Purnabrata kobita ghor

Classics Fantasy Others

4.5  

Purnabrata kobita ghor

Classics Fantasy Others

না ফেরার দেশে

না ফেরার দেশে

7 mins
305


সাল টা ছিল ২০১৫ আগস্ট মাস। তখন আমার বয়স ২১ , আমি একটা কল সেন্টারে কাজে ঢুকি। আমার জীবনের প্রথম কোম্পানি তার নাম ছিল কোচার ইনফোটেক। সেই খানে কাজ করতে করতে আমার দুই বন্ধু হয়। তাদের নাম হলো বিশ্বনাথ সাউ , আফ্তাব আলম আর আমার নাম পূর্ণব্রত ভট্টাচার্য। গোটা অফিস জানতো আমাদের বন্ধুত্বের কথা। সব কাজ আমরা একসাথে করতাম। লাঞ্চ থেকে শুরু করে ঘুরতে যাওয়া সব। আমাদের অনেকে বলতো ত্রি ধর্মী , কারণ আমি হলাম বাঙালি , বিশ্বনাথ ছিল বিহারি আর আফ্তাব ছিল মহামাডান। আমাদের মধ্যে কোনো দিন আমাদের ধর্ম নিয়ে কোনো অসুবিধা হয়নি। আমরা সবাই খাবার ভাগ করে এক সাথে খেতাম এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একে ওপরের বাড়ি যেতাম। যেমন আমার বাড়ির পুজো , বিশ্বানাথদের ছোট পুজো , আফ্তাবদের বগরিত। এই ভাবে আমরা একসাথে একি কোম্পানিতে ২ দু বছর ছিলাম। তারপর অন্য কাজে অন্য অফিস জয়েন্ট করার ফলে আমরা তিন জন আলাদা হয়ে যাই। কিন্তু তাতেও আমরা হোয়াটস্যাপ ফাসেবুকে কথা বলতাম হয়তো দেখা তেমন হতোনা। ভালো মনে পরে বিশ্বনাথের বিয়ে তে আমরা খুব আনন্দ করেছিলাম। তারপর বিশ্বনাথ অন্য কোম্পানিতে চলে যায়। আমি আফ্তাব রয়ে যাই। আমার আফতাবতের দেখা বেশি হতো কারণ আমার বাড়ি বৈদ্যবাটী আর আফ্তাব এর বাড়ি রিষড়া। আমি অন্য অফিস জয়েন্ট করার পরেও বালি স্টেশনে মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যেত আমাদের। আমার বিয়েতে লাস্ট আমরা তিন বন্ধু একসাথে হয়েছিলাম। তারপর থেকে প্রায় দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে যায়। আফ্তাব শুধু মাঝে মাঝে কল করতো। স্টেশনে দেখা হলে মিনিট ১০ - ১৫ কথা বলতাম। সত্যি বলতে বিয়ের পরে আমি তেমন কল বা মেসেজ করতাম না আফ্তাব কে। বিশ্বনাথ তো ওর দুই বাচ্চা আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এমনি বেশ অনেক দিন পর আফ্তাব আমার হোয়াটসআপ স্টেটাসে একটা রিপ্লাই করে। ছবিতে আমি আর আমার ওয়াইফ একসাথে ছিলাম। আফ্তাব লেখে তোমাদের এই ছবির সুন্দর মুহূর্ত টাকে বার করে ঘরেতে সাজিয়ে রাখো। আমি তখন ওকে লিখি তুমি কেমন আছো কুশল প্রশ্ন করি। তখন ও লেখাটা সীন করে আমাকে ভিডিও কল করে। আমি কলটা রিসিভ করে হতবাক হয়ে যাই। দেখি সে বিছানাতে শুয়ে আছে পাশে সেলাইন চলছে। আমি এই আফ্তাব কে কোনো দিন দেখিনি , শুকিয়ে একদম দড়ি হয়ে গেছে। সেই আফতাব কই যাকে আমি চিনতাম। তার চোখ গুলো যেন কোটরে ঢুকে গেছে যেন হারের উপর বসানো। সেই দৃশ্য দেখে আমার প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড়। হয়তো ও সেটা বুঝতে পেয়েই কল টা কেটে দেয়। তারপর আমি কল করি আফ্তাব কে। জানতে চাই কি হয়েছে কবে থেকে। ও বলে মাত্র দুই মাসে ওর এই হাল হয়েছে। মুখ দিয়ে ব্লাড বেরিয়েছিল ওর। সেই দেখে ডাক্তার কে দেখতে গিয়ে রিপোর্টে দেখা যায় যে ওর লিভারে ক্যান্সার ধরা পড়েছে লাস্ট স্টেজে আছে ও। এখন ওর কেমো চলছে ৬ টা কেমো নেওয়ার পর অপারেশন হবে। আমি কেঁদে ফেলি এই সব শুনে। আমাকে ও বলে ভাই একবার আমাকে দেখে যা হয়তো আর দেখতে পাবোনা তোকে । আমি এই সব কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যাই । আমার বাবা মা ও আফতাব কে খুবি ভালো বাসতো, তারাও এই কথা শুনে খুব কষ্ট পায় । তারপর একদিন আমি বাবা আফতাবদের বাড়িতে গিয়ে তাকে দেখে আসি । চোখের সামনে আফতাব কে ওই অবস্থায় দেখে মন টা আরও খারাপ হয়ে গেল । তবে দেখলাম ওই অবস্থায় বিছানায় শুয়ে ও আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে সে । ওর দাদা কে চাও মিষ্টির ব্যবস্থা করতে বলে । অনেক আপত্তি করাতে ও শুনলো না । বুঝতে পারছিলাম যে বেশি কথাও সে বলতে পারছিল না । তাও কষ্ট করেও হলে সে আমাদের খবর আমার মায়ের খবর জানতে চাইলো । সে বললো তুমি বললো তোমরা আমার আপনজন তোমাদের দেখে নিলাম মন শান্তি হয়ে গেল । বুঝলাম ভিতরে ভিতরে ও একদম ভেঙে পরেছে । আমি বললাম কিছু হবে না তোর , সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে । আমার কথা শুনে ও শুধু একটু হাসলো । বাবা ওর মাথায় হাত দিয়ে আশিবার্দ করে বললো তুমি খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠবে । আফতাব শুধু একটাই কথা বললো তোমরা আমার জন্য বেশি বেশি করে দোয়া করো যেন আমি তোমাদের সাথেই থাকতে পারি । এই বলে সে মুখে হাত দিয়ে দৌড়ে চলে যায় বাথরুমে । সেখানে ওর দাদা ছিল , ওর দাদা আমাদের বলল ওর নাকি কিছু খেলেই রক্ত বমি হচ্ছে । ওর লিভার এ তিনটি ঘা বেড়িয়েছে টেস্ট রিপোর্টে । শুধু লিকুইড খাবার খাচ্ছে তাও সব উঠে যাচ্ছে । ডাক্তার বলেছে ছয়টা কেমো টানার পর অপারেশন করবে । তিনটে কেমো নেওয়া হয়েছে । এর মধ্যেই দেখি আফতাব চলে এসেছে । আমি আর ওকে বেশি কথা বলাতে চাইলাম না । ওকে বললাম তাহলে আসি ভাই , আমি কাল কল করবো । আফতাব বলে কাকে ? আমি বললাম কেন তোকে । সে বললো কাল আমার কেমো আছে , আর কেমন নেওয়ার পর আমি বেহুঁশ থাকি তিন চার দিন । আমি ওর দাদার দিকে তাকালাম, ওর দাদা ঘাঢ় নাড়লো । আমি আবার ওর হাতটা ধরে ওর মনে সাহস দিয়ে বাড়ি চলে আসি । তারপর হোয়াটসঅ্যপে আমি খোঁজ নিতাম ওর । আর ওর দাদার নম্বর টা এনে ছিলাম মাঝে মাঝে কল করতাম । যখন কেমো চলতো তখন ওকে আর অনলাইন দেখতে পেতাম না । তারপর কিছুদিন পর দেখি আফতাবের ভিডিও কল আসছে । আমি কলটা ধরি দেখি হসপিটালে বেডে শুয়ে আছে সে। কিছুই বলছে না শুধু জল ভরা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি এই দেখে ওর দাদা কে কল করি । ওর দাদা বলে ডাক্তার বলেছে আর দেরি করা যাবে না অপারেশন করতে হবে । আমি বললাম ভালো হয়ে যাবে তো , ওর দাদা শান্ত গলায় বললো হ্যাঁ ।