Suvam Guchhait

Tragedy Classics

4.1  

Suvam Guchhait

Tragedy Classics

শেষ চিঠি

শেষ চিঠি

5 mins
220


প্রিয়তমা

অনামিকা,

আশা করি তুমি বেশ ভালোই আছো। এই জটিল জীবনের ব্যস্ততা কে উপেক্ষা করে তুমি হয়তো অনেকটা দূরে এগিয়ে গেছো। এখন পিছন ফিরে তাকালে হয়তো আমার অস্পষ্ট একটা ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি তোমার ঐ দু চোখের সামনে ভাসবে। আমি তোমার এই অগ্রগতিকে অমান্য করিনা। কেবল কষ্ট হয়, তুমি দ্রুত আমায় ছাড়িয়ে চলে গেলে। রাগ হয়না, অভিমান হয়না। তবে এটা সত্যি, আগে হতো, অনেকটা হতো। তবে দিন যত এগিয়েছে, তোমার মর্ম তত আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। তবে এই উপলব্ধি বোধ হয় তোমার সাথে ভাগ করে নিতে পারলাম না। কারণ তুমি অনেকটা এগিয়ে গেছো। 

এখন কেবল বুকের পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে আসে শ্রান্ত, ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস। আর দু চোখ ভরে আসে জলে। তোমার মনে আছে কিনা জানি না, তোমার সেবার খুব শরীর খারাপ হয়েছিল। তুমি সারারাত ঘুমোতে পারোনি। এদিক ওদিক করে কেবল ছটফট করেছো।

কিন্তু, আমি..... আমি কিন্তু তোমার পাশে শুয়ে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমিয়েছি। তোমার খেয়াল টুকুও করিনি। আমি তো জানতাম, তোমার শরীর খারাপ অতটা মূল্যবান নয়, তাই তা নিয়ে ভাবার ও কিছু নেই। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে, তুমি কিছুই বলো নি আমায়। কোনোদিন বলো নি।

তাই বুঝি আমার এই উপলব্ধিটা অনেকটা পরে হলো। দীর্ঘ সময় নিলো নিজেকে পরিপক্ক করে তুলতে। আমার বিবেক বলে কোনো বস্তু কোনোদিন ছিল কিনা জানিনা। হয়তো কোনোদিন বুঝতেই চাইনি।

আমার মনে পড়ে, সেই দুর্গাপুজোর অষ্টমীর কথা। আমি পাঞ্জাবি পরে তৈরি হচ্ছিলাম, আর তুমি শাড়ি। হ্যাঁ আমার দেওয়া সেই শাড়িটা। লাল পাড়, সাদা শাড়ি। সত্যি শাড়িতে তোমায় বড্ড সুন্দর লাগতো, পরে বুঝেছিলাম। শাড়ির আঁচল ঠিক করে দেওয়ার জন্য তুমি আমায় কতবার ডেকে ছিলে, কিন্তু আমি তোমার সমস্ত ডাক অগ্রাহ্য করে,নিজের ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। তোমায় দেখাচ্ছিলাম, দেখো.. আমি কতটা ব্যস্ত একজন মানুষ,কর্পোরেট জগতে আমার কতটা নাম ডাক। কতটা প্রিসিয়াস আমি কোম্পানির কাছে।

কিন্তু তখনো বুঝিনি, তুমি আমার কাছে ঠিক কি? কতটা অমূল্য।

তোমার ডাক অগ্রাহ্য করার পরেও, তুমি কিছুই বলো নি। আমি ভাবতাম, হ্যাঁ, মাঝে মাঝে ভাবতাম, তুমি কেন কিছু বলো না? তোমার কি আলাদা কেউ আছে? অন্য কোনো পুরুষ? অন্য কোনো প্রেমিক? 

রাগ উঠেছিল সেইদিন, যেদিন তুমি ফোনে অনেকক্ষন ব্যস্ত ছিলে। আমি অফিস থেকে বারবার ফোন করেও তোমায় পাইনি। তখনই, সেইদিনই আমার সন্দেহ দৃঢ় হয়। আমি প্রতিজ্ঞা করি, এই অপমানের যোগ্য জবাব আমি তোমায় দেব। তাই রাগে, অভিমানে আমি সেদিন অফিস থেকে অনেক দেরিতে বাড়ি ফিরি। কাজে ব্যস্ত ছিলাম, সেটা নয়। আসলে আমি আমার প্রিয় প্রেমিকার সাথে লাঞ্চ, ডিনারে ব্যস্ত ছিলাম। ব্যস্ত ছিলাম, তার সাথে আদরে সোহাগে। 

বাড়ি ফিরে দেখি, তুমি টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছো।তোমায় দেখার পর, সেই রাগ ফের তার মূল্যবোধ খুঁজে পায়। ধিক করে জ্বলে ওঠে মাথাটা। উফফ কি বীভৎস সেই রাগ। তোমার নাম ধরে ডাকতেও ঘেন্না হচ্ছিল। কারণ তখন আমার মাথা, আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস, ফিসফিস করে বলছিল, তুমি একটা বেশ্যা, বারোয়ারি। 

সেইদিনের ঘটনার পরেও তুমি কিচ্ছু বললে না। কেন বললে না?? কেন? কেন সত্যটা উদ্ঘাটিত করলে না? কেন বললে না? সে তোমার প্রেমিক নয়, সে তোমার আপন ভাই ছিল। যে তোমার জন্য নিজের প্রাণ টুকুও বিসর্জন দিয়েছিল। 

বুকের পাঁজর ফেটে যাচ্ছে আজ।কিন্তু তোমায় ধরবো কি করে? 

লিখতে লিখতে কলম কাঁপছে। জানিনা এই চিঠি কবে তোমার কাছে পৌঁছাবে। 

তোমার মনে আছে? তুমি আমায়, আমার জন্মদিনে একটা দারুন ঘড়ি উপহার দিয়েছিলে? মনে আছে? আমার কিন্তু আছে। তোমার দেওয়া ঘড়িটা আমি হারিয়ে ফেলি। 

কিন্তু সত্যিটা সেটা নয়। সত্যিটা বড্ড সস্তা আজ। আমার সেই প্রেমিকা তোমার দেওয়া ঘড়িটা রাগে,মাটিতে আছাড় দিয়ে ভেঙে দেয়। তোমায় বলিনি। ঘড়ি হারিয়ে যাওয়ার খবরে তুমি খুব কেঁদে ছিলে, কিন্তু মুখ ফুটে কিছুতেই কিছু বললে না আমায়। হঠাৎ করে আমারও বুকটা চিনচিন করে উঠেছিল। কারণ ঘড়িটা আমার ও বড্ড প্রিয় ছিল। কিন্তু তখন তো আমি প্রেমিকার রসে মজে ছিলাম,তোমায় বুঝতাম কি করে? 

আজ বুঝি। শিরায় শিরায় উপলব্ধি হয়। আজ ধমনী বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

আমি জানতাম, তুমি গৃহিণী। তুমি কর্পোরেট জগৎ বুঝবে কি করে? আসলে এখানে এমন অনেক কিছুই ঘটে। ঘটাতে হয়। তোমার ওই সাদামাটা রূপ দেখতে দেখতে চোখ গুলো বিষিয়ে উঠেছিল আমার। তোমার শরীর থেকে অদ্ভুত বাজে গন্ধ বেরোতো রাতে। তোমায় আদর করতেও ভালোলাগত না। তোমার বুকের উপর আঁকিবুকি কাটতে ও ভালোলাগতো না। তুমি জাপটে জড়িয়ে ধরতে, উলঙ্গ হয়ে আমার কাছে এসে আমার মন পাওয়ার সর্বাগ্র চেষ্টা করতে, কিন্তু আমি তোমার দিকে ফিরেও তাকাই নি। তোমার শরীরের ভাঁজে বেড়ে ওঠা চর্বি, আমার অপছন্দের ছিল। কিন্তু তোমার ঐ ঠোঁটের নীচে তিল টা আমি ভালোবাসতাম। 

তবে ওই একটা জিনিস নিয়ে তো আর গোটা মানুষকে পছন্দ করা যায়না। তাই না? বিয়ের কয়েক বছরেই ফুরিয়ে যায় আমার যৌন আকাঙ্খা। তুমি বড্ড সাদামাটা হতে শুরু করো। তোমার কাছে ঘেঁষতাম না। তাও তুমি কিছুই বলো নি। তবে আমি জানি, তুমি রাতে একাকী ডুকরে কেঁদেছো। আমি তখন তোমারই পাশে শুয়ে দিব্যি নাক ডাকছি।


এদিকে কর্পোরেট জগতের সেই মেয়েটি, রূপসী, লাবণ্য তে ভরা তার যৌবন। ওর ভাঁজে ,খাঁজে তো কোনো চর্বি ছিল না। রোজ রাতে ওকে পাওয়ার আকাঙ্খা আমায় তাড়িয়ে বেড়াতো। ওর ঠোঁটে, ঠোঁট ডুবিয়ে রাখার বাসনা আমায় তিল তিল করে ওর নেশায় মাতিয়ে তুলেছিল। হ্যাঁ, অনেক রাত,অনেক দিন আমি তার সাথে কাটিয়েছি। ভরা যৌবন কে আমি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছি। ওর শরীরের কোথাও কটা তিল, আমি চোখ বুজে বলে দিতে পারি। ওর বুকের উপরেও আমি ছবি এঁকেছি। 


আজ তোমায় এই সব বলছি। আজ অনেকটা সময় পেরিয়ে আসার পর উপলব্ধিটা জন্মালো। আজ মনে হচ্ছে তোমায় না বললে হয়তো জীবনে আর কোনোদিন বলতে পারবো না।


আমার সময় যে আগত প্রিয়। আক্ষেপ একটাই থেকে গেল, তুমি কেন কিছু বললে না? যদি বলতে তবে হয়তো তোমার ক্যানসার টা তাড়াতাড়ি ধরতে পারতাম। হয়তো,হয়তো তোমায় বাঁচিয়ে নিতে পারতাম এই বেলা।


পারিনি। তোমার ভাই তোমার বাবা তোমার মা, সবার কাছে আমি অপরাধী। তোমার ভাইয়ের কাছে তো বেশি করে। দুটো কিডনি দিয়ে নিজের জীবন সে উৎসর্গ করেছে। তাও তুমি ফিরলে না। ছেড়ে চলে গেলে আমায়। 


আজ দীর্ঘ ১০ বছর আমি একা।বড্ড একা। এই একাকিত্বের ভার আর সইতে পারছিনা। আমায় ও যে ফিরতে হবে। ফিরতে হবে অনেক দূরে।অনেক হিসেব মেলানো বাকি।


নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় এখন। শরীরের নিচের অংশ আজ অবশ। বাম দিকের একটা ভাগ পড়ে গেছে। এইভাবে বাঁচতে চাইনা, আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, আমায় নিয়ে চলো তোমার কাছে অনু…. আমি জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য। তবে এও জানি, তুমি আমায় ফেরাবে না।


আমি আসছি। দরজা টা খোলা রেখো। আমি আসছি। 


ইতি তোমার ………………



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy