Abanti Pal

Classics Inspirational

4  

Abanti Pal

Classics Inspirational

মানভঞ্জন

মানভঞ্জন

4 mins
333


কর্তার শ্রাদ্ধকর্ম শেষে নিজের ঘরে এসে বসলেন পূর্নশ্রী দেবী। ফাঁকা ঘরে এবার আর চোখের জল বাধা মানল না। অভিমানিনী সুরে কাঁদতে কাঁদতেই কর্তাকে স্মরণ করে বললেন

'এই এত বছরের সাজানো সংসার ছেড়ে এমনি হুট করে চলে যেতে পারলে? একটুও ভেবে দেখলে না আমি একা বুড়ি এই এত্ত বড় বাড়িটায় কিভাবে থাকব, কি করে বাঁচব...'

'ও গিন্নীশ্রী' ভারী গলার আওয়াজে চমকে উঠলেন পূর্নশ্রী দেবী। এ তো ওনার সদ্য গত হওয়া কত্তামশাইয়ের কণ্ঠস্বর! উনিই তো পূর্ণশ্রী দেবীকে ভালবেসে গিন্নীশ্রী ডাকতেন এই ভরাট স্বরে!

চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন কেউ কোথাও আছে কি না। না তো, ফাঁকা ঘর এক্কেবারে। কত্তামশাই কি তাহলে সাথে করে ওনার মাথাটাও নিয়ে গেলেন, সগ্গ্যে বসে বসে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবেন আর ওনাকে জ্বালাবেন বলে!

'ধুর, কি আজেবাজে ভাবছি' নিজের মনেই ভাবলেন উনি। সারাজীবন খুঁচিয়ে রাগিয়ে জ্বালিয়ে খেতেন মানুষটা ঠিকই, তবে অভিমানিনী আদরিনী বউয়ের রাগ ভাঙার কৌশল জানা ছিল বৈকি লোকটার।

ভরাট গলায় 'ও গিন্নীশ্রী' বলে ডাক দিলেই, পূর্ণশ্রী দেবীর আর সাধ্যি ছিল না সে ডাকের অবমাননা করেন। এবার কার ওপরই বা অভিমান করবেন, আর কেই বা ওনার মানভঞ্জন করতে আসবেন? ভেবেই আরেক দফা কান্না শুরু করতে যাচ্ছিলেন, ওমনি আবার এল সেই গলার আওয়াজ

'সত্যিই বড় চিন্তার ব্যাপার হলো বটে গিন্নীশ্রী। কে আর আমার মিষ্টি বৌটাকে এমনভাবে চেনে, যেমনটা আমি চিনি! সে যে আদা-মিছরির অসামান্য সমন্বয়' তারপর সেই হো হো হাসি.. অবিকল কত্তামশাইয়ের মতন যে!

এবার একটু ঘাবড়ে গেলেন পূর্নশ্রী দেবী।

মোটা চশমার কাঁচটা মুছে, উঠে দাঁড়ালেন সত্তরোর্ধ ভদ্রমহিলা। বাতগ্রস্ত পা নিয়ে হাঁটা চলায় বেশ বেগ পেতে হয় আজকাল, তায় আবার সুগার, প্রেসার, কোলেস্টেরল কোনোটাই বাদ নেই। ধীর পায়ে কত্তামশাইয়ের ছবিটার দিকে এগিয়ে গেলেন। রজনীগন্ধার মালা পরানো ছবির পেছনে আজও সেই সদাহাস্যমান মুখটা বিরাজমান। তবে হাসিটা যেন জীবন্ত মনে হচ্ছে না? ওই তো, নাকের পাটা ফুলছে আবার নামছে, আর পুরু গোঁফগুলোও কেমন দুলছে! চাপা হাসিতে চোখগুলো যেন অর্ধ-নিমীলিত, ভ্রুযুগল ঈষৎ কুঞ্চিত। যেন দমফাটা হাসি চেপে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস!

'ভঁয় পেঁলেঁ চঁলঁবেঁ? এপাঁরেঁ তোঁমাঁকেঁও যেঁ একঁদিঁন আসঁতেঁ হঁবেঁ গিঁন্নীশ্রীঁ' হঠাৎ বলে উঠল ছবিটা।

'ও মাআআ গোওওওওও' আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন পূর্নশ্রী দেবী। আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিলেন, কোনক্রমে আরামকেদারাটা হাতের নাগালে পেয়ে নিজেকে সামলে নিলেন।

'আহা, আজও শিখলে না কিছু, সবেতেই চেঁচামেচি হুলুস্থূল... বলি লোককে না শুনিয়ে যে দুটো দাম্পত্য কথা বলব, তার জো নেই, সেই বিয়ে হওয়ার প্রথম দিন থেকে দেখে আসছি’

বড় বড় চোখ করে পূর্নশ্রী দেবী ছবিটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন এবার

'হ্যাঁ গো, আমি কি সত্যি দেখছি? তুমি মানে... তুমি তো, তুমি তো...'

'কি তুমিতো তুমিতো করে যাচ্ছ? বিশ্বাস হচ্ছে না আমি এখানেই? আরে ফটো বানিয়ে দিলেই কি ফুটে যাব না কি! এত্ত সহজ! একবার যখন তোমায় সহধর্মিনী বানিয়েছি, তখন অন্তত সাত জন্ম পার না করে তোমায় ছাড়ছিনা, এই বলে রাখলাম!'

'সত্যি? তুমি তাহলে আমার সাথেই আছ গো কত্তামশাই?'

'তা নয়তো আর বলছি কি গিন্নীশ্রী! তাড়াতাড়ি সগ্গ্যে এলাম কি আর এমনি এমনিই? পরের জন্মেরটা গোছাতে হবে না? পাকাপাকি বন্দবস্ত করি আগে এখানে দাঁড়াও... তোমার যা সোনা শরীর, হেন রোগ নেই যে তোমার মায়া ছাড়েনি, সব এসে বসবি তো বস, আমার বৌটার মধ্যেই জুড়ে বসেছে!'

'আবার? ওখানে গিয়েও তুমি রাগাবে আমাকে?' হুঙ্কার গিন্নীশ্রীর।

'না না, অভিমান করে না সোনাটা, তা যা বলছিলাম, উফফফ এত্ত বিরক্ত করো না কথার মাঝে... এখানে ভালো ব্যবস্থা করি তোমার জন্য সগ্গ্যে... সে তো ওই পৃথিবীতেও যখনই ঘুরতে যেতাম, হোটেল মোটেল সব আমি কত আগে থেকে ব্যবস্থা করতাম জীব্বদশায়, তা এখানে আগে থেকে আমার সোনামনার জন্য ভালো ব্যবস্থা করতে হবে না! নাহলে সে থাকবে কিভাবে!'

'আদিখ্যেতা দেখ না! বুড়ো হয়ে বেরিয়ে গেল, তাও এসব রংবাহারি কথাবার্তা গেল না'

'আহা, বুড়ো তো আর মন থেকে হইনি। এই তো আবার পুনর্জন্মের খাতায় নাম জমা দেব তোমার আমার, তখন খোকা-খুকি হয়ে যাব আবার, হে হে! তোমাকে আগে নিয়ে আসি সব পাকাপাকি ব্যবস্থা করে... তারপর টুপ্ করে নতুন বেশে আবার আমরা পাড়ি দেব আমাদের খেলা-খেলা সংসারে'

'যত্তসব, চা করতে জানে না, মশারি খাটাতে পারে না, শাড়ী মেলতে গিয়ে নিজেই শাড়ীতে জড়িয়ে গিয়ে আদ্ধেক শাড়ী পরে ফেলে, সে আবার নতুন সংসারের স্বপ্ন দেখছে! সব বুঝি! তলে তলে আমাকে দিয়ে খাটিয়ে নেওয়ার ধান্দা! এমন বৌটি আর কোথায় পাবে, যে বোকার মতন খেটে মরে, তাই তো এত তোড়জোড়, হুম'

'ওই দেখ, ও গিন্নীশ্রী, রাগ করে না সোনা! আচ্ছা সামনের জন্মে তোমার শাড়ীর কুচি ধরা ঠিক শিখে নেব, বিনুনিও বেঁধে দেব তোমার সাদা ফুরফুরে চুলে, লাল ফিতে দিয়ে… তবে বিরিয়ানি কিন্তু তোমায় ঠিক করে শিখতেই হবে! ওসব বিরিয়ানি নাম করে আচার-ভাত, রসগোল্লা নাম করে ছানার ডেলা, স্যুপের নাম করে ডালের জল, এসব আমি আর মোটে মেনে নেব না'

কপট রাগ দেখাতে গিয়েও হেসে ওঠেন পূর্নশ্রী দেবী। কত্তামশাই বড্ড খাদ্যরসিক ছিলেন বটে, তবে কলেস্টেরল-পীড়িত স্বামীকে সামাল দেওয়ার কৌশল উনিও বেশ রপ্ত করেছিলেন। কিন্তু যে যাই বলুন, খুব যত্নপরায়ণ ছিলেন বটে স্বামীটি ওনার।

তা না হলে আজও এপার-ওপার থেকে কি আর এই টক-ঝাল-মিষ্টি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারতেন!

মায়ের হাসির আওয়াজে ছেলে বউ দৌড়ে এসেছিল পূর্নশ্রী দেবী ঘরে। এসে দেখে, মা সারাদিনের ক্লান্তিশেষে ঘুমিয়ে পড়েছেন, তবে মুখে এক বহুপরিচিত শিশুসুলভ হাসি লেগে রয়েছে।

'স্বপ্ন দেখে হাসছিল না কি মা?' একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ছেলে।

'হুম্, মানভঞ্জনের শেষে এমনিই পরিতৃপ্তির হাসি লেগে থাকত মায়ের মুখে। যাক, এপার-ওপার হয়েও মনে হচ্ছে সে সূত্র অটুট। কিছু সম্পর্ক নিঃসন্দেহে শাশ্বতকালীন' নিশ্চিন্ত হয়ে বলল বৌমা।

নক্ষত্রখচিত সন্ধ্যার আকাশ-বাতাস এক করে দিয়ে, ঘুরে ফিরে ধ্বনিত হয় এক মিঠে সুর

‘করি পারাপার স্বপনেতেই স্বর্গসুখের দেশে,

আলোয় ভালোয় ভরুক মন মিঠে এই আবেশে…’

সমাপ্ত।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics