Debdutta Banerjee

Drama

3  

Debdutta Banerjee

Drama

মায়ের আঁচল

মায়ের আঁচল

5 mins
1.9K


আজ নাকি মাতৃদিবস, মায়েদের দিন। গঙ্গার ধারে এই বৃদ্ধাশ্রমে বীথিকা দেবী এসেছেন আজ চার বছর। ছেলে মেয়েরা দু বার এসেছিল খোঁজ নিতে। অবশ‍্য ওরা জোর করে বীথিকা দেবীকে এখানে রেখে যায়নি। উনি এসেছিলেন সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়।

 মেয়ে থাকে অষ্ট্রেলিয়ায়। ওদের ব‍্যস্ত জীবন, সময় নেই দু দণ্ড মায়ের কাছে বসার। ছেলে আছে ব‍্যাঙ্গালোরে, বৌমা ও ছেলে দু জনেই ডাক্তার। ওদের একমাত্র ছেলে দেরাদুনে পড়ে। ছুটিছাটায় ওরা বিদেশে যায় ছেলে নিয়ে। কলকাতা আসতে পারে না। মাকে নিয়ে নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছিল বহুবার। কিন্তু বীথিকা দেবীর ওখানে বড্ড একা লাগে। কথা বলার একটা লোক নেই। রান্নার লোকটাও কন্নর, আর রান্নাও তেমনি যা তা। ছেলে বৌ তো সকালে ফল দুধ কর্নফ্লেকস ওটস এসব খেয়ে চলে যায়। দুপুরে হাসপাতালেই খায়। রাতে ফিরে রুটি আর সবজি। ভাত মাছ এসবের ব‍্যবস্থাই নেই। বীথিকা দেবী নিজের টুকু নিজেই করে নিতেন। ছেলে বৌ রাতে যখন ফিরত বসে থাকতে থাকতে ঘুম পেয়ে যেত। 

এদিকে কলকাতার অতবড় বাড়িতে একা একাও হাঁঁফিয়ে উঠতেন। যদিও তিনটে কাজের লোক ছিল, পাড়ায় পরিচিতিও ছিল। তবু ছেলেমেয়ের দুশ্চিন্তার জন‍্য উনি নিজেই এই বৃদ্ধাশ্রমে চলে এসেছিলেন। আজ সকালেই ছেলে মেয়ে ওঁকে ফোনে মাতৃদিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। তুমুল ব‍্যস্ত জীবনে এটুকু যে ওরা মনে রাখতে পেরেছে তার জন‍্যই ওদের মা খুশি। সন্তানরা তার সদাই ব‍্যস্ত। ফোনে কথা বলার ও সময় পায় না সব সময়। 

স্বামীকে যখন হারিয়েছিলেন মেয়ে পাঁচ আর ছেলে আট। সারাটা জীবন একাই লড়াই করে ওদের মানুষ করেছেন। আজ আর কোনো দুঃখ নেই তাই। এই গঙ্গার ধারে সমবয়সীদের মাঝেই কেটে যায় দিন গুলো। স্মৃতি এসে কড়া নাড়লেও তিনি দরজা খোলেন না সব সময়। পুরানো কথা রোমন্থন করে দুঃখ পেয়ে কি লাভ। শুধু ভগবানকে ডেকে বলেন -''আমার তো প্রয়োজন শেষ। এবার আমায় তুলে নাও ঠাকুর। আমি এই পৃথিবীতে এখন এক অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা। ''

চোখের জল ওঁর বহুদিন শুকিয়ে গেছে। মাঝে মধ‍্যে ভুল করে ছেলে মেয়ে ফোন করলে বুকটা একটু চিনচিন করে শুধু।


-''বীথিকা দির ভিজিটার, '' একজন কর্মচারীর ডাকে একটু অবাক হলেন উনি। কে আসলো আবার? ভুল করেছে বোধহয় কর্মচারীটা !! স্বামী মারা যাওয়ার পর ভয়ে সব আত্মীয় দূরে সরে গেছিল। উনিও আর যোগাযোগ করেননি কখনো। স্বামী যা স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি রেখে গেছিলেন ওঁর অসুবিধা হয়নি কখনো। তবে আজ এখন এখানে কে এলো? 

অফিস ঘরের পাশেই ভিজিটার্স রুম। সেখানে গিয়েই দেখে বুবান আর একটি অল্প বয়স্ক বৌ। বুবান এসেছে ওঁর খোঁজে!! খুব অবাক হয়েছিলেন উনি। 

মাধবী ঠিকা কাজ করত ওঁর গড়িয়ার বাড়িতে। তার ছেলে বুবান। তিনদিনের জ্বরে যখন মাধবী চলে গেলো বুবান ক্লাস এইটে পড়ে। বাবাটা পরের মাসেই বিয়ে করেছিল। এরপর নতুন কাজের মেয়ে রেবার মুখেই বিথীকা দেবী শুনেছিলেন বুবানের দুর্দশার গল্প। মাটা খেতে দিত না, পড়াও বন্ধ। ওকে চায়ের দোকানে কাজে ঢুকিয়েছিল মাতাল বাপটা। রোজ নাকি পালা করে মা বাপে পেটাতো। 

উনি শুনেই দারোয়ান রতন কে পাঠিয়েছিলেন বুবানের খোঁজে। প্রবল জ্বর গায়ে বুবান এসেছিল দেখা করতে। তারপর উনিই ওর চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করেছিলেন। নিচের তলায় একটা ঘরে থাকতে দিয়েছিলেন, পড়াশোনা শুরু হয়েছিল নতুন করে। বীথিকা দেবী নিজে স্কুলে গিয়ে সারেদের সাথে কথা বলেছিলেন বুবানের জন‍্য। ওঁর বাড়িতে এত গুলো কাজের লোকের মাঝে বুবানের কোনো অসুবিধাই ছিল না। 

কিন্তু ছুটে এসেছিল ওর বাপটা। চায়ের দোকান থেকে মাসে পাঁচশ দিত। সেটা যে বন্ধ হয়ে গেছিল সেই রাগে। বীথিকা দেবীর কাছ থেকে এরপর প্রতিমাসে পাঁচশ করে নিয়ে যেত সে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেত বুবান। উচ্চমাধ‍্যমিক পাশ করে ও একটা ওষুধের দোকানে কাজ নিয়েছিল , বীথিকাদেবীকে বলতে এসেছিল বাবাকে আর টাকা দিতে না। ও রোজগার করে সব সামলে নেবে। খুব রেগে গেছিলেন বীথিকা দেবী। বলেছিলেন -'কলেজটা তো ঠিক করে পাশ কর। তারপর রোজগার করবি। আপাতত তো আমি আছি। পড়তে থাক। '


বুবান এমএ পাশ করে একটা ছোট চাকরি পেয়ে আসানসোল চলে গেছিল কয়েকবছর পর। তারপর মাঝে মাঝে ফোন করত। কোম্পানি ওকে পুনেতে পাঠিয়েছিল এরপর। গত চারবছরে আর যোগাযোগ ছিল না। সেই বুবান ওঁর খোঁজে আজ এখানে। চোখ দুটো ভিজে ওঠে বীথিকা দেবীর। 

প্রণাম করেই কেঁদে ফেলে বুবান। বলে -''তুমি এখানে কেনো মামনি? দাদা দিদি তোমায় এভাবে এখানে রেখে গেলো ?''

-''ধুর পাগল, ওরা রাখবে কেনো? আমি নিজেই এসেছি। এখানে কত বন্ধু আমার জানিস ? ''

-''আমি তোমায় এখানে থাকতে দেবো না। আজই নিয়ে যাবো। এই আমার বৌ। মিতা, খুব ভালো মেয়ে। ও আর আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই মামনি। ''

বীথিকা দেবী শ‍্যামলা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখেন। মিষ্টি মুখখানা। মেয়েটিও বলে -''আপনাকে নিতেই এসেছি। ''

-''দাঁড়া, আগে তোদের দেখি? এতদিন কোথায় ছিলি ? কত বছর পর দেখলাম। ''

-''তোমায় কত খুঁজেছি জানো? অতবড় বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট হয়েছে দেখলাম। কিন্তু তুমি কোথায় কেউ জানে না। গত পরশু রেবা মাসির সাথে দেখা হয়েছিল। সে বলল এই জায়গার কথা। তাই তো আমরা ছুটে এসেছি। ''


পুরানো স্মৃতি গুলো আজ ভিড় করে আসে। একটু খাবার আর থাকার জায়গা দিয়েছিলেন উনি। ফাঁকা ঘর তো কতই ছিল। আর খাবার তো রোজ সবাই খাওয়ার পর বেশি হত, ফেলাই যেত। ওর বাবাকে টানা কয়েক বছর টাকা দিয়েছিলেন। এটুকুই যা করেছিলেন। স্নেহ মাখা দুটো কথা, একটু ডাক খোঁজ নেওয়া এর বাইরে তো কিছু করেননি। আজ ছেলেটা ওঁর দায়িত্ব নিতে এসেছে। 

চোখ মুছে নিজের গলার সোনার চেনটা খুলে মিতার গলায় পরিয়ে দেন উনি। বলেন -''এভাবেই আসিস মাঝে মাঝে খোঁজ নিতে। ভালো লাগবে। আর নিজের ছেলে মেয়ের কাছে তো থাকিনি। তাই তোদের সঙ্গে থাকলে ওরাও দুঃখ পাবে। আমি এখানেই ভালো আছি। ''

-''ওরা দুঃখ পাবে না। ওরা তাহলে জোর করেই তোমায় নিয়ে যেত। আমি নিয়ে যাবোই। এদের অফিসে কথা বলেছি। আপাতত গিয়ে কিছুদিন থাকো। যদি অসুবিধা মনে হয় ফিরে আসবে না হয়। মিতার না মা ছিল না । মামা বাড়িতে মানুষ। ওকে একটু মায়ের আদর দেবে। আমি তো তোমার আদর কতদিন খাইনি। মায়ের থেকেও বেশি মনে পড়ে তোমার কথা। ''

বুবানের নাছোড় আব্দারে গলে যায় বীথিকা দেবীর জেদ। খুব ইচ্ছা করে শেষ বয়সে একটা পরিবারের ছায়ায় থাকতে। এই গঙ্গার ধারের বৃদ্ধাশ্রমে ভালো আছেন অভিনয় করতে করতে উনি ক্লান্ত। 

-''মামনি, চলো না। আমি সব সময় তোমার সাথে থাকবো। তোমায় সময় দেবো। তোমার থেকে রান্না শিখবো। গল্প শুনবো। ও অফিস চলে গেলে আমরা মা মেয়ে গল্পের ঝুলি খুলে বসব। '' মিতা ওঁর হাত দুটো জড়িয়ে ধরে।

ওদের ভালোবাসার জালে আটকা পড়ে এক মা, বহুদিন পর শুস্ক চোখে আজ বান ডেকেছে যেন। দু হাতে শক্ত করে দুজনকে ধরে মনে মনে ভগবানকে বলেন 'এত সুখ সইবার ক্ষমতা দিও আমায়।'


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama