Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy

2  

Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy

মেঘমিত্রার কলঙ্ক

মেঘমিত্রার কলঙ্ক

8 mins
388



টেক অফের সাথে সাথে প্লেনের ইঞ্জিনের যান্ত্রিক আওয়াজে মেঘমিত্রার কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়। এই ছত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত নাহলেও ছ'শোবার প্লেনে চাপতে হয়েছে মেঘমিত্রাকে, কাজের তাগিদে। তবুও আজও অভ্যাসটা হয়নি। সেই প্রথম বারের মতোই এখনো সেই টেক অফের সময়ে ভয়ানক অস্বস্তি, রীতিমতো কষ্ট হয় ওর। আরও অনেককিছুতেই তো কষ্ট হয়, কষ্টে বুকটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে চায়। অশেষ ধৈর্য্যের পরীক্ষা দেয়।


প্রেম তো কখনোই স্বার্থপর নয়, প্রেমের পরতে পরতে যে মিশে থাকে সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের পাপড়ির মতো নরম তুলতুলে অনুভূতির স্পর্শ! তবে? তবে কেন এমন দুর্ঘটনা ঘটে গেলো? কেন মেঘমিত্রা পারলো না নিজের মনের গভীরতম কোণে শিকড় গেড়ে থাকা আকৈশোরের প্রেমকে বাঁচাতে? এমনি করে কেবলমাত্র পরিস্থিতির চাপে পড়ে হারিয়ে ফেললো মেঘমিত্রা নিজের প্রেমকে? ওর মধ্যে কী তবে কোথাও লজ্জা, ভয়, সঙ্কোচ, অথবা অবহেলা বাসা বেঁধেছিলো? জানে না মেঘমিত্রা। এই এতোগুলো বছরেও এর একটা উত্তরও খুঁজে পায়নি মেঘমিত্রা। শুধু মনের অন্ধকার ঘরে আর কখনো আলো জ্বলেনি। মানে মেঘমিত্রা আর কাউকেই নিজের জীবনে জায়গা দিতে পারেনি। মেঘমিত্রা মনে মনে ঐ কলঙ্কময় অধ্যায়ের স্মৃতি আগলে বসে আছে। এইই হয়তো ওর প্রায়শ্চিত্ত!




******




"ফার্স্ট রো, রাইট সাইড কর্ণার... ল্যাবে অথবা আমার অফিসে এসে একবার দেখা করে যেও। কথা আছে দরকারী," গমগমে গলায় বলে উঠলেন সৌপর্ণ স্যার... স্টুডেন্ট মহলে বা রুটিনে লেখা এস ডি জি অর্থাৎ সৌপর্ণ দাশগুপ্ত। ফিজিওলজি অনার্সের ফাইনাল ইয়ারের পুরো ক্লাসের চোখে কৌতূহল। সবার চোখ যেন পুরোপুরি আঠা লাগানো হয়ে সেঁটে গেলো মেঘমিত্রার মুখে। মেঘমিত্রা সেনগুপ্ত, কলেজের সেরা ছাত্রী। লেখাপড়ার পাশাপাশি গান, নাটক, ডিবেট, এক্সটেম্পো... এমনকি স্পোর্টস অ্যাণ্ড গেমসেও। আর সৌন্দর্যে? একটিই বাক্য যথেষ্ট, কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকে ফাইনাল ইয়ার, সব ছেলেদের হার্টথ্রব মেঘমিত্রা...

মেঘমিত্রা সেনগুপ্ত, ফিজিওলজি অনার্স, ফাইনাল ইয়ার। আর ডঃ সৌপর্ণ দাশগুপ্ত... মাত্র কয়েকমাস এই কলেজে, হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট ডঃ দেবাশীষ মিত্র রিটায়ার করার ঠিক পরপরই সৌপর্ণ স্যার এসেছেন। তবে এইচওডি না হয়েও প্রায় সম্পূর্ণ কাজের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। আসলে ভয়ানক ডায়নামিক! 




সৌপর্ণ স্যারের বয়স বড়জোর বছর আঠাশ কি তিরিশ হবে। তবে যথেষ্ট গুরুগম্ভীর রাশভারী বলেই তো মনে হয়। তা নাহলে সারা কলেজের ছাত্রীমহল একেবারে ফিদা হওয়া সত্ত্বেও এইরকম হ্যাণ্ডু প্রফেসরের জন্য, কেউ আজ পর্যন্ত সৌপর্ণ স্যারের কাছাকাছি ঘেঁষার চেষ্টাও করতেই পারেনি? সুতরাং এহেন সৌপর্ণ স্যার মেঘমিত্রাকে ডেকে নিয়ে আলাদাভাবে কী এমন কথা বলতে চান? কৌতূহল তো অবশ্যই হবে সবার। আর মেঘমিত্রা... যে নাকি পাত্তাই দেয়নি এপর্যন্ত কলেজে ওর অগণিত গুণমুগ্ধদের... তার মুখটাও কী মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো? চিন্তার রেখা কী খেলে গেলো মুখে? আলাদা করে একলা কেন?




ক্লাসে লেকচার শেষে মেঘমিত্রার উদ্দেশ্যে কথাকটি বলেই গটগট করে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন সৌপর্ণ স্যার। গায়ের ইষৎ তামাটে রং, উচ্চতা ছ'ফুটের আশেপাশে, চওড়া কপাল, একমাথা ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল, পুরুষালি চৌকো মুখে রিমলেস চশমার পেছনে একজোড়া উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ... সৌপর্ণ স্যারের ব্যক্তিত্বকে কয়েকগুণ বাড়িয়েছে। স্যার ক্লাস ছেড়ে বেরোনোর সাথে সাথে মেয়েমহলে "আহা, উহু" শুরু হলো বুকের ওপর হাত রেখে, ঠোঁট সরু করে, চোখ বুজে, এ ওকে জড়িয়ে ধরে। আর ক্লাসের ছেলেগুলোর চোয়াল শক্ত হয়েছে শুধু।  প্রয়োজনের বাইরে যে স্যার কিনা একটা কথাও বলেন না, তার কী এমন কথা থাকতে পারে মেঘমিত্রার সাথে? তাও আবার একলা, আলাদা করে? কল্পনা-জল্পনা তুঙ্গে। 




ওদের ক্লাসের জয়দীপ কলেজের জিএস। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে মেঘমিত্রাকে পটানোর চেষ্টা করে চলেছে। সুতরাং জয়দীপের এই ব্যাপারটা মোটেই হজম হলো না। খুব স্বাভাবিক সেটা। তবে এই নিয়ে মেঘমিত্রাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ক্লাসের সবাই খেয়াল করলো, মেঘমিত্রা কাঁধে ব্যাগটা ফেলে ক্লাসরুমের বাইরে পা বাড়িয়েছে। একটু অন্যমনস্ক মেঘমিত্রা। মাথা নীচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে ও কলেজের লম্বা করিডোর ধরে ধীরেধীরে এগিয়ে গেলো ফিজিওলজি ল্যাবের দিকে। গোটা ক্লাস প্রবল উত্তেজনা আর উৎকন্ঠায় নিজেদের ক্লাসরুমের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে রইলো, সৌপর্ণ স্যারের সাথে দেখা করে মেঘমিত্রার ফিরে আসার অপেক্ষায়। ভাগ্যিস এটা অফ পিরিয়ড।


 


মেঘমিত্রা আজকাল এমনিতেই একটু ভয়ে ভয়েই দিন কাটাচ্ছে। এবারে বোধহয় ওর রেজাল্টটা আর অতটাও ভালো হবে না। কিছুতেই পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না, প্রতিবছরের মতো। তাছাড়াও আরো একটা বিষয় নিয়ে বাড়ীতে তুমুল অশান্তি চলছে। কাউকে কিছু বোঝাতেই পারছে না। আসলে কেউ যদি জেদ ধরে বসে থাকে যে কিছুতেই বুঝবে না, তবে আর কে তাকে বোঝাবে? একরকম হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছে মেঘমিত্রা। দিদি দিতিপ্রিয়া হয়তোবা বুঝবে, এমন একটা আশা ছিলো ওর মনে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো পুরো উল্টো, দিদিও বুঝতেই চাইলো না। অথচ এই দিদির জন্য কীকীই না করেছে মেঘমিত্রা। যাকগে, ও আর কাউকে কিছু বোঝাবে না। নিজের একটা চাকরির খুব দরকার, অথচ পড়াশোনা শেষ না করেও তো সম্ভব নয় তা।




সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ফিজিওলজি ল্যাব লাগোয়া সৌপর্ণ স্যারের অফিস চেম্বারের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে মুখ বাড়িয়ে মেঘমিত্রা বললো, "আসতে পারি?" চৌকোমুখ হাসিতে চওড়া হলো সৌপর্ণ স্যারের। চোখে "হ্যাঁ, এসো", আমন্ত্রণ। মেঘমিত্রা ভেতরে ঢুকে বসলো সৌপর্ণ স্যারের মুখোমুখি। খুব অপ্রত্যাশিত কিছু নয়, প্রত্যাশিত মতোই দু-একটি মামুলি কথাবার্তা। তবুও কেন যেন চোখদুটো ভিজে উঠলো মেঘমিত্রার, আর বোধহয় তা লুকোতেই "আসি" বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও। চেম্বারের সুইং ডোর ঠেলে বাইরে বেরিয়ে দোপাট্টার কোণে চোখ মুছতে মুছতে করিডোর ধরে নিজেদের ক্লাসরুমের দিকে এগোচ্ছিলো ও, নেক্সট পিরিয়ডটা তো অফ নয়। এমনিতেই কলেজ ফেস্টের রিহার্সাল রিহার্সাল করে বেশ কটা দিন ঠিক এই ক্লাসটাই মিস্ করেছে মেঘমিত্রা। এরপর অ্যাটেনডেন্সের সমস্যা হলে আবার কলেজ ইউনিয়ন আর জিএসকে ধরাধরি করতে হবে। এসব একদম পোষায় না ওর। কিভাবে যে বাড়ীর সমস্যা সামলে, পড়াশোনা শেষ করে, ভালো রেজাল্ট আর একটা চাকরি জোগাড় করবে... তাই নিয়ে দিশেহারা অবস্থা মেঘমিত্রার।




লম্বা করিডোর পেরিয়ে ক্লাসরুমের কাছাকাছি পৌঁছে চোখমুখ মুছে ক্লাসে ঢোকবার মুহূর্তে প্রবল হৈচৈ শুরু হয়ে গেলো ক্লাসে। ধুন্ধুমার স্লোগান আর চিৎকার চেঁচামেচি। ফর্সা লালচে গাল আর ভেজা চোখে হতভম্ব মেঘমিত্রা, কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই জিএস জয়দীপ ইউনিয়নের সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে হকিস্টিক, ক্রিকেট ব্যাট আর উইকেটগুলো বাগিয়ে ধরে হৈহৈ করতে করতে করিডোর ধরে ছুটতে শুরু করলো। তুমুল হৈ হট্টগোলের মধ্যে মেঘমিত্রা শুনতে পাচ্ছে, "সৌপর্ণ দাশগুপ্ত নিপাত যাক। সৌপর্ণ দাশগুপ্তের স্বৈরাচার মানছি না, মানবো না। সৌপর্ণ দাশগুপ্তের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। কলেজের অফিসে বসে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি! সৌপর্ণ দাশগুপ্ত... হায় হায়, ছিঃছিঃ, সৌপর্ণ দাশগুপ্ত... হায় হায়, ছিঃ ছিঃ!" মেঘমিত্রা দু'হাতে মাথার চুল খামচে ধরে বসে পড়েছে করিডোরের মেঝেতে। কিচ্ছু বলতেই পারেনি কাউকে। শোনেনি কেউ। মাথায় হাত দিয়ে বসে কেঁদেছে হাপুস, যখন পুলিশ এসে রক্তাক্ত, শার্ট ছেঁড়া সৌপর্ণ স্যারকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়ে পুলিশ ভ্যানে তুলেছে।




তারপর থানায় যেতে হয়েছে মেঘমিত্রাকেও। এমনকি কলেজ থেকে খবর পাঠানো হয়েছে ওর বাড়ীতেও। বাবা, মা, দিদি, ছোটকাকু এসে হাজির থানায়। মেঘমিত্রা প্রথমে পুলিশের কাছে কোনো স্টেটমেন্ট দিতে অস্বীকার করেছিলো। ও বলেছিলো, "আমার কোনো অভিযোগ নেই। স্যার আমার সাথে কোনো অশালীন আচরণ করেননি। আমি কাউকে কিচ্ছু বলিনি স্যারের নামে? কেন বলবো? খারাপ কিছু তো হয়ইনি।" কিন্তু কে কার কথা শোনে? কলেজ ইউনিয়ন থেকে ততক্ষণে মিডিয়াকে ডাকা হয়ে গেছে। জিএস জয়দীপ এবং তার দলবল, ওদের ক্লাসের অন্যান্য ছেলেমেয়েরা সবাই স্টেটমেন্ট দিয়েছে, "ক্লাসেই সৌপর্ণ স্যার ডেকে আলাদা করে মেঘমিত্রাকে ল্যাবে অথবা স্যারের অফিস চেম্বারে একলা দেখা করতে বলেন। মেঘমিত্রাও যায় দেখা করতে। হয়তো ফাইনাল ইয়ারে এসে স্যারের কথা না শুনলে ইন্টার্নাল মার্কস বা অ্যাটেনডেন্সের সমস্যা হতে পারে। এইসব ভেবেছে হয়তো মেঘমিত্রা। তারপর আমরা সবাই দেখেছি মেঘমিত্রা চোখমুখ লাল করে কাঁদতে কাঁদতে স্যারের ঘর বেরিয়েছে। মেঘমিত্রা এতোটাই শকড্ ছিলো যে কোনো কথাই বলতে পারেনি।" থানায় বসে বসেও মেঘমিত্রা চুপচাপ কেঁদে গেছে শুধু, একটা কথাও বলেনি আর শেষের দিকে। হুলুস্থূল কাণ্ডের মধ্য দিয়ে মারাত্মক এক বিপর্যয় নেমে এলো মেঘমিত্রার জীবনে। বাবা, মা, দিদি... ওকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ীতে ফিরে গেলো। লক আপের সামনেটায় বিরাট ভিড় হয়ে রয়েছে। ভেতরে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছেন সৌপর্ণ স্যার... কর্মক্ষেত্রে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করে ধরা পড়া আসামী... শহরের নামজাদা কলেজের ফিজিওলজি প্রফেসর ডঃ সৌপর্ণ দাশগুপ্ত... ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভীষণ পপুলার তরুণ এস ডি জি স্যার। তার এই কীর্তি? ছিছিক্কার পড়ে গেছে গোটা কলেজে... ছাত্র-ছাত্রীমহলে।




বাড়ীতে ফিরে মেঘমিত্রা নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসেছিলো। রাস্তাতেও গাড়িতে আসার সময়েও একটাও কথা বলেনি। রাত আটটা নাগাদ মেঘমিত্রা দিদিকে ডেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে আবার। তারপর ঘন্টাদেড়েক পরে মেঘমিত্রাকে নিয়ে দিদি দিতিপ্রিয়া আর ওর বর অম্লান থানায় এসে পৌঁছয়। সেখানেও বিরাট হৈহল্লা। "বিশাখা কেসে" অ্যারেস্ট হওয়া প্রফেসর ডঃ সৌপর্ণ দাশগুপ্ত লক আপেই সুইসাইড করেছে। লক আপের সামনে পোস্টেড পুলিশ প্রাকৃতিক কারণে হালকা হতে গিয়েছিলো। ফিরে এসে দেখে অদ্ভুত ভঙ্গীতে সৌপর্ণ দাশগুপ্ত ঘাড় এলিয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। ফিজিওলজির প্রফেসরের খুব ভালো করে জানা ছিলো গলার কোন অংশে কীভাবে ক্ষত করলে নিশ্চিত মৃত্যু। অস্ত্র বলতে পকেটে গোঁজা পার্কার ফাউন্টেন পেনটা। মেঘমিত্রা ডুকরে উঠলো। পেনটা যে মেঘমিত্রাই দিয়েছিলো তার সৌপর্ণ স্যারকে, নতুন চাকরি পেয়ে ওদের কলেজে জয়েন করতে আসার ঠিক আগের সন্ধ্যায়, লেকের পাড়ে বসে, হাতে হাত রেখে।




