Sanhita Ghosal

Romance Inspirational Others

4.0  

Sanhita Ghosal

Romance Inspirational Others

অন্য দুর্গা পুজো

অন্য দুর্গা পুজো

5 mins
285



এবছর পুজো অক্টোবরের শেষে হ‌ওয়ায় একটা সুবিধা হয়েছে। আবহাওয়া বেশ মনোরম। সবাই ঘুরে ফিরে ঠাকুর দেখছে।টুকাই এবং ওর মা মিতাও বাদ যায়নি, ডাক্তার বাবাকে পাকড়াও করে ষষ্ঠী ও সপ্তমী কলকাতার বড় বড় ঠাকুর গুলো দেখে নিয়েছে। সুমনের এই কদিন ওপিডি থাকে না, বৌ মেয়ের সাথে সময় কাটানোর বড় সুযোগ। টুকাই কাল রাতে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ বায়না ধরল দিদুকে দেখতে যাবে। বছর ছয়েকের টুকাই দিদুকে খুব ভালোবাসে। সুমনের মনে ওর জন্য কষ্ট হলেও মিতা আর টুকাইকে ওর দিদুর বাড়ি টালিগঞ্জে রেখে এল। নিজের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে প্রায় দেড়টা বাজল।হাত মুখ ধুয়ে শুতে করতে প্রায় আড়াইটের কাছে। তাই আজ সকালে নরম বিছানায় শরীরটাকে মেলে দিয়ে ও আরাম করছে। 

   তখন প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে। পাড়ার প্যান্ডেলে ঢাক বাজছে।ঢাকের সাথে যেন তার মিলিয়ে ফোনটা বেজে উঠলো। হাসপাতাল থেকে কল আসছে। ফোনটা ধরল, ওপ্রান্তে তখন রিনরিনে কন্ঠস্বর,"ডক্টর সুমন মুখার্জি বলেছেন?"

--"হুম।"

--"আপনার একজন পেশেন্ট মিসেস লতা ঘোষ আজ এখানে ভর্তি হয়েছেন।হাই সুগার, সাথে ডিহাইড্রেশন‌ও আছে বমির জন্য।আর.এম.ও দেখেছেন কিন্তু পেশেন্টের কন্ডিশন ভালো নয়।"

-"স্যালাইন কি দেওয়া শুরু হয়েছে?"

--"হ্যাঁ স্যার।"

--"ওকে আমি যাচ্ছি। সুগার লেভেল , পালস্ রেট মনিটর করতে বলো।"

--" হুম ঠিক আছে।"

সুমন ফোন কেটে দিয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এক গ্লাস দুধ আর বিস্কুট খেয়ে নিল। গাড়িকে কল দিল। পনেরো মিনিট পর গাড়ি এসে হাজির। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে ও বুঝল এখন গাড়ির জ্যাম ঠেলে হাসপাতালে পৌঁছোনো এক অসাধ্য সাধন কর্ম। চারিদিকে গান বাজছে, লোকজনের হুড়োহুড়ি, সবাই আগে যেতে ব্যস্ত।ও এইগুলো দেখছিল। একটু অন্য মনস্ক হয়ে গেছে। হঠাৎ সেই সময় আবার ফোন, রিনরিনে কন্ঠস্বর এবার বেশ উত্তেজিত,"স্যার আপনি কত দূরে? পেশেন্টের কন্ডিশন ক্রমশ খারাপ হচ্ছে।"

--"আমার পৌঁছাতে আরও আধ ঘন্টা লাগবে। কী অবস্থা এখন?"

--" সুগার তিনশ আশি, প্রেশার আপ ডাউন করছে।কি করা হবে?"

--" ইনসুলিন পুশ করতে বলো। মেডিসিন নেন। ভালো করে লক্ষ্য রাখতে বলো। আমাকে কল করবে অসুবিধা হলে।"

--" ইয়েস স্যার।"

   ফোন কেটে গেল। বিস্তর চেষ্টা করে জ্যাম ঠেলে ও প্রায় এক ঘন্টা পর হাসপাতালে পৌঁছোলো। হাসপাতালের মুখে ও মিস্টার ঘোষকে দেখতে পেল। ওনার দুটো চোখ তখন দিশাহীনভাবে অপেক্ষারত সুমনের জন্য। সুমনকে দেখে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ও বলল," চলুন দেখি কি হয়েছে?"হাসপাতালের মেইন গেট পেরিয়ে ও যখন ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছে ওর চোখ দুটো আটকে গেল একজোড়া করুণ ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে।মুখ দুটো লতা ঘোষের দুই মেয়ের।ওরা মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে চেম্বারে আসে। ছোট মেয়েটি টুকাইএর বয়সী, বছর ছয়েকের। ওকে দেখে সুমনের মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। কোথায় বাবা মাকে নিয়ে বেলুন হাতে নিয়ে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখবে তা নয় এখন দিদির কোলে মাথা রেখে বসে আছে মায়ের অপেক্ষায়।আর বছর আটেকের দিদি ওর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সুমন মনকে শান্ত করে এগিয়ে গেল লতাকে দেখতে। দেখে বুঝল কোন‌ও ইনফেকশন হয়েছে। সেই জন্য ওষুধ কাজ করতে দেরি হচ্ছে। যিনি আগে দেখেছিলেন উনি বললেন ইনসুলিন পুশ করার সাথে জোফার ইঞ্জেকশন‌ও দিয়েছেন। সুমন দেখল এমনিতে সব ঠিক আছে।ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে এসে মিস্টার ঘোষকে সব বলে জানতে চাইল কী খেয়েছে এই কিছু কথা।আবার ওয়ার্ডে ফিরে গিয়ে নার্সকে কিছু ব্লাড টেস্ট করার কথা বলল।আর রিপোর্ট অসুবিধাজনক হলে মেইল করে দিতে বলল। এবার বাইরে এসে বলল," মিস্টার ঘোষ মেয়েদের নিয়ে বাড়ি যান। ঠিক আছে আমি দেখছি ‌"

--" বাড়িতে ওদের কেউ দেখার নেই তাই ও সঙ্গে এনেছি। আপনি বলেছেন যখন তখন বাড়ি ফিরে যাই।"উনি চলে যাওয়ার পর ও আবার অন্য পেশেন্টে দেখতে গেল । ঠিক বিকাল পাঁচটায় সব রিপোর্ট দেখে দেখল লতার অবস্থা স্থিতিশীল।ও গাড়ি করে বাড়ির পথে পা বাড়ালো। তখন অস্তমিত সূর্যকে ম্লান করে শহর কলকাতা প্রাণের আলোয় উদ্ভাসিত। বাড়ি ঢুকে হাত-পা ধুয়ে মিতাকে ফোন করল টুকাইএর সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু টুকাই তখন দাদু দিদুর সাথে প্যান্ডেলে। মায়ের কাছ থেকে বেলুন কেনার টাকা নিয়ে গেছে। আসলে বেলুন, লজেন্স, ফুচকা এই সব ছাড়া ছোটদের দূর্গা পূজা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।ও টুকটাক কথা বলে ফোনটা ছেড়ে দিয়ে এক কাপ চা আর স্যার এপিজে কালামের লেখা ব‌ই 'উইংস অফ ফায়ার' নিয়ে বসল। এগারোটা হবে,সবে মিতার তৈরী খাবারগুলো গরম করে খেতে বসবে তখনই ফোন এর," স্যার পেশেন্টের প্রবল শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেন লেভেল কমে গেছে। পারলে একবার আসুন।"

--" দেখছি কি করা যায়।"

    ফোন রেখে এবার নিজেই গাড়ি নিয়ে ছুটল। এসির মধ্যে তখন ওর কপালে চিন্তার ঘাম জমেছে।ভীড় ঠেলে যখন ও হাসপাতালে পৌঁছাল তখন প্যান্ডেলে সন্ধিপূজা শুরু হয়েছে।ঢাকের তীব্র আওয়াজ।দেবী দূর্গা তখন মা চামুন্ডা রূপে চন্ড ,মুন্ড অসুর বধের জন্য আপ্রাণ লড়ছেন।আর সুমন তখন আরও দুই জন ডাক্তারকে সঙ্গী করে আই সি ইউতে এগিয়ে যাচ্ছে লতার শরীরে বাসা বাঁধা চন্ড ,মুন্ডকে বধের উদ্দেশ্যে। একদিকে একের পর এক ইঞ্জেকশন দেওয়া, অক্সিজেন সরবরাহ করা, প্রেশার দেখা সব মিলিয়ে তীব্র ব্যস্ততা। প্রায় চার ঘণ্টা লড়াই করে তবে লতার শরীর স্থিতিশীল হল। ওরা বেশ ক্লান্ত।সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি। তীব্র ইনফেকশন হয়ে এই অবস্থা হয়েছে লতার। সুমন ক্লান্ত শরীরে করিডোরে এল।। শহর কলকাতা চন্ড মুন্ড বধের পর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।ওর দুচোখে তখন‌ও ঘুম নেই।আর‌ও কয়েক ঘণ্টা কাটলে তবে বোঝা যাবে।আর‌ও কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর যখন দেখল লতার অবস্থা স্থিতিশীল ও বাড়ির পথে পা বাড়ালো। বাড়ি ঢুকে শরীর বিছানায় মেলে দিল। টেবিলে তখন‌ও ফাঁকা খাবারের থালা আর বাটি ভর্তি খাবার ওর অপেক্ষায়। মুখে গেল না কিছু। শুধু প্রশান্তির ঘুম ওকে ডেকে নিল অচিনপুরে। দশমীর দিন সকালে আবার গেল হাসপাতালে। আবার সেই ছোট্ট দুটি মুখ। ওকে দেখে বড় মেয়েটি বলল," কাকু মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব তো?"

--" দাঁড়াও গিয়ে দেখে আসি।"

ও তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল লতাকে দেখতে।লতা তখন জেনারেল ওয়ার্ডের বেডে বসে তরল খাবার খাচ্ছে। ডাক্তার বাবুকে দেখে মৃদু হাসল। সুমন সব রিপোর্ট দেখে নার্সকে বলল আগামীকাল যেন ডিসচার্জ সার্টিফিকেট তৈরী রাখে। বাইরে এসে মিস্টার ঘোষ ও দুই মেয়েকে ডাকলেন ।একটু ঝুঁকে লতার ছোট মেয়েকে বলল," মা ঠিক আছে এখন। কাল এসে নিয়ে যাস।"

--" সত্যি কাকু মা ভালো আছে!"

টুকাই এর বয়সী ছোট মেয়েটির কাছে মাকে ফিরিয়ে দিতে পেরে আনন্দ লাগছে।ওর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল।

একাদশীর দিন শূণ্য মন্ডপ দেখতে দেখতে সুমন যখন হাসপাতালে পৌঁছে গেল তখন মনটা খালি লাগছে, আবার এক বছরের প্রতীক্ষা।অন্য মনস্ক হয়ে পথ হাঁটছে ও, হঠাৎ ছোট্ট গলার স্বরে ওর হুঁশ ফিরল।

--"কাকু মাকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি।"

--" ভালো করে যত্ন নেবে কেমন।"

--" হুম অবশ্যই ,টা টা।"

মা দূর্গাকে নিয়ে লক্ষ্মী, সরস্বতী যেন বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সুমনের মনটাও ওর মা লক্ষ্মীর জন্য উতলা হয়ে উঠল। হাসপাতালের ডিউটি সেরে সুমন ছুটল টুকাইএর কাছে ।সামনেই লক্ষ্মী পূজো যে আমার লক্ষ্মী ছাড়া ঘর যে অন্ধকার।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance