Sanhita Ghosal

Classics Inspirational

3  

Sanhita Ghosal

Classics Inspirational

গণতন্ত্রের উৎসবে কিছু প্রশ্ন

গণতন্ত্রের উৎসবে কিছু প্রশ্ন

3 mins
268



  

  তুলিকার সারা রাত ঘুম হয় নি। জীবনে প্রথম বার ভোট, তার ওপর ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছানোর পর চূড়ান্ত অব্যবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।তুলিকাদের ভোট গ্রহণ কেন্দ্রটি উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ছোট্ট একটি ঘরে ব্যবস্থা করা হয়েছিল।ওরা চারজন তখন ভোট গ্রহণের সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে ওখানে পৌঁছালো তখন অফিসার অফিসার ভাব একেবারে উড়ে গেছে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রাণ পাখি চুপটি করে বসতে চাইছে। কিন্তু তাকে তো আর এই সময় বসতে দেওয়া যায় না কারণ কাল ভোট কিন্তু এই ঘরে মানুষ ছাড়া বাকি সকলের বসবাস। অনেকক্ষণ ধরে ঘর পরিষ্কারের লোক খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নিজেরাই ঝাঁটা হাতে তুলে নিয়েছিল।তুলিকা বিলক্ষণ বুঝতে পারছিল ক্লাস নাইনে পড়া ঢেঁকি নিয়ে প্রবাদ প্রবচন একেবারে সত্যি।


  দীর্ঘ দুই ঘণ্টার লড়াইএ অত্যন্ত নোংরা ঘরকে ভোট গ্রহণ কক্ষে পরিণত করা কি তীব্র প্রচেষ্টা। কিন্তু এরপর থেমে থাকলে চলবে না। কালকের কাজ এগিয়ে রাখতেই হবে।তাই খাওয়া ভুলে কলম ছুটিয়ে দিতে হল তীব্র গতিতে। পরিস্থিতির বিরুদ্ধে গিয়ে সমস্ত কাজ যখন শেষ হল তখন ঘড়ির কাঁটা একটার ঘর পার করতে চলল। নাহ্ শরীর এবার বিশ্রাম চাইছে। কিন্তু বিশ্রাম করবে কোথায়? অগত্যা ভোট গ্রহণ কক্ষের কোণে বাথরুমের কাছে তুলিকা বেছে নিল পরম বিশ্রামস্থল হিসেবে।বাকি তিনজন একটি সরু বেঞ্চ,দুটি নড়বড়ে চেয়ারের ভরসায় রাতটুকু কাটাবে বলে স্থির করেছিল। তীব্র গরম, ওষুধ ও বাথরুমের থেকে নির্গত গন্ধে দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি।

  

  জানালা দিয়ে ভোরের শীতল হাওয়া চোখ দুটোতে যখন ঘুমের আবেশ এনেছে ঠিক তখনই মোবাইলের অ্যালার্ম চিৎকার করে ঘোষণা করে ওঠার জন্য। একরাশ ক্লান্তিকে জলের ঝাপটায় চোখ থেকে বিদায় জানিয়ে প্রস্তুত হল গণতন্ত্রের উৎসবে। গণতন্ত্রের উৎসবে ওরা চারজন হোতা, একটু ভুল হলে এই উৎসব অন্ধকারে পরিণত হতে পারে, এই চিন্তা বারবার মনের মধ্যে এলেও সময় যখন ভোট গ্রহণ শুরুর মাহেন্দ্রক্ষণ স্পর্শ করেছিল সব চিন্তা উড়ে গিয়েছিল ডানা মেলে।


