মাতৃত্বের একুশে পা
মাতৃত্বের একুশে পা


হে মহাজীবনের কারিগর,
আমি কী তবে বৃদ্ধ হলাম? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি। অতি সাধারণ এক গৃহবধূ আমি। রূপে-গুণে কোনো ঔজ্জ্বল্য নেই, ছিলোও না কোনোকালেই। তবে বয়সের একটা আলগা চটক তো ছিলোই। অপাঙ্গের চাউনি দেখে বিয়ের বাজারে এক সম্বন্ধেই উৎরে গিয়েছিলাম, আমার পতিদেবতা কুপোকাত হয়েছিলো সে নজরে। বলে ফেলেছিলো সে কথা দুর্বলতম মূহুর্তে।
আজ বড় ক্লান্ত, বড় অবসন্ন দেখাচ্ছে আমাকে। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের দাম্পত্যের মুখোশহীন মূহুর্তেরা সাক্ষী, অগণিত ভালো মন্দের উপাখ্যান ছড়িয়ে আমার ঘরে দুয়ারে। বড়ো অবর্ণনীয় বর্ণময় দাম্পত্য, তারপর মাতৃত্বের ইতিহাস রচিত হয়েছে, প্রতি দণ্ডে পলে তিলতিল করে আমার সর্বস্বত্ত্ব গ্রাস করে। প্রতি ক্ষণে ক্ষণে জানান দিয়ে এসেছে আমার পরাধীনতার বার্তা এতকাল ধরে। প্রহরেরা বন্দী সময় প্রহরীর চোখরাঙানিতে। সীমাপ্রান্তের সীমান্তে আমার ইচ্ছেরা স্তব্ধ দাঁড়িয়ে, রুদ্ধকন্ঠে প্রতীক্ষায় অসীমের রুদ্ধ দ্বারপ্রান্তে নিশ্চুপে, কখনো কোনো মূহুর্তে অধরা স্বাধীনতার দেখা যদি কদাচিৎ মেলে।
সব মেয়ের মতোই আমিও সর্বান্তঃকরণে ভাবতে চেয়েছিলাম, বিয়েতেই হয়তো প্রোথিত স্বাধীনতার মোক্ষপ্রাপ্তির অন্তর্নিহিত বীজখানি। ভেঙ্গেছিলো সে ভুল অচিরেই, ভ্রান্ত ধারণারা হয়েছিলো দিকভ্রান্ত। ছিলাম তপ্ত তাওয়ায়, ছিটকে পড়লাম গিয়ে জ্বলন্ত চুলার আগুনে। বহুকাল ধরেই মালিন্যে মাখা ক্লান্ত স্থবিরতায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছি, পড়ে আছি তো পড়েই আছি। এখন আর জোরও পাই না উঠে দাঁড়াবার। ঐ কোনোরকমে ঘষটে ঘষটে চলছে জীবন, ঐ সেই দিনগত পাপক্ষয়!
মা যখন হলাম, মাতৃত্বের আকন্ঠ সুধামৃতে নবজীবন পেয়েছিলাম। আমার মনে তখন নতুন অঙ্কুরোদগম। মনে হোলো, আমি এখন সব পেয়েছির দেশে, হাতে আমার যাদুদণ্ড, একবার বুলিয়ে নিয়ে গিলি গিলি গে বললেই আমার জীবনে অমৃতভাণ্ড উপুড় হবে। সব মালিন্য, সব কালিমা, সব দীনতা একেবারে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে মাতৃত্বের অমৃতধারায়।
দীর্ঘ সে ইচ্ছাসারি, কতদিনের অপ্রাপ্তিরা, দিনের পর দিন ধরে লালিত মনের চরৈবেতির ফুটন্ত আবেগ, আজ হঠাৎ কেমন যেন জরাভারে জীর্ণ-শিথিল। আজ আমার মাতৃত্ব একুশে পা দিলো, ছেলে আমার কুড়ি পেরিয়ে একুশে। কত পূর্ণিমা অমাবস্যা পার করেছি, শুধু এই দিনটির আশায়।
আমি স্বাধীনতার স্বাদ পাবো এই আশায়। আমার সদ্য একুশের ছেলে তার মায়ের জন্য করবে ঠিক স্বাধীনতার আয়োজন।
তবে বাস্তবে তা আর হোলো কোথায়? কারই বা আছে মহাকালের করালী নিয়ম লঙ্ঘন করার সাধ্য? ছেলের আমার নিজের জীবন হোলো, তার নিজের, ব্যক্তিগত জীবন। সে জীবনে মায়ের ঠাঁই নেই। হঠাৎ এই আবিষ্কার হোলো। আমার কষতে থাকা এতোদিনের কুসীদ হিসেবে বিরাট ভুল! ছেলে স্বাবলম্বী হবো হবো, শুভানুধ্যায়ীদের ভিড়ে তার মা ঢুকতেই পারে নি। আর ছেলেও খোঁজে নি যে, তার মা কোথায়? আবার বেরোলাম এক সুদৃশ্য ভ্রান্তির মায়াজাল কেটে।
জরা শুধু শরীরে নয়, মনেও আসে। আসে সে যে গুটিগুটি পদচারণে, নিঃশব্দে, ঠিক যৌবনের হাত ধরেই একটু একটু করে, ধীরে, অতি ধীরে। তাই বোধহয় সে অনুভূতিদের নজর পিছলে, অবগুন্ঠনের আড়ালেই থেকে যায়, নিভৃতে। শুধু কালের ছায়ায়, কালের মায়ায়, জমাট শ্যাওলা জমে সম্পর্কদের ফাঁকে ফাঁকে, তবুও সম্পর্ক কিন্তু বৃদ্ধ হয় না। বার্ধক্য শুধু সম্পর্কিত মানুষগুলোর হয়, তাদের মনে ধূসর প্রহেলিকার আচ্ছাদন। সবসময় মন চায় ঝোড়ো উন্মাদ এক হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে যাক সেই প্রহেলিকাময় মোহজালের আবরণটা। এসব ভাবি শুধু, এলোমেলো ভাবনায়, কখনোই সত্যিই হবে না জেনেও। আসলে এই ভাবাতেই সুখ, ভাবতে শেখানো হয়েছে যে আবাল্য সংস্কারে।
অচেনা অজানা অদেখা এক মানুষের সাথে জীবনটা যেদিন গ্রথিত হয়েছিলো, ঠিক সেইদিনই বিসর্জন ঘটেছিলো নিজস্বতার। তাও আপ্রাণ মানিয়ে নিয়েছি, পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, শেখানো হয়েছিলো যে। স্বামীর উচ্ছৃঙ্খলতা বা দোষত্রুটি ধরতে নেই, ঢাকতে হয়। কারণ শেখানো হয়েছিলো যে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। সেই মহাগুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে আঁচলের তলায় চাপা পড়েছে কালশিটেরা। হাসিমুখের তলায় লুকিয়েছে কান্নাভেজা দুটি চোখের বেদনা। সময়ের ধূসরতা একটু একটু করে গ্রাস করেছে সব কষ্টদায়ী মূহুর্তদের। মনে তিলতিল করে তিলোত্তমা ইচ্ছা সৃষ্টি হয়েছে অবশ্যম্ভাবী এক প্রাপ্তির আশায়। আমার ছেলে একুশে পা দিলেই আমার সব রোদন বেদনের অবসান। তবে আদতে ভবিষ্যতের দিনযাপনের সম্ভাব্য কার্যক্রমে মায়ের নামের তালিকাভুক্তি না হলেও চলে, তাও বুঝলাম।
আবার যথারীতি ইচ্ছাদের ডানা পুড়িয়ে দিয়েছি।
এই বোধহয় বেশ হোলো! পঞ্চাশের বাবার একুশের ছেলের মসৃণ জীবনধারণের পথ আমার স্বপ্ন পেষাই করা তেল দিয়েই পিচ্ছিল গতিশীল থাক। আমি বরং পরজন্মে যেন পুরুষ জন্ম পাই, পাই যেন স্বাধীনতার স্বাদ।
প্রণাম, হে মহাজীবনের কারিগর!
ইতি...
অভাগিনী এক মা (মায়েদের প্রতিভূ)
(বিষয়: চিঠি লেখার অভিজ্ঞতা)