আলো আঁধারী
আলো আঁধারী
" সেই বার তুই সত্যি ভুত দেখেছিলিস??"
" হ্যাঁ, বিশ্বাস কর। সত্যি। তোকে মন গড়া কথা বলে আমার কি লাভ বলতো??"
" বেশ। বুঝলাম, শুনি তোর সেইবারের কথা। যদি গাঁজাখুঁড়ি হয়েছে। মার খাবি ভীষণ।" বলে আমার বন্ধু কুন্তল একটা চেয়ার টেনে এনে বসলো।
কুন্তল আমার ছোটোবেলার বন্ধু। ছোটোবেলা বলতে একদম সেই নার্সারি থেকেই। আমার জীবনের যাবতীয় ঘটনা, রটনা বা অভিজ্ঞতা সব সব ওর জানা। ও সব কিছু বিশ্বাস করলেও ভুতে ঠিক ওর বিশ্বাস নেই। আমার জীবনের কিছু বিরল অভিজ্ঞতা শুনেও ও নাক সিটকে বলে, " থাক। আর ঢপ দিতে হবে না।। অনেক গল্প শুনিয়েছিস।"
অগত্যা আমিও চুপ করে যাই। আমার অভিজ্ঞতার কথা একমাত্র আমিই জানি। তাই ওকে আর জোর করে বিশ্বাস করাই না।
আজ কি এক দরকারে আমার বাড়ি এসেছে। আর বাড়ি আসার পর মুহূর্তেই উঠলো ভীষণ ঝড়। আর সাথে কারেন্ট গেল চলে। এমত অবস্থায় কুন্তল বললো " ধুস!! দেখলি তো কি অবস্থা। আর ভালো লাগে না। আসার পথে তো মেঘ ও ছিল না। ধুর ধুর... ছাতা ও তো আনিনি।"
আমি বললাম " ঠিক আছে। একটু থেকে যা। আমি বরং মুড়ি মাখছি। তেল, চানাচুর আছে। সাথে এক কাপ গরম চা। কি বলিস??"
" বাহ, জমে যাবে। সাথে তোর ওই ঢপের ভুতের গল্প ও বলিস। সময় টা বেশ কেটেই যাবে।"
আমি কয়েক মুহূর্ত ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর একটা নিশ্বাস ফেলে রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে চলে গেলাম। প্রায় ২০ মিনিট পর সব কিছু তৈরি করে এনে আমি বললাম বিছানায়। ও আমার সামনে চেয়ারে।
কারেন্ট তখনো আসেনি। আর বৃষ্টির বেগ আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে।
কুন্তল মুড়ি খেয়ে চায়ের কাপে সশব্দে একটা চুমুক দিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বললো " বল বল,শুনি। এই সময় বলে ফেল। যদি একটু ভয়টোয় লাগে। গা শিরশির করে। কারেন্ট এসে গেলে হবে না।"
ওর এই ব্যঙ্গাত্মক কথার অবশ্য কোনো প্রতিবাদই আমি করিনা। আমি চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করলাম।
" তুই তো জানিস। আমার ফিল্ডে কাজ। অফিসের কাজের ঝক্কির থেকে এইসব কাজে ঝক্কি ও ঝামেলা অনেক বেশি। আর এইসব কাজের জন্য আমায় না না জায়গায় যেতে হয়। রাত কাটাতে হয়। সেইবার ও আমি গেছিলাম অফিসের কাজে বর্ধমান। অবশ্য বর্ধমান যে এই প্রথম গেলাম তা নয়। এর আগেও আমি গেছিলাম। তবে সেইবার আমি থাকিনি। কিন্তু এই দু মাস আগে যে বর্ধমান গেলাম, তখন অবশ্য আমায় সেখানে একরাত থাকতে হয়েছিল। আর ঘটনাটা তখনকার।"
কুন্তল হাত উঠিয়ে বললো " জানি জানি, তারপর বল। আসল গল্পটা বল।"
আমি "হুম" বলে শুরু করলাম।
" সেইবার বর্ধমান পৌঁছাতে আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এতে আমার কোনো দোষ ছিল না। ট্রেন লেট ছিল। বর্ধমান স্টেশনে যখন নামলাম তখন বাজে দুপর ২ টো। এদিকে কাজ এখনো শুরু হয়নি। এদিকে দারুন খিদে। স্টেশনে যাই হোক একটা কিনে খেয়ে সোজা চলে গেলাম আমাদের ক্লায়েন্টের অফিসে। ওখানে কাজ শেষ করে উঠতে উঠতেই বেজে যায় প্রায় সন্ধ্যে ৬টা। এর মাঝে অবশ্য ওই অফিসের ক্যান্টিনে আমি খেয়ে নিয়েছিলাম। তাই খিদের চাগাড়টা অতটা দেয়নি।
কাজ শেষ করে দ্রুত এসে পৌঁছালাম স্টেশনে। কিন্তু এতটাই খারাপ ভাগ্য ছিল আমার যে কয়েক মিনিট আগে একটা আপ ট্রেন বেরিয়ে গেছে। এর পরে আর একটা ট্রেন আছে সেটা অবশ্য রাত ৯টা। কিন্তু সেটা মাঝে মাঝেই লেট করায়। কখনো এক ঘন্টা, কখনো বা দুই। কি আর করবো ভেবে না পেয়ে স্টেশনেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।"
" তারপর..."
আমি বলতে যাবো, ঠিক সেই মুহূর্তেই বাইরে ভীষণ ধ্বনিতে বাজ পড়ার শব্দ হলো। আমরা দুজনেই একটু হলেও চমকে উঠেছিলাম।
" হুম, তারপর, আমি শেষ ট্রেনের টিকিট কেটে স্টেশন মাস্টার কে জিজ্ঞেস করলাম ওখানে থাকার কোনো জায়গা আছে কিনা?? স্টেশন মাস্টার ঘাড় নেড়ে বললেন যে এটা তো শিয়ালদা বা হাওড়া না। তাই আপাতত আমায় এই স্টেশনেই থাকতে হবে। আমি অগত্যা মশার কামড় সহ্য করে স্টেশনের মাঝে অবস্থিত একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ধীরে ধীরে যত সময় এগোতে লাগলো, লোক সংখ্যা ও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছিল। রাত তখন ৮টা। খিদেটা আচমকা ফের চাগাড় দিয়ে উঠলো যেন। স্টেশনের আশেপাশে খাবারের দোকান আছে। তাই সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্বে আমি চট করে গিয়ে রাতের জন্য রুটি আর তরকারি কিনে নিয়ে এলাম। আর একটা বিস্কুটের প্যাকেট। ভেবেছিলাম, ট্রেনে উঠে খাবো।
রাত ৯টা বাজলো। ট্রেনের আসার কোনো সংবাদ শোনা গেল না। এদিকে আমি একাকী স্টেশনে বসে প্রহর গুনতে লাগলাম। ১০টা বাজলো কিন্ত তখনো ট্রেন আসার কোনো সংবাদ আমি পেলাম না।
অতঃপর বাধ্য হয়ে আমি স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে অগ্রসর হলাম। গিয়ে দেখি উনি একটা লম্বা বেঞ্চে চাদর পেতে শোয়ার তোড়জোড় করছে।
আমি গিয়ে ওনাকে ট্রেনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে উনি যা বললেন তাতে আমার সারা শরীর কয়েক সেকেন্ডের জন্য অবশ হয়ে গেছিল। এই আপ লাইনের ওভারহেট তার ছিঁড়ে গেছে। সেটা মেরামত হলে ফের স্বাভাবিক হবে ট্রেন। কিন্তু সেটা কখন হবে তার কোনো ঠিক নেই।
এই রাতে আমি পড়লাম বড্ড ফাঁপড়ে। কোথায় হোটেল ,কোথায় রাত কাটাবো সেই চিন্তাই বারবার মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে লাগলো। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সব দোকান বন্ধ। একটা খাবারের দোকান তার ঝাঁপ ফেলছে। আমি দৌড়ে গেলাম তার দিকে,কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম " দাদা, এখানে থাকার কোনো হোটেল পাওয়া যাবে?? এক রাত থাকার??"
লোকটি পানের পিক রাস্তায় ফেলে বললো " হ্যাঁ, পাওয়া যাবে না কেন? স্টেশনের ধারে যেটা ছিল ওটা অনেক দিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখান থেকে ২ কিমি রাস্তার পরে আপনি সব হোটেল পেয়ে যাবেন।"
রাত তখন ১১ টা। আমি ঠিক কি করবো কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। স্টেশনে থাকবো নাকি 2 কিমি হেঁটে যাবো এই রাতে। চোরের উপদ্রব কেমন তাও তো জানিনা। সত্যি বলতে একটু একটু যেন ভয় করতে লাগলো আমার। স্টেশন ধীরে ধীরে জনমানব শূন্য হয়ে এলো। এখন গোটা স্টেশনে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কেউ না।
অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে আমি ওই বেঞ্চেই আমার ব্যাগ কে বালিশের মতন করে মাথার দিকে রেখে একটা পাতলা চাদর গায়ে টেনে শুয়ে পড়লাম। রাত তখন ঠিক কটা হবে জানিনা। হঠাৎ একটা "খু, খু....." কাশির শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল আমার। ঘুম জড়ানো চোখে সামনের দিকে চাইতেই দেখি একজন বয়স্ক লোক, গায়ে চাদর জড়ানো, বসে আছেন। চোখ কচলে একবার চারিদিক তাকিয়ে দেখে নিলাম। স্টেশনের বেশ কিছু আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। দু একটা জ্বলছে, তার ও জ্যোতি খুব একটা জোরালো নয়। এমন আবছা আলো ও অন্ধকারে কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল এই স্টেশনে।
আমি উঠে বসতেই আমার সামনে কিছুটা দূরে মাটিতে বসা লোকটিও নড়ে চড়ে উঠলো। আমি ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালাম তার দিকে। সঙ্গে বিশেষ কিছু ছিল না ওর, একটা ছোট্ট নোংরা কাপড়ের ব্যাগ ছাড়া। মাটিতে একটা খবরের কাগজ পেতে বসেছে। আমি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় ১টা ছুঁই ছুঁই।
একটা বড় হাই তুলে উঠে বসলাম বেঞ্চে। ট্রেন তখনো আসেনি। সামনে বসা লোকটির প্রতি দৃষ্টি যেতেই কেন জানিনা বারবার সন্দেহ হতে লাগলো। আমার সাথে অনেক গুলো টাকা ছিল, আর ভয় ছিল সেই টাকা গুলোর জন্যই। আমি মিনিট খানেক সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
আচমকাই সামনে বসা লোকটি একটু "খু খু" করে কেশে ভাঙা ভাঙা অদ্ভুত একটা গলায় বলে উঠলো, " বাবু কলকাতায় থাকেন নাকি??"
আমার সন্দেহ যেন ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করলো। আমি ব্যাগটা ভালো করে কোলের কাছে আঁকড়ে ধরে বললাম " হ্যাঁ.."।
লোকটি তেমনি একটু কেশে নিয়ে বলল " ওহ!! তা আপনার ভয় নেই। আমি চোর নই.... আপনার ওই ব্যাগ আমি চুরি করবো না.....।"
লোকটির এই কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। লোকটি জানলো কিভাবে আমার মনের কথা??
লোকটি ফিক করে হেসে বলল " আপনি যেভাবে ব্যাগটা আঁকড়ে আছেন, তাতে সবাই বুঝতেই পারবে...."।
মনে মনে অবাক হলাম, " লোকটির দৃষ্টি আছে বলতে হয়...."।
আমি জিজ্ঞেস করলাম " এই ট্রেন কখন আসবে? বলতে পারেন?"
" শুনলাম তো তার নাকি ছিঁড়ে গেছে। তা কাল ভোরের আগে তো আশাই নেই....।"
কথাটা শুনেই আমার শিরদাঁড়া অবশ হয়ে এলো। "সারারাত আমায় এইভাবে একজন অচেনা লোকের সাথে ভয়ে ভয়ে কাটাতে হবে?? সর্বনাশ!!"
লোকটি ফের বললো " কাজের সূত্রে এসেছিলেন??"
আমি ঘাড় নাড়লাম। লোকটি বলল "ওহ... আমার নাম মদন। আমি এইখানেই থাকি। ঘরে বড্ড গরম, তাই স্টেশনে শুতে আসি।"
লোকটির কথা শুনে আমি তো অবাক। বলে কি এই লোকটি!! ঘরে গরম বলে স্টেশনে? এই লোক বদ্ধ উন্মাদ। কথাটা মনে হতেই ভয়ে আরো বেশ কয়েক গুণ হয়ে চেপে বসলো আমার উপর।
" জানিস ই তো কুন্তল, ভুতের থেকে পাগলের ভয় বেশি..."।
আমার কথা শুনে কুন্তল মাথা নেড়ে বললো " তারপর..."
"লোকটির কথা শুনে, আমি কোনো উত্তর দিলাম না। ব্যাগ থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বের করে খেতে শুরু করলাম। লোকটি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। এই আলো অন্ধকারে লোকটিকে ভালো করে দেখার ও উপায় নেই। শুধু এই টুকু বুঝতে পারছিলাম লোকটির মুখ মন্ডল ছাড়া বাদ বাকি আপদ মস্তক চাদরে আবৃত। চোখ আর মুখ অস্পষ্ট। তবে যে টুকু বুঝলাম তার গাল ভর্তি দাড়ি।
চোখের চাহনি ও বড় অদ্ভুত।
হঠাৎ করে লোকটি বলে উঠলো, " আমায় একটা বিস্কুট দেবেন? খুব খিদে পেয়েছে..."।
অগত্যা আমি পুরো বিস্কুটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম তার দিকে। লোকটি তখন একটা অদ্ভুত কথা বলল । বললো " আপনি ছুঁড়ে দিন। আমি নিয়ে নেব.."।
লোকটি আর আমার মধ্যে ২০ হাতের দূরত্ব। আমি ছুঁড়ে দিলাম তার দিকে বিস্কুটের প্যাকেটটা।
বিস্কুটের প্যাকেট হাতে পেয়ে তার মুখের কি অভিব্যক্তি হয়েছিল তা এই আঁধারে বোঝার উপায় ছিল না। লোকটি একটি বিস্কুট মুখে পুড়ে বলল " জানেন। আমার ও একটা পরিবার ছিল... বাবা মা, বউ, ছেলে মেয়ে সবাই ছিল....।"
আমি বেঞ্চে হেলান দিয়ে, ব্যাগটা পাশে রেখে লোকটির কথার প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, " ছিল বলছেন কেন??"
" কারণ, তারা আর কেউ বেঁচে নেই।"
লোকটির কথা শুনে আমার বেশ খারাপ লাগলো। আমি বললাম," ওহ!! খুব দুঃখিত হলাম। তা ওনারা মারা গেলেন কিভাবে??"
" সে অনেক কথা.... আপনি শুনবেন?"
আমি ভেবে দেখলাম, ট্রেন আস্তে এখনো অনেক দেরি। আর টাকা ভর্তি ব্যাগ কে কিছুতেই চোখের আড়াল করা যাবে না, তাই সময় কাটানোর জন্য এটাই মোক্ষম উপায়।
আমি বললাম " হুম। শুনবো বলুন।"
লোকটি একটু কেশে বলতে শুরু করলো " আমি আগে চাকরি সূত্রে কলকাতায় থাকতাম সপরিবারে। তারপর হঠাৎই আমার চাকরিটা চলে যায়। অনেক খোঁজার চেষ্টা করি চাকরি খোঁজার, কিন্তু কলকাতার মতন বড় শহর গুলোতে আমার চাকরি কোনো ভাবেই যেন জোগাড় হচ্ছিল না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমাদের মতন সেকেলে লোক গুলো যেন কোম্পানির জন্য এক একটা আস্ত আবর্জনায় পরিণত হতে শুরু করলো। আমার সাথে অনেক লোকের চাকরি চলে যায়। প্রায় মাস তিনেক অনেক চেষ্টা করার পরেও যখন কিছুই জোটাতে পারলাম না, তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই ফিরে এলাম এই গ্রামের বাড়িতে। এই বাড়িতে অবশ্য বাবা মা আগে থেকেই থাকতেন। আমি আর আমার স্ত্রী ও ছেলে এসে জুটলাম। ওই টুকু খাবার। তার উপর ৫ জন প্রাণী। স্বাভাবিক ভাবেই ভাড়ারে টান পড়লো। বেরিয়ে পড়লাম মজদূরী করতে। সারা দিন চড়া রোদে খেটে বাড়িতে যখন ঢুকতাম, তখন শরীরে আর কিছুই অবশিষ্ঠ থাকতো না। এইভাবেই কাটতে লাগলো। দিন দিন যেন মাথাটা ও গরম হতে শুরু করলো। একটু কিছুতেই হঠাৎ হঠাৎ রেগে যেতাম। শরীরের কষ্ট লাঘবের জন্য মদ্যপান শুরু করলাম। শেষে এমন অবস্থা হলো যে লোকে মজদুরের বদলে মাতাল বলেই বেশি চিনতো আমায়।"
এই টুকু বলে লোকটি থামলো। তারপর গোটা দুয়েক বিস্কুট পুরে নিলো মুখে। চিবিয়ে জল খেয়ে ফের শুরু করলো বলতে। আমি এই ফাঁকে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিলাম কটা বাজে। রাত ৩টে।
লোকটি বলল " এই ভাবে কেটে গেল কয়েক মাস। কয়েক বছর। হঠাৎই একদিন কি যে হলো, বাড়ি ফিরে কি একটা কথায় সবার সাথেই আমার ঝগড়া হয়ে গেল। আর মাথা গেল আগুন হয়ে। দিকবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে বাড়িতে থাকা একটা চপার নিয়ে এক ধার দিয়ে সবার গলা কেটে দিলাম। ফিনকি দিয়ে বেরোতে লাগলো রক্ত। উফফ কি রক্ত!! কি রক্ত। ঘরের মেঝে, দালান ভেসে যেতে লাগলো রক্তে। আমি পাথরের মতন দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলাম। চোখের কোনে এক চিলতে হাসি।"
লোকটির শেষ কথা গুলো শুনে আমি অনুভব করলাম আমার শিরদাড়াটা যেন শিরশির করে উঠছে। সারা শরীর দিয়ে নেমে গেল মুহূর্তের মধ্যে ঠান্ডা কনকনে রক্তের স্রোত। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে ওঠার জোগাড়। আমি আর ওখানে বসে থাকতে পারছিলাম না।
লোকটি বলে চললো " তারপর, খুন গুলো করে, আমার খুব একটা দুঃখ হয়নি। আবার আনন্দ ও পাইনি। ঠিক কি যে অনুভূতি হয়েছিল বলে বোঝানো যাবে না। অতঃপর লাশ গুলো কে আমারই বাড়ির নীচে মাটিতে পুঁতে দি। আর সেই দিন থেকেই বাড়িতে কিছুতেই ঘুমোতে পারিনা , বুঝলেন??! বড্ড গরম লাগে আমার। মনে হয় কেউ যেন সারা শরীরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। উফফ অসহ্য যন্ত্রনা। "
আমি মনে মনে ইস্টনাম জপ করতে লাগলাম। এ কোন বদ্ধ উন্মাদের পাল্লায় পড়লাম আমি?? সারা শরীর আমার কাঁপছে। পা দুটো যেন ভারী হতে হতে অবস হয়ে আসছে। মনে এই আতঙ্ক গ্রাস করলো " আমি হাঁটতে পারবো তো??"
বুকের ভিতরের হৃদপিণ্ড টাও ভয়ে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। আমি কোনো রকমে ঢোক গিললাম। ঠিক সেই মুহূর্তেই কান ফাটানো একটা আওয়াজ আমায় প্রায় চমকে দিলো। আর একটু হলেই বোধ আমার আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে পালাতো।
ট্রেনের ঘোষণা হচ্ছে। আপ শিয়ালদা ট্রেন আসছে। আর ১০ মিনিটে।
বুকের মধ্যে যেন হঠাৎ করেই জীবনী শক্তি খুঁজে পেলাম আমি।
আমি বেঞ্চ ছেড়ে উঠতে যেতেই লোকটি বলল, " জানেন। এই কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারিনি। তাই একদিন আমি বাড়ির ওই সিলিংয়ে গামছা বেঁধে ঝুলে পড়লাম। খুব কষ্ট হয়েছিল প্রথমে। একটু কাঁপুনি এসেছিল।কিন্তু বিশ্বাস করুন, কয়েক সেকেন্ড পরেই এক অপার শান্তি এসে জড়িয়ে নিলো আমায়।"
আমার মুখ ততক্ষনে হা হয়ে হয়েগেছে। আমার ব্যাগটা হাত থেকে সশব্দে খসে পড়ে গেছে। আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি ওই আপাদমস্তক ঢাকা ছায়ার দিকে। লোকটি কি মজা করছে??
বুকের ধরফরানী ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল আমার। নিশ্বাস নিতেও যেন খুব কষ্ট হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ করেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম মাটিতে। তারপরের ঘটনা কিছুই মনে নেই।
জ্ঞান যখন ফিরলো তখন আমি রেলের পুলিশের অফিসে শুয়ে। একজন লোক আমার মুখে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে।
জ্ঞান ফিরতেই ধরমরিয়ে উঠে বসলাম। পাশে বসা লোকটিকে চিনতে অসুবিধা হলো না আমার। এ যে সেই স্টেশন মাস্টার। আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে উনি বললেন " যাক!! এই যাত্রা বেঁচে গেছেন....."।
ওনার কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। " তার মানে??"
" তার মানে আবার কি?? ঘুমের ঘোরে আপনি তো মশাই ট্রেন লাইন ধরে হাঁটছিলেন। আর সেই সময় আপ লাইনের ট্রেন আসছিল। ভাগ্গিস আমি আগে ভাগেই দেখতে পাই। নইলে...."।
কোনো কথা নেই আমার মুখে। আমি যেন বোবা হয়ে গেছিলাম। কেবল কষ্ট করে একটা কথা জিজ্ঞেস করলাম কোনো মতে। " আচ্ছা ওখানে আর কোনো লোক ছিল কি??"
" লোক?? কই?? কেউ না। পুরো স্টেশন ফাঁকা। আপনি ছাড়া আর কেউ ছিল না।"
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম " তাহলে,সে কে ছিল??"
স্টেশন মাস্টার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন " কে??"
" সেই লোক। যে আমার সামনেই বসেছিল। নিজের নাম বলেছিল মদন..."।
স্টেশন মাস্টার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। তারপর একটা অদ্ভুত কথা বললেন " আপনার কি মাথায় ব্যামো আছে?? কি সব আবোল তাবোল বলছেন? আপনি ছাড়া আর কেই ছিল না।"
আমি আর কথা বাড়াই নি। তারপরের দিন সকালেই ট্রেন ধরে কলকাতা ফিরি।
আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তীব্র শব্দে ফের একটা বাজ পড়লো। আর সাথে সাথেই জানলার পাল্লা গুলো দমকা হাওয়ায় সশব্দে খুলে গেল।
সেই পাল্লা খুলে গেছিলো না কেউ খুলে দিল বলতে পারিনা।
কুন্তল অবশ্য কারেন্ট আসার পরেও বেশ অনেকক্ষন বাড়ি ফিরতে পারেনি।
সমাপ্ত।