 ঠিক সাতটা বেজে তিন মিনিটে ওরা চারজন অবতীর্ণ হল গণতন্ত্রের উৎসবে হোতার ভূমিকায়। তুলিকা প্রথম পোলিং অফিসার। ভোটাররা ভোট গ্রহণ কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথে তুলিকা তাদের এগিয়ে দিচ্ছে মতদান কক্ষের দিকে। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা দুটো যখন বারোটার ঘরে পেটে ছুঁচো মশাই ডন দিতে শুরু করেছেন। এদিকে বাইরে তখন বিশাল লাইন।থামলে চলবে না। ছুঁচো মশাইকে ঘুমের দেশে যাওয়ার অনুরোধ করে একের পর এক ডাক চলছে। থামলে চলবে না।এর মধ্যে ভোট গ্রহণ কক্ষে ধীর পায়ে দুই জন মহিলার প্রবেশ। দেখতে দুই জনকে এক‌ই রকম প্রায়। সহজেই বোঝা যায় দুই বোন হতে পারে। দুজনে ভোটার কার্ড এগিয়ে দিল তুলিকার দিকে। তুলিকা শনাক্ত করল দুজনকে। একজনের নাম রেজিনা। রেজিনা বলে উঠল,"দিদিমণি, আমার দিদি আফসানা ভোট দিতে পারবে নি।ও তো কথা বলতে পারে না।"

-"সে ঠিক আছে উনি কি কথা বুঝতে পারেন? মানে বুঝিয়ে দিলে?"

-"বুঝতে পারে তবে এখন ঠিক বলতে পারবু নি দিদিমণি।"

-"দেখি একবার বুঝিয়ে যদি উনি পারেন।"

-"দ্যাখেন তবে।"

এই কথাগুলোর মাঝে তুলিকা লক্ষ্য করল আফসানা নামে ভদ্রমহিলা উৎসুক চোখ নিয়ে তুলিকার দিকে তাকিয়ে আছেন।তুলিকা এবং প্রিসাইডিং অফিসার নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত কাগজ হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বোঝাতে শুরু করল আফসানাকে। বোঝানো যখন শেষ পর্যায়ে আফসানা হঠাৎ হাত তুলে ওদের বোঝালো ও বুঝতে পেরেছে। এরপর হাতে কালি লাগিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল মতদান কক্ষের দিকে।ভোট গ্রহণ কক্ষে তখন অদ্ভুত নীরবতা। পোলিং এজেন্ট, পোলিং অফিসার সবার চোখ আফসানার দিকে এবং মনে একটাই প্রশ্ন ও পারবে তো? আফসানা সবাইকে অবাক করে নীল বোতামে হাত স্পর্শ করালো। ঠিক সাত সেকেন্ডের মধ্যে সমস্ত নীরবতা ভেঙে শব্দ হল।ঐ শব্দ শুধু নীরবতা ভাঙল না, উচ্চারিত হল গণতন্ত্রের উৎসবে প্রকৃত মন্ত্রের। আফসানা মতদান কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে বিজয়ীর হাসি হেসে এগিয়ে গেল তুলিকাদের ধন্যবাদ দিতে। পোলিং এজেন্টরাও তখন একসাথে আনন্দের হাসি হাসছেন।আফসানার জয় সবাইকে এক করে দিল। তুলিকা গণতন্ত্রের উৎসবে হোতা হয়ে উৎসবের প্রকৃত উদযাপনকে। মুখে প্রশান্তির হাসি লেগে থাকলেও চোখের কোণে নোনা বাষ্প ঘনীভূত হয়ে সবার অলক্ষ্যে তুলিকার মুখে ঢাকা মাস্কে অদৃশ্য হল।

   

  ধীরে ধীরে আফসানা ভোট গ্রহণ কক্ষ ত্যাগ করল আর রেখে গেল কিছু প্রশ্ন,"আমরা কি সত্যি পারি না?যোগ্যতা একটু মাপতে পারো না? আমাদের কি মতামত থাকতে নেই? আলাদা কেন ভাবো হাতটুকু ধরে দেখার চেষ্টা টুকু করতে পারো?" সব প্রশ্নের উত্তর ই ভি এম এ একটা শব্দে আবদ্ধ হয়ে গেছে তখন।

    তুলিকা উপলব্ধি করল গণতন্ত্রের উৎসবে সবাই সমান,আফসান সেই বার্তা দিয়ে চলে গেল।ওর প্রতিটা পদক্ষেপ মত প্রকাশের লড়াই সার্থক করল পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই উৎসবকে যা দেশের প্রতিটি নাগরিকের চালিকা শক্তি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics