Ananya Podder

Classics Inspirational

3  

Ananya Podder

Classics Inspirational

মনের হদিশ

মনের হদিশ

6 mins
317



"শোন্ তমা, শোন্, যাস না মা, আমার কথা শোন্ | "

"না, মা, শুনবো না | এতদিন তোমাদের সবার কথা শুনেছি | কিন্তু আজ আর না, আজ বাবাকে বলতেই হবে | "

" তোর বাবা মানবেন না | অশান্তি আরও বাড়বে | "

"অশান্তি একদিন হবেই মা | কিন্তু তাই বলে সত্যি টা থেকে আর কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?? "

তমা যখন মৃন্ময়ী দেবীর কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো, তখন শেষ ভরসা সুস্মিতা এসে পথ আটকালো তমার| "যাস না বোন, বাবার বয়স হয়েছে, এই বয়সে উনাকে এমন কোনো কিছু জানাস না যাতে উনি সেটা শুনে কষ্ট পান | "

" কষ্ট পেলে পাবে | কিন্তু মিথ্যে কল্পনার জীবনে বেঁচে থেকে আনন্দ নেওয়ার কোনো মানে আছে কি?? "

এরপর তমার সামনে আর কেউ পথ আটকাতে পারলো না | তমা গিয়ে দাঁড়ালো দোর্দণ্ডপ্রতাপ নারায়ণ সান্যালের সামনে | চার পুরুষ আগে এই সান্যাল পরিবার ছিল বাঁকুড়া জেলার দুর্লভপুর গ্রামের জমিদার বংশ | আজ আর কোনো জমিদারি না থাকলেও মেজাজ আর অর্থে এখনও নারায়ণ সান্যাল নিজেকে জমিদার ছাড়া কিছু কম জানেন না | সেই নারায়ণ সান্যালের মেয়ে হলো তিলোত্তমা | তিলোত্তমা বারো ক্লাসের পরে আর দুর্লভপুর গ্রামে থাকেনি | পাঁচ বছর ধরে তার বাসস্থান হলো কলকাতা | সেখানকার সাইন্স কলেজের ছাত্রী সে | দুর্লভপুর গ্রামের বাড়িতে নারায়ণ সান্যাল, তার স্ত্রী মৃন্ময়ী সান্যাল, পুত্রবধূ সুস্মিতা সান্যাল আর জনা তিনেক সবসময়ের জন্য কাজের লোক থাকেন | নারায়ণ বাবুর দুই সন্তান, ছেলে অলকেন্দু ও মেয়ে তিলোত্তমা দুজনেই আপন ইচ্ছেতে বাড়ির বাইরে রয়েছে বহুদিন | নারায়ণ বাবুর বয়স হলেও তাঁর মেজাজে এখনও পূর্ণ বসন্তের ছোঁয়া আছে |

সেই নারায়ণ বাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তমা| নারায়ণ বাবুকে প্রণাম করে স্মিত স্বরে বলল, " তোমার সাথে কিছু কথা আছে বাবা | "

" কখন এলি তুই?? ... "

"এই তো কিছুক্ষন হলো | "

"তা বেশ ভালো | তাহলে হাত মুখ ধুয়ে, খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম কর | পরে কথা বলবো | "

"না, বাবা, আমার কথাটা জরুরী | "

"বেশ তো | দুপুরে খাবার টেবিলে বলিস | "

"না, বাবা কথাটা এখনই বলতে হবে আমাকে | "

"বেশ, বল, কি বলতে চাস তুই |"

"তুমি দিদিভাইয়ের বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবলে কি?? "

"তমা !!!.... স্তব্ধ হও | তুমি বোধহয় জানোনা, তুমি কি বলছো?? "

" আমি জানি বাবা | তুমিও জানো, আমি কিছু ভুল বলছি না | তবে কেন দিদিভাইকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছ তুমি?? "

"আমি তোমার দিদিভাইকে কষ্ট দিচ্ছি !!! .... একথা মিতা নিজে তোমায় বলেছে?? "

" দিদিভাই কখনো নিজের জন্য কিছু বলেছে কাউকে, যে আজ বলবে?? .... আমি বলছি, দিদিভাইকে তুমি বিয়ে দাও | ওর একজন জীবনসঙ্গী দরকার, যাকে ভালোবেসে ঘর বেঁধে দিদিভাই ভালো ভাবে বাঁচতে পারবে | "

"না, সেটা হয় না | আর কে বলল, যে, মিতা ভালো ভাবে বেঁচে নেই?? .... আমি মিতার সাথে নিজে কথা বলেছি | ও তো কোনোদিন বলেনি, যে, ও খারাপ আছে | আর ও খারাপ থাকবেই বা কেন?? .... ওর কিসের অভাব রেখেছি আমি?? "

"তুমি ওর জীবনের প্রয়োজন মেটাচ্ছ বাবা, ওর জীবনের চাহিদা নয় | আর কতদিন বাবা মিথ্যে ভালোবাসার মায়া জালে ওকে বেঁধে রেখে দেবে?? "

" তোর সাথে আর এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না আমি | "