সৌপর্ণ দাশগুপ্ত, জন্ম আফ্রিকার কোনো এক দেশে। মা আফ্রিকান, বাবা ভারতীয়... বাঙালী... প্রফেসর সৌরীন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। চাকরি করতে গিয়েছিলেন আফ্রিকায়, তারপর আফ্রিকান সহকর্মীকে বিয়ে করে ওদেশেই সংসার পেতেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস... সৌপর্ণের জন্ম দিতে গিয়েই মারা যান ভদ্রমহিলা। তারপর আর সৌপর্ণর বাবার মন ওদেশে টেকেনি। তিনমাসের ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসেন দেশে। তারপর একাই মানুষ করেছেন ছেলেকে। মেঘমিত্রার দিদির শ্বশুরবাড়ীর পাড়াতেই বাড়ী সৌপর্ণদেরও। ওখানেই ওদের পথে পরিচয়। গোঁড়া পরিবার মেঘমিত্রাদের, আফ্রিকান মায়ের ছেলেকে জামাই হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো পরিবারের। উচ্চতা, গায়ের রঙের মিশেল আর কোঁকড়ানো চুল ছাড়া বাকী আর সবকিছুই সৌপর্ণর বাবার মতোই। তবুও ব্রাত্য সৌপর্ণ... তিন বছরের জমাট প্রেমের প্রেমিকার পরিবার পরিজনের কাছে। কলেজের যেসব ছেলেরা চেয়েও মেঘমিত্রাকে সামান্যতমও পটাতে পারেনি, চরম হতাশায় তারা তিলকে তাল করে ফেললো। সৌপর্ণ ডেকেছিলো মেঘমিত্রাকে সদ্য পাওয়া একটা খুশির খবর শোনাতে। আর দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। সৌপর্ণ বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর চাকরি পেয়েছে, আর মেঘমিত্রার স্কলারশিপের পাকাপোক্ত ব্যবস্থাও একটা করে ফেলতে পারবে, ওদেশে পৌঁছে। ওরা দু'জনেই পাড়ি দেবে বিদেশে। বাড়ীতে খবরটা যেন আজই জানায় মেঘমিত্রা। মেঘমিত্রার পরীক্ষা শেষ হলেই মাসতিনেকের মধ্যেই রওনা হতে হবে। যদিও সৌপর্ণ আগেই চলে গিয়ে জয়েন করবে। আপাতত মেঘমিত্রার একটাই কাজ, মন দিয়ে পড়ে রেজাল্টটা ভালো করা, আর বাড়ীতে সবকিছু খুলে বুঝিয়ে বলা। উত্তেজনায় কেঁদে ফেলেছিলো মেঘমিত্রা, সাথে মনে খিচখিচে ব্যথা... একমাসের মধ্যেই সৌপর্ণকে বিদেশে পাড়ি দিতে হবে। যদি এখানে খারাপ কিছু হয়, বাড়ী থেকে যদি আটকে দেয় মেঘমিত্রাকে। তবে এই আশঙ্কার কথা মুখে কিছু না বলে মেঘমিত্রা পা বাড়িয়েছিলো পরের ক্লাসটা অ্যাটেন্ড করার জন্য। তারপর তো কোথা থেকে যে কী হয়ে গেলো! অভিমানী সৌপর্ণ লজ্জায় ঘৃণায় দুঃখে অপমানে অভিমানে কুঁকড়ে গিয়েছিলো। মেঘমিত্রার পাথরের মতো মূর্তি, মেঘমিত্রার বাবার তাচ্ছিল্যভরা মন্তব্য, "রক্তের দোষ যাবে কোথায়?" আত্মাভিমানী সৌপর্ণর আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে হয়নি হয়তো। মেঘমিত্রাকে রুখে দাঁড়ানোর অবকাশটুকু না দিয়েই চলে গেলো সৌপর্ণ। আর নিজের প্রেমের স্বীকৃতি সর্বসমক্ষে দিতে না পারার গ্লানি আজ যেন কলঙ্ক হয়ে চেপে বসেছে মেঘমিত্রার মনে। এই কলঙ্কের মধ্যেই মেঘমিত্রা আজও বাঁচিয়ে রেখেছে সৌপর্ণর সাথে প্রেমের আবেশটুকুকে।




কলকাতার মাটি ছুঁয়েছে প্লেন, প্রবল ঝাঁকুনিতে মেঘমিত্রা ফেরত এলো বাস্তবে। মেঘমিত্রা এখনও একলা, বছরে কয়েকবার আফ্রিকা আর ভারত যাতায়াত করে, শুধু সৌপর্ণর একটা স্বপ্ন ছিলো আফ্রিকায় ফিরে নিজের মায়ের বাড়ীটায় একটা ছোট্ট সেন্টার করবে, দেশ কাল বা বর্ণ ধর্মের ঊর্দ্ধে উঠে একটা আশ্রয়... যেখানে সৌপর্ণর মতো সঙ্কর শিশুরা থাকবে... যাদের কেউ নেই। সৌপর্ণর স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছে মেঘমিত্রা। এয়ারপোর্টে নেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘমিত্রা বলে, "সৌপর্ণ, আমি তোমার প্রেমের উপযুক্ত ছিলাম না। তোমার পবিত্র প্রেমের পরিণতিই আমার কলঙ্ক। ক্ষমা কোরো সৌপর্ণ, ক্ষমা কোরো।"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy