প্রিয় প্রমিলা (তৃতীয় পর্ব)
প্রিয় প্রমিলা (তৃতীয় পর্ব)
ডিসেম্বর মাস, শেষের মুহূর্তে এসে হাজির হয়েছে। আজ 29 শে ডিসেম্বর, সকালে প্রমিলা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আজ সে নিজের যাবতীয় কাজ সম্পূর্ণ করে নিয়েছে। অনন্ত বাবুর সাথে বাইরে বেড়াতে যাওয়ার অনুভূতিটা কি হতে পারে সেটার জন্য বেশ উৎসাহিত সে।খুশি হয়েছিলেন, মায়ের কাছে অনুমতি পেয়ে গিয়েছিলেন বলে। জানুয়ারির প্রথম দিনটা অনন্তের সঙ্গে পাহাড়ে থেকে কাটাতে চাই। প্রথমটা একটু ভয়ও পেয়ে গিয়েছিল প্রমিলা দেবী। এতটা উৎসাহ মেনে নিতে পারছিল না যদি কোন বিপদ হয়ে যায়। এত সুন্দর ভালো মুহূর্ত সে ছেড়ে দিতে চাইছিল না। যেমন হোক জীবনের প্রথম প্রেম। যদিও সেটি একে অপরকে জানায় নি এখনো, তবুওতো ভালোবাসার কিছুটা অনুভব আছে।
প্রমিলা,মাকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দিয়ে,লাঞ্চ সেরে গাড়িতে উঠলেন । আমার অফিসে―বিভূতি বাবুকে, সকালেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রমিলা, তার যাবার কথা। প্রমীলার কলকাতা পৌছাতে পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। বিভুতি বাবু অফিসে প্রমীলা দেবীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন।তিনি প্রমীলা দেবীর বলেঙ্গে যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ ভাবে করে রেখেছিলেন।
প্রমীলা গাড়ি থেকে নেমে বিভূতি বাবুকে সম্মান জানানোর জন্য সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং বললেন
―আপনিই কি বিভূতি বাবু?
―হ্যাঁ, প্রমিলা দেবী।
―প্রমিলা একগাল হেসে বলল,আপনি তো আমাকে চেনেন না। তাহলে আমাকে চিনলেন কিভাবে???
―অনন্ত বাবুর মুখে আপনার রূপের অনেক কথা শুনেছিলাম। তখন থেকেই ছবিটা মনে আঁকা হয়ে আছে।
প্রমিলা তাকে জোড়হাত করে নমস্কর সহিত সন্মান জানালো।
ড্রাইভার সমস্ত লাগেজ গুলি নামিয়ে দিয়ে, টাকা নেবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। প্রমিলা তার কাছ থেকে টাকা দেবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। এমন সময় বিভূতি বাবু বলে উঠলেন---
―না, না প্রমিলা দেবী, আপনার দেওয়া নিষেধ আছে। আপনি থামুন;
বলেই বিভূতি বাবু পকেট থেকে কয়েকটি 500 টাকার নোট বার করে ড্রাইভার কে দিলেন ।ড্রাইভার টাকাটি নিয়ে চলে গেলেন।
ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়ে বিভূতি বাবু প্রমিলা দেবীকে আসুন বলে, অফিসের দিকে নিয়ে গেলেন---
প্রমিলা এর আগে কোনোদিন এত বড় অফিস দেখেনি। গ্রামের মেয়ে এই অফিসে আসবে বলেও ভাবতে পারেনি। তার শানিত চোখে একটি বিন্দুও বাদ যাচ্ছিল না এমনি কৌতূহলী হয়ে সে অফিস দেখছিল।বিভূতি বাবু দু কাপ কফি নিয়ে এসে বললেন---
―এই নিন প্রমিলা, আসুন আপনাকে অনন্ত বাবুর কেবিনটিতে নিয়ে যায়।প্রমিলা অনন্ত বাবুর কেবিন শুনেই বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলেন।বিভূতি বাবু প্রমিলা দেবীকে অনন্ত বাবুর কেবিনে নিয়ে গেলেন। প্রমিলা কেবিনটা ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলেন।তারপর তার চোখ আচমকা টেবিলের উপরে গেল। অনন্ত বাবু,টেবিলে প্রমীলা দেবীর একটি ছবি খুব যত্ন করে রেখেছেন। প্রমিলা দেবী ছবিটি দেখে খুবই খুশি হলেন।কেউ যে ভালোবেসে তার ছবিটা টেবিলে সাজিয়ে রাখতে পারে তা কোনোদিন কল্পনা করেনি সে। খুব খুশি হয়ে অনন্ত বাবুর হুইল চেয়ারে বসে পড়লেন এবং বিপরীত পাশের চেয়ারে বসা বিভূতি বাবুর সঙ্গে খোশমেজাজে গল্প জুড়ে দিলেন।
গল্প করতে করতে অবশেষে বিভূতি বাবু বললেন,
―প্রমিলা দেবী, বলেঙ্গে যাওয়ার জন্য আপনার সমস্ত রকম ব্যবস্থা করেছি আপনি কিসে যেতে চান?
― কি ব্যবস্থা করেছেন বিভূতি বাবু?
―আপনি― ট্রেনে, গাড়িতে বা ফ্লাইটে যেতে পারেন।কোনটিতে আপনার যেতে ভালো লাগবে সেটা ঠিক করুন।
―অনন্ত বাবু কিছু বলেননি ??
―না না, সে আপনাকে আপনার পছন্দমতো বেছে নিতে বলেছেন??
প্রমিলা দেবী যৎসামান্য চিন্তা করে বললেন ― বিভূতি বাবু আপনি আমার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন।আমার গাড়িতে যাওয়াটাই ভালো হবে।
―কেন প্রমিলা দেবী ? ফ্লাইট তো আপনার পক্ষে ভালো হতো!
―হত ঠিকই কিন্তু ফ্লাইটে যেতে গেলে একজন সঙ্গী হলে ভালো হয়। বেশ মজা করতে করতে আকাশে উড়ার খুশিটা উপভোগ করা যায়। তাছাড়া ফ্লাইটে যাওয়ার আনন্দটা আমি প্রথম অনন্ত বাবুর সাথেই উপভোগ করতে চাই।
―ও তাই,ঠিক আছে;আমি গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। আপনি ডিনারটা সেরে নিন।আপনার ডিনারের ব্যবস্থা এখানেই করেছি।
প্রমিলা দেবী হাতে পরা সোনালী ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে ইতস্তত করতে লাগলো।সময় তখন মাত্র সাড়ে নটা রাত্রি বারোটা বাজতে এখনো অনেক সময় আছে,তাছাড়া ডিনার সে 11 টার আগে করে না।
বিভূতি বাবু গাড়ির ব্যবস্থা করতে চলে গেলেন। প্রমিলা দেবী এত বড় অফিসে একাই কি করবেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকার পর, মনে মনে ভাবলেন অনন্তবাবুর কেবিনটাই ভালো করে দেখা যাক। তিনি সমস্ত কিছু নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। টেবিলের ডান সাইডে রাখা ব্ল্যাকবক্সটি দেখে অনেকটাই সে অবাক হয়ে গিয়েছিল। প্রমিলা ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে ভাবতে লাগলো এটাতে হাত দেওয়া ঠিক হবে কি হবে না― শেষমেশ,নিজের উপর বিশ্বাস রেখে খুলতে লাগলেন। বাক্সটি খুলে প্রমিলা অনেকটাই অবাক হয়ে গেলেন। বাক্সের মধ্যে রয়েছে গত বছরের একটি ডায়েরি, কিছু চিঠিপত্র ও কাগজের বানানো একটি লাল রঙের গোলাপ। গোলাপ ফুলটি দেখে প্রমীলার মন কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল।সদ্য অভিভূত হওয়া প্রণয় টুকরো হয়ে যাবে না তো।প্রমিলা যথেষ্ট ভীতি অনুভব করলো মনে মনে। ভয়ে বাক্সটা ঢাকা দিয়ে আবার বক্সেই রেখে দিলেন । মনে মনে ভাবলেন অন্যের চিঠিপত্র ও ডায়েরি পড়াটা ঠিক নয়। চিন্তিত হয়ে সে পুনরায় হুইল চেয়ারে বসে পড়লো। অবশেষে ভাবল মনের সন্দেহটা দূর করতে হবে তাই সে পুনরায় বাক্সটি খুলে ডাইরিটা হাতে নিলো। প্ৰথম পাতায় সেইরকম কিছু নেই।দৈনন্দিন জীবনের সকাল থেকে রাত্রি অবধি সমস্ত ঘটনা আছে। একপাতা দুপাতা করে উল্টাতে উল্টাতে প্রথম দিনের আলাপের তারিখটাতে পৌছালো প্রমিলা। ডাইরির পাতাটা দেখে প্রমিলা বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল।ডায়েরিতে প্রমিলা দেখলো—
“ অদৃশ্য কুহেলিকা কাটিয়ে আজ চিত্তের নিবিড় শূন্য প্রাঙ্গনে একটি সুশ্রী প্রভা শোভিত হয়েছে।কমনীয় নয়ন দ্বয় আমায় কঠোর বাস্তবিকতার নিষ্ঠুর অভিপ্রায় বুঝিয়েছে।পরিত্রাণ পাবার উপায় নেই।নয়ন প্রান্তে কাজল ন্যায় বাহ্যিক রূপ এক লহমায় আমার অন্তঃকরণ তছনছ করে দিয়েছে।কম্পমান ওষ্ঠের, গোলাপি আভা; তুলির টানের অভাবে যৎসামান্য ফিকে হলেও অপূর্ব গঠন শৈলী তার ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করেছে।
আজ নয়ন দ্বয় অতিশয় বেদনা পেয়েছে। মুহূর্মুহ,অভ্যন্তরীণ দুঃখে নয়ন দ্বয় ভিজিয়ে উঠছে। খুব কষ্ট পেয়েছে হৃদয়ে । কয়েকটি কথা হলো ঠিকই তবুও তার নাম জানবার ইচ্ছাটা চেপেই রাখলাম।নয়ন প্রান্তে গড়িয়ে পড়া কয়েক ফোঁটা লবনাম্বু সম্পূর্ণ মুখমন্ডলের রূপ অনন্য করে তুলেছে।
অদ্ভুত এই অজানা পৃথিবীর এক কোনে,আমার মন ভোলানোর ললনা থাকতে পারে তা আমার কাছে অলীক। পরিস্থিতির অবকাশে নামটা অবগত হল না। কি নামে পরিচয় হবে তার সঙ্গে?
তার অনুভবি দৃষ্টি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিল।কিন্তু মনে শোকের ছায়া ছিল, তাই কিছু বলার অবসর পায়নি বোধহয়।
আমার তাকে খুব ভালো লেগেছে। নয়ন সমুখে প্রতিচ্ছবির মত সবসময় ভাসছে।চোখের রূপের কথা বারবার বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কে এই বিলাসিনী ? আগে তো কোনোদিন একে দেখিনি।
এই চঞ্চল মন বারবার দেখতে চাইছে― রূপের ঘনঘটা লেগেছে তার বহিরাকৃতিতে।
এই সময় যদি তাকে কাছে পেতাম! ―মন ভরে যেত―
নয়ন প্রান্ত ছল ছল করে উঠলো এক ফোটা জল চিবুক বেয়ে ডাইরির পাতাতে এসে পড়লো। আরো কত মনের ভাবনা হয়তো লেখা আছে ডাইরিতে।পাতা না উল্টে সযত্নে ডাইরিটা ব্লাকবক্সে রেখে দিল প্রমিলা।
ডাইরি দেখতে দেখতে কখন যে 11 টা পার হয়েছে তা মোটেই লক্ষ্য করেনি প্রমিলা। বিভূতি বাবু বাড়িতে ঢুকে বললেন,
―চলুন প্রমিলা দেবী আপনার 11 টা পেরিয়ে গেছে ডিনারটা সেরে নেবেন। বিভূতি বাবু অফিসের ক্যান্টিনে ডিনারের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রমিলা দেবী বিভূতি বাবু কে অনুসরণ করলেন। ডিনার করতে করতে বিভূতিবাবু প্রমীলা দেবীর সঙ্গে গল্প জুড়েদিলেন।
―প্রমিলা দেবী এবার তাহলে কি করবেন বলে ভাবছেন?
―সেরকম কিছুই না…… রিসার্চের জন্য এপ্লাই করেছি। প্রফেসর নিজের পছন্দমত ল্যাব খুঁজে নিতে বলেছেন।
―ও ও তার জন্য বোধহয় আপনি বলেঙ্গে যাচ্ছেন?
―না না শুধু তাই নয়।অনন্ত বাবু খুব অনুরোধ করেছিলেন।বলেঙ্গে, তার ওখানে যাওয়ার জন্য। তার অনুরোধ ফেলতে পারলাম না।
―ও বুঝেছি।
―তাছাড়া আমার ওই জায়গাটি দেখার খুব ইচ্ছা হয়েছে কারণ অনন্ত বাবু জায়গাটি সম্বন্ধে খুব ভালো কিছু আমায় বলেছেন। দেখলে নাকি মন জুড়িয়ে যাবে। সেই জন্যই আরও ওখানে যাব।
―ফিরবেন কবে বলে ভেবেছেন?
―দেখি ওটা অনন্ত বাবুর উপর নির্ভর করছে …
আপনি তো দেখছি অনন্ত বাবুকে খুব শ্রদ্ধা করেন। তাহলে সারা জীবনই অনন্ত বাবুর কাছে রয়ে যান না—
প্রমীলা দেবীর হাসি আর বন্ধ হল না। হাসিটা এমনই ছিল যেন সে জীবনে এই প্রথম মন খুলে হাসছে।
বাইরে থেকে একটা গাড়ি দুবার হর্ন দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। বোধহয় গাড়ি এসে গেছে।
ডিনার শেষ করতে করতে প্রায় রাত বারোটা বেজে গেল। বিভূতি বাবু প্রমীলা দেবীকে তৈরি হয়ে যেতে বললেন। প্রমিলা দেবী অনন্ত বাবুর রুমে গিয়ে নিজের শাড়িটা চেঞ্জ করে নিলেন ও যে শাড়িটি পরে অনন্ত বাবুর রুমে প্রথম ঢুকেছিলেন সেই শাড়িটি প্যাকেট করে অনন্ত বাবুর ব্ল্যাক বক্সের সামনে নামিয়ে রাখলেন এবং ব্ল্যাক বক্স থেকে অনন্ত বাবুর ডাইরিটি নিজের ব্যাগে যত্ন সহকারে নিলেন। বিভূতি বাবু প্রমীলা দেবীর জন্য কিছু ফাস্টফুড এর আয়োজন করেছিলেন সে গুলি একটি প্যাকেটে কুড়িয়ে প্রমীলা দেবীকে দিলেন এবং বললেন
―গাড়িতে যাওয়ার সময় হয়তো আপনার এগুলোর প্রয়োজন হতে পারে আপনি সঙ্গে এগুলো নিয়ে যান।
―বিভূতি বাবু, আপনি ড্রাইভারকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন তো,
―আমি সব গুছিয়ে বলে দিয়েছি। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে যেতে পারেন।
প্রমিলা গাড়িতে উঠার উদ্দেশ্যে বাইরে বেরিয়ে এলেন। গাড়িতে ওঠার আগে বিভূতিবাবুকে আরেকবার নমস্কার জানিয়ে গাড়িতে উঠলেন এবং বললেন,
―ভালো থাকবেন বিভূতি বাবু।আপনার সঙ্গে কাটানো এই মুহূর্তগুলো আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। ভালো থাকবেন।
বিভূতি বাবু ঘাড় নাড়লেন এবং বললেন সেখানে পৌঁছে যাওয়ার পর অনন্ত বাবুকে একবার ফোন করতে বলবেন।আমি আজ অফিসেই থাকব অফিসের নাম্বারে ফোন করলেই আমাকে পেয়ে যাবেন।
ঠিক আছে, বলে দেবো। আসছি…………..
গাড়িতে উঠে প্রমিলা দেবী ড্রাইভার এর সঙ্গে কিছু
কথা বলার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু ড্রাইভার কোন কথা না বলে গাড়ি চালানোর দিকে মন দিলেন।
বলেঙ্গে যেতে প্রায় এক দিন 13 ঘণ্টা সময় লাগে।অর্থাৎ আজ রাত্রে বেরিয়েছে মানে আগামী পরশু দিন সকালের দিকে বলেঙ্গে গিয়ে পৌঁছবে। টানা 33 ঘণ্টা গাড়িতে জার্নি খুব অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে বলেই প্রমিলা গোপনে অনন্ত বাবুর ডাইরিটা নিজের ব্যাগে ভরে নিয়েছিলেন।
রাত্রে গাড়িতে ঘুম আসছিল না। প্রমিলা দেবী বঙ্কিমচন্দ্র ও বুদ্ধদেব বসুর লেখা কিছু বইও সঙ্গে নিয়েছিলেন।গাড়ির ল্যাম্পটা জেলে বই নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।চন্দ্রশেখর ও শৈবলিনির বাল্য প্রণয় থেকে সমাজ জীবনের টানাপোড়েন ও ভালোবাসা প্রমিলার মনকে কিছুক্ষনের জন্য মোহময় করে তুলেছিল। একটা সময়ের জন্য তার নিজের ভালোবাসার সংকীর্ণতার কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছিল।নিজের অস্থিরতা কাটিয়ে তোলার জন্য উপন্যাস দ্বয় সরিয়ে রেখে অনন্তবাবুর ডায়েরিটা বের করলেন। সিটে হেলান দিয়ে ডাইরিটা বুকের সামনে নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করলেন। প্রথম কতগুলো পাতা ফাঁকাই ছিল। তারপর প্রথম দিনের লেখাটা,প্রথম দিনের লেখাটা উল্টানোর পর এমনই কিছু একটা ছিল যাতে প্রমিলা দেবী অনেকটা আশ্চর্য্য হয়ে গেল।ডায়েরির পাতাতে অনন্ত বাবুর প্রথম
আলাপের দেখায়, নিজের হাতে আঁকা প্রমীলা দেবীর অনন্য সুন্দর ছবি।ছবিটা দেখে প্রমিলা ভাবতে পারেনি যে, কোন মানুষের মনে তার বহিরাকৃতি নিয়ে এত সুন্দর নিপুণতা ফুটে উঠতে পারে ছবিটির নিচে তারিখ দিয়ে লেখা ছিল ‘প্রিয়’ ও তার নিচে লেখা ছিল ড্র বাই রক্তিম।.প্রমিলাদেবীর উৎসাহ আরো বেড়ে গেলো ডাইরি পড়বার জন্য।দ্বিতীয় পাতাটি উল্টে দেখলেন―

প্রভাতেই তপবন(অনন্তের বাড়ি) বেশ সুশোভিত হয়েছে।আজ বিলাসিনী এসেছে প্রভাতেই আমার দুয়ারে।বৈচিত্রহীন বাঙালি শাড়িতে তার রূপের অবধি ছাড়িয়ে গেছে।লেখনী তার রূপের কথায় এতটাই মুগ্ধ যে তাকে জড়িয়ে ধরতে চাই।আজ চোখের কাজলটা চোখ দ্বয়কে খুবই চিত্তগ্রাহী করে তুলেছে। গোলাপি আভা ন্যায় চিবুক দ্বয় আবেগপ্রবণ করে তুলেছে সমস্ত মুখমন্ডলকে।তাহার নাম জানার জন্য ব্যাকুল চিত্তে তাকিয়ে ছিলাম ―
আমার উদগ্রীব দৃষ্টিপাত দেখে বোধ হয় মনের কথাগুলি ধরে ফেলেছিল।নিজেই পরিচয় দিয়ে এগিয়ে এলো― আমি প্রমিলা।
বা! নামটা এই মাত্র জানলাম।তাহার নামে ঘুমের আবেশ।নামের সঙ্গে তার চরিত্রের অভূতপূর্ব মিল, নামটি বেশ সুন্দর মানিয়েছে।তার দেওয়া পরিচয় ও কথাবার্তার শালীনতাবোধ ,সেই মুহূর্তে আমাকে স্থির করে দিয়েছে।
প্রিয়ভাষিণী ,সরল বৈচিত্রহীন ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলেছে।আমার হাতে তৈরি কটু কফিটাও সে খুব আনন্দের সহিত, আরো পাঁচজনের মত পান করেছে।কফির প্রসঙ্গে তার কাছে সত্য জানতে চাওয়ায় সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে আমার মর্যাদা রেখেছে। মনের মধ্যে তার যে কোনো তিক্ততা বোধ নেই তা ভালো ভাবেই সে বুঝিয়ে দিয়েছে। তার পিতাশ্রীর দেহাবসান তাকে গভীর কষ্টের সম্মুখীন করেছে। পিতাশ্রীর দেহাবসান তার কাছে ভবিষ্যতে দেখা স্বপ্নের থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ হয়ে উঠেছে। খুব ভয় পেয়ে গেছে স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হওয়ার। আমি তার সমস্ত কথা শুনেছি, কিন্তু কিছু কথা যে স্পষ্ট করে বলা যায়না তার অনেকটাই আভাস পেয়েছি। আজ তার সমস্তটাই কম্পিত কণ্ঠে বেরিয়ে আসলো। তাতে তার মনের অন্তরালে হৃদয় যে ভিজিয়া গিয়েছিল তাহা তার প্রতিটি কথাতেই স্পষ্ট অনুভূতি হচ্ছিল। সে আমার মধ্যে এমন কি দেখেছিল যে তাকে আমার কাছে আসতে বাধ্য করেছিল।তার উত্তর আমি আজও পাইনি। যখন আমি বলেছিলাম তার দেখা স্বপ্নের পেছনে আমি স্থির হয়ে আছি; তখন তার মনের খুশিটা এতটাই হয়েছিল যে হয়তো আমার লেখনী ধারায় তা লিখে বোঝানো যাবে না। সে আমার দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। যেটা সেই মুহূর্তে আমার কাছে লজ্জার একটা কারণ হয়ে উঠেছিল।
অনেক অনুরোধ করেছিলাম লাঞ্চটা আমার বাড়ি থেকে সেরে যাবার জন্য কিন্তু সে আমার সেদিনের কথা রাখেনি আমাকে এড়িয়ে চলে গিয়েছিল।
ডাইরিটা পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল প্রমিলা নিজেও জানে না। ড্রাইভারের ডাকে তার ঘুম ভেঙে গেল। ড্রাইভার বললো—
মেডাম, মেডাম, উঠুন সকাল হয়ে গেছে––
প্রমিলা চোখ খুলে দেখলো , সকাল হয়েছে ঠিকই কিন্তু সূর্য উঠেনি এখনো। গতকাল রাত্রে অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছে তাই ঘুমটা ভাঙেনি। পুনরায় ড্রাইভার ডেকে বললেন–
মেডাম, আপনি গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ান
কেন?
আরে দাঁড়ান না মেডাম। বেশ মজা পাবেন–
মজাটা যে কি তা কয়েক মিনিট বাদেই প্রমিলা বুঝতে পারলো। যখন প্রথম সূর্যোদয় দেখলো। রাস্তার এক প্রান্তে একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে সে সেদিনের প্রথম সূর্য্যদ্বয় দেখলো। আনন্দে প্রমিলার মনটা বেশ ভরে উঠলো। সে ড্রাইভারকে বললো–
আপনি বেশ পরিবেশ প্রেমী লোক দেখছি।
হ্যাঁ, মেডাম ওই একটু আর কি।
আপনি গতকাল কেন কথা বললেন নি?
মেডাম, বাড়ির জন্য একটু চিন্তাতে ছিলাম । অনেকদিন বাড়ি ফেরা হয়নি তাই।
ও বুঝলাম। আপনার নাম কি?
মধুসূদন। মেডাম আপনি এখানেই প্রাতরাশ করবেন তো?
না না তার প্রয়োজন নেই। বিভূতি বাবু আমার জন্য খাবার দিয়েছেন। আপনি যদি করতে চান তো করে নেন।
মধুসূদন, একটু ইতস্তত করে প্রাতরাশ সারতে গেল। প্রমিলা গাড়িতে উঠলেন, ডাইরিটা খোলাই ছিল। তা বন্ধ করে বিভূতি বাবুর দেওয়া টিফিন যত্ন করে সারলেন।
প্রায় আধাঘণ্টা বাদে মধুসূদন গাড়ী স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করল।প্রমিলা বলল-
―মধুসূদন, আমরা এখন কোথায় আছি?
―মেডাম, আমরা এখন নাগরাকাটা চা বাগানের সামনে দিয়ে যাচ্ছি।
―এখনো তাহলে কত দেরি???
―মেডাম, এখনো প্রায় 1020 কিলোমিটারের মত হবে।
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ যাওয়ার পর মধুসূদন বলল,
―মেডাম আপনি চা বাগান দেখেছেন নাকি?
―না, আমার দেখা হয়নি।
―দেখবেন?
প্রমিলা অত্যন্ত আনন্দের সহিত বলতে চেয়েছিল দেখবো, কিন্তু আসাটা সংবরন করে, না বলে দিল। কেননা,কোনো একজন প্রিয় ছাড়া যে চা বাগান দেখার আনন্দ উপভোগ করাটা ভালো লাগবে না সেটা ডাইরিটা বেশ ভালোই অনুভূতি দেয়।
প্রমিলার আসার খবরই আমার অস্থিরতার কারন,আর রুক্মিণী দেবীর মজার বিষয়বস্তু হয়ে উঠবে তা ভাবতেই পারিনি।এখন রুক্মিণী দেবী তো আমায় সবসময় দেখলেই মুচকি হাসে। । যদিও তাকে প্রমিলার আসার খবরটা বলা হয়নি।জানতে পারলে বোধহয় আনন্দে নেচে উঠবে।এই দুদিন কাজের চাপটা বেশ অনেকটাই কম। সকালে ভাবছি প্রমিলা কতটা এসেছে, তখনই ফোনটা বেজে উঠলো।
হ্যালো–
―কেমন আছেন?
ফোনের সেপাশ থেকে বিভূতিবাবুর গলা শুনে বেশ খুশি হলাম।বললাম,
―ভালো আছি, আপনি?
―খুব ভালো। প্রমিলাকে দেখে আরো অনেক ভালো লাগছে ।
―কেন বিভূতি বাবু , প্রমিলাকে দেখে ভালো লাগছে কেন????
―আরে মশাই, আপনি তো চাঁদে হাত দিয়েছেন।আপনি যা বলতেন তার তুলনায় অনেক বেশি-----
―আর কেমন বুঝলেন????
―লাখে একটা। বলে বোঝানো যাবে না।
―গতকাল কখন ছেড়েছিলেন?
―১২টার দিকে। কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বোধ হয় এতক্ষন।
―ঠিক আছে।
ফোনটা রেখে দিলাম। আমার রুম থেকে রুক্মিণী কে হাঁক দিলাম।রুক্মিণী দেবী আসছি বলে প্রায় 15 মিনিট বাদে এলেন ও বললেন―
―বলুন,অনন্ত বাবু । হাঁকছিলেন কেন????
―আপনাকে একটা খবর দেবার ছিল।
বলুন না বলে, আমার আরামকেদার টা ঝাড়তে লাগলো।
―আচ্ছা রুক্মিণী দেবী আপনার কি একমুহূর্তর জন্য স্থির থাকতে নেই–
―আপনি বলুন না শুনছি তো―
―আমার প্ৰণয়িনী আসছে।
রুক্মিণী দেবীর মুখটা তখন দেখার মত ছিল । সে পুনরায় বললেন,
―কি বললেন অনন্তবাবু?
―আপনি ঠিকই শুনেছেন। প্ৰণয়িনী আসছে???
আনন্দে আত্মহারা হয়ে হাসতে হাসতে আমার নিকট এসে বললেন,
―কবে? কখন?
―আগামীকাল সকালে―
―ঠিক বলছেন তো?
―একদম ঠিক।
রুক্মিণী দেবী মোটেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না প্রমিলার আসার কথা। তার সেই মুহূর্তের খুশিটা সেদিন আমার ডাইরিটাকে বেশ মন মাতানো করে তুলেছিল। হয়তো তার প্রেমের ঘাটতিটা আমার প্রেমের মধ্যে পূরণ হবে ভেবেছে।সে আরো উঠে পড়ে লেগেছে বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য।কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমার ঘরটা আরো সুন্দর গোছগাছ করে দিলো।
তখন প্রায় বিকেল, প্রমিলা মধুসূদন কে জিজ্ঞাসা করলো-
―মধুসূদন আমরা এখন কোথায় এসেছি???
―তেজপুর এসেছি মেডাম। এখনো প্রায় 500 কিমি যেতে হবে। আপনি টিফিন করবেন তো করে নিন।
―না না টিফিন করবো না। সামনে কোনো যদি মন্দির আছে তাহলে সেখানে চলো। মন্দিরে প্রার্থনা করে তারপর যাব।
প্রমিলার কথামতো মধুসূদন নিকটবর্তী মহাভৈরব শিব মন্দিরে নিয়ে গেলেন।
প্রমীলার মনের ব্যাকুলতা দূর করার জন্য বোধহয় সেই মুহূর্তে মন্দিরে আরতি দেখতে গিয়েছিল।কতদিন অনন্ত বাবুকে দেখেনি, মুখে বলা না হলেও দুজনের মধ্যে যে ভালোবাসার ইঙ্গিত দুজনেই পেয়েছে তার একটা ধৈর্য ভাঙ্গা টানাপোড়েন, মন উত্তাল করে তুলেছে।সুস্থির স্বভাবের মহিলাটি কিভাবে যে প্রথম কথা শুরু করবে সেই নিয়ে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করল এবং সঠিক ভাবে পৌঁছে তার সামনে উপস্থিত হওয়ার আশা জানালো।
মন্দিরের আরতি শেষ হতে হতে প্রায় নটা বেজে গেল। প্রমিলা মধুসূদনকে টিফিন করে নিতে বলল এবং নিজেও কিছু টিফিন করে নিয়ে পুনরায় গাড়িতে উঠলো। বলেঙ্গে পৌছাতে পৌছাতে প্রায় ভোর হয়ে যাবে। প্রমিলা অনন্ত বাবুর ডায়েরিটা বের করে অনন্ত বাবুর শেষ লেখা ডায়রির পরের পাতায় নিজের অনুভূতিগুলো তুলতে লাগলো—
আপনার কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার প্রায় ভোর হয়ে যাবে। আগামীকালের প্রথম সূর্যোদয় আমি আপনার সাথেই দেখতে চাই।তবে সেটা যেখানেই হোক না কেন। আপনাকে দেখিবার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে উঠেছি। নয়ন দ্বয় গভীর আগ্রহে আপনার প্রত্যাশায় অস্থির হয়ে উঠেছে।কয়েকদিন আগেও আমার এরকম মনে হচ্ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে কেন আমি এত অস্থির হয়ে উঠেছি তা নিজেই বুঝতে পারছিনা। এখান থেকে আমি আপনার জন্য প্রসাদ নিয়ে যাচ্ছি আশা করি আপনার ভালো লাগবে।
প্রমিলা ডাইরিটি বন্ধ করে সিটের পেছনের দিকে হেলান দিলেন। অনন্ত বাবুর সঙ্গে ভোরের মুহূর্তটা সে গভীরভাবে অনুভব করতে চাই। তাই বিশ্রামের প্রয়োজন বোধ করলেন।