" কেন বলতে চাও না | দিদিভাই পরের মেয়ে বলে !! ... "

"তমা !!! "... নারায়ণ বাবু চিৎকার করে তমাকে থামিয়ে দিতে চান | এমন সময় লক্ষ্য করেন, ঘরের এক কোণে মৃন্ময়ী দেবী আর সুস্মিতা এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে |


সুস্মিতাকে দেখে নারায়ণ বাবু শিশুর মতো বলে ওঠেন, " দেখেছিস মিতা, তমা কি বলছে?? .... আমি নাকি তোকে পরের মেয়ে ভাবি !! "

" তুই থাম তমা | "... পাশ থেকে সুস্মিতা, তমা যাকে দিদিভাই বলে ডাকে, সে তমাকে থামানোর চেষ্টা করে|


" না, আমি আজ কিছুতেই থামবো না | সত্যিটা আজ তোমাদের সবাইকে মানতে হবে | কেন বাবা, কিসের জন্য দিদিভাইকে তুমি এই সংসারে বেঁধে রেখেছো?? ... কিসের অধিকারে?? ... যার সাথে সম্পর্ক তৈরী করিয়ে নিয়ে এসেছিলে তুমি দিদিভাইকে, সেই তো তোমার সংসার ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে আজ বারো বছর হয়ে গেল | বড়দা তোমার মুখের উপর কখনও কিছু বলতে পারেনি | তাই সে কোনোদিন তোমায় জানাতেও পারেনি, সে তার কলেজেরই একটি মেয়েকে ভালোবাসে | তুমি মায়ের কাছ থেকে সব শুনেও দাদার বিয়ে তার পছন্দ মতো মেয়ের সাথে দিলে না কারণ, তোমার ভয় ছিলো, শহরের মেয়ে এসে যদি তোমার সংসারে মানিয়ে নিতে না পারে !! ... তাই প্রায় এক প্রকার দাদাকে ধরে বেঁধে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিদিভাইকে নিয়ে এলে এ সংসারের বউ করে | কি লাভ পেলে তুমি?? ... তোমার জেদের সামনে সাময়িক মাথা নোয়ালেও বড়দা তোমার জেদের মতোই জেদ করে বৌভাতের দিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল চিরকালের জন্য | দিদিভাইকে শুধু সিঁদুর পরালো সে, কিন্তু স্ত্রী বলে মানতে পারলো না, তাই তাকে স্পর্শ টুকু করার ইচ্ছেও সে রাখেনি | তাই ফুলসজ্জা হবার আগেই তোমার ছেলে গৃহত্যাগী হলো | তোমাদের বাবা ছেলের জেদের লড়াইয়ে পিষে গেল আমার দিদিভাইয়ের জীবন |.... তুমি দিদিভাইয়ের পরিবারকে দেখে রাখলে, মিথ্যে পিতৃ স্নেহে জালে জড়িয়ে রাখলে দিদিভাইকে | দিদিভাইও বোকার মতো তোমার মিথ্যে গরিমাকে বাঁচিয়ে রাখতে জীবনের অমূল্য বারোটা বছর নষ্ট করে দিলো | পাছে দিদিভাই ঘরের বাইরে গিয়ে সংসার বিমুখ হয়, তাই তুমি দিদিভাইকে কলেজে পড়তে দিলে না পর্যন্ত | শুধু বললে, মিতাকে রোজ চোখের সামনে না দেখলে নাকি তোমার দিন ভালো কাটে না | এ কেমন স্বার্থপর ভালোবাসা তোমার, এ কেমন স্বার্থের পিতৃত্ব?? ".... দিদিভাইরা গরিব বলে তুমি ওর সাথে যা খুশি করতে পারো না !! "

"না, মিতাকে আমি কখনো এ সংসার থেকে ছাড়বো না | অলকেন্দু একদিন নিজের ভুল ঠিক বুঝতে পারবে | একদিন সে ফিরবেই এ সংসারে | সে যেদিন ফিরে আসবে, সেদিন সে দেখবে, তার স্ত্রী সেদিনও তার জন্য অপেক্ষা করে আছে | আমি যে তার জন্য ভুল পাত্রী নির্বাচন করিনি, সেদিন সে বুঝতে পারবে | "

"তুমি এখনও বিশ্বাস করো বাবা, যে, বড়দা আবার ফিরে আসবে?? .... ফিরে এসে দিদিভাইয়ের সাথে সংসার করবে?? "

"হ্যাঁ, সে ফিরবেই | তাকে ফিরতেই হবে | "

"বড়দা আর কোনোদিন ফিরবে না | কারণ, বড়দা আবার বিয়ে করেছে | সে তার পছন্দের জীবনসঙ্গিনীকে নিয়ে ভালো আছে, সুখে আছে | ওদের দুটি সন্তান আছে | তাহলে কেন দিদিভাইয়ের কাছে ফিরে আসবে সে?? "

"মিথ্যে বলছিস তুই | "

"মিথ্যে আমি বলছি না বাবা | বড়দা আবার বিয়ে করেছে, আর সেই বিয়ে করেছে আইনসম্মত ভাবে, রেজিস্ট্রি করে | বড়দার জীবনে দিদিভাই কোথাও নেই | এই দেখো, বড়দার বিয়ের রেজিস্ট্রি কপির জেরক্স | বড়দা নিজে আমাকে দিয়ে বলেছে, "বাবাকে বলিস, আমার আর মধুছন্দার বিয়ে ভাঙবে, এমন ক্ষমতা বাবার নেই | সুস্মিতা আমার কখনো কেউ ছিলো না, আর কোনোদিন কেউ হবেও না | "


..... তারপরেও বাবা, তুমি দিদিভাইকে এই মিথ্যে সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়ে রাখবে?? .... দিদিভাই তোমাকে বারো বছর ধরে শুধু বাবা বলে ডাকেই না, আমার চেয়েও তোমায় বেশি ভালোবাসে, বেশি সম্মান করে | সেই ভালোবাসার কি কোনো দাম দেবে না তুমি?? .... যদি বড়দার জায়গায় দিদিভাই চলে যাওয়া তো দূরের কথা, মারাও যেত, তাহলে তুমি কি বড়দাকে আবার বিয়ে দিতে না?? .... তবে দিদিভাইয়ের সময় এই ভেদাভেদ কেন?? আইনত দিদিভাইয়ের সাথে বড়দার তো কোনো বৈবাহিক সম্পর্কই নেই | তবে কেন দিদিভাই মিথ্যে মিথ্যে বড়দার নামের সিঁদুর পড়বে?? .... "


"কিন্তু সমাজ কি বলবে মা?? "

"সমাজ তোমার মিতার জীবনের কষ্ট ভাগ করে নিতে এসেছে কখনো, যে আজ তার সুখের হিসাব নিতে আসবে?? .... তুমি যেদিন দিদিভাইকে এ বাড়িতে আটকে রাখলে এ বাড়ির বউ করে, সেদিন আমি খুব ছোটো ছিলাম | তোমার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারিনি | তাই নিজের মতো করে প্রতিবাদ করে কোনোদিন বৌদি বলিনি তোমার কুমারী পুত্রবধূকে | সে চিরদিন আমার দিদিভাই হয়ে থেকে গেছে | "

" সত্যিই বড়ো স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম আমি | মিথ্যে মোহে নিজেও জড়িয়ে ছিলাম, তোকেও জড়িয়ে রেখেছিলাম | আমার কাছে আয় মিতা, তোর এই বুড়ো বাবাকে ক্ষমা করতে পারবি কি মা কোনোদিন??"

"এভাবে বোলো না বাবা, তোমাকে আমি নিজের বাবার চেয়ে কোনোদিন কিছু কম ভাবিনি | "


"বল মা, তুই কি চাস আমার কাছে?? "


"দিদিভাইয়ের মনের হদিশ আমি পেয়েছি বাবা | আমাদের রঞ্জনদা দিদিভাইকে প্রথম থেকেই পছন্দ করে | দিদিভাইয়েরও খুব খারাপ লাগে না রঞ্জনদাকে | রঞ্জনদা যখন আমাকে পড়াতে আসতো, আমি দেখেছি রঞ্জনদার চোখে দিদির প্রতি নিঃস্বার্থ ভালো লাগা, যাকে কোনোদিন রঞ্জনদা ভালোবাসার নাম দেননি, পাছে দিদিভাইয়ের কোনো অসম্মান হয় | আজও রঞ্জনদা দিদিভাইকেই মনে মনে ভালোবাসে, তাই আজও সে অবিবাহিত | তুমি ওদের চার হাত এক করে দিয়ে সমাজকে দেখাও, তোমার চোখে ছেলে, মেয়ে সবাই সমান | গ্রামের জমিদারের মতোই তুমি সুবিচার করো বাবা | সেখানে স্বার্থপরতা দেখিয়ো না|"


"তুই ঠিকই বলেছিস তমা | আমি অলকেন্দুকে ত্যাজ্য পুত্র করবো, আর মিতাকে আইনত মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করবো | তারপর তোর দিদিভাইকে কন্যাদান করবো রঞ্জনের কাছে | "


নারায়ণ বাবুর কথা শুনে তিলোত্তমা জড়িয়ে ধরে তার কোনোদিন বৌদি না হওয়া আদরের দিদিভাইকে | সে আজ খুব খুশি | সে পেরেছে তার দিদিভাইয়ের মনের হদিশ তার বাবার কাছে পৌঁছে দিতে | সে পেরেছে, সংসার সমাজের মিথ্যে গরিমা ভেঙে বাড়ির বউকে তার প্রাপ্য অধিকার, প্রাপ্য ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে | সে সমাজকে দেখাতে পেরেছে, জীবনে ভালো থাকার অধিকার সবার সমান, সেখানে শুধু সাম্যের অধিকার চলে, ঘুঁচে যায় নারী পুরুষের ভেদাভেদ, বেঁচে থাকে মানুষ, বেঁচে থাকে মানবতা |

----------------------------------------------



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics