নয়াবতার
নয়াবতার


“হ্যাল্লো নাগেশ বাবু বলুন।”
“মন্ত্রী মশাই কোথায় বোস বাবু? ওনাকে দিন তাড়াতাড়ি।”
“উনি তো একটা মিটিং এ বসেছেন।” সামনে স্কচের গ্লাস নিয়ে বসে থাকা মন্ত্রী মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে ইশারা করলেন পি.এ বোস বাবু, নিঃশব্দে হাসতে লাগলেন মন্ত্রী মশাই।
“এই সময় মিটিং!”
“তবে কি আমি মিথ্যে কথা বলছি?” গলাটা গম্ভীর করলেন বোস।
“না… মানে… বোস বাবু…”
“আরে বাবা আপনি এতো চাপ নিচ্ছেন কেন! স্যার যখন আপনার সাথে আছেন তখন কেউ আপনার একটা চুলও স্পর্শ করতে পারবেন না।”
“কিন্তু মিডিয়ার লোকগুলো তো…”
“আরে ছাড়ুন তো মশাই, ওরা একটা টপিক পেয়ে গেছে তাই এখন চিৎকার করবে কিছু দিন তারপর ঠিক চুপ করে যাবে, আপনি তাতে এতো টেনশন নেবেন না।
আর বলছিলাম কি নাগেশ বাবু…”
“কি?”
“একলাই সব চেটেপুটে খেলেন, আমাদেরও তো একটু ভাগ দিতে পারতেন, খিদে তো আমাদেরও পায় নাকি!
হ্যালো… হ্যালো… নাগেশ বাবু? হ্যালো…
যাহ বাবা!”
“কি হলো?” ঠোঁটের কাছে নিয়ে চলে যাওয়া গ্লাসটাকে ইঞ্চি তিনেক সরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মন্ত্রী মশাই।
“কেটে দিলো।”
“ভালো তো। কাটুক গে।
বড্ড ঘ্যান ঘ্যান করছে লোকটা।”
“আসলে এবারে মিডিয়ার কাছে খবর পৌঁছে গেছে বলে ঘাবড়ে গেছে আর কি।”
“হাঃ হাঃ হাঃ… ঘাবড়ে কি হবে! দুদিন শুধু একটু লুকিয়ে থাকলেই হলো। এখন লোকে উত্তেজিত হয়ে চেল্লাচ্ছে, দুদিন পর নতুন একটা খবর এলেই ব্যাস সব্বাই তখন সেদিকে ছুটবে। এসব তখন আর কে মনে রাখে!”
“ঠিক বলেছেন স্যার।”
“নতুন খবর তৈরি করতে চাইলে এক্ষুনি করতে পারি আমি, কিন্তু দাঁড়াও আগে একটু মজা লুটে নি।”
“হাঃ হাঃ হাঃ… আর নাগেশ বাবুর মতো পুলিশ অফিসারগুলোকে পায়ের তলায় রাখতে হলে এরকম একটু আধটু খেলানো ভালো।”
“বাহ্ বোস! লাখ টাকার কথা বললে একটা।”
“হেঁ হেঁ সব আপনার কাছেই শেখা স্যার।”
“হ্যালো… হ্যালো…ধুত্তোর লাইনটা কেটে গেল নাকি!” ফোনটা কান থেকে নামিয়ে নাগেশ দত্ত দেখলেন সুইচড অফ হয়ে গেছে সেটা। কিন্তু কি করে হলো, তিনি তো এই হোটেলে এসেই ফুল চার্জ দিয়েছিলেন!
ফোন নিয়ে বেশি গবেষণা করার আগেই ঝুপ করে অন্ধকার নামলো ঘরে। “যাহ বাব্বা!” মুখ থেকে একখানা বিস্ময়সূচক শব্দ বের করলেন নাগেশ দত্ত। লোডশেডিং! কিন্তু এরা জেনারেটর চালাচ্ছেনা কেন তবে! কিছুক্ষণ অন্ধকারের মধ্যেই উশখুশ করে আন্দাজে দরজার দিকে পা বাড়ালেন তিনি। অচেনা জায়গায় হিসেব করে পা ফেলতে হয় কিন্তু তাঁর মন এখন অশান্ত, অতো হিসেব করে চলার অবস্থায় নেই তিনি।
দরজার কাছাকাছি পৌঁছতেই শক্ত একটা কিসে যেন একটা ধাক্কা খেলেন নাগেশ দত্ত, ছিটকে পড়লেন মাটিতে। সাথে একটা মাংস পচা গন্ধ এসে ঝাপটা মারলো তাঁর নাকে। গাটা গুলিয়ে গেল। যদিও অন্ধকারে কিছু দেখার উপায় নেই তাও নাগেশ দত্তের মনে হলো যে জিনিসটার সাথে তিনি ধাক্কা খেলেন সেটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে, তবে কি ওটা কোনো মানুষ? পচা গন্ধটার তীব্রতা বেড়েই চলছে ক্রমশ। নাগেশ দত্ত এবার বেশ ভয় পেয়ে গেছেন। আমতা আমতা করে কোনো মতে জিজ্ঞেস করতে গেলেন, “কে?”
কিন্তু পারলেন না, মুখটা খোলামাত্রই যেন পচা গন্ধটা ভুরভুর করে ঢুকে পড়ল তার মুখ দিয়ে; আর সামলাতে পারলেন না পেটটা পাক দিয়ে উঠতেই হড়হড় করে বমি করে ফেললেন সারা গায়ে।
দপ… একটা আলো জ্বলে উঠলো হঠাৎ করে, নাহ গোটা ঘরটা আলোকিত হলো না, এমনকি ঘরের একটা কোণাতে অবধি পৌঁছালো না সেই আলোর রেশ। নাগেশ দত্ত শুধু দেখতে পেলেন একটা হাত এগিয়ে আসছে তার দিকে। আলোটা কোথাও থেকে এসে পড়ছে হাতটার ওপর নাকি হাতটারই নিজস্ব আলো ওটা? বুঝতে পারলেন না তিনি। ওটা একটু একটু করে আসছে তার দিকে… হঠাৎ নাগেশ দত্ত খেয়াল করলেন হাতটার ওপর একটা প্রজাপতির ট্যাটু… খুব চেনা চেনা লাগছে না! কোথায় দেখেছেন তিনি! আরে সেই নাইট ক্লাব থেকে ফেরার পথে যে মেয়েটাকে রেপ করা হয়েছিল সেই মেয়েটার হাতেও তো…! কিন্তু সেতো মারা গিয়েছে অনেকদিন, সে কিভাবে আসবে এখানে! ওই কেসের অভিযুক্তরা তো এখনও ফেরার, নাগেশ দত্তের সাহায্য ছাড়া তাদের পালানো কি আর সম্ভব হতো! বেশ মোটা টাকা বকশিশ পেয়েছিলেন সেবার। এখনও অবশ্য লেন দেনটা মাঝে মাঝে চলে। ছোট্ট একটা খবর দেওয়ার বিনিময়ে নাগেশ দত্তের একাউন্টে ঢুকে যায় একটা মোটা অঙ্কের টাকা।
ঝপ করে নিভে গেল আলোটা। হাতটা আর দেখতে পেলেন না নাগেশ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দপ করে আবার জ্বলে উঠলো, না এবার হাত নয় এবার দেখতে পেলেন একজোড়া চোখ, গাঢ় বাদামি রঙের। এমন চোখ তো অনেকেরই হয়, কিন্তু কেন নাগেশ দত্তর বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই মেয়েটাকে! প্রায় বছর খানেক আগে থানায় এসেছিলো মেয়েটা ধর্ষণের অভিযোগ জানাতে; কার নামে অভিযোগ না খোদ মন্ত্রী মশাইয়ের ভাইপোর নামে! পাগল নাকি! তিনদিনের মধ্যেই কোনো এক অজ্ঞাত কারণ বশত মেয়েটার বাড়িতে আগুন লেগে যায়, পুরো পরিবার একসাথে শেষ।
আবার আচমকা নিভে গেল আলোটা, আবার নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। পচা গন্ধটা আরও তীব্র হচ্ছে, শ্বাস নিতে পারছেননা নাগেশ। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি বলে তার পা দুটোও যেন বাঁধা পড়েছে মেঝের সাথে। দপ করে আবার জ্বললো আলো… এবার দেখা গেল একটা কান, আবার ঝপ করে নিভল, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার জ্বলে উঠলো এবার দেখা গেল অন্য একটা হাত…
এভাবেই শিশুর মতো ক্রমাগত আলো জ্বালানো নেভানোর খেলায় মেতে উঠেছে আগন্তুক; প্রত্যেকবারের আলোর ঝলকানির সাথে সাথে নাগেশ দত্ত দেখতে পাচ্ছেন আগন্তুকের এক একটি অঙ্গ আর সেই সাথে মনে পড়ে যাচ্ছে কোনো না কোনো পূর্ব স্মৃতি, যে স্মৃতি অত্যন্ত গোপন...অত্যন্ত জঘন্য।
অবশেষে, আলোকিত হলো আগন্তুকের ঠোঁট দুটো, ক্ষতবিক্ষত... রক্তাক্ত…কিন্তু নীচের ঠোঁটের লাল তিলটা স্পষ্ট দেখা যায়।
আঁ… আঁ… আঁ… চিৎকার করে উঠলেন নাগেশ দত্ত। আর তখনই ওই ঠোঁট দুটো থেকে ভেসে এলো একটা ছোট্ট বাচ্চার খিলখিল হাসির শব্দ। গলাটা অবিকল সেই বাচ্চাটার মতো না যে বাচ্চাটাকে পরপর কতগুলো পশু খুবলে খাওয়ার পরও প্রায় নিস্পন্দ ওই ছোট্ট শরীরটায় শেষ কামড়টা বসিয়েছিলেন নাগেশ দত্ত স্বয়ং! অপহৃত বাচ্চাটাকে উদ্ধার করতে গিয়ে ওর নগ্ন শরীরটাকে দেখে নিজের প্রথম রিপুকে দমন করতে পারেননি তিনিও। তাঁর কিই বা দোষ, সবই তো আসলে রিপুর খেলা!
