নিরুত্তর
নিরুত্তর
"বাসনগুলি চটপট মেজে ফেলি, বাড়ী ফিরে আবার রান্না করতে হবে।"
হাত চালাল সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা বাড়ীর কাজের মেয়ে। গতবছর অবধি স্কুলে যেত। এখন তিন বাড়ী ঠিকে কাজ করে। কয়েকমাস আগে বাপটা আবার বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। তিন ভাইবোনকে নিয়ে ওর মায়ের তো নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড়! তাই পড়াশুনো ছেড়ে অগত্যা এই কাজে লেগেছে।
সকালবেলা এই কাজ করে দিয়ে গেল,আবার বিকেলে আসবে। দুপুরের বাসন মেজে, ঘর ঝাড়ু দেবে। এ বাড়ীর গিন্নিকে সে মামী ডাকে। মামী বেশ ভাল কিন্তু!কাজে ফাঁকি না দিলে অকারণে বকাবকি করে না,বরং রোজই প্রায় কিছু না কিছু খেতে দেয়।এঁটো কাঁটা বা না খেতে পারা ফেলে দেওয়া খাবার নয়, আলাদা করে তাকে খেতে দেয়।
রোজ সকালে এ বাড়ীতে জলখাবারে রুটি হয়, সঙ্গে সাদা আলুর তরকারি। কোন কোন দিন আলু ভাজা বা আলু পোস্ত। তারপর একটা করে গুজিয়া, ঠাকুরের প্রসাদ, কোন কোন দিন পান্তুয়া। ভাইবোনগুলির জন্য মন কেমন করে, বলে,
"মামী, আমাকে দিয়ে দাও, আমি বাড়ী গিয়ে খেয়ে নেব।"
কিন্তু মামীর ওই এক কথা, এখানে বসেই খেতে হবে।
বিকেলে আবার চা খায়,সঙ্গে বিস্কুট। বিস্কুটগুলো খুব ভাল খেতে। মামা নাকি নিউ মার্কেট থেকে নিয়ে আসে। পরীদিদি আবার এই বিস্কুট ছাড়া খেতে পারেনা।
ওহ্ ! এই পরীদিদিটাই একমাত্র উৎপাত এই পরিবারের। সারাক্ষণ ওর পেছনে লাগছে। কখনো ওর চটি বাড়ীর ছাদে লুকিয়ে রাখে তো কখনো কাজের সময় ওর জামার মধ্যে বরফ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মালিকের মেয়ে, নালিশ করাও যায় না, ভাবে, যদি তাড়িয়ে দেয়!
পরীদিদি তার থেকে বছর খানেকের বড় হবে।এ বছর সেভেনে উঠেছে। কিন্তু দস্যিপনা দেখো, পুরো মাত্রায় করে যাচ্ছে এখনো! মামা এতো প্রশ্রয় দেয়,মামী কিছু বলতেই পারেনা।
আজ পরীদিদির ছুটি। এদিকেই আসছে। নিশ্চয়ই কোন বদমায়েশি বুদ্ধি আছে!
"কি করছিস সুনু?" সন্
ধ্যাকে সুনু বলে ডাকে।
"এই তো হাতের বাসন-কটা মাজছি দিদি। "
"অমলেট খাবি?"
"অমলেট!!! সেটা কী???"
'সে কী রে!! তুই অমলেট জানিস না!! গোদা বাংলায় যাকে বলে ডিমভাজা।"
"ও, তাই বলো! ওটাকে মামলেট বলে। "
"ধুর বোকা, ওটা অমলেট। ছোটলোকরা বলে মামলেট!" ফস করে বলে বসে পরী।
গায়ে লেগে যায় সন্ধ্যার। কি ! এতবড় কথা! সে তাদের খায় না পড়ে। পরীদিদির মত বাপের পয়সায় ফুর্তি করেনা। কষ্ট করে রোজগার করে।
ঝাঁঝিয়ে ওঠে সন্ধ্যা, "পুরো ইলাকার লোক বলে মামলেট! তুমি আমাকে শেখাচ্ছ?? আবার ছোটলোক বলছো??"
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে পরী, খুব মজা পেয়েছে সন্ধ্যাকে রাগতে দেখে। বলে,
"তোদের পুরো এলাকাই তো ছোটলোক!তাই তারা মামলেট বলে।"
"মুখ সামলে কথা বলো পরীদিদি!"
"ছোটলোক, ছোটলোক, ছোটলোক...."
হঠাৎ একটা চড় এসে পড়ে পরীর গালে।
অবাক হয়ে যায় পরী বাবাকে দেখে। এই প্রথম বাবা তার গায়ে হাত তুললো!চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে থাকে পরীর। বাবার প্রতি তার একটা আলাদা টান আছে,যেটা সারা পৃথিবীতে আর কারো ওপর নেই। একটা কাজের মেয়ের জন্য বাবা আজ তার নিজের মেয়েকে চড় মারলো!!
ধরা গলায় বলে, "তুমি আমাকে মারলে??"
"মারলাম, তোমার বেয়াদবি দেখে।" কঠিন গলায় বলেন অনিমেষ বাবু।
"কি করেছি আমি??ও একটা কাজের লোক!!!"
"ও তোমার থেকে আলাদা নয়। এটা তোমাকে বুঝতে হবে।"
"আলাদা নয়!! তাহলে ও বাসন মাজে কেন??পড়াশোনা করে না কেন? স্কুলে যায় না কেন?" গড়গড় করে কথাগুলি বলে ছুট্টে চলে যায় পরী।
কি করে মেয়েকে শেখাবেন সাম্য? সুশিক্ষা দেবেন কি ভাবে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর তো তারও জানা নেই!