আমি ও শান্তি পেলাম একটু । তারপর কিছুদিন পর আমি আর কোনো খোঁজ খবর নিইনি । তারপর প্রায় দিন পনেরো পর দেখি আফতাবের মধ্যে হোয়াটসঅ্যপে অনলাইন হয়নি । ওকে অনলাই দেখলে আমি বুঝতাম ও ভালো আছে । কিন্তু পনেরোটি দিন ও অফ লাইন , আমার একটু চিন্তাই হলো । ওর দাদাকে কল করলাম , জানতে পারলাম যে আফতাব হসপিটালে আছে । আমি জানতে চাইলাম এতোদিন ধরে হসপিটালে আছে ও । ওর দাদা বললো না তা না । অপারেশন হয়ে গেছে ওকে বাড়িতেও নিয়ে চলে এসে ছিলো , কিন্তু জল পরা বন্ধ হচ্ছে না তাই আবার ভর্তি করেছে হসপিটালে এই দুদিন হলো । এখন খুব দুর্বল ও একটু ফিট হলে আবার অপারেশন হবে , তাই এখন হসপিটালে থাকতে হবে কিছুদিন । তারপর আমি আর কল করিনি , মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যপে চেক করতাম আফতাবদের লাস্ট সিন টাইম । কিন্তু সেই একি ডেট দেখাতো । আমিও অফিসের কাজের চাপে ব্যস্ত থাকতাম । এই ভাবে কিছু দিন পর হোয়াটসঅ্যপে দেখি আফতাব অনলাইন হয়ে ছিল , লাস্ট সিন সেই দিনই দেখাচ্ছিল । তখন দুপুর বেলা আমি অফিসে ছিলাম । আমি ব্যস্ত থাকার কারণে একটা এস এম এস করি আফতাবকে " ভাই কেমন আছো , বাড়ি ফিরেছো " এই কথা গুলো টাইপ করে আমি সেন্ড করে দিই হোয়াটসঅ্যপে , দিনটা ছিল বুধবার ৩১\০৭\২৩ । দেখলাম যে ডবল টিক পরলো । তারপর আমি অফিস ছুটির পর বাড়ি গিয়ে ফোনটা চার্জে ফেলে চান করতে যাই । ফিরে এসে ফ্রেস হয়ে বিছানায় বসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি আজানা নম্বর থেকে দুটো মিস কল এসেছে । আমি চান করতে গিয়েছিলাম তখন এসেছে । আমি সেই নম্বর টিকে রিং ব্যাক করলাম এক ব্যক্তি কলটা রিসিভ করলো । আমি বললাম আপনি আমাকে কল করেছিলেন । ওই ব্যক্তি আমাকে বললো তুমি আফতাবদের বন্ধু । আমি বললাম হ্যাঁ, ওই ব্যক্তি আফতাবদের বড়ো দাদা ছিলেন । আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম দাদা আফতাব কেমন আছে বাড়ি ফিরেছে । তখন উনি আমাকে বলেন যে আফতাবদের জল পড়া বন্ধ হচ্ছিল না অপারেশন সফল হয়নি শনিবার আফতাব সকাল ৬ টার সময় হসপিটালেই মারা গেছে মানে ২৯\০৭\২০২৩ । সেই কথা শুনে আমার হাত থেকে ফোন পরে যাওয়ার উপক্রম । আফতাবের দাদা বলে অনেক কষ্ট পেয়েছে ও অনেক চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারলেন না আমরা। আমি আর শুনতে পারছিলাম না তখন আমার চোখে জল তার আধিপত্য বিস্তার করে দিয়েছে । ফোনটা কেটে আমি বসে পরি । আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আফতাব আর নেই । আমার বাবা মা কে বলার সাথে সাথে তারাও কান্নায় ভেঙে বলে । আমি তখন বলি মনে মনে দেখ আফতাব দেখে যা রক্তের সম্পর্ক সব না তোর জন্য আমার বাবা মায়ের চোখের জল আজ বাধ ভেঙেছে । সেদিন রাতে আমরা আর কেউ কিছুই খাই নি । শুধু আফতাবের সব স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভাসতে লাগলো । মনে পরলো তার সেই বলে যাওয়া শেষ কথা খানা " তোমাদের এই ছবির সুন্দর মুহূর্তে টাকে বার করে ঘরেতে সাজিয়ে রাখো ভাই " । তাই করবো আমি এই ছবির সাথে জড়িয়ে থাকবে তার স্মৃতি থাকবে আমার প্রাণের কাছে ।

তুমি সুখে থেকো বন্ধু আমার , তোমার ওই না ফেরার দেশে ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics