ওগো শুনছো (শারদ সংখ্যা)
ওগো শুনছো (শারদ সংখ্যা)
বিরিঞ্চি বাবু অনেক কষ্ট করে চচ্চড়ি টা করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু অদৃষ্টের হাস্যকর পরিহাসে চচ্চড়ি টা কড়ার মধ্যে লেগে কড়াটার চচ্চড়ি বানিয়ে ছাড়ল। অগত্যা আর কি!! আজ ও বোধ হয় বিরিঞ্চি বাবু কে সেই জল ঢালা ভাত ও আলু সেদ্ধ খেয়েই কাটাতে হবে। বিরিঞ্চি বাবুর বিয়ে হয়েছে ৪বছর হলো। নিজের থেকে ছোটো মেয়েকে বিয়ে করার জন্য তার প্রাক্তন পত্নী ভীষণ গাল মন্দ করেছিলেন বটে,তবে তিনি তা গায়ে মাখেননি, কারণ তার প্রাক্তনা ইহ জগতে বিচরণ করেন না।
কিন্তু সমস্যা হলো দ্বিতীয় বউটিও না থাকায়। আহা না না তিনি জগতের মায়া ত্যাগ করেননি, আসলে লকডাউনের জন্য তিনি সেই যে বাপের বাড়ি গেলেন ব্যস আসার আর নাম গন্ধ নেই। তাই বিরিঞ্চি বাবুকে রোজ হাত পুড়িয়ে রাঁধতে হয়। সত্যি কি কষ্ট, বউ থেকেও নেই।উফফ এমন কষ্ট বিরিঞ্চি বাবুর প্রাক্তন বউয়ের জন্য ও বোধহয় হয়নি।
"কি গা, আজ ও ভাত আলু নাকি??"
চমকে উঠলেন বিরিঞ্চি বাবু, কে ডাকে?? ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখলেন , কাউকে দেখতে পেলেন না।
" আঃ মরণ। পেছনে আমি নেই। আমি দেওয়ালে!"
দেওয়াল কথাটা শুনেই আর একটু হলেই ভিরমি খেতেন, তবে যুৎসই ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে রান্না ঘর ছেড়ে সামনে বসার ঘরে এসে দেওয়ালে টাঙানো বউয়ের ছবির দিকে তাকালেন।
বউ ওমনি একটা ফিক করে হেসে বললো " কি!! কচি বউ ফাঁকি দিয়েছে বুঝি??" বিরিঞ্চি বাবুর অবস্থা খারাপ। তিনি রীতিমতো কাঁপছেন। এমন ভুতুড়ে কান্ড জন্মেও তিনি দেখেননি।
" ননিবালা!!! তুমি?? ফটো থেকে?? উড়ি বাবা রে?....."
" আঃ মরণ। কচি মেয়ে বিয়ে করার সময় ৬০ বছরেও পৌরসত্ব বেরিয়ে পড়ে, আর এখন দেখো ভিরমি খায় বুড়ো। মর মর, মরলে হাড় জুড়ুক।"
এমন ভীষণ গালি শোনার পর বিরিঞ্চি বাবু মেঝে থেকে কোনো মতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বউয়ের ছবির দিকে ভালো করে তাকিয়ে চোখ কচলালেন। না কোনো ভুল নেই। বউ তো দিব্বি ছবির ভিতর থেকে দন্ত বিকশিত করেই আছে।
" সেই মেয়ে পালিয়েছে...... ও আর ফিরবে না"
এবার বিরিঞ্চি বাবুর বড্ড কষ্ট হলো। " এমন বলো না ননিবালা, মেয়েটি যথেষ্ট ভালো। সুন্দরী। ও না ফিরলে আমি যে মরেই যাবো।"
" হ্যাঁ, ওটা বলো, সুন্দরী।কচি। উফফ মনে হয় মাঝে মাঝে গলা টিপে দি। কই আমি মরে যাওয়ার সময় তো এত দুঃখ করোনি। ওহ আমি কচি ছিলাম না বলে নাকি সুন্দরী নই??"
মহা ফাঁপরে পড়লেন বিরিঞ্চি বাবু। ঢোক গিলে বললেন " আরে তুমিযে কি বলো, আমি তোমায় ভালোবাসি এখনো ননিবালা। তবে বয়স হচ্ছে তো। ছেলে মেয়েও নেই যে দেখবে। তাই তো বিয়ে করতে বাধ্য হলুম। কিন্তু তুমি তো জানো, আজ অবধি ও মেয়ের গায়ে আমি স্পর্শ করিনি।"
ননিবালা দেবী কে দেখে মনে হলো একটু শান্ত হলেন। তিনি বললেন " হুম তা ঠিকই। কিন্তু আমার ভীষণ রাগ হয় ও যখন তোমার কাছে আসে, তোমার উপর পা তুলে ঘুমোয়। আমি সব দেখি।"
এই টুকু বলে খানিক চিন্তা করার পর ননিবালা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন " তা বুড়ো তুমি নাকি স্পর্শ করোনি?? লকডাউনের আগে ওইদিন রাতে তুমি ওর উপর......"
বিরিঞ্চি বাবু হাত উঁচিয়ে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে জিব কেটে বললেন " আরে করো কি?? সবাইকে শোনাবে নাকি? আরে ওই রাতে বৃষ্টি পড়ছিল, ঠান্ডা বাতাস, তাই আর কি......"
ননিবালা দেবী যদি ফটোর মধ্যে না থাকতেন তবে নিশ্চিত, আজ বিরিঞ্চি বাবুর শেষ দিন হত। বিরিঞ্চি বাবু ননিবালা কে চুপ করিয়ে রান্না ঘরে এলেন বাকি রান্না টুকু, মানে ওই ভাতের ফ্যান গলানোর কাজটা শেষ করতে।
দুপুরে রোজকার এক ঘেঁয়ে খাবার খাওয়ার পর, বিরিঞ্চি বাবু ভাবলেন একবার ফোন করবেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী রাধারানী কে।
ননিবালা দেবী তার ইহজগতে বরের মনোভাব বুঝতে পেরে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন " আদিখ্যেতা..... মর মর, সবার ঘাড় মুটকিয়া ছাড়ুম।"
দ্বিতীয়...
বিরিঞ্চি বাবুকে আর কষ্ট করে ফোন করতে হলো না। রাধারাণীর ঘর থেকেই ফোন এলো। ঢাউস মার্কা রিসিভার টা তুলে বিরিঞ্চি বাবু বেশ ভারিক্কি গলায় বললেন " হ্যালো....কে????"
ওপার থেকে একটা পুরুষের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো
" বিরিঞ্চি দা?? আমি রাধার দাদা বলছি।"
" হা, বলুন। রাধা কেমন আছে? এই লকডাউনের মধ্যে বাইরে বেরোয়নি তো? আমি খুব তাড়াতাড়িই যাবো ওকে আনতে।"
খানিকক্ষণ চুপ থেকে রাধকান্ত, মানে রাধারানীর দাদা, বললেন " ইয়ে। মানে, বিরিঞ্চি বাবু। বলছি একটা কথা ছিল।"
"আহা, ওতো খাবি খাচ্ছেন কেন? বলেই ফেলুন না। কি ব্যাপার?"
একটা দীর্ঘশ্বাস এর শব্দ শুনতে পেলেন বিরিঞ্চি বাবু ফোনের ওপার থেকে।
" হা, বিরিঞ্চি বাবু, রাধারানী আর ফিরবে না......"
কথাটা শোনার সাথে সাথেই মনে হলো বিরিঞ্চি বাবুর পায়ের তলার জমি কেউ টেনে সরিয়ে দিল। টাল সামলাতে পারলেন না। পাশে রাখা চেয়ারটা ধরে ফেললেন।
কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন " মানে?? কবে কিভাবে আমি তো জানতেই পারলাম না।"
" কবে কিভাবে জানিনা। তবে বেশ কিছুদিন ধরেই ও এমন মত পোষণ করছিল। আজ বলেদিল। তাই আমি আপনাকে জানালাম।"
" মানে?? মত পোষণ?? সে আবার কি?? কেউ কি মৃত্যুর আগে তার মরার দিন ঠিক করে নাকি??"
ওপারের কণ্ঠটি হঠাৎ বিব্রত হয়ে উঠলো। " আরে না না, বিরিঞ্চি বাবু আপনি ভুল করছেন। বোন আমার ভালোই আছে। তবে ও আর আপনার কাছে ফিরবে না। ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়ে দেব। ভুল বুঝবেন না। রাখলাম"।
বিরিঞ্চি বাবুর কানে ফোনটা ধরাই ছিল। ওপার থেকে ফোনটা টুক করে কেটে গেল। বিরিঞ্চি বাবুর চোখটা কেমন যেন জলে টলমল করে উঠলো। তিনি বুঝতেই পারলেন না হঠাৎ করে কি হলো। এই ৪, ৫ মিনিটের মধ্যে বিশাল একটা ঝড় বয়ে গেল। এক নিমেষে তার সোনার সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। রাধারানী এমন করতে পারে? কত ভালোবেসেছিল ও রাধারানী কে। তাও?? নাহ এই অপমান মেনে নেওয়া যায়না। মনে হচ্ছিল গলায় দড়ি দেয়।
ফোনের রিসিভারটা রেখে দুঃখে চোখ মুছলেন বিরিঞ্চি বাবু।
" কি হলো? তুমি কাঁদছো? তোমার চোখে জল কেন?"
বিরিঞ্চিবাবু চশমাটা পড়ে নিয়ে ধরা গলায় বললেন " ওহ কিছু না"।
তারপর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। দেওয়ালে টাঙানো ছবির থেকে ননিবালা দেবী এক দৃষ্টিতে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বিরঞ্চিবাবু শুয়েই কাটালেন। ভালোলাগছে না আর উঠতে। খালি একটা কথাই তার মাথায় ঘুরছে। যাকে এত এত ভালো বাসলেন সেই মানুষটা তাকে এমন ভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারে? এ তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি। মনে মনে রাগ কষ্ট সবই হচ্ছে বিরিঞ্চি বাবুর। সন্ধ্যে নামতে তিনি বিছানা থেকে নেমে ছাদে দিকে গেলেন। যাওয়ার সময় ও শুনতে পেলেন " কিগো?? কথা বলবে না তুমি??"
বিরিঞ্চি বাবু সত্যি কোনো উত্তর দেননি। এদিকে ননিবালা দেবীর ভারী ভয় হলো। লোকটা ছাদে গিয়ে আত্মহত্যা করবে না তো?
বিরিঞ্চি বাবু ছাদে এসে একটা চাটাই পেতে বসলেন। সন্ধ্যে নেমেগেছে চারিদিকে কালো অন্ধকার। কিছু জোনাকি আলো ছড়িয়ে এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। চারিদিক কেমন যেন শান্ত থমথমে। মনে হচ্ছিল সবাই বিরিঞ্চি বাবুর শোকে শোকাহত। আচমকা কোথা থেকে একটা ঠান্ডা বাতাস এসে লাগলো ওনার মুখে। "আঃ কি শান্তি" অস্ফুট স্বরে বললেন বিরিঞ্চি বাবু।
এমন সময় ঠিক তার পাশে থেকে কেউ বলে উঠলো" আর কতক্ষন মুখ বেজার করে থাকবে"। অপরিচিত কেউ হলে নির্ঘাত তিনি হার্টফেল করতেন তবে এই গলা তার চেনা ভীষণ, যার সাথে তিনি প্রায় ২৪ বছর কাটিয়েছেন। পাশের দিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না, তবুও সেই শব্দের উৎস লক্ষ্য করে বললেন " কি করবো বলো? কেউ তো আর পাশে রইলো না আমার। যাকেই চাই, সেই ফাঁকি দেয়। তুমিও দিলে এও দিলো।" সেই অদৃশ্য শব্দ উৎস থেকে কোনো উত্তর এলো না। কিন্তু বিরিঞ্চি বাবু হঠাৎ তার শরীরে তার মুখে একটা ঠান্ডা নরম হাতের স্পর্শ অনুভব করলেন।
"ননী... তুমি কি ফিরতে পারো না?"
হাতের স্পর্শের চলন টা হঠাৎ থামলো। ননিবালা দেবী বললেন " তা তো সম্ভব নয়। আমি যে মায়া অনেকদিন আগেই ত্যাগ করেছি। তুমি কষ্ট পেয়ো না। আমি এসে রান্না করে দেব।"
বিরিঞ্চি বাবু চোখ বুজলেন , একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে বললেন " রান্নার জন্য নয়। আমি বড্ড একা হয়ে গেলাম ননী। তোমার চলে যাওয়ার পর একাকীত্ব আমায় কুরেকুরে খেয়েছিল। আচ্ছা তুমি কি আমায় তোমার কাছে নিয়ে যেতে পারো না।"
ননিবালা দেবী ঈষৎ রেগে বললেন " কেন আজে বাজে কথা বলো? কিসের একা তুমি? আমি তো আছি। আর ওই মেয়ে শালা, আট কুঁড়ের বেটি ও তোমার টাকা খেতে এসেছিল। তোমায় মোটেও ভালোবাসে নি। তবে ওই হৃদয়হীনার জন্য এত প্রেম কিসের? মনে তো হচ্ছে গিয়ে ঘাড় মুটকে দিয়ে আসি।"
বিরিঞ্চি বাবু তার প্রাক্তন স্ত্রীকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে বললেন " আরে, ঠিক আছে। ও বাচ্চা মেয়ে। ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও।"
সময় বয়ে যেতে লাগলো। কখন যে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে গেল বুঝতেই পারলেন না বিরিঞ্চি বাবু, ননির সাথে অনেকদিন পর এতটা মন খুলে কথা বললেন তিনি। ইহলোকের সাথে পরোলোকের প্রেম বিনিমনে, এ যেন একটা স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে ওরা দুজনই বিভোর ছিলেন।
ননিবালা বললেন " শোনো তুমি চিন্তা করোনা। আমি তো আছি। মৃত্যুর আগে তো ভালোবাসো নি। মৃত্যুর পর নয় বাসো। ভালোলাগছে। এমন দিন বা মুহূর্তের জন্য আমি কত অপেক্ষাই না করেছি। কিন্তু তুমি মুখ ফিরিয়ে তাকাও নি আমার দিকে। যাক গে। এখন এমন ভাবে রোজ গল্প করবো। সত্যি বেশ লাগছে। কিন্তু একটাই আফসোস জানো। আমার সময়টা একটু তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে গেছে। এখন চাইলেও তোমার কোলে মাথা দিয়ে শুতে পারবো না। "
বিরিঞ্চি বাবুর ভারী দুঃখ আর কষ্ট হলো। সত্যি তো তিনি বড্ড বেশি অবহেলা করেছিলেন তার স্ত্রীকে। আজ বুঝতে পারছেন লোকে কেন বলে " দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝো"।
আজ ৬০ বছর বয়সে এসেও বিরিঞ্চি বাবুর খালি মনে হচ্ছিল ইস যদি ননিবালা থাকতো তবে রোজ এই ভাবে গল্প করতাম। এত ভালোবাসতাম। লোকে যে যাই বলুক, ভালোবাসার কি আর বয়স হয়?
আসলে ননিবালার মুখ থেকে ওই " ওগো, শুনছো" ডাকটা ভীষণ মিস করছে বিরঞ্চিবাবু। ননিবালা দেবী বোধহয় স্বামীর মনের কথা বুঝেছিলেন। তাই হঠাৎ করেই খিল খিল করে হেসে উঠে বললেন " বুড়োর ভীমরতি গেল না। বুড়োর রস কম নয়।"
"ধুস। আমি চললাম" বলেই উঠে পড়লেন বিরিঞ্চি বাবু।
ননিবালা দেবী মিষ্টি সুরে ডেকে উঠেলন " ওগো শুনছো???"
বিরিঞ্চি বাবু পেছন ঘুরলেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না......।