হেসেই চলেছে ঠোঁট দুটো… হঠাৎ মাথার ওপর ঘটঘট করে একটা শব্দ শুরু হলো। ঠান্ডা হওয়া গায়ে এসে লাগতেই নাগেশ দত্ত বুঝলেন ফ্যানটা চলতে শুরু করেছে, কিন্তুটা আলোটা আসছেনা কেন! ভাবা মাত্রই কিন্তু এবার দপ করে জ্বলে উঠলো টিউব লাইটটা। ঘটনার আকস্মিকতায় ওপরের দিকে তাকালেন নাগেশ দত্ত… আর ঠিক তখনই মাথার ওপর সশব্দে ঘুরতে থাকে সিলিং ফ্যানটা খুলে পড়লো নীচে, সোজা নাগেশ দত্তর মাথায়। থেঁতলে যাওয়া ঘিলুটা ছিটকে গিয়ে রাঙিয়ে দিলো দেওয়ালের সাদা…
বাথরুম থেকে বেরিয়ে মন্ত্রী মশাই দেখতে পেলেন না বোসকে। মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেন, বোস আজকাল নিজেকে খুব কেউকেটা ভাবতে শুরু করেছে, বেশি উড়লে ডানা দুটো ছেঁটে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
তখনই ঝপ করে নিভে গেল ঘরের আলো, বন্ধ হলো এসিও। আঁতকে উঠলেন মন্ত্রী মশাই, গরম যে তাঁর একেবারে বরদাস্ত হয়না। কি হলো ব্যাপারটা! “এই বোস, সুধীর, বাঁকা… কে কোথায় আছিস? কি হলো এটা!” হাঁক পাড়লেন মন্ত্রী মশাই, কিন্তু সাড়া পেলেননা কারুরই। কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরেটা একবার দেখার চেষ্টা করলেন, আজ অমাবস্যা তাই আকাশে একটাও তারা নেই, সেই সঙ্গে গুমোট অন্ধকার। সাফোকেশন শুরু হলো তাঁর।
দরজার দিকে এগোতে যেতেই মনে হলো কেউ যেন একটা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
“এই কে রে?” জিজ্ঞেস করলেন মন্ত্রী মশাই, কিন্তু আগন্তুক নিরুত্তর রইল।
“উত্তর দিচ্ছিস না কেন?” এমন বেয়াদপির সঙ্গে মন্ত্রী মশাইয়ের খুব একটা পরিচিত নন তাই চোখ পাকালেন তিনি। আগন্তুক আগের মতোই মুখে কোনো উত্তর দিলো না কিন্তু মন্ত্রী মশাই স্পষ্ট বুঝতে পারলেন সে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। ভয় পেয়ে গেলেন মন্ত্রী মশাই, এক পা দু পা করে পেছাতে শুরু করলেন তিনি।
“এই তুমি কে? কথা বলছ না কেন?” তুই থেকে তুমিতে উঠে এলেও তাঁর গলার স্বর নেমে গেল খাদে। আগন্তুক আরও এগিয়ে আসছে, আর মন্ত্রী মশাইও তাল মিলিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ। অবশেষে তাঁর পিঠ ঠেকে গেল বিশাল কাঁচের জানালায়; আর তখনই দপ করে জ্বলে উঠলো একটা আলো। নাহ তাঁর ঘরটা এতে আলোকিত হলোনা, এমনকি ঘরের একটা কোণাতে অবধি সেই আলো গিয়ে পৌঁছালো না। সেই আলোয় শুধু মন্ত্রী মশাই দেখতে পেলেন আগন্তুকের চেহারাটা…
কাঁচের জানালা ভেঙে নীচে পড়ার আগে মুহূর্তে মন্ত্রী মশাই জীবনের শেষ চিৎকারটা করলেন, “ফ্র্যাঙ্ক….এন….স্টা আ আ ...ইন…।”