পাহাড়ে
পাহাড়ে


স্বামীর কর্মসুত্রে বিদেশে থাকি, সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যে, মাঝে মাঝেই মন দৌড়োয় কলকাতার অলিতে- গলিতে, আনাচে- কানাচে, যেখানে কেটেছে কুড়িটা বসন্ত।
কলকাতায় বয়ষ্ক বাবা- মা একাই থাকেন। তাঁদের চিন্তাতেও মন ভরে থাকে। ভোরে বা রাতে ফোন এলেই বুক কেঁপে ওঠে অজানা আশঙ্কায।
এক ভোরেই এল সেই অপ্রত্যাশিত ফোন...কিন্তু খুশির হাওয়া নিয়ে। বাবা পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, গরমের ছুটিতে। আমরা দুই বোন, বোনও প্রবাসী। আমার দুই কন্যা, বোনের দুই কন্যা ও জামাতা বাবাজীদের নিয়ে, অনেকদিন বাদে একত্রিত হলাম বাবা- মায়ের কাছে- কলকাতায়। কলকাতার দুর্দান্ত গরম ছেড়ে নিঃশ্বাস নিতে পৌঁছে গেলাম দার্জিলিং এর পাহাড়ে...
ওমা! নিঃশ্বাস নেওয়ার উপায় তো দার্জিলিং ও রাখেনি, প্রায় অক্সিজেন মাস্ক নেওয়ার অবস্থা। আমার ছেড়ে যাওয়া, সবথেকে প্রিয় হিল স্টেশন সেই দার্জিলিং কোথায়? মনে হল কলকাতার বড়বাজারে পৌঁছে গেছি। তবুও ভালোলাগায় মন ভরে উঠলো।
আমাদের জন্যে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল। তিরিশ বছর আগে থেকে যাওয়া, সে...ই হোটেলেই থাকার ব্যবস্থা করেছেন বাবা। বোন আর আমি পুরনো স্মৃতি রোমন্থনের জন্যে একটু হাঁটতে বেরোলাম, চললাম মলের দিকে। জনবহুল দার্জিলিং এর পথের একটি বিশেষ ভীড় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। উঁকি মেরে দেখি একটা বাচ্চা ছেলে পয়সা দিয়ে ম্যাজিক দেখাচ্ছে। একটু দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।এবারে ফেরার পালা।
বোন হঠাৎ বলল, ‘দিদি, তোর তাঁকে মনে আছে? গতবারে আমাদের হোটেলেই ছিলেন, পয়সা দিয়ে বাচ্চাদের ম্যাজিক দেখাতেন। জানিস, আজ তিনি কত বিখ্যাত, দূরদর্শনের পর্দায় প্রায়ই তাঁকে দেখা যায়। এক ঝলক দমকা হাওয়া আমার শাড়ী, চুল এলোমেলো করে দিল। এক ঝটকায় নিয়ে গিয়ে ফেলল, তিরিশ বছর আগের আরও একটা গরম কালের দার্জিলিং- পাহাড়ে।
ইলেভেনে পড়ি, পরের বছরে হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা। মনের প্রসারতায় বিশ্বাসী আমার উদার বাবা রিলাক্সেশানের জন্যে দার্জিলিং যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেললেন- পড়াশোনার চাপ, কলকাতার জীবন-যুদ্ধ থেকে কয়েকদিনের জন্যে মুক্তি পেতে। ষোল বছর বয়েস, কলকাতা ছেড়ে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই রোমাঞ্চ শুরু হয়ে গেল।
জলপাইগুড়ি পৌঁছেই প্রেমে পড়লাম দূরের হাতছানি দেওয়া পাহাড়ের সারির, টয় ট্রেনের। প্রেমে পড়লাম ঝিরঝিরে- ঝরঝরে ঝোরার, গুচ্ছ গুচ্ছ রঙ- বেরঙের গোলাপের, মাথার ওপরে নেমে আসা মেঘের। এক কথায় যা কিছু আমার চোখ দেখল, কান শুনল, নাক ঘ্রাণ নিল, ত্বক স্পর্শ করল... সব, সব। সে তো প্রেমে পড়ারই বয়েস। টয় ট্রেনে দার্জিলিং পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে হোটেলের সামনের বাগানে ঘোরাঘুরি করছিলাম, নজর কাড়লেন, অসম্ভব সুন্দর হাসির অধিকারী একজন মানুষ। একদল বাচ্চা তাঁকে ঘিরে রেখেছে- তাদের নানারকম আব্দার তিনি হাসিমুখে পূর্ণ করে চলেছেন।
স্কুলে আমি চ্যাটার বক্স নামে কুখ্যাত, কারুর সঙ্গে আলাপ করতেই বিশেষ সময় লাগে না আমার... সে ও দেখলাম আমারই ক্যাটেগোরির। খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুত্ব হয়ে গেল, অনেক রাত অবধি আমরা গল্প করলাম, কত ক...ত রকমের গল্প। তখন বুঝতে পারিনি, দুদিনের সেই বন্ধুত্ব কখন যেন প্রথম প্রেমে বদলে গেছে। আমরা কথাই বলে গেছি, ভবিষ্যতে যোগাযোগ রাখার কথা কারুর মনেই পড়েনি। কলকাতা ফিরছিলাম, ওঁরাও ফিরছেন, দেখা হলো স্টেশ... কে জানত সেইই শেষ দেখা। পরীক্ষা হয়ে গেল, কলেজে ভর্তি হলাম। পথে ঘাটে আমার দু- চোখ কাকে যেন খুঁজে বেড়াতে থাকল। কত লোকের সঙ্গে তো দেখা হয়, বাঞ্ছিত- অবাঞ্ছিত, বিশেষ কারুর সঙ্গে কেন দেখা হয়না? গ্র্যাজুয়েশানের পরে বিয়ে হয়ে বিদেশে চলে গেলাম, অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল একটা সুন্দর সম্পর্ক। ‘এই দিদি, কি ভাবছিস রে? কখন থেকে ডাকছি...’ রুঢ় বাস্তবের সম্মুখীন হলাম। হোটেলে পৌঁছে, অনেক বদলে যাওয়া সেই পুরনো হোটেলের যায়গায় যায়গায় কাকে যেন খুঁজে বেড়াল চোখ জোড়া। মজার ব্যাপার- তাকে দেখতেও পেলাম সেদিনই টি ভি দেখতে বসে। ড্রামাটিক আয়রণি কি একেই বলে?