদযাপন। বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা একে একে নাচ, গান, আবৃত্তি করল। শিক্ষকতাকালে এক সময় ক্লাসে গণিত, রসায়নের মত বিষয় ছাত্রীদের হৃদয়ঙ্গম করাতে আমি যে ভাবে ব্যস্ত থাকতাম সেই আমি আজ মঞ্চে নিস্প্রভ হয়ে বসে আছি। ছাত্রীরা আমার সাথে কাটানো সময়কাল সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করছে।আর ওদের দেখে আমার মনে হচ্ছে আমার অস্থি- চর্মসার দেহ হয়তো সমাপ্তির পথযাত্রী, কিন্তু আমার ছাত্রীরা সেই আলোকবিন্দু যাদের মধ্যে দিয়ে আমি দীর্ঘকাল এই সমাজের বুকে থেকে যাব।এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। এরপর এই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা কাজরী রায় ঘোষণা করলেন,"আজ আমরা সত্যিই ভারাক্রান্ত। আমাদের দীর্ঘদিন বটবৃক্ষের মতো আগলে রাখা আশাদি আজ বিদ্যালয়ের কর্মজীবন শেষ করতে চলেছেন। বিদ্যালয়ের সকলের পক্ষ থেকে ওনার জন্য র‌ইল শুভ কামনা।আর ওনার ছাত্রী তথা এই বিদ্যালয়ের নব নিযুক্ত শিক্ষিকা তরুলতা দাস ওনার সম্পর্কে কিছু কথা বলবে। আমি ওনাকে অনুরোধ করছি মঞ্চে এসে বলার জন্য।"

তরুলতা মঞ্চে এল। ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল," দিদির প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। তবে দিদির উৎসাহে গণিত নিয়ে পড়া এবং এই বিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষিকা হ‌ওয়া।এই দিনে দিদিকে আমি বিশেষ উপহার দিতে চাই।আশা করি সবাই আমার পাশে থাকবে।"এই পর্যন্ত বলে একটি ছোট বক্স থেকে একটি চাবি বের করে ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এল। আমার পা স্পর্শ করে আমার হাতে চাবিটা দিল। আমি তো অবাক, মাত্র এক সপ্তাহ আগে বিদ্যালয়ের নতুন তৈরী হ‌ওয়া গণিত গবেষণাগার গুছিয়ে তার হাতে যে চাবি তুলে দিয়েছিলাম আজ সেই চাবি আমার হাতে দিল। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তরুলতা বলল," হ্যাঁ দিদি গণিত গবেষণাগার আপনার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তার কাজ শেষ হতে এত দেরী হল যে সেখানে আপনার দৃপ্ত উপস্থিতি থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। তাই সবার অনুরোধ আপনার অবসর নয় আমাদের মধ্যে থাকুন আর আপনার স্বপ্নে বিচরণ করে আমাদের সোনালী দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যান।"তখন বিদ্যালয়ের মাঠে ছাত্রীদের কলতান,"হ্যাঁ দিদি, হ্যাঁ দিদি, আবার আসুন ‌।"

আমার দু চোখে তখন আনন্দের জলোচ্ছ্বাস।এ যে আমার জীবনে সেরা উপহার। আমার সব সহকর্মীরা একসাথে চায় গণিত গবেষণাগারে আমি আসি।আর তরুলতা কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, "কাল থেকে আমি দিদি ক্লাস ফাইভের তরু,তরুলতাদি নয়।"আমি ওর মিষ্টি হাসি ভরা মুখের দিকে চেয়ে বললাম," কানমোলা দেব কিন্তু।"বলে আমরা দুজনে হেসে উঠলাম। জীবনের সেরা বিদায় উপহার আমার ঝুলিতে তখন জাজ্বল্যমান।